Sunday 14 November 2021

সাইবার যুদ্ধে মার্কিনীরা কেন আক্রমণে যেতে চাইছে?

১৪ই নভেম্বর ২০২১

মার্কিন 'কলোনিয়াল পাইপলাইন' সিস্টেম; যা যুক্তরাষ্ট্রের পুরো পূর্ব উপকূলে জ্বালানি তেলের সরবরাহ করে। গত মে মাসে হ্যাকাররা এর নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার নিরাপত্তা যে নিশ্ছিদ্র নয়, তা পেন্টাগনের ‘জিরো ট্রাস্ট’ নীতিই বলে দিচ্ছে। একইসাথে মার্কিন সাইবার কমান্ডের প্রতিপক্ষের নেটওয়ার্কের ভিতর অবস্থান করা এবং নিজেদের নেটওয়ার্কে হামলার আগেই হামলা ঠেকিয়ে দেয়ার নীতির দিকে ধাবিত হওয়া বলে দিচ্ছে যে, প্রতিরক্ষামূলক নয়, বরং আক্রমণাত্মক সাইবার ‘ডিটারেন্ট’ তৈরির দিকেই এখন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বেশি। 


গত মে মাসে রুশ হ্যাকাররা যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ‘কলোনিয়াল পাইপলাইন’ নেটওয়ার্কে ‘র‍্যানসমওয়্যার’ দিয়ে হামলা করে। এর ফলশ্রুতিতে বিশাল এলাকায় জ্বালানি তেলের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং তেলের মূল্য আকাশচুম্বি হয়। শেষ পর্যন্ত ৫ মিলিয়ন ডলার দিয়ে হ্যাকারদের কাছ থেকে নেটওয়ার্ক উদ্ধার হয়। ‘কলোনিয়াল পাইপলাইন’ হলো যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘতম পরিশোধিত জ্বালানি তেলের পাইপলাইন; যা টেক্সাসের হিউস্টন থেকে শুরু হয়ে নিউ ইয়র্ক পর্যন্ত বিস্তৃত। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও পূর্ব উপকূল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৯ হাজার কিঃমিঃ লম্বা এই পাইপলাইন দিয়ে দৈনিক গড়ে প্রায় ১০ কোটি গ্যালন পরিশোধিত তেল সরবরাহ হয়। গত অক্টোবরে মার্কিন বিমান বাহিনী সচিব ফ্রাঙ্ক কেন্ডাল ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স ট্রান্সপোর্টেশন এসোসিয়েশন’এর এক অনুষ্ঠানে কথা বলতে গিয়ে এই ঘটনার ব্যাপারে বলেন যে, এই পুরো ব্যাপারটাই ঘটেছে একটামাত্র পাসওয়ার্ডের জন্যে। তিনি বলেন যে, এটা আইসবার্গের চূড়ার মতো। যুক্তরাষ্ট্র তার তথ্যকে রক্ষা করতে না পারলে শত্রুরা তথ্য চুরি করবে বা মার্কিন সামরিক অপারেশন বিঘ্নিত করবে। একই অনুষ্ঠানে বিমান বাহিনীর জেনারেল জ্যাকিলিন ভ্যান ওভোস্ট বলেন যে, হ্যাকাররা যদি জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়িয়ে ফেলতে সক্ষম হয়, তাহলে ধারণা করা যায় যে, লেগে থাকলে পুরো ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তারা কি করতে সক্ষম হবে। সামরিক ম্যাগাজিন ‘ব্রেকিং ডিফেন্স’ বলছে যে, এই সাইবার হামলা সামরিক স্থাপনার উপর না হলেও বাণিজ্যিক সংস্থার সাইবার নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এই কোম্পানিগুলি মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের লজিস্টিকস মেরুদন্ডের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মার্কিন সামরিক বাহিনীর ‘ট্রান্সপোর্ট কমান্ড’ বেসামরিক সংস্থার কাছ থেকে জ্বালানি তেল নেয়া ছাড়াও বিমান পরিবহণ, নৌ পরিবহণ এবং অন্যান্য সার্ভিসের জন্যে নির্ভরশীল। ফ্রাঙ্ক কেন্ডাল বলেন যে, পেন্টাগনের এই বাণিজ্যিক সহযোগীদের কর্মকান্ড বিঘ্নিত হলে যুদ্ধের সময় মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। তিনি বলেন যে, ট্রাক ও লজিস্টিকস কোম্পানিগুলির অর্ধেকেরও চিফ ইনফর্মেশন সিকিউরিটি অফিসার নেই। শান্তির সময়ে এই সমস্যাগুলি হয়তো সমাধান করা যাবে; কিন্তু যুদ্ধের সময়ে জয় পরাজয়ের সিদ্ধান্ত এখানেই হয়ে যাবে।

