Tuesday 16 November 2021

তুর্কিরা কেন ট্যাংক বাহিনী শক্তিশালী করছে?

১৬ই নভেম্বর ২০২১

তুরস্কের নিজস্ব ডিজাইনের 'আলতায়' ট্যাঙ্কের পরীক্ষামূলক প্রোটোটাইপ। সিরিয়ার যুদ্ধের অভিজ্ঞতাই হয়তো তুর্কিদের বুঝিয়েছে যে, পুরোনো ট্যাঙ্ক দিয়ে সামনের দিনগুলিতে সকল কাজ করা যাবে না; নতুন ট্যাংক লাগবে। সেকারণেই ‘আলতায়’ ট্যাংক প্রকল্পে হয়তো গতি এসেছে। তুর্কিরা জার্মান ইঞ্জিন এবং ট্রান্সমিশন গিয়ারবক্সের দিকেই তাকিয়ে ছিল; কারণ সেগুলি বিশ্বসেরা। তুরস্কের ‘আলতায়’ ট্যাংক প্রকল্প শুধু একটা জাতীয় গৌরবের বিষয় নয়। তুরস্ক তার ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষা বাস্তবায়নে সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক বাহিনীকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। সেকারণেই তারা শুধু নতুন ট্যাংক নিয়েই ব্যাস্ত নয়, পুরোনো ট্যাঙ্কগুলি নিয়েও ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছে।

 
২০২০এর শেষের দিকে ককেশাসে নাগোর্নো কারাবাখ নিয়ে আজেরবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মাঝে ঘটে যাওয়া যুদ্ধে একটা ব্যাপার নিয়ে সবচাইতে বেশি আলোচনা হয়েছে; আর তা হলো মনুষ্যবিহীর ড্রোন বিমান। অনেক বিশ্লেষকেরাই ড্রোন যুদ্ধকে যেমন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন, তেমনি কেউ কেউ আবার যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাঙ্কের যাত্রা শেষ হয়ে আসছে বলে মন্তব্য করেছেন। তারা বলেছেন যে, আকাশ থেকে ছুঁড়ে দেয়া ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ট্যাঙ্কগুলিকে অসহায় করে ফেলেছিল। হয়তো এখন থেকে ট্যাঙ্কগুলিকে যুদ্ধক্ষেত্রে রক্ষা করা খুবই কঠিন হয়ে যাবে। অর্থাৎ ট্যাঙ্কগুলি বাহিনীর শক্তিশালী স্তম্ভ না হয়ে বরং দুর্বল অংশ হয়ে দেখা দেবে। তবে কিছু বিশ্লেষকেরা যুক্তি দিয়েছেন যে, সকল যুদ্ধক্ষেত্রে বাস্তবতা একরকম হবে না; এবং যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাঙ্কের ব্যবহার থাকবেই। অন্ততঃ কিছু রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর নতুন প্রযুক্তির ট্যাঙ্ক ডেভেলপ করা দেখে বোঝা যাচ্ছে যে, তারা অন্ততঃ মনে করছে না যে, ট্যাঙ্কের ভবিষ্যৎ এখানেই শেষ। এই দেশগুলির মাঝে রয়েছে তুরস্ক; যারা ট্যাঙ্কের পিছনে যথেষ্ট সম্পদ বিনিয়োগ করেছে।

