Friday 19 November 2021

রাশিয়া কেন ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে মহাকাশে নিজেদের স্যাটেলাইট ধ্বংস করছে?

২০শে নভেম্বর ২০২১

‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রকে আলোচনায় বসতে বাধ্য করতেই রাশিয়া মহাকাশে স্যাটেলাইট ধ্বংসের প্রকল্পে নেমেছে। একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রও রুশ কর্মকান্ডকে দায়িত্বজ্ঞানহীন আখ্যা দিয়ে বিশ্বব্যাপী জনসমর্থন আদায় করছে। মার্কিন সামরিক কর্মকর্তারাও মহাকাশে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কথা না বলে রুশ হুমকি মোকাবিলার পাল্টা কৌশলের উপরেই গুরুত্ব দিচ্ছেন। মহাকাশে কোন আন্তর্জাতিক আইনের অনুপস্থিতি এতকাল সমস্যা সৃষ্টি না করলেও ভেঙ্গে পড়া বিশ্বব্যবস্থায় তা দুশ্চিতার কারণ হচ্ছে।


মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের কর্মকর্তারা গত ১৫ই নভেম্বর বলে যে, রাশিয়া একটা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে তাদের নিজস্ব একটা পুরোনো স্যাটেলাইট ধ্বংস করেছে। এর ফলে মহাকাশ জুড়ে হাজারো ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে পড়েছে; যেগুলি অন্যান্য স্যাটেলাইটের জন্যে হুমকির সৃষ্টি করেছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন প্রশ্ন করেন যে, রুশরা তো জানতো যে এধরণের কর্মকান্ডে কিরকম ধ্বংসাবশেষ তৈরি হবে। তাহলে তারা কি করে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে নিজেদের মহাকাশচারীদেরকেই বিপদে ফেললেন? মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস সাংবাদিকদের বলেন যে, রুশদের এই কর্মকান্ড ভয়ঙ্কর এবং একপরকার ভন্ডামি। যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের সাথে নিয়ে এই দায়িত্বজ্ঞানশূণ্য কাজের জবাব দেবে। মার্কিন স্পেস ফোর্সের ইন্টেলিজেন্স ডিরেক্টর মেজর জেনারেল লেয়া লডারবেক একটা মহাকাশ কনফারেন্সে বলেন যে, এটা খুব সম্ভবতঃ যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে একটা বার্তা ছিল। রাশিয়া ডিটারেন্টকে চিন্তা করে মার্কিন মহাকাশ সক্ষমতাকে প্রতিরোধ এবং দুর্বল করার লক্ষ্যেই রাশিয়া এটা করেছে।

মার্কিন স্পেস কমান্ডের হিসেব মতে, এটা ছিল ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে স্যাটেলাইট ধ্বংস করার চতুর্থ পরীক্ষা। এর আগে ২০০৭ সালে চীনারা প্রথমবারের মতো তাদের ‘ফেনইউন ১সি’ স্যাটেলাইট ধ্বংস করে। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাদের ‘অপারেশন বার্নট ফ্রস্ট’এর মাধ্যমে একটা গোয়েন্দা স্যাটেলাইট ধ্বংস করে। ২০১৮ সালে ভারত তাদের নিজস্ব ‘মাইক্রোস্যাট আর’ ধ্বংস করে। আর সর্বশেষ রুশরা তাদের ‘কসমস ১৪০৮’ স্যাটেলাইট ধ্বংস করলো। মার্কিনীরা বলছে যে, রুশ স্যাটেলাইট ধ্বংসের ফলে তৈরি হওয়া কমপক্ষে ১০ সেন্টিমিটার আকৃতির ১৫’শ ধ্বংসাবশেষ এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। অথচ ২০১৮ সালে ধ্বংস করা মার্কিন স্যাটেলাইট থেকে উৎপন্ন হওয়া ১’শ ৭৩টা ধ্বংসাবশেষের মাঝে একটাও এখন মহাকাশে নেই। ২০০৭ সালে চীনা স্যাটেলাইটের ৩ হাজার ৬’শ ৭৯টা ধ্বংসাবশেষের মাঝে কমপক্ষে ৩ হাজার ১৩টা এখনও মহাকাশে ঘুরছে। ২০১৮ সালের ভারতীয় স্যাটেলাইটের ১’শ ৬৮টা ধ্বংসাবশেষের একটা এখনও মহাকাশে রয়েছে। মাত্র কিছুদিন আগেই ২০০৭ সালে চীনা স্যাটেলাইটের ধ্বংসাবশেষের সাথে সংঘর্ষ এড়াতে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনকে স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছিল।

