Thursday 18 November 2021

পোল্যান্ড এবং বেলারুশের সীমান্তে ব্রিটেন কি চাইছে?

১৮ই নভেম্বর ২০২১

পোল্যান্ড বেলারুশ সীমান্তে শরণার্থী সমস্যা মোকাবিলায় ব্রিটেন পোল্যান্ডের সাথে থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। অমানবিকতার উদাহরণ সৃষ্টি করে ঠান্ডায় জমে যাওয়া শরণার্থীদেরকে শক্তি প্রয়োগে ঠেকিয়ে রাখতে পোল্যান্ডকে সমর্থন এবং টেকনিক্যাল সহায়তা দিয়ে ব্রিটেন প্রমাণ করছে যে, তার ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ কৌশল বিশ্বব্যাপী আদর্শকে পূনপ্রতিষ্ঠা করার জন্যে নয়; নিছক ইংরেজি ভাষাভাষী দেশগুলিকে বিশ্বের সবচাইতে প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে।

 
পোল্যান্ড বেলারুশ সীমান্তে শরণার্থী সমস্যা মোকাবিলায় ব্রিটেন পোল্যান্ডের সাথে থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। ১৩ই নভেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব লিজ ট্রাস ‘সানডে টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার এক লেখায় বলেন যে, বেলারুশের প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো অসহায় শরণার্থীদেরকে খুব সুচতুরভাবে ব্যবহার করে একটা সমস্যার জন্ম দিয়েছেন। তিনি সমস্যা সমাধানে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানান। ‘ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ইইউ এই সমস্যাকে বেলারুশ সরকারের ‘হাইব্রিড যুদ্ধ’ বলে আখ্যা দিচ্ছে। তারা বলছে যে, বেলারুশ মধ্যপ্রাচ্য থেকে শরণার্থীদের পোল্যান্ডের সীমানায় জড়ো করে চাপ সৃষ্টি করছে। লিজ ট্রাসের জবাবে পরদিন রুশ পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেন যে, এই সমস্যার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট পুতিনের কোন দায়বদ্ধতা নেই। তিনি উল্টো বলেন যে, বরং ইরাকে ব্রিটিশ হামলাই ছিল সুচতুরভাবে করা। ইরাকের জনগণের মৃত্যু, রাষ্ট্রের পতন, অগুণিত শরণার্থী, আইসিসের উত্থান, মানবাধিকার দুর্যোগের জন্যে ব্রিটেন পুরোপুরিভাবে দায়ী। যতক্ষণ পর্যন্ত লন্ডন এই অপরাধগুলির জন্যে দায়বদ্ধতা নিচ্ছে না, ততক্ষণ তাদের প্রতিনিধিদের অন্য কারুর দিকে আঙ্গুল তাক করার অধিকার নেই। ভ্লাদিমির পুতিন একই দিনে রুশ টেলিভিশনের এক স্বাক্ষাতে জাখারোভার কথাগুলিকেই সমর্থন দেন। তিনি বলেন যে, পোলিশ সেনারা শরণার্থীদের পেটাচ্ছে, তাদের মাথার উপর দিয়ে গুলি ছুঁড়ছে এবং রাতের বেলায় বাতি এবং সাইরেন দিয়ে তাদের দূরে রাখছে। এই কর্মকান্ডগুলি পশ্চিমা দেশগুলির মানবাধিকারের কথাগুলির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

পোল্যান্ডই কেন?