তুরস্কের স্বপ্নের ট্যাংক ‘আলতায়’…

গত মার্চ মাসে ‘ডিফেন্স নিউজ’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে জানায় যে, তুর্কি কোম্পানি ‘বিএমসি’ দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি ‘দুসান’ এবং ‘এসএন্ডটি ডাইনামিকস’এর সাথে এক চুক্তি করে। চুক্তি মোতাবেক ‘বিএমসি’ তুরস্কের নিজস্ব ডিজাইনের ট্যাংক ‘আলতায়’এর জন্যে দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানিগুলি থেকে ‘ডিভি২৭কে’ ডিজেল ইঞ্জিন এবং ‘ইএসটি১৫কে’ ট্রান্সমিশন গিয়ারবক্সের সরবরাহ পাবে। ‘আলতায়’ ট্যাঙ্কে জার্মানির ‘এমটিইউ’ কোম্পানির ইঞ্জিন, ‘রেঙ্ক’এর ট্রান্সমিশন এবং ‘রেইনমেটাল’ কোম্পানির ১’শ ২০মিঃমিঃ কামান ব্যবহার করার কথা ছিল। কিন্তু তুরস্ক সিরিয়ার যুদ্ধে জড়াবার পর জার্মানি তুরস্কের উপর অস্ত্র অবরোধ আরোপ করে। এর ফলশ্রুতিতে জার্মানি তুরস্ককে প্রযুক্তি সরবরাহ করা বন্ধ করে দেয় এবং ট্যাঙ্কের প্রকল্প থেমে যায়। তুরস্ক নিজস্ব ইঞ্জিন ডেভেলপ করার প্রকল্প হাতে নিলেও তা শেষ হতে আরও অনেক সময় লেগে যেতে পারে। জার্মান প্রযুক্তির উপর অবরোধ বাইপাস করার জন্যেই তুরস্ক দক্ষিণ কোরিয়ার সরণাপন্ন হয়।

কোরিয়া তাদের নিজস্ব ডিজাইনের ‘কে২ ব্ল্যাক প্যান্থার’ ট্যাংক ডেভেলপ করছে। তারাও নিজস্ব প্রযুক্তি ডেভেলপ করতে গিয়ে সমস্যায় পতিত হয়। ‘দ্যা ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় সামরিক বিশ্লেষক সেবাস্টিয়ান রোবলিন জানাচ্ছেন যে, কোরিয়ার সেনাবাহিনী চাইছিল এমন একটা ট্রান্সমিশন, যা ১০ হাজার কিঃমিঃ কোনপ্রকার সমস্যা ছাড়াই চলতে পারবে। কিন্তু ‘এসএন্ডটি ডাইনামিকস’এর ‘ইএসটি১৫কে’ ট্রান্সমিশন গিয়ারবক্স ছোটখাটো সমস্যার কারণে এই মানদন্ডে পাস করেনি। তবে তুরস্কের সেনাবাহিনী তাদের ‘আলতায়’ ট্যাঙ্কের জন্যে ৬ হাজার ৭’শ কিঃমিঃএর মানদন্ড রাখার কারণে তারা কোরিয়ার ট্রান্সমিশন নিতে আগ্রহী হয়। তুর্কি কোম্পানি ‘বিএমসি’ নিজেরাই ‘বাটু’ নামে ১৫’শ হর্সপাওয়ারের একটা ইঞ্জিন ডেভেলপ করছে; যা হয়তো পুরোপুরি অপারেশনে আসতে কয়েক বছর লেগে যাবে। তাই আপাততঃ তারা কোরিয় ইঞ্জিনের উপরেই নির্ভর করবে। তুর্কিরা পশ্চিমা ধাঁচের ৬৫ থেকে ৭২ টনের একটা ভারি ট্যাঙ্ক ডেভেলপ করার লক্ষ্যেই ‘আলতায়’ প্রকল্পে হাত দিয়েছে। গতি, গোলাবর্ষণের শক্তি এবং মূল্যমানের দিক থেকে তা মার্কিন ‘এম১ আব্রামস’, জার্মান ‘লেপার্ড ২’ এবং ব্রিটিশ ‘চ্যালেঞ্জার ২’এর মতোই হবে। তুরস্কের ‘আসেলসান’ কোম্পানির ডেভেলপ করা ‘ভালকান ৩’ ফায়ার কন্ট্রোল সিস্টেম এবং ‘আক্কর’ ‘একটিভ প্রোটেকশন সিস্টেম’ বা ‘এপিএস’ এই ট্যাঙ্কের সক্ষমতাকে অনেক এগিয়ে নেবে। ‘এপিএস’ হলো ট্যাংক বা অন্যান্য গাড়ির জন্যে এমন একটা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে ট্যাংক বিধ্বংসী রকেট বা ক্ষেপণাস্ত্র ট্যাঙ্কে আঘাত করার আগেই তাকে ঘায়েল করে ফেলা হবে। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাঙ্কের টিকে থাকার সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। ‘আক্কর’কে ডেভেলপ করা হয়েছে ‘পুলাট’ সিস্টেম থেকে; যা বর্তমানে তুরস্কের অন্যান্য ট্যাঙ্কে বসানো হচ্ছে।