পেন্টাগনের সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছে ‘ডিরেক্টরেট অব অপারেশনাল টেস্ট এন্ড ইভ্যালুয়েশন’ বা ‘ডিওটিএন্ডই’। এর কাজ হলো সামরিক প্রযুক্তিগুলির সাইবার নিরাপত্তা পরীক্ষা করা। এই কাজের জন্যে তাদের সাথে কাজ করে গোয়েন্দা সংস্থা ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি’র ‘রেড টিম’ বা সার্টিফাইড হ্যাকার গ্রুপ। তবে সংস্থার প্রধান নিকোলাস গুয়েরটিন বলছেন যে, এই গ্রুপটা এখন সাধ্যের সর্বোচ্চ পর্যায়ে কাজ করছে; কারণ তাদের সক্ষমতা সীমিত। তিনি অক্টোবর মাসে মার্কিন সিনেটের কাছে এক লিখিত বক্তব্যে বলেন যে, ‘রেড টিম’এর আরও সক্ষমতা দরকার এবং তাদের সহায়তার জন্যে আরও অটোমেশনও প্রয়োজন।

অক্টোবর মাসে ‘টেকনেট সাইবার’এর এক অনুষ্ঠানে মার্কিন সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ লেঃ জেনারেল জন মরিসন বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে যারা সাইবার নিরাপত্তা দিচ্ছে, তাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। তিনি বলেন যে, এই মুহুর্তে বিভিন্ন সংস্থা এবং স্থাপনার নিজস্ব সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে; যেগুলির মূলতঃ আলাদা দায়িত্ব, মানদন্ড এবং কর্মকান্ড রয়েছে। এগুলি একটা আরেকটা থেকে ভিন্ন। যখন কোন সাইবার হামলা হয়, তখন মার্কিন সাইবার কমান্ডের নিরাপত্তা দল সেখানে পাঠানো হয়। কিন্তু এই দলের সক্ষমতাও সীমিত। কাজেই এই ছোট নেটওয়ার্কগুলির প্রাথমিকভাবে নিজস্ব নিরাপত্তা দেয়ার চেষ্টাটা গুরুত্বপূর্ণ। এটা করা সম্ভব হবে যদি সকল নেটওয়ার্ক একই রকমের মানদন্ড অনুসরণ করে। তিনি বলেন যে, সেনাবাহিনী চায় তাদের ব্রিগেড কমব্যাট টিমগুলি যুদ্ধ করুক; তথ্য ও সাইবার বিশ্লেষণে সময় পার না করুক। এই কাজটা ডিভিশন লেভেলে করা অপেক্ষাকৃত সহজ; কারণ তাদের হাতে কিছুটা সময় থাকবে। আবার আঞ্চলিক সাইবার সেন্টারেও করা সহজ; কারণ তাদের হাতে আরও বেশি সময় থাকবে। জেনারেল মরিসন বলেন যে, পেন্টাগনের তথ্য নেটওয়ার্ক রক্ষায় সেনাবাহিনী জনবল নিয়োগ দিচ্ছে। মূলতঃ ছোট নেটওয়ার্কগুলির সক্ষমতা বৃদ্ধিই এর লক্ষ্য।
 
