Saturday 13 November 2021

ইরান কি ইরাকের উপর প্রভাব ধরে রাখতে পারবে?

১৩ই নভেম্বর ২০২১

ছবিঃ ইরাকের 'পপুলার মোবিলাইজেশন ইউনিট' বা 'পিএমইউ'এর মিলিশিয়া সদস্যরা বসরায় প্যারেডে অংশ নিচ্ছে। ইরাকের জনগণের কাছে ইরান সমর্থিত মিলিশিয়ারা যখন রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে ঠেকছে এবং মুকতাদা আল সদরের মতো ইরান বিরোধী নেতারা জনপ্রিয়তা পাচ্ছেন, তখন ইরানের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা ইরাকে প্রভাব বিস্তারে অগ্রগামী ভূমিকা নিতে চাইছে। একারণে যুক্তরাষ্ট্র পরবর্তী ইরাকের রাজনীতিতে পূর্বের মতো প্রভাব ধরে রাখাটা ইরানের জন্যে কঠিন হয়ে যাচ্ছে; যা ইরানের জন্যে নতুন ধরনের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের জন্ম দেবে।

 
গত ৭ই নভেম্বর ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মুস্তফা আল কাধিমির প্রাণনাশের প্রচেষ্টার পর থেকে দেশটার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং সেখানে প্রতিবেশী দেশ ইরানের প্রভাবের ব্যাপারে ব্যাপক আলোচনা চলছে। ইরাকের নিরাপত্তা বাহিনী বলছে যে, তিনটা ড্রোন ব্যবহার করে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে হামলা করা হয়; যেখানে দু’টা ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করলেও একটা হামলা করতে সক্ষম হয়। হামলায় প্রধানমন্ত্রীর কিছু না হলেও তার ছয়জন দেহরক্ষী আহত হয়। কেউ হামলার দায় স্বীকার না করলেও ইরাকের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বলছেন যে, হামলার জন্যে ইরান সমর্থিত মিলিশিয়ারাই দায়ী। হামলার প্রযুক্তিগত জ্ঞান থাকা ছাড়াও ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াগুলির ঘোষণা দেয়া সহিংসতাকেও উল্লেখ করছেন তারা। গত অক্টোবরের নির্বাচনে ভরাডুবি হলে মিলিশিয়ারা কারচুপির অভিযোগ করে নির্বাচনের ফলাফল বয়কট করে।

‘আল জাজিরা’র এক প্রতিবেদনে ইরাকের মিলিশিয়াদের উপর ইরানের নিয়ন্ত্রণকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। ইরাকের প্রধানমন্ত্রীর উপর আক্রমণের পরপরই অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে ইরানও ঘটনার নিন্দা জানায়। এবং একইসাথে পরিস্থিতি সামাল দিতে ইরানের প্রভাবশালী ‘ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কোর’ বা ‘আইআরজিসি’র আন্তর্জাতিক উইং ‘কুদস ফোর্স’এর প্রধান এসমাঈল ঘানিকে বাগদাদে পাঠায় ইরান। এটা বলা যাচ্ছে না যে, ঘটনার ব্যাপারে ইরান আগে থেকে অবগত ছিল কিনা। তবে প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ঘটনার পর তেহরানের অবস্থান দেখে অনেকেই মনে করছেন যে, এই হামলা অন্ততঃপক্ষে ইরানের পুরোপুরি সম্মতি ছাড়াই ঘটেছে। ইরাকি বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, এই মুহুর্তে ইরান চাইবে ইরাকের শিয়া মিলিশিয়াদের নিয়ন্ত্রণে এনে শিয়াদের মাঝে দ্বন্দ্ব বন্ধ করা, যা না করতে পারলে ইরাকে ইরানের আকাংক্ষা বাস্তবায়ন কঠিন হবে।

হামলার আগে মিলিশিয়া গ্রুপগুলি যথেষ্টই ক্ষেপে ছিল। নির্বাচনে বিজয়ী শিয়া নেতা মুকতাদা আল সদর ইরান সমর্থিত ‘আল ফাতাহ’ গ্রুপকে বাইপাস করে বিভিন্ন আলোচনা করেছেন; যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তী সরকারে ইরান সমর্থিত গ্রুপগুলি স্থান পাবে না। আল সদর পার্লামেন্টের ৩’শ ২৯টা আসনের মাঝে ৭৩টা পেয়ে সবচাইতে প্রভাবশালী অবস্থানে রয়েছেন। মোহাম্মদ আল হালবুসিএর ‘প্রগ্রেস পার্টি’ ৩৭টা, এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নূরি আল মালিকিএর ‘স্টেট অব ল’ পেয়েছে ৩৪টা আসন। সেই তুলনায় নির্বাচনে ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াদের মাঝে ‘বদর অর্গানাইজেন’এর প্রধান হাদি আল আমেরিএর নেতৃত্বে ‘ফাতাহ এলায়েন্স’ কোয়ালিশন পেয়েছে সর্বোচ্চ ১৭টা আসন।