মার্কিন বিবৃতির প্রত্যুত্তরে রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই সোইগু বলেন যে, মহাকাশের এই ধ্বংসাবশেষ মহাকাশের কোন কর্মকান্ডকেই হুমকির মাঝে ফেলবে না। ১৯৮০এর দশকের একটা স্যাটেলাইটকে রুশরা নিখুঁতভাবে ধ্বংস করেছে। তবে ‘বিবিসি’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, এরকম স্যাটেলাইট ধ্বংসকারী পরীক্ষা মহাকাশে ধ্বংসাবশেষের আরও বড় সমস্যার মাঝে একটামাত্র। মহাকাশে মানুষের পদচারণা বাড়ছেই; যা এই সমস্যাকে আরও গভীর করছে। মহাকাশে বর্তমানে বিশাল এক জঙ্গল অবস্থান করছে। এর মাঝে রয়েছে বিভিন্ন স্টেজের রকেট; যেগুলি কয়েক দশক ধরে মহাকাশে ঘুরতে থাকে।

মার্কিন প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘ডিফেন্স ওয়ান’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, রাশিয়ার মহাকাশের পরীক্ষার পর পেন্টাগন মহাকাশে তাদের সম্পদগুলিকে রক্ষা করার জন্যে নড়েচড়ে বসেছে। ১৭ই নভেম্বর মার্কিন স্পেস ফোর্সের লেঃ জেনারেল নিনা আরমাইনো লাস ভেগাসে একটা মহাকাশ কনফারেন্সে বলেন যে, রাশিয়া মূলতঃ একটা অস্ত্র পরীক্ষা দেখিয়েছে। তারা যদি একটা রুশ স্যাটেলাইট ধ্বংস করতে পারে, তাহলে একটা মার্কিন স্যাটেলাইটও ধ্বংস করতে পারবে। শুধু রাশিয়া নয়; চীনও এটা পারবে। প্রতিবেদনে মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, গত জুলাই মাসে চীনারা একটা হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে, যা মহাকাশে পুরো পৃথিবী ঘুরে এসেছে। রাশিয়া এবং চীনের এই পরীক্ষাগুলি পেন্টাগনের টনক নড়িয়েছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব অস্টিন সাংবাদিকদের বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র মহাকাশের ‘সশস্ত্রীকরণ’এর ব্যাপারে চিন্তিত। যুক্তরাষ্ট্র তার সর্বোচ্চ সাধ্যমতো বিভিন্ন প্রকারের হুমকি মোকাবিলায় কাজ করছে। জেনারেল আরমাইনো বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র চাইবে তাদের মহাকাশের সম্পদগুলিকে খুঁজে পাওয়া কঠিন করে ফেলা অথবা সেগুলিকে বাজে টার্গেট হিসেবে পেশ করা। সেই পরিকল্পনা মোতাবেক যুক্তরাষ্ট্র তাদের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করবে; একইসাথে কক্ষপথের ভিন্নভিন্ন স্তর তৈরি করবে; হাইব্রিড সক্ষমতাসহ ছোট স্যাটেলাইট ডেভেলপ করবে; এবং বাণিজ্যিক সক্ষমতাকেও এর সাথে যুক্ত করবে। এগুলি করতে রাশিয়ার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ক্ষেপণাস্ত্র পূর্বাভাষ সক্ষমতাকে টার্গেট করা কঠিন হয়ে যাবে।