‘জেনসাইবার’ নামের প্রকল্পের অধীনে ৪৬টা রাজ্য, ওয়াশিংটন ডিসি এবং পুয়ের্তো রিকোতে মোট ১’শ ৪৬টা ক্যাম্পে কাজ চলছে। লুবার বলেন যে, ‘এনএসএ’র পরবর্তী জেনারেশনের সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তৈরিতে তারা স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক এবং অধ্যাপকদের কাজে লাগাচ্ছেন। যেখানে যথেষ্ট পারশ্রমিক না দিতে পারার কারণে মার্কিন সরকার সেরা মেধাগুলিকে নিজেদের অধীনে আনতে ব্যর্থ হচ্ছে, সেখানে বেসরকারি সেক্টরের ব্যবসায়িক লক্ষ্যকে বাস্তবায়ন করেই যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে তার কাজ গুছিয়ে নেবে, তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ব্যক্তি এবং বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক স্বার্থ বাস্তবায়ন না করে পেন্টাগন এক চুলও এগুতে পারছে না; যা মার্কিন সামরিক শক্তির প্রধানতম দুর্বলতা হয়ে দেখা দিচ্ছে। 


সাইবার নিরাপত্তা এখন মার্কিনীদের বড় সমস্যা

প্রতিরক্ষা মিডিয়া ‘সিফোরআইএসআরনেট’এর ‘সাইবারকন’ অনলাইন প্যানেল আলোচনায় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি’ বা ‘এনএসএ’র সাইবার নিরাপত্তা ডিরেক্টরেটের ডেপুটি ডিরেক্টর ডেভিড লুবার মার্কিন সাইবার নিরাপত্তা কর্মকান্ডের কিছু পরিকল্পনার ব্যাখ্যা দেন। ‘এনএসএ’ পৃথিবীব্যাপী ইলেকট্রনিক সিগনালসএর উপর নজরদারি করে। প্রায় একই ধরনের কাজ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও করে থাকে। এই দুই তথ্যের মাঝে সমন্বয় করতে ‘এনএসএ’ ‘সাইবারসিকিউরিটি কল্যাবরেশন সেন্টার’ তৈরি করেছে, যার সহায়তায় সরকারি এবং বেসরকারি তথ্য বিশ্লেষনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বীদের কর্মকান্ড সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা পাচ্ছে তারা। গত দুই বছরের মাঝে তারা ৫০টারও বেশি সাইবার হুমকির আগাম পূর্বাভাস দিয়েছে। এর মাধ্যমে তারা রুশ এবং চীনা হ্যাকারদের গুরুত্বপূর্ণ নেটওয়ার্কে ঢোকার পদ্ধতি এবং ‘ম্যালওয়্যার’ সম্পর্কেও আগাম ধারণা দিয়েছে। একইসাথে লুবার বলেন যে, ইরান বা উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা অর্থের জন্যে যে কাজটা করে, সেটাও একটা হুমকি। মার্কিন কোস্ট গার্ডের সাইবার কমান্ডের প্রধান রিয়ার এডমিরাল মাইক রায়ান বলেন যে, তাদের সামনে একটা চ্যালেঞ্জ হলো সাইবার নিরাপত্তায় দক্ষ জনবল রিক্রুট করা। তারা যথেষ্ট পারিশ্রমিক তাদের দিতে পারেন না। তবে অনেকেই নিঃস্বার্থেই তাদের সাথে কাজ করেন। তবুও আর্থিক দিকটা চিন্তা করেই কোস্ট গার্ড বোনাসের ব্যবস্থা করছে। ‘এনএসএ’র ডেভিড লুবার রিক্রুটের ব্যাপারে কিছু কর্মকান্ডের কথা উল্লেখ করেন। তারা ৩’শ ৪০টা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কে পড়ার জন্যে ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করছে। প্রত্যেক গ্রীষ্মে প্রায় ৩’শ ছাত্রকে ‘এনএসএ’ ইন্টার্নিশিপের অধীনে ১২ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এদের মাঝে ৭০ থেকে ৮৫ শতাংশ ছাত্র শেষ পর্যন্ত গ্র্যাজুয়েশনের পর সংস্থায় চাকুরি নেয়। এছাড়াও ‘এনএসএ’ কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রদেরকে ‘সামার ক্যাম্প’এর মাধ্যমে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং গণিত বিষয়ে অনুপ্রাণিত করছে; একইসাথে তাদেরকে সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কেও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। ‘জেনসাইবার’ নামের এই প্রকল্পের অধীনে ৪৬টা রাজ্য, ওয়াশিংটন ডিসি এবং পুয়ের্তো রিকোতে মোট ১’শ ৪৬টা ক্যাম্পে কাজ চলছে। লুবার বলেন যে, ‘এনএসএ’র পরবর্তী জেনারেশনের সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তৈরিতে তারা স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক এবং অধ্যাপকদের কাজে লাগাচ্ছেন।