‘আলতায়’ ট্যাংক ডেভেলপ করতে গিয়ে তুরস্ক ট্যাঙ্কের বর্ম নিয়েও সমস্যায় পড়েছিল। ফ্রান্সের কাছ থেকে বর্মের প্রযুক্তি আনার কথা থাকলেও ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের সাথে ফ্রান্সের দ্বন্দ্ব শুরু হলে ফ্রান্স প্রযুক্তি সরবরাহ করতে গরিমসি শুরু করে। অগত্যা তুরস্ক নিজেই বর্ম প্রযুক্তি ডেভেলপ করা শুরু করে। তুর্কি কোম্পানি ‘রকেটসান’ বোরন কার্বাইড ব্যবহার করে ‘নন এক্সপ্লোসিভ রিয়্যাকটিভ আর্মার’ বা ‘নেরা’ বর্ম প্রযুক্তি ডেভেলপ করেছে। এই বর্ম ট্যাঙ্ককে আক্রমণকারী রকেট বা ক্ষেপণাস্ত্র বা শেলকে মূল ট্যাঙ্ককে ক্ষতি করা থেকে বিরত রাখবে। ‘টারকিশ ডিফেন্স নিউজ’এর সম্পাদক ইউসুফ মেতিন ‘আলতায়’ ট্যাঙ্কের বর্মের বর্ণনা দিয়েছেন। ট্যাঙ্কের সামনে এবং উপরের দিকে থাকবে ৮’শ মিঃমিঃ ‘নেরা’ বর্ম। কিছুটা নিচের দিকে থাকবে ‘ইআরএ’ বর্ম; যা প্রায় ৫’শ থেকে ৬’শ মিঃমিঃএর মতো হবে। ট্যাঙ্কের উপরের দিকের ১’শ ৫০ মিঃমিঃ বর্ম তুলনামূলকভাবে খুবই শক্তিশালী; যা আক্রমণকারী বিমান বা হেলিকপ্টারের গুলি মোকাবিলা করতে পারবে। ‘আলতায়’এর প্রথম ভার্সন হবে ‘টি১’, যার ৪০টা তৈরি হবে; ‘টি২’ তৈরি হবে ২’শ ১০টা; যেগুলির কামানের ব্যারেল দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ার ব্যবস্থা থাকবে। ‘টি৩’ ভার্সনের একটা পরীক্ষামূলক কপি চাওয়া হয়েছে; যেটাতে রুশ ‘টি১৪ আরমাতা’ ট্যাঙ্কের আদলে টারেটের ভিতর কোন মানুষ থাকবে না।