কানাডার ‘অটাওয়া ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর পল রবিনসন রুশ মিডিয়া ‘আরটি’র এক লেখায় বলছেন যে, এই মুহুর্তে মহাকাশে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধে কোন চুক্তি নেই। অর্থাৎ মহাকাশ এখন একটা যুদ্ধক্ষেত্র। যুক্তরাষ্ট্র নিজেই এখন মহাকাশে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণকে সমর্থন করে না। কিন্তু রুশ ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা দেখিয়ে দেয় যে, হয়তো যুক্তরাষ্ট্র এব্যাপারে চিন্তা করলে ভালো করবে। রবিনসন বলছেন যে, যদিও রুশ এই পরীক্ষা মহাকাশের ধ্বংসাবশেষের সমস্যাকে খারাপ করেছে, তথাপি আন্তর্জাতিক কোন আইন না থাকার কারণে বলা যাচ্ছে না যে, রুশরা বেআইনী কিছু করেছে। তিনি বলছেন যে, মহাকাশের ‘সামরিকীকরণ’ এবং ‘সশস্ত্রীকরণ’এর মাঝে পার্থক্য রয়েছে। সামরিক যোগাযোগের জন্যে মহাকাশ বহু আগে থেকেই ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে ‘সশস্ত্রীকরণ’ মাত্র শুরু হতে চলেছে, যার মাধ্যমে মহাকাশে ধ্বংস সক্ষমতা তৈরি করা হচ্ছে। মার্কিনীরা মনে করছে যে, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা থাকতে থাকতে তাদের উচিৎ মহাকাশে এগিয়ে যাওয়া; কারণ মহাকাশে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শেষপর্যন্ত কেউই আটকাতে পারবে না।

২০০৮ সালে চীন এবং রাশিয়া ‘ট্রিটি অন প্রিভেনশন অব দ্যা প্লেসমেন্ট অব ওয়েপন্স ইন আউটার স্পেস’ এবং ‘থ্রেট অর ইউজ অব ফোর্স এগেইনস্ট আউটার স্পেস অবজেক্ট’ নামে দু’টা চুক্তির খসরা তৈরি করলেও যুক্তরাষ্ট্র তা প্রত্যাখ্যান করে। এরপর থেকে জাতিসংঘেও দুই পক্ষ মহাকাশ নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র মহাকাশ প্রযুক্তিতে ব্যাপকভাবে এগিয়ে আছে এবং বিশ্বব্যাপী তার সামরিক কর্মকান্ড মহাকাশের উপর যথেষ্টই নির্ভরশীল। তাই তারা রাশিয়া বা চীনের সাথে মহাকাশ নিয়ন্ত্রণের কোন চুক্তিতে যেতে অনিচ্ছুক। এমতাবস্থায় ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রকে আলোচনায় বসতে বাধ্য করতেই রাশিয়া মহাকাশে স্যাটেলাইট ধ্বংসের প্রকল্পে নেমেছে। একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রও রুশ কর্মকান্ডকে দায়িত্বজ্ঞানহীন আখ্যা দিয়ে বিশ্বব্যাপী জনসমর্থন আদায় করছে। মার্কিন সামরিক কর্মকর্তারাও মহাকাশে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কথা না বলে রুশ হুমকি মোকাবিলার পাল্টা কৌশলের উপরেই গুরুত্ব দিচ্ছেন। মহাকাশে কোন আন্তর্জাতিক আইনের অনুপস্থিতি এতকাল সমস্যা সৃষ্টি না করলেও ভেঙ্গে পড়া বিশ্বব্যবস্থায় তা দুশ্চিতার কারণ হচ্ছে।

No comments:

Post a Comment