সাইবার আক্রমণেও ধার দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

১০ই নভেম্বর ‘সাইবারকন’ অনুষ্ঠানে কথা বলেন মার্কিন সাইবার কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডার লেঃ জেনারেল চার্লস মুর জুনিয়র। তিনি মার্কিন সামরিক সাইবার সক্ষমতার একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেন। তারা ১৪টা অতিরিক্ত সাইবার কমব্যাট টিম তৈরি করছেন; যেগুলি আগামী ১৮ মাসের মাঝে কর্মক্ষম হবে। এর মাঝে অর্ধেকের কাজই হবে মহাকাশের নেটওয়ার্কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তিনি একইসাথে মার্কিন সাইবার কমান্ডের আক্রমণাত্মক মিশনগুলির কথাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে, তারা প্রতিপক্ষের নেটওয়ার্কে সর্বদাই তাদের অবস্থান রাখছেন এবং এতে প্রতিপক্ষ কিভাবে চিন্তা করছে এবং তারা কি কি সাইবার অস্ত্র ডেভেলপ করছে, সেব্যাপারে আগে থেকেই জানতে পারছেন এবং নিজেদের নেটওয়ার্ককে প্রস্তুত করতে পারছেন। কিছু ক্ষেত্রে তাদের প্রতিপক্ষের প্রত্যুত্তর দেখেও তারা বুঝতে পারছেন যে, তারা কতটুকু সফল। প্রতিপক্ষের মাঝে উত্তর কোরিয়ার সাইবার আক্রমণ নিয়ে কথা বলেন জেনারেল মুর। তিনি বলেন যে, উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা অন্যান্য রাষ্ট্রের হ্যাকার থেকে আলাদা। তারা মূলতঃ আয় করার জন্যে হ্যাকিং করে; রাষ্ট্রের আয় বৃদ্ধি করতে চায়। তারা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সক্ষমতা নষ্ট করার পিছনে আগ্রহী নয়।

মার্কিন সরকারের কর্মকর্তারা সাইবার নিরাপত্তায় নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী বলে বলছেন। অক্টোবরে পেন্টাগনের হবু চিফ ইনফর্মেশন অফিসার জন শেরমান সিনেট কমিটির সামনে বলেন যে, তাইওয়ান নিয়ে যদি কোন যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়, তাহলে যেকোন সম্ভাব্য চীনা সাইবার হামলা প্রতিরোধে পেন্টাগনের যথেষ্ট প্রস্তুতি রয়েছে। তিনি বলেন যে, তারা চীনাদেরকে পিছু হটে কর্মকান্ড চালাতে বাধ্য করবেন। ‘ব্রেকিং ডিফেন্স’ বলছে যে, শেরমানের কথাগুলি সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন কৌশল পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। মার্কিন সাইবার কমান্ডের জেনারেল পল নাকাসোনি গত জুন মাসে বলেন যে, তারা ‘ডিফেন্ড ফরওয়ার্ড’ কৌশলে যাচ্ছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেটওয়ার্ক পর্যন্ত পৌঁছাবার আগেই তারা সাইবার হামলা প্রতিরোধ করবেন। এই বিবৃতিগুলি আসছে এমন সময়ে যখন অনেকেই প্রশ্ন করছেন যে, চীনাদের তুলনায় মার্কিন সাইবার নিরাপত্তা যথেষ্ট কিনা। মার্কিন সেনাবাহিনীর চিফ ইনফর্মেশন অফিসার রাজ লেয়ার মার্কিনীদের তুলনায় চীনারা বেশি সক্ষম, এই কথাটাকে ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা’ বলে আখ্যা দেন। শেরমান একইসাথে চীনা ইলেকট্রনিক্সের ব্যাপারেও তার সন্দেহ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে, তার ধারণায় যেকোন চীনা হার্ডওয়্যার বা সফটওয়্যারকে মার্কিন সিস্টেমের ধারেকাছেও আসতে দেয়া ঠিক হবে না।
 
