Sunday 1 August 2021

তিউনিসিয়া… গণতন্ত্রের সাফল্যের গল্প?

০৮ই অগাস্ট ২০২১

যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ একইসাথে সাইয়েদের সমালোচনা করা থেকে বিরত থেকেছে, যা ‘এননাহদা’ এবং তুরস্কের মাঝে সম্পর্কোন্নয়নকে নিরুৎসাহিত করছে। লিবিয়াতে তুরস্কের হস্তক্ষেপ পশ্চিমারা মেনে নিলেও তিউনিসিয়ার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। আরব বসন্তের পর তিউনিসিয়ার তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক সফলতা’ নয়, বরং ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাই দেশটার ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ পশ্চিমা গণতন্ত্রের আদর্শিক চিন্তার বাস্তবয়নের চাইতে ভূকৌশলগত নিরাপত্তাই এখন পশ্চিমা দেশগুলির কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।


গত ২৫শে জুলাই তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট কাইস সাইয়েদ প্রধানমন্ত্রী হিচেম মেচিচিকে বরখাস্ত করে পার্লামেন্ট স্থগিত করেন। পার্লামেন্টে সবচাইতে বড় দল মুসলিম ব্রাদারহুডপন্থী ‘এননাহদা পার্ট’র নেতা স্পিকার রাচেদ ঘানুচি এই ঘটনাকে অভ্যুত্থান বলছেন। এছাড়াও ‘হার্ট অব তিউনিসিয়া’, ‘আত্তায়ার’ এবং ‘আল কারামা’ দলগুলিও এটাকে অভ্যুত্থান বলছে। প্রাক্তন একনায়ক বেন আলির সমর্থক সেকুলার ‘ফ্রি দেস্তুরিয়ান পার্টি’ কোন মন্তব্য করেনি। অপরদিকে পার্লামেন্টে ২’শ ১৭ আসনের মাঝে ১৫ আসন নিয়ে থাকা ‘চাব’ দল প্রেসিডেন্টকে সরাসরি সমর্থন করেছে। প্রেসিডেন্টের পক্ষে এবং বিপক্ষে মানুষ রাস্তায় নেমেছে। এমতাবস্থায় আরব বসন্তের সফল গণতন্ত্র বলে আখ্যা দেয়া তিউনিসিয়া কতটা সফল, সেটা নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা।

‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, তিউনিসিয়ার ঘটনায় আন্তর্জাতিক বিবৃতি নির্ভর করেছে কে ইসলামিক দলগুলির কতটা পক্ষে বা বিপক্ষে, সেটার উপর। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলি তিউনিসিয়ার ঘটনায় কি বলবে, তা তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। ২৬শে জুলাই যুক্তরাষ্ট্র তিউনিসিয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং স্থিতিশীলতার আহ্বান জানায়। তবে এই ঘটনা একটা অভ্যুত্থান ছিল না, সেব্যাপারে কোন কথা বলেনি। তিউনিসিয়ার প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্স তিউনিসিয়ায় আইনের শাসন কায়েমের স্বপক্ষে জোর দেয় এবং সকল রাজনৈতিক দলকে সহিংসতা বর্জন করতে বলে। ইইউ একইসাথে সকল দলকে সংবিধান মেনে চলতে বলে এবং সহিংসতা এড়াতে অনুরোধ করে। জার্মান সরকারের মুখপাত্র সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন যে, এটাকে অভুত্থান বলার ইচ্ছে তাদের নেই। তারা বার