তুরস্কের ‘আলতায়’ ট্যাংক প্রকল্প শুধু একটা জাতীয় গৌরবের বিষয় নয়। তুরস্ক তার ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষা বাস্তবায়নে সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক বাহিনীকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। সেকারণেই তারা শুধু নতুন ট্যাংক নিয়েই ব্যাস্ত নয়, পুরোনো ট্যাঙ্কগুলি নিয়েও ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছে। বিভিন্ন হিসেবে তুরস্কের প্রায় আড়াই থেকে ৩ হাজার ট্যাংক রয়েছে। তবে এর বেশিরভাগই পুরোনো মার্কিন এবং জার্মান ডিজাইনের; যেগুলি আধুনিক সমরে বিপক্ষের আধুনিক ট্যাঙ্কের সামনে দাঁড়াতে পারবে না। তুরস্ক চাইছে এই পুরোনো ট্যাঙ্কগুলিকেই নতুন প্রযুক্তি যুক্ত করে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত করতে। তুরস্ক তার ট্যাংক উন্নয়ন প্রকল্পগুলিকে সাজিয়েছে সিরিয়াতে তাদের সামরিক অপারেশনের অভিজ্ঞতাকে মাথায় রেখে। সেখানে তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল বড় কোন সামরিক শক্তি নয়; বরং কুর্দি বিদ্রোহীরা এবং আইসিস। বিমান শক্তি না থাকলেও তাদের হাতে ছিল শক্তিশালী ট্যাংক বিধ্বংসী রকেট এবং ক্ষেপণাস্ত্র। তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যে তার ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষা বাস্তবায়নে এই ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী অস্ত্রগুলিকে বাধা হিসেবে দেখছে। একইসাথে তুরস্কের উপর ইউরোপিয় অবরোধের কারণে ‘আলতায়’ ট্যাঙ্কের প্রকল্প অনেক পিছিয়ে গেছে। একারণেই পুরোনো ট্যাঙ্কগুলিকে নতুন করে সাজাতে বাধ্য হচ্ছে তুরস্ক। ‘আলতায়’ ট্যাংক’ হয়তো তুরস্ক হাতে পাবে ঠিকই; কিন্তু তত সময় পর্যন্ত তুরস্কের আকাংক্ষা বাস্তবায়ন তো থেমে থাকবে না।

 
সিরিয়ার ইদলিবে তুরস্কের 'এম ৬০টিএম' ট্যাংক; যার উন্নয়ন করা সিস্টেমগুলি দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে। ‘আলতায়’ ট্যাংক’ হয়তো তুরস্ক হাতে পাবে ঠিকই; কিন্তু তত সময় পর্যন্ত তুরস্কের আকাংক্ষা বাস্তবায়ন তো থেমে থাকবে না। তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যে তার ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষা বাস্তবায়নে ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী অস্ত্রগুলিকে বাধা হিসেবে দেখছে। একইসাথে তুরস্কের উপর ইউরোপিয় অবরোধের কারণে ‘আলতায়’ ট্যাঙ্কের প্রকল্প অনেক পিছিয়ে গেছে। একারণেই পুরোনো ট্যাঙ্কগুলিকে নতুন করে সাজাতে বাধ্য হচ্ছে তুরস্ক।