এই সমস্যার মাঝে পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মাটিউজ মোরাউইয়েকি ন্যাটোকে জড়িত হবার অনুরোধ করেছেন। তিনি বলেন যে, পোল্যান্ড নিজেদের সমস্যাগুলি জনসন্মুখে বলেছে সেটাই যথেষ্ট। এখন পোল্যান্ড ন্যাটোর সদস্য দেশগুলির কাছ থেকে বাস্তব সহায়তা আশা করছে। ১২ই নভেম্বর ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা দপ্তরের বরাত দিয়ে ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ জানায় যে, ব্রিটিশ সরকার পোল্যান্ডের সীমানা রক্ষায় ১০ জন ব্রিটিশ সেনা পাঠিয়েছে। এই সেনারা সীমানা প্রাচীর আরও শক্তিশালী করতে ইঞ্জিনিয়ারিং সহায়তা দেবে। তবে এরপর আর কোন সৈন্য পাঠাবার উদ্দেশ্য ব্রিটেনের নেই বলে জানায় তারা। ইতোমধ্যেই পোলিশ সরকার বেলারুশের সীমানায় ২০ হাজার সেনা মোতায়েন করেছে। পোলিশ সরকার ব্রিটেনের কাছে সহায়তা চাইলেও ইইউএর সীমানা ব্যবস্থাপনা সংস্থা ‘ফ্রনটেক্স’এর সহায়তা চায়নি। পত্রিকাটা বলছে যে, কি কারণে পোল্যান্ড ব্রিটেনের সহায়তা চেয়েছে তা পরিষ্কার না হলেও ইইউএর সাথে উভয় দেশই দ্বন্দ্বে জড়াবার পর থেকে তাদের মাঝে সখ্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থা ‘এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ বলছে যে, যখন শরণার্থীরা মারা যাচ্ছে, তখন তাদের সহায়তা না দিয়ে ব্রিটিশ সেনা পাঠিয়ে সীমানা প্রাচীর শক্তিশালী করাটা মানুষের জীবনের প্রতি মারাত্মক অবহেলা এবং অভিবাসী প্রত্যাশী মানুষের অধিকারের প্রতি চরম অবহেলাকে দেখিয়ে দেয়।

 
সমতলভূমি হওয়ায় দেশটা পশ্চিম ইউরোপ এবং রাশিয়ার মাঝে একটা খোলা জায়গা। এই অবস্থানটাই পোল্যান্ডকে অষ্টাদশ শতকের পর থেকে চ্যালেঞ্জে ফেলেছে। অষ্টাদশ শতকে রাশিয়া এবং প্রুশিয়া এবং ঊনিশ শতকে জার্মানির আবির্ভাবের পর থেকে জার্মানি, রাশিয়া এবং অস্ট্রিয়া মিলে পোল্যান্ডের ভূখন্ড ভাগাভাগি করে ফেলে। এর ফলশ্রুতিতে ষোড়শ শতকের শক্তিশালী পোলিশ লিথুয়ানিয়ান সাম্রাজ্য প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোল্যান্ড ইউরোপের অন্যান্য শক্তিদের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়।

পোল্যান্ডের ভৌগোলিক অবস্থান দেশটার এধরনের সমস্যার একটা প্রধান কারণ। পোল্যান্ডের ভৌগোলিক চ্যালেঞ্জের একটা বর্ণনা দিয়েছে মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘স্ট্রাটফর’। দেশটা উত্তর ইউরোপের সমতলভূমির উপর অবস্থিত; যার পূর্ব এবং পশ্চিমে তেমন কোন বড় ভৌগোলিক বাধা নেই। তবে এর উত্তরে বল্টিক সাগর এবং দক্ষিণে কার্পেথিয়ান পর্বতমালা দেশটাকে উত্তর-দক্ষিণে সংকুচিত করে রেখেছে। সমতলভূমি হওয়ায় দেশটা পশ্চিম ইউরোপ এবং রাশিয়ার মাঝে একটা খোলা জায়গা। এই অবস্থানটাই পোল্যান্ডকে অষ্টাদশ শতকের পর থেকে চ্যালেঞ্জে ফেলেছে। অষ্টাদশ শতকে রাশিয়া এবং প্রুশিয়া এবং ঊনিশ শতকে জার্মানির আবির্ভাবের পর থেকে জার্মানি, রাশিয়া এবং অস্ট্রিয়া মিলে পোল্যান্ডের ভূখন্ড ভাগাভাগি করে ফেলে। এর ফলশ্রুতিতে ষোড়শ শতকের শক্তিশালী পোলিশ লিথুয়ানিয়ান সাম্রাজ্য প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোল্যান্ড ইউরোপের অন্যান্য শক্তিদের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবের অধীন হয়ে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পোল্যান্ড ১৯৯৯ সালে ন্যাটোতে যুক্ত হয় এবং ২০০৪ সালে ইইউতে যুক্ত হয়। বিপুল পশ্চিমা বিনিয়োগে পোল্যান্ডের অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত উন্নতি হতে থাকে। রাশিয়ার ভীতি পোল্যান্ডকে ন্যাটোর সামরিক বাহিনীর উপর নির্ভরশীল করেছে এবং দেশটাতে ইউরোপের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়। একইসাথে ইউক্রেনকে পশ্চিমা ধাঁচে নিয়ে এসে পোল্যান্ড তার পূর্ব সীমানাকে নিরাপত্তা দেয়ার চেষ্টা করেছে।