সাইবার নিরাপত্তায় দক্ষ জনবলের ঘাটতি এখন মার্কিনীদের বড় সমস্যা। মার্কিন সংস্থা ‘ডিওটিএন্ডই’এর কাজ হলো সামরিক প্রযুক্তিগুলির সাইবার নিরাপত্তা পরীক্ষা করা। এই কাজের জন্যে তাদের সাথে কাজ করে গোয়েন্দা সংস্থা ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি’র ‘রেড টিম’ বা সার্টিফাইড হ্যাকার গ্রুপ। তবে সংস্থার প্রধান নিকোলাস গুয়েরটিন বলছেন যে, এই গ্রুপটা এখন সাধ্যের সর্বোচ্চ পর্যায়ে কাজ করছে; কারণ তাদের সক্ষমতা সীমিত। তদুপরি যুদ্ধ করতে গেলে বন্ধু দেশগুলির সাইবার নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু নিজেদের সামরিক বাহিনীর নেটওয়ার্কগুলির মাঝে সমন্বয়ই যখন মার্কিনীদের জন্যে কঠিন হচ্ছে, তখন মার্কিন বন্ধু দেশগুলির নীতি পরিবর্তন করিয়ে তাদেরকে একই সাইবার নিরাপত্তার ছত্রছায়ায় আনা কতটা কঠিন হতে পারে, তা অনুমেয়।


তবে দুর্বলতা থেকেই যাচ্ছে...

‘সিফোআইএসআরনেট’এর ‘সাইবারকন’ অনুষ্ঠানে আসেন মার্কিন সরকারের সাইবার নীতি বিষয়ক প্রধান উপসহকারী প্রতিরক্ষা সচিব মিয়েকে ইওইয়াং। তিনি বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিদ্বন্দ্বী মোকাবিলা করতে হলে নিজেদের বন্ধুদের সাথে নিয়ে যুদ্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে বন্ধুদের সাইবার নিরাপত্তাও গুরুত্বপূর্ণ; কারণ একত্রে যুদ্ধ করতে হলে নিজেদের মাঝে তথ্য আদানপ্রদান ছাড়াও কমান্ড এন্ড কন্ট্রোলের ক্ষেত্রে একই নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকতে হবে। প্রতিদ্বন্দ্বীরা নেটওয়ার্কের দুর্বল জায়গাটা দিয়েই ভেতরে ঢুকে পরবে। যুক্তরাষ্ট্র নিয়মিতভাবেই ন্যাটো, ইউরোপ এবং ইন্দোপ্যাসিফিকের বন্ধুদের কাছ থেকে সাইবার নিরাপত্তা দেয়ার অনুরোধ পাচ্ছে। ‘ডিফেন্স সিকিউরিটি কোঅপারেশন এজেন্সি’র মাধ্যমে এই বন্ধুদেরকে সহায়তা দিতে পেন্টাগনকে আরও ভালোভাবে কাজ করতে হবে বলে বলেন তিনি; যাতে বন্ধুরা নিজেদের সাইবার নিরাপত্তা শক্তিশালী করতে পারে। এই কাজটা করতে গেলে আবশ্যিকভাবেই বেসরকারি সহায়তার প্রয়োজন। যেহেতু পেন্টাগন মেধাবি জনবলকে যথেষ্ট পারিশ্রমিক দিতে পারে না, তাই সবচাইতে ভালো লোকগুলিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেই পাওয়া যায়। তিনি বেসরকারি সেক্টরকে কিভাবে পেন্টাগনের সাথে কাজ করানো যায়, সেই ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনার কথা বলেন। তবে নির্দিষ্ট করে কোন প্রকল্পের কথা তিনি বলেননি।