পুরোনো ট্যাঙ্কগুলিকেই উন্নয়নে বাধ্য হচ্ছে তুরস্ক

২০২০এর জুলাইতে ‘ডেইলি সাবাহ’ তুরস্কের ‘প্রেসিডেন্সি অব ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিজ’ বা ‘এসএসবি’এর বরাত দিয়ে জানায় যে, তুর্কি সেনাবাহিনীর সকল ‘এম৬০টি’ ট্যাংকগুলিকে ‘এম৬০টিএম’ পর্যায়ে উন্নীত করার কাজ শেষ হয়েছে। ‘এসএসবি’র প্রধান ইসমাঈল দেমির বলেন যে, তুরস্ক বিশ্বের তৃতীয় দেশ হিসেবে নিজেদের ট্যাঙ্কগুলিকে ‘এপিএস’ দ্বারা সজ্জিত করার সক্ষমতা রাখে। ‘ফিরাত প্রজেক্ট’ নামের এই প্রকল্পের অধীনে ২০১৭ সালের মে মাসে তুর্কি প্রতিরক্ষা কোম্পানি ‘আসেলসান’কে এই ট্যাঙ্কের উন্নয়নের কাজ দেয়া হয়েছিল। দেমির বলেন যে, একসময় তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের অক্ষমতার কারণে ট্যাঙ্কগুলির উন্নয়নের জন্যে ইস্রাইলের উপর নির্ভর করতে হয়েছিল। তবে এক দশকে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন বাইরের দেশের উপর নির্ভরশীলতা কমেছে। বর্তমানে যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাঙ্কগুলির প্রতি হুমকির ব্যাপারে আগাম সতর্কতা পাবার প্রযুক্তি সংযোজিত করা ছাড়াও ট্যাঙ্ক ধ্বংসী অস্ত্রকে বোকা বানানো এবং ট্যাঙ্কের কামানের নিজস্ব টার্গেটিংএর জন্যে ইমেজিং সিস্টেমেরও উন্নয়ন করা হয়েছে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো ট্যাঙ্কগুলির স্বল্প থেকে মধ্যমপাল্লায় গোলাবর্ষণের সক্ষমতা বৃদ্ধি; স্বল্প থেকে দূরপাল্লায় ট্যাঙ্কের বেঁচে থাকার সক্ষমতা বৃদ্ধি; এবং ট্যাঙ্কের মেইনটেন্যান্সের সুবিধা বৃদ্ধি করা। এই প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কাজগুলি তুরস্কের নিজস্ব ডিজাইনের ট্যাংক ‘আলতায়’এর জন্যে পথ উন্মোচন করেছে। সেনাবাহিনীর ‘এম৬০’ ট্যাংক ছাড়াও ‘লেপার্ড’ ট্যাঙ্কগুলিরও উন্ননের কাজ চলছে। ‘ডেইলি সাবাহ’ বলছে যে, সিরিয়ার অভ্যন্তরে তুরস্কের ‘পিস স্প্রিং’, ‘অলিভ ব্রাঞ্চ’ এবং ‘ইউফ্রেতিস শিল্ড’ অপারেশনগুলির সময়ে উন্নয়ন করা ট্যাঙ্কগুলি বেশ ভালো ফলাফল দেখিয়েছে। কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী ‘পিকেকে’ এবং আইসিসের বিরুদ্ধে চালিত অপারেশনের সময় ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের বিরুদ্ধে এই ট্যাঙ্কগুলি ভালোভাবে বেঁচে ছিল। এছাড়াও শহর অঞ্চলে ট্যাঙ্কগুলির অপারেশনসও ভালো হয়েছিল বলে বলা হয়। যেসব নতুন প্রযুক্তি ‘এম৬০টিএম’ ট্যাঙ্কে সংযুক্ত করা হয়েছে, তার মাঝে রয়েছে নতুন ‘লেজার ওয়ার্নিং সিস্টেম’; যার মাধ্যমে কোন লেজার গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র ট্যাঙ্ককে টার্গেট করলেই ট্যাঙ্কের ক্রুরা বুঝে যাবে যে তাকে টার্গেট করা হচ্ছে। এছাড়াও রয়েছে ‘সার্প’ ‘স্ট্যাবিলাইজড রিমোট ওয়েপন সিস্টেম’; যা মূলত রিমোট কন্ট্রোল মেশিন গান; ‘টেলিস্কোপিক পেরিস্কোপ সিস্টেম’, যা ট্যাঙ্কের ক্রুদের ভেতর থেকে বাইরে সকল দিকে দেখার সুবিধা দেয়; ‘পুলাট’ ‘এপিএস’; যা ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রকে ধ্বংস করবে। আরও রয়েছে ‘পজিশন এন্ড ওরিয়েন্টেশন ডিটেকশন সিস্টেম’, ‘ইয়ামগোজ’ ‘ক্লোজ ডিসট্যান্স সার্ভেইল্যান্স সিস্টেম’, ‘ট্যাঙ্ক ড্রাইভার ভিশন সিস্টেম’, ‘প্রোটেকশন প্রাইমার’, ‘এয়ার কন্ডিশনিং সিস্টেম’ এবং ‘অক্সিলারি পাওয়ার ইউনিট’।