২০২০এর জানুয়ারিতে মার্কিন ড্রোন হামলায় ‘কুদস ফোর্স’এর প্রধান জেনারেল কাসেম সোলাইমানি এবং ইরাকের ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াদের প্রভাবশালী নেতা আবু মাহদি আল মুহান্দিস নিহত হন। ‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এর পর থেকেই মিলিশিয়াদের নিয়ন্ত্রণে সমস্যায় রয়েছে ইরান। নতুন ব্যবস্থা হিসেবে ইরান ‘কাতাইব হিযবুল্লাহ’, ‘আসাঈব আহল আল হাক্ব’ বা ‘এএএইচ’ এবং ‘বদর অর্গানাইজেন’এর মতো বড় মিলিশিয়াগুলিকে বাইপাস করে গোপনে সবচাইতে নির্ভরযোগ্য কিছু ব্যক্তিকে নিয়ে ছোট গ্রুপ গঠন করছে। ইরাকি মিলিশিয়ারা বলছে যে, তারা এই গ্রুপের সদস্য এবং নেতা কাউকেই চেনে না। ইরাকের নিরাপত্তা বাহিনীও এদের উপর নজর রাখছে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট’এর এসোসিয়েট ফেলো হামদি মালিক এক লেখায় বলছেন যে, মিলিশিয়াগুলি ২০০৩ সালে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর এবং পরবর্তীতে আইসিসের আবির্ভাবের পর সামরিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে নিজেদেরকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। কিন্তু আইসিসের পতন এবং ইরাক থেকে সর্বশেষ মার্কিন সেনাদের প্রত্যাহারের কথায় মিলিশিয়াগুলির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এমতাবস্থায় মিলিশিয়াগুলি সামরিক কর্মকান্ডের মাধ্যমেই নিজেদের জাহির করতে চাইছে। তারা বরং তেহরানের কাছ থেকে সামরিক মিশন বৃদ্ধি করার নির্দেশ পেতেই বেশি আগ্রহী। একসময় তাদের নেতারা নিজেদের অবস্থানকে গোপন রেখে কাজ করলেও এখন তারা টেলিভিশনে এসে যুক্তরাষ্ট্রকে হুমকি দিচ্ছেন। ইরান সমর্থিত মিলিশিয়া ‘এএএইচ’এর প্রধান কাইস আল খাজালি ইরাকের ‘আল এতিজাহ’ টেলিভিশনের সাথে এক সাক্ষাতে বলেন যে, উত্তর ইরাকে তুর্কি সেনারা হামলা করলে ইরাকের জনগণের মাঝে মিলিশিয়াদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করা সহজ হবে; মিলিশিয়ারা চ্যালেঞ্জ পছন্দ করে।

ইরাকের রাজনৈতিক সমস্যাগুলি নতুন নয়। ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’এর ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে আশংকা প্রকাশ করা হয় যে, ইরান যদি ইরাকের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মিলিশিয়াদেরকে ব্যবহার করে হস্তক্ষেপ করতে চায়, তাহলে সেদেশের পরিস্থিতি আরও বেসামাল হয়ে যেতে পারে। অপরদিকে যদি মিলিশিয়াগুলিকে নতুন করে সংগঠিত করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে সেটা হবে কঠিন এবং বিপজ্জনক। প্রতিবেদনে ভবিষ্যৎবাণী করা হয় যে, ইরাকের অভ্যন্তরে ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াগুলির কর্মকান্ড জনগণ অপছন্দ করায় ইরাকের মাটিতে যুদ্ধ শেষ হবার পরেও ইরানের জন্যে মিলিশিয়া নির্ভর নীতি অনুসরণ করে যাওয়াটা হিতে বিপরীত হতে পারে। এখানে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হবে ইরাকের জনগণ দেশের রাজনীতিতে মিলিশিয়াদের ভূমিকাকে কিভাবে দেখবে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর এক লেখায় ‘ইউনিভার্সিটি অব তেহরান’এর এসিসট্যান্ট প্রফেসর হাসান আহমাদিয়ান বলছেন যে, ইরাকের যুক্তরাষ্ট্র প্রবর্তিত রাজনৈতিক কাঠামোতে ইরানের আস্থা নেই। একারণেই ইরাকের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের ব্যাপারে ইরানের খুব একটা বক্তব্য ছিল না। বরং ইরাকি মিলিশিয়াদের উপরেই ইরানের আস্থা বেশি। তবে ইরান চায় তার প্রতিবেশী দেশের পরিস্থিতি যেন ইরানের জন্যে হুমকি না হয়। সেকারণেই ইরাকের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ইরানের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। আহমাদিয়ানের কথাগুলি ইরাকের ব্যাপারে ইরানের প্রধান লক্ষ্যকে নির্দেশ করলেও আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের অবস্থানকেও এক্ষেত্রে হিসেবে আনতে হবে। প্রধানমন্ত্রী আল কাধিমি ইরানের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলিকেও পাশে চাইছেন ইরানের প্রভাবকে ব্যালান্স করতে। তিনি গত এপ্রিলে সৌদি আরব ঘুরে এসেছেন; এবং বলেছেন যে, তিনি তার দেশকে সৌদি আরবের উপর হামলায় ব্যবহৃত হতে দেবেন না। গত অগাস্টে ইরাকের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জুমা ইনাদ ঘোষণা দেন যে, তার দেশ তুরস্ক থেকে ড্রোন, এটাক হেলিকপ্টার এবং ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার অস্ত্র কিনতে চাইছে। এই ঘটনাগুলি ঘটছে যখন ইরাকের জনগণের কাছে ইরান সমর্থিত মিলিশিয়ারা রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে ঠেকছে এবং মুকতাদা আল সদরের মতো ইরান বিরোধী নেতারা জনপ্রিয়তা পাচ্ছেন। একারণে যুক্তরাষ্ট্র পরবর্তী ইরাকের রাজনীতিতে পূর্বের মতো প্রভাব ধরে রাখাটা ইরানের জন্যে কঠিন হয়ে যাচ্ছে; যা ইরানের জন্যে নতুন ধরনের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের জন্ম দেবে।

No comments:

Post a Comment