মিয়েকে ইওইয়াং সাইবার নীতির ফোকাস হিসেবে নির্বাচনের নিরাপত্তা এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে, একসময় অনেকেই সাইবার হ্যাকিংকে একটা অপরাধ এবং বিরক্তির কাজ হিসেবে দেখতো; যেখানে পেন্টাগনের জড়িত হবার দরকার রয়েছে বলে কেউ মনে করতো না। কিন্তু ‘র‍্যানসমওয়্যার’এর মাধ্যমে ‘কলোনিয়াল পাইপলাইন’ হ্যাকিংএর মত উদাহরণ দেখিয়ে দেয় যে, এটা এখন কেন পেন্টাগনের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলির একটা।

যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুদের সাইবার নিরাপত্তা কেন, নিজেদের নেটওয়ার্কের নিরাপত্তার ব্যাপারেই যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছে না। ‘সাইবারকন’ অনুষ্ঠানে এসেছিলেন পেন্টাগনের সাইবার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ডেপুটি চিফ ইনফর্মেশন অফিসার ডেভিড ম্যাকিওয়ন। তিনি বলেন যে, গত ফেব্রুয়ারিতে ‘সোলার উইন্ডস’ হ্যাকিংএর ঘটনা প্রকাশ হবার পর থেকে পেন্টাগন ‘জিরো ট্রাস্ট’ নীতিতে যাচ্ছে। ‘সোলার উইন্ডস’ ঘটনায় রুশ হ্যাকাররা মার্কিন বেসরকারি সফটওয়ার কোম্পানির নেটওয়ার্কে ঢুকে সেখান থেকে সরকারি বহু সংস্থার নেটওয়ার্কে ঢুকে পরে এবং সেখানে কয়েক মাস অবস্থান করে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর নজরদারি চালিয়ে যায়। মার্কিনীরা ধরেই নিচ্ছে যে, প্রতিপক্ষরা মার্কিন নেটওয়ার্কে ঢুকে পরতে পারবে এবং সেখানে তারা অবস্থান করবেই। এতকাল তারা সাইবার নিরাপত্তায় ‘সীমানা রক্ষা’ করেছেন; অর্থাৎ নেটওয়ার্কে ঢোকার জায়গায় পাহাড়া দিয়েছেন। এখন তারা চাইছেন যে, তারা নেটওয়ার্কের ভিতরে নিরাপত্তা বৃদ্ধি করবেন। এর মাধ্যমে নেটওয়ার্কের একটা স্থান থেকে অন্য স্থানে ঢুকতে হলে পাসওয়ার্ড লাগবে; অর্থাৎ নেটওয়ার্কে কেউ কেউকে বিশ্বাস কবে না। তবে এই ব্যবস্থার প্রবর্তন খুব সহজ হবে না; কারণে এখনও নিজেদের নেটওয়ার্কগুলির মাঝে সমন্বয় সময়সাপেক্ষ। তিনি বলেন যে, আগামী পাঁচ থেকে সাত বছরের মাঝে তারা হয়তো এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার নিরাপত্তা যে নিশ্ছিদ্র নয়, তা পেন্টাগনের ‘জিরো ট্রাস্ট’ নীতিই বলে দিচ্ছে। একইসাথে মার্কিন সাইবার কমান্ডের প্রতিপক্ষের নেটওয়ার্কের ভিতর অবস্থান করা এবং নিজেদের নেটওয়ার্কে হামলার আগেই হামলা ঠেকিয়ে দেয়ার নীতির দিকে ধাবিত হওয়া বলে দিচ্ছে যে, প্রতিরক্ষামূলক নয়, বরং আক্রমণাত্মক সাইবার ‘ডিটারেন্ট’ তৈরির দিকেই এখন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বেশি। এই নীতির পিছনে মূল কারণ হলো নিজেদের নেটওয়ার্কের নিরাপত্তা দেয়ার সক্ষমতার ব্যাপারে অনিশ্চয়তা। যুক্তরাষ্ট্রকে শুধুমাত্র পেন্টাগনের নেটওয়ার্ককেই রক্ষা করতে হবে না, বেসরকারি