জার্মান রুশ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বল্টিক সাগরে ব্রিটেনের অবস্থান


পোল্যান্ড একদিকে যেমন উত্তর ইউরোপের সমতলভূমির উপর বড় একটা দেশ, তেমনি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বল্টিক সাগরে পোল্যান্ডের রয়েছে উপকূল এবং বড় সমুদ্রবন্দর। বল্টিক সাগরে ব্রিটেনের রয়েছে ঐতিহাসিক উপস্থিতি। ২০১৮ সালে ব্রিটেন এস্তোনিয়ার স্বাধীনতার শতবর্ষ উদযাপন করে। সেই অনুষ্ঠানে এস্তোনিয়ানরা মনে করে যে, ১৯১৮-১৯ সালের সেই যুদ্ধে ব্রিটিশ নৌ এবং বিমান শক্তি এস্তোনিয়ার স্বাধীনতা অর্জনে বড় ভূমিকা রেখেছিল। এস্তোনিয়ার স্বাধীনতা ছিল রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশের সামরিক মিশনের ফলাফলস্বরূপ যুদ্ধ। ব্রিটিশরা তখন রাশিয়ার উত্তরে মুরমানস্ক এবং আর্কেঞ্জেলস্ক এবং দক্ষিণে ইউক্রেনে বলশেভিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিল। প্রায় একইসাথে চলেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে সদ্য গঠিত দ্বিতীয় পোলিশ রিপাবলিকের সাথে লেনিনের বলশেভিক রাশিয়ার যুদ্ধ। পোল্যান্ডের সরকারি ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে যে, ১৯২০ সালের অগাস্টে সোভিয়েত বাহিনীর হাত থেকে পোলিশরা যখন তাদের রাজধানী ওয়ারশ মুক্ত করার চেষ্টা করছিল, তখন ব্রিটিশরা পোল্যান্ডকে ১’শটা যুদ্ধবিমান এবং বেশকিছু কামান এবং বন্দুক সরবরাহ করেছিল। এভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ব্রিটেন বল্টিকে তার প্রভাবকে আরও বাড়াতে চেষ্টা করে। তবে জার্মানি এবং রাশিয়ার কারণে এই প্রভাব সবসময়ই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।

‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ব্রিটেনের সাথে পোল্যান্ডের সম্পর্কটা দৃঢ় হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করলে ব্রিটেন যুদ্ধে যোগ দেয়। ব্রিটেন পোল্যান্ডকে নিরাপত্তা দিতে না পারলেও হাজার হাজার পোলিশ নাগরিক ব্রিটেনের নিরাপত্তার জন্যে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং জীবন দেয়। ‘দ্যা ফার্স্ট নিউজ’এর এক প্রতিবেদনে মনে করিয়ে দেয়া হয় যে, বিশ্বযুদ্ধের সময় পোলিশ ইন্টেলিজেন্স ছিল ইউরোপের সবচাইতে সফল ইন্টেলিজেন্স সংস্থা। কর্নেল স্টানিসলাউ গানোর নেতৃত্বে এই ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক ছিল ব্রিটিশ তথা মিত্রবাহিনীর ইন্টেলিজেন্সের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর মূল অফিস ছিল পশ্চিম লন্ডনের হ্যামারস্মিথের সেন্ট পলস স্কুল। বিশ্বযুদ্ধের শেষে ১৯৫১ সালে ব্রিটেনে পোলিশ নাগরিক ছিল প্রায় ১ লক্ষ ৬০ হাজার; যা পোল্যান্ডের ইইউতে যোগদানের পর ২০১১ সাল নাগাদ ৫ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। ২০০৪ সালে পোলিশরা ব্রিটেনের ১৩তম বিদেশী নাগরিকের গ্রুপ ছিল; ২০০৮ সাল নাগাদ তারা হয়ে যায় বৃহত্তম।