‘আনাদোলু এজেন্সি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ২০১০ সালের এপ্রিল নাগাদ ইস্রাইল তুরস্কের জন্যে মোট ১’শ ৭০টা ‘এম৬০ এ১’ ট্যাংককে ‘এম৬০টি’ পর্যায়ে উন্নয়ন করে দিয়েছিল। ২০০২ সাল থেকে ইস্রাইলের কোম্পানি ‘ইস্রাইল মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিজ’ প্রায় ৭’শ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে এই কাজ করে। ১ হাজার হর্সপাওয়ারের নতুন ‘এমটিইউ’ ইঞ্জিন এবং ‘রেঙ্ক’এর ট্রান্সমিশন গিয়ারবক্স যুক্ত করে ট্যাঙ্কগুলিকে সেবার আরও শক্তিশালী এবং দ্রুতগামী করা হয়েছিল। বর্মও উন্নত করা হয়েছিল। তবে ইঞ্জিন এবং ট্রান্সমিশন উভয়ই ছিল জার্মান প্রযুক্তির। রাতের বেলায় অপারেশন চালাবার জন্যে ‘থারমাল সাইট সিস্টেম’ প্রযুক্তিও যুক্ত করা হয়েছিল। ‘ডিফেন্স নিউজ’ বলছে যে, তুর্কি ট্যাঙ্কগুলি সিরিয়ার অভ্যন্তরে অপারেশনে গিয়ে ক্ষয়ক্ষতির মাঝে পড়েছিল বলেই জরুরি ভিত্তিতে ট্যাঙ্কগুলির উন্নয়নের কাজ হাতে নেয়া হয়। ২০১৭ সালে শুরু করা প্রকল্পে ৪০টা ‘এম৬০ এ৩’, ১’শ ২০টা ‘এম৬০ টি’ এবং ৪০টা ‘লেপার্ড ২এ৪’ ট্যাঙ্ককে উন্নয়নের কথা বলা হয়। তুর্কি সামরিক কর্মকর্তারা বলছেন যে, ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের বিরুদ্ধে ট্যাঙ্কগুলির বেঁচে থাকার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রকল্পের শুরুতে অনেকেই মনে করছিলেন যে, ট্যাঙ্কগুলিতে বিদেশী প্রযুক্তি সংযুক্ত করা হবে।

তুর্কি সামরিক ওয়েবসাইট ‘ডিফেন্স তুর্ক’ বলছে যে, ২০০৫ সাল থেকে জার্মানি নিজেদের ব্যবহৃত সাড়ে ৩’শ ‘লেপার্ড ২এ৪’ ট্যাংক তুরস্ককে সরবরাহ করে। এই ট্যাংকগুলিকে উন্নয়নের কথা বিভিন্ন সময়ে বলা হলেও খুব একটা কর্মকান্ড পরিলক্ষিত হয়নি। ২০১৯ সালে ‘লেপার্ড’ ট্যাঙ্কের উপর কিছু ‘এক্সপ্লোসিভ রিয়্যাকটিভ আর্মার’ বা ‘ইআরএ’এ সহ ছবি সোশাল মিডিয়ায় চলে আসে। ‘ইআরএ’ হলো এক ধরনের বর্ম, যা ট্যাঙ্কের গায়ের উপর বসিয়ে দেয়া হয় এবং কোন ট্যাংক বিধ্বংসী রকেট বা ক্ষেপণাস্ত্র এই ‘ইআরএ’এর উপর আঘাত করলে এটা নিজে বিস্ফোরিত হয়ে মূল ট্যাঙ্কের বর্মকে রক্ষা দেয়। ২০২০ সালে তুর্কি কোম্পানি ‘রকেটসান’এর প্রচারপত্রের মাঝে ‘ইআরএ’ একটা পণ্য হিসেবে তালিভুক্ত হলে বোঝা যায় যে, তারাই ‘লেপার্ড’ ট্যাংক নিয়ে কাজ করছিল। ২০২১এর ফেব্রুয়ারিতে ঘোষণা দেয়া হয় যে, তুরস্ক মোট ৪০টা ‘লেপার্ড ২এ৪’ ট্যাঙ্ককে ‘লেপার্ড ২এ৪ টি১’এ উন্নীত করবে; যার মাধ্যমে ট্যাঙ্কের রক্ষাকারী বর্ম উন্নত করা ছাড়াও ট্যাঙ্কের জন্যে নতুন টারেট দেয়া হচ্ছে। টারেটের প্রযুক্তি খুব সম্ভবতঃ কোরিয়ার ‘কে২’ ট্যাংক থেকে আসছে।