বহু প্রতিষ্ঠানকে নিরাপত্তা দিতে হবে; যাদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পেন্টাগনের নেটওয়ার্কে ঢোকা সম্ভব। আবার গ্রেট পাওয়ার প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে চীন বা রাশিয়াকে মোকাবিলা করতে পারবে না। ভৌগোলিক কারণেই মার্কিনীদেরকে অবশ্যই বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বহু দেশের সাথে একত্রে যুদ্ধ করতে হবে। সেক্ষেত্রে নিজেদের নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়া বন্ধু দেশগুলির সাইবার নিরাপত্তাও একই গুরুত্ব পেতে হবে। কিন্তু নিজেদের সামরিক বাহিনীর নেটওয়ার্কগুলির মাঝে সমন্বয়ই যখন মার্কিনীদের জন্যে এতটা কঠিন হচ্ছে, তখন মার্কিন বন্ধু দেশগুলির নীতি পরিবর্তন করিয়ে তাদেরকে একই সাইবার নিরাপত্তার ছত্রছায়ায় আনা কতটা কঠিন হতে পারে, তা অনুমেয়। শুধু তাই নয়, বন্ধুদের সাইবার নিরাপত্তা দিতে উপসহকারী প্রতিরক্ষা সচিব মিয়েকে ইওইয়াং বেসরকারি সেক্টরের সহায়তা চাইছেন। যেখানে যথেষ্ট পারশ্রমিক না দিতে পারার কারণে মার্কিন সরকার সেরা মেধাগুলিকে নিজেদের অধীনে আনতে ব্যর্থ হচ্ছে, সেখানে বেসরকারি সেক্টরের ব্যবসায়িক লক্ষ্যকে বাস্তবায়ন করেই যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে তার কাজ গুছিয়ে নেবে, তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ব্যক্তি এবং বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক স্বার্থ বাস্তবায়ন না করে পেন্টাগন এক চুলও এগুতে পারছে না; যা মার্কিন সামরিক শক্তির প্রধানতম দুর্বলতা হয়ে দেখা দিচ্ছে। নিজ নেটওয়ার্ক রক্ষা না করতে পারার এই দুর্বলতাই এখন সাইবার যুদ্ধকে প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ থেকে আক্রমণাত্মক যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে নিজেদের নিরাপত্তা নয়, বরং প্রতিপক্ষের সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক এবং লজিস্টিক্যাল ক্ষতি করার মাঝেই থাকবে কৌশলগত সফলতা। অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি নিতে পারার সক্ষমতা কার কতটুকু থাকবে, সেটাই নির্ধারণ করবে ভবিষ্যতের সেই সাইবার যুদ্ধে কে এগিয়ে থাকবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে আরও একটা সমস্যা রয়েছে; তা হলো নির্বাচনের নিরাপত্তা দেয়ার মাধ্যমে নিজেদের গণতান্ত্রিকতাকে রক্ষা করা, যা ২০২০ সালের বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর থেকে মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়েছে। অর্থাৎ গ্রেট পাওয়ার প্রতিযোগিতার মাঝে সাইবার যুদ্ধে গণতন্ত্র রক্ষা এখন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে আলাদা বোঝা!

No comments:

Post a Comment