 

ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’ বা ‘রুসি’র এক লেখায় এসোসিয়েট ফেলো ডানকান ডিপ্লেজ বলছেন যে, ২০০৮ সালে রাশিয়া জর্জিয়া আক্রমণ করার পর ছোট বল্টিক রাষ্ট্রগুলি দুশ্চিন্তায় পরে যায়। বিশেষ করে রাশিয়া ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করে নেবার পর এই দুশ্চিন্তা জেঁকে বসে। উত্তর এস্তোনিয়ার শহরগুলিতে রুশ নাগরিকের অধিক্য সবসময়ই এস্তোনিয়ানদের ভয়ের মাঝে রাখছে। ন্যাটোর সদস্য হওয়ায় এই দেশগুলি রুশ আক্রমণের শিকার হলে ন্যাটোর অন্যান্য দেশ এখানে হস্তক্ষেপ করবে। আর বল্টিকে সম্ভাব্য যেকোন হস্তক্ষেপে ব্রিটেন নেতৃত্ব দেবে। ২০১৭ সাল থেকে ব্রিটেন ন্যাটোর ‘ফ্রেমওয়ার্ক নেশনস কনসেপ্ট’ বা ‘এফএনসি’এর অধীনে বল্টিকে সামরিক মিশন প্রেরণ করছে। ২০১৯ সালে ‘অপারেশন কাবরিট’এর অধীনে ব্রিটেন এস্তোনিয়াতে ৯’শ সেনা প্রেরণ করে। ১৬তম এয়ার এসল্ট ব্রিগেডের প্রায় ২’শ সেনা আকাশ থেকে প্যারাশুট জাম্প করে। সেবছরের এপ্রিল মাস থেকে রয়াল এয়ার ফোর্সের ৪টা ‘ইউরোফাইটার টাইফুন’ যুদ্ধবিমান এস্তোনিয়াতে মোতায়েন করা হয়। তবে ব্রিটিশ বিমান শক্তি মোতায়েনের এরকম কার্যক্রম নিয়মিত চলছে ২০০৪ সাল থেকেই। ২০২০এর জুলাই মাসে রয়াল এয়ার ফোর্স বলে যে, তাদের ‘টাইফুন’ বিমানগুলি তিনটা রুশ যুদ্ধবিমানকে লিথুয়ানিয়ার কাছাকাছি আকাশে বাধা দেয়। এরকম ঘটনা প্রায় নিয়মিতই ঘটছে। বিশেষ করে বল্টিক সাগরে ন্যাটোর সামরিক মহড়া সর্বদাই মস্কোর জন্যে বিরক্তির কারণ। আবার প্রত্যুত্তর হিসেবে রাশিয়াও অত্র অঞ্চলে নিয়মিত সামরিক মহড়া চালায়। বল্টিকে ব্রিটিশ বিমানগুলির সাথে জার্মান, ফরাসি, স্প্যানিশ এবং অন্যান্য মোট ১৪টা দেশের যুদ্ধবিমানও আকাশ পাহাড়া দেয়। তিনটা বল্টিক রাষ্ট্র লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া এবং এস্তোনিয়ার জনসংখ্যা যথাক্রমে ২৮ লক্ষ, ১৯ লক্ষ এবং ১৩ লক্ষ। ছোট্ট এই দেশগুলির বিমান বাহিনীতে কোন ফাইটার বিমান নেই। তাই দেশগুলি নিরাপত্তার জন্যে ন্যাটোর উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতাই ব্রিটেনকে বল্টিক সাগরে গুরুত্বপূর্ণ করে রেখেছে।