 
চীনাদের তৈরি 'টাইপ ১৫' বা 'ভিটি ৫' হাল্কা ট্যাংক; যার মূল উদ্দেশ্য হলো হিমালয়ের উচ্চতায় যুদ্ধ করা। কেউ কেউ বলছেন ট্যাঙ্কের দিন শেষ; আবার অনেকেই বলছেন ট্যাংকের ব্যবহার ভবিষ্যতেও চলবে। যুদ্ধক্ষেত্রের ধরণই বলে দিচ্ছে যে, বিশ্বের কোথায় ট্যাংক গুরুত্বপূর্ণ থাকবে, আর কোথায় অগুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাবে। আর ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা বলে দিচ্ছে যে, কোন যুদ্ধক্ষেত্র কখন গরম হয়ে উঠতে পারে। অন্ততঃ ট্যাংক ডেভেলপমেন্টের প্রকল্পগুলির দ্রুততাই বলে দিতে পারে কোন যুদ্ধক্ষেত্র কত দ্রুত উত্তপ্ত হতে চলেছে।

তুরস্কের ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষা এবং যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাংকের ভবিষ্যৎ

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ক্যালেব লারসন ‘দ্যা ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় বলছেন যে, তুরস্কের ট্যাংক বাহিনীর একটা বড় অংশ হলো ১৯৫০এর দশকে ডিজাইন করা মার্কিন ‘এম৪৮’ এবং ‘এম৬০’ ট্যাংক। এর সাথে রয়েছে জার্মানির তৈরি ‘লেপার্ড ১’ এবং ‘লেপার্ড ২’ ট্যাংক; এগুলিও পুরোনো হয়ে গেছে। পুরোনো মার্কিন ট্যাঙ্কগুলি ২০১৬ সালে সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে তেমন একটা ভালো করেনি। প্রায় ডজনখানেক ট্যাংক ধ্বংস হয়েছিল সেখানে। এমনকি তুরস্কের সেরা জার্মান ‘লেপার্ড ২এ৪’ ট্যাঙ্কও ধ্বংস হয়েছে সেখানে। এই ট্যাঙ্কগুলিকে বিভিন্নভাবে ব্যাপক উন্নয়নের মাঝ দিয়ে নেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। তবে যুদ্ধের অভিজ্ঞতাই হয়তো তুর্কিদের বুঝিয়েছে যে, পুরোনো ট্যাঙ্ক দিয়ে সামনের দিনগুলিতে সকল কাজ করা যাবে না; নতুন ট্যাংক লাগবে। সেকারণেই ‘আলতায়’ ট্যাংক প্রকল্পে হয়তো গতি এসেছে। তুর্কিরা জার্মান ইঞ্জিন এবং ট্রান্সমিশন গিয়ারবক্সের দিকেই তাকিয়ে ছিল; কারণ সেগুলি বিশ্বসেরা। ভারতের ‘অর্জুন’ ট্যাংক এবং ফ্রান্সের ‘লেকলার্ক’ ট্যাঙ্কেও ‘রেঙ্ক’এর ট্রান্সমিশন ব্যবহার করা হয়েছে। কোরিয়রাও মূলতঃ জার্মান প্রযুক্তিকেই অনুসরণ করে নিজেদের গিয়ারবক্স ডেভেলপ করেছে; যা নিয়ে এখনও তারা পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেনি।