বল্টিকের নিরাপত্তায় ন্যাটোর মাঝে নেতৃত্ব ব্রিটেনের হাতে

বল্টিক সাগরের উপকূলে ব্রিটেনের বর্তমান সামরিক অবস্থানকে বুঝতে হলে ন্যাটোর ‘এফএনসি’এর দিকে তাকাতে হবে। সুজারল্যান্ডের থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর সিকিউরিটি স্টাডিজ’ বা ‘সিএসএস’এর এক প্রতিবেদনে ‘জার্মান ইন্সটিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল এন্ড সিকিউরিটি এফেয়ার্স’ বা ‘এসডব্লিউপি’এর রেইনার গ্লাটজ এবং ‘সিএসএস’এর মার্টন জাপফে ন্যাটোর ‘এফএনসি’এর একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। ‘এফএনসি’এর অধীনে ২০১৩ সাল থেকে ন্যাটোর তিন সীমানা অঞ্চলের নিরাপত্তা দিতে তিনটা দেশের নেতৃত্বে তিনটা নিরাপত্তা কাঠামো পরিকল্পনা করা হয়। এই তিনটা কাঠামোর নেতৃত্বে রয়েছে জার্মানি, ব্রিটেন এবং ইতালি। জার্মানির নেতৃত্বে গ্রুপটা মোট ১৬টা সামরিক সক্ষমতার কথা উল্লেখ করেছে; এর মাঝে ন্যাটোর যে দেশ এই সক্ষমতাগুলির যেটা দিতে পারবে, তারা সেটাতে অংশ নেবে। জার্মানির নেতৃত্বে এই গ্রুপের একটা গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো ন্যাটোর পূর্ব সীমান্তে একটা সমন্বিত সেনাবাহিনী তৈরি করা। ইতালির নেতৃত্বে গ্রুপটা কাজ করবে ইউরোপের দক্ষিণ সীমান্তে; মূলতঃ উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে। তবে এই গ্রুপটা খুব বড় কোন লক্ষ্য রেখে এগুচ্ছে না। উত্তর ইউরোপে যে গ্রুপটা বড় লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছে, সেটা হলো ব্রিটেনের নেতৃত্বে থাকা ‘জয়েন্ট এক্সপিডিশনারি ফোর্স’ বা ‘জেইএফ’। ২০১২ সালে পরিকল্পিত হওয়া ‘জেইএফ’এর মাঝে ২০১৪ সালে যুক্ত হয় নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশ নরওয়ে এবং তিনটা বল্টিক রাষ্ট্র লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়া। ২০১৭ সালে ন্যাটোর বাইরের স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশ সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডও যুক্ত হয়। এদের একটা লক্ষ্য ছিল ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়া ব্রিটেনের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন। তবে এই দেশগুলির সবগুলিরই মূল লক্ষ্য ছিল উত্তর ইউরোপে রাশিয়ার আগ্রাসী অবস্থানকে মোকাবিলা করা। ব্রিটেন ‘জেইএফ’ নামের এই গ্রুপের কাঠামোটাকে এমনভাবে ডিজাইন করেছে যে, যেকোন দেশ যেকোন সময়ে এই মাঝে যুক্ত হতে পারবে। ‘জেইএফ’এর মূল কর্মক্ষেত্র হলো নরওয়ের উপকূল এবং বল্টিক সাগর। নিয়মিতভাবেই ‘জেইএফ’এর মহড়া অনুষ্ঠিত হচ্ছে বল্টিকে এবং নরওয়ের উপকূলে। ব্রিটেন এর মাধ্যমে পোল্যান্ডের সাথে সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে চাইবে।

 
এপ্রিল ১৮০১ সাল। কোপেনহাগেনের যুদ্ধে ব্রিটিশরা ড্যানিশ নৌবাহিনীকে পরাজিত করে বল্টিকের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে। বল্টিক সাগরে ব্রিটেনের স্বার্থ কয়েক শতক ধরে। সপ্তদশ শতক থেকে ঊনিশ শতকের শুরু পর্যন্ত কাঠের পালতোলা জাহাজের যুগে ব্রিটেনের একটা বড় বাণিজ্য ছিল বল্টিকের সাথে। ব্রিটিশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ তৈরির উপকরণের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ আসতো সুইডেন, রাশিয়া, প্রুশিয়া, পোল্যান্ড, নরওয়ে থেকে। এই বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে ব্রিটেন স্প্যানিশ, ডাচ এবং ড্যানিশদের সাথে যুদ্ধও করেছে।


বল্টিকে ব্রিটেনের ঐতিহাসিক স্বার্থ

বল্টিক সাগরে ব্রিটেনের স্বার্থ কয়েক শতক ধরে। সপ্তদশ শতক থেকে ঊনিশ শতকের শুরু পর্যন্ত কাঠের পালতোলা জাহাজের যুগে ব্রিটেনের একটা বড় বাণিজ্য ছিল বল্টিকের সাথে। ব্রিটিশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ তৈরির উপকরণের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ আসতো সুইডেন, রাশিয়া, প্রুশিয়া, পোল্যান্ড, নরওয়ে থেকে। এই বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে ব্রিটেন স্প্যানিশ, ডাচ এবং ড্যানিশদের সাথে যুদ্ধও করেছে। ১৭১৮ থেকে ১৭২৬ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশরা বল্টিকে টহল দিয়েছে রুশ হামলা থেকে সুইডিশ উপকুলকে রক্ষা করতে। স্থলভাগে রুশদের আগ্রাসী কর্মকান্ড ব্রিটিশরা থামাতে না পারলেও ১৭৫০এর দশকে প্রুশিয়াকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে বল্টিকে প্রভাব ধরে রাখে। বল্টিক সাগরে ঢোকার পথের নিয়ন্ত্রণ মুলতঃ ডেনমার্ক এবং সুইডেনের হাতে; কারণ কোপেনহাগেন শহর এবং সুইডেনের মালমো শহরের পাশ দিয়েই জাহাজগুলিকে বল্টিক সাগরে ঢুকতে বা সেখান থেকে বের হতে হয়। মাত্র ৩ থেকে ৫ কিঃমিঃ চওড়া এই প্রণালির নিয়ন্ত্রণ যাতে অন্য কারুর হাতে চলে না যায়, সেজন্য ব্রিটেন দু’বার কোপেনহাগেন আক্রমণ করে। ১৮০১ সালে প্রথমবার রুশ প্রভাব থেকে মুক্ত করার জন্যে ড্যানিশ নৌবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ব্রিটেন। রুশ রাজা জার পল হত্যার পর বল্টিকের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরিভাবে ব্রিটেনের হাতে যায়। অনেকেই মনে করে থাকেন যে, জার পলের হত্যার পিছনে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত চার্লস হুইটওয়ার্থ জড়িত ছিলেন। এর ছয় বছর পর ১৮০৭ সালে ব্রিটেন আবারও কোপেনহাগেন আক্রমণ করে যাতে ন্যাপোলিয়নের ফ্রান্স ডেনমার্কের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ড্যানিশ যুদ্ধজাহাজগুলিকে বল্টিকের নিয়ন্ত্রণ নিতে ব্যবহার করতে না পারে।

ঊনিশ শতকে জার্মানির আবির্ভাবের পর ব্রিটিশ নৌবাহিনী বল্টিকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়ে। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ‘অপারেশন রেড ট্রেক’ নামে বল্টিকে বলশেভিক বিরোধী মিশন শুরু করে; যার ফলশ্রুতিতে এস্তোনিয়া এবং লাটভিয়ার জন্ম দেয় ব্রিটেন। ১৯১৮ সালের ডিসেম্বরে ব্রিটিশ নৌবাহিনী এস্তোনিয়ার স্বাধীনতাকামীদেরকে বলশেভিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাড়ে ছয় হাজার রাইফেল, ২’শ মেশিন গান এবং দু’টা কামান সরবরাহ করে। এস্তোনিয়া এবং লাটভিয়া ব্রিটিশদের দ্বারা এতটাই প্রভাবিত ছিল যে, তাদের নতুন তৈরি করা নৌবাহিনীর পতাকাগুলিও ছিল ব্রিটিশ ইউনিয়ন জ্যাক পতাকার আদলে তৈরি। ব্রিটিশ সহায়তা ছাড়া এই দেশগুলির স্বাধীনতা অর্জন যেমন সম্ভব ছিল না, তেমনি তাদের স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখাও ছিল পুরোপুরিভাবে অবাস্তব।

‘রুসি’র ডানকান ডিপ্লেজ বলছেন যে, ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্র তিনটা বল্টিক রাষ্ট্রকে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে ছেড়ে দিলে অনেকেই তা মানতে পারেননি। তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর এই দেশগুলিকে ন্যাটোর মাঝে এনে নিরাপত্তা দেয়ার ব্যাপারটা কিছুটা হলেও পুরোনো ক্ষতগুলিকে সাড়াতে সহায়তা করবে। 