তুর্কিরা নিশ্চিত যে, সামনের দিনগুলিতে তাদেরকে মধ্যপ্রাচ্যে এবং হয়তো ককেশাস বা আফ্রিকাতেও যুদ্ধে জড়াতে হবে। অন্ততঃ উসমানি খিলাফতের ইতিহাসকে পুঁজি করে স্বপ্ন দেখা তুরস্ক তেমনই একটা ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষাকে লালন পালন করছে। এই আকাংক্ষা একদিকে যেমন তুরস্কের পশ্চিমা বন্ধুদের কাছে অগ্রহণযোগ্য, তেমনি তুরস্কের বর্তমান নিজস্ব প্রযুক্তিগত সক্ষমতার জন্যেও বড় চ্যালেঞ্জ। তুরস্ক এব্যাপারেও নিশ্চিত যে, ট্যাংক ছাড়া তার সেনা অভিযানগুলি সম্ভব নয়। তুরস্কের মতো আরও কিছু দেশ মনে করছে যে, যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাঙ্কের প্রয়োজন যথেষ্টই রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও ককেশাস, উত্তর আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া এবং কোরিয় উপদ্বীপে ট্যাঙ্কের কদর কমেনি বিন্দুমাত্র। নিজেদের বিশাল স্থলসীমানা রক্ষায় রুশরাও সামনের দিনগুলিতে ট্যাংক তৈরি করে যাবে। চীনারা হিমালয়ের উচ্চতায় সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্যে ৭০ টনের ট্যাঙ্কের বদলে ৩৬ টনের ‘টাইপ ১৫’ বা ‘ভিটি ৫’ হাল্কা ট্যাংক ডেভেলপ করছে। ইন্দোনেশিয়াও জঙ্গলে যুদ্ধের জন্যেও তুরস্কের সহায়তায় ৩৫ টনের হাল্কা ‘কাপলান এমটি’ বা ‘হারিমাউ’ ট্যাংক ডেভেলপ করছে। এখানকার সেনাবাহিনীগুলি মনে করছে যে, সামনের দিনগুলিতে শতশত বা হাজার হাজার ট্যাঙ্কের সমন্বয়েই যুদ্ধ সংঘটিত হবে। অপরদিকে ইউরোপিয়রা ট্যাঙ্কের সংখ্যা কমিয়ে ফেলছে; তারা মনে করছে যে, ড্রোন এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মতো নতুন প্রযুক্তিই যুদ্ধক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হবে বেশি। মার্কিন ম্যারিন কোরও তাদের ট্যাংকগুলিকে ফেলে দিচ্ছে। তারা মনে করছে যে, চীনকে মোকাবিলায় প্রশান্ত মহাসাগরের ছোট দ্বীপগুলিতে যুদ্ধ করতে তাদের ট্যাঙ্কের চাইতে বেশি দরকার হবে ব্যালিস্টিক এবং ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। যুদ্ধক্ষেত্রের ধরণই বলে দিচ্ছে যে, বিশ্বের কোথায় ট্যাংক গুরুত্বপূর্ণ থাকবে, আর কোথায় অগুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাবে। আর ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা বলে দিচ্ছে যে, কোন যুদ্ধক্ষেত্র কখন গরম হয়ে উঠতে পারে। অন্ততঃ ট্যাংক ডেভেলপমেন্টের প্রকল্পগুলির দ্রুততাই বলে দিতে পারে কোন যুদ্ধক্ষেত্র কত দ্রুত উত্তপ্ত হতে চলেছে।

No comments:

Post a Comment