মার্চ ২০২১। ব্রিটেনের নেতৃত্বে থাকা ‘জয়েন্ট এক্সপিডিশনারি ফোর্স’ বা ‘জেইএফ’ মহড়া দিচ্ছে বল্টিক সাগরে। ব্রিটেন শুধু বল্টিক সাগরে নিজের অবস্থানই ধরে রাখতে চাইছে না; ইউরোপের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ককেও নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। ব্রিটেন এখন ওয়ারশতে নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে চাইছে। বেলারুশের সাথে পোল্যান্ড এবং বল্টিক রাষ্ট্রগুলির সীমান্ত সমস্যায় ব্রিটেন অগ্রগামী ভূমিকা নিতে চাইছে এমন এক সময়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্র চাইছে বাকি বিশ্ব থেকে তার বাহিনী সরিয়ে ইন্দোপ্যাসিফিকে চীনের বিরুদ্ধে মোতায়েন করতে। পূর্ব ইউরোপের উত্তেজনার উপর ব্রিটেনের প্রভাব যত বেশি থাকবে, যুক্তরাষ্ট্র তার ইউরোপ নীতির জন্যে ব্রিটেনের উপর ততটাই নির্ভর করতে বাধ্য হবে।

ব্রিটেন আসলে কি চাইছে?

ব্রিটেন শুধু বল্টিক সাগরে নিজের অবস্থানই ধরে রাখতে চাইছে না; ইউরোপের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ককেও নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। রাশিয়ার ব্যাপারে জার্মানি এবং পোল্যান্ডের নীতির পার্থক্য রয়েছে। জার্মানরা যখন রুশ গ্যাসের উপর তাদের নির্ভরশীলতা বাড়িয়েছে, তখন পোলিশরা রুশ হুমকি মোকাবিলায় নিজ দেশে ন্যাটোর সেনা মোতায়েন চেয়েছে। আর ছোট্ট বল্টিক রাষ্ট্রগুলি নিজেদের কোন নিরাপত্তা কাঠামো না থাকায় ন্যাটোর উপর সম্পূর্ণই নির্ভরশীল থাকতে বাধ্য। ঠান্ডা যুদ্ধের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পোল্যান্ডের সম্পর্ক গভীর হয়েছে। ব্রিটেন এখন ওয়ারশতে নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে চাইছে। বেলারুশের সাথে পোল্যান্ড এবং বল্টিক রাষ্ট্রগুলির সীমান্ত সমস্যায় ব্রিটেন অগ্রগামী ভূমিকা নিতে চাইছে এমন এক সময়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্র চাইছে বাকি বিশ্ব থেকে তার বাহিনী সরিয়ে ইন্দোপ্যাসিফিকে চীনের বিরুদ্ধে মোতায়েন করতে। পূর্ব ইউরোপের উত্তেজনার উপর ব্রিটেনের প্রভাব যত বেশি থাকবে, যুক্তরাষ্ট্র তার ইউরোপ নীতির জন্যে ব্রিটেনের উপর ততটাই নির্ভর করতে বাধ্য হবে। আর ইউরোপ নীতি নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের সীমিত সম্পদের বিশ্বব্যাপী বন্টনকে প্রভাবিত করবে বলেই যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হবে। ব্রেক্সিটের পর যে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ নীতি নিয়ে ব্রিটেন এগুচ্ছে, তার ফলাফলই এখন দেখছে মানুষ বেলারুশের সীমানায়। অমানবিকতার উদাহরণ সৃষ্টি করে ঠান্ডায় জমে যাওয়া শরণার্থীদেরকে শক্তি প্রয়োগে ঠেকিয়ে রাখতে পোল্যান্ডকে সমর্থন এবং টেকনিক্যাল সহায়তা দিয়ে ব্রিটেন প্রমাণ করছে যে, তার ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ কৌশল বিশ্বব্যাপী আদর্শকে পূনপ্রতিষ্ঠা করার জন্যে নয়; নিছক ইংরেজি ভাষাভাষী দেশগুলিকে বিশ্বের সবচাইতে প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে।

No comments:

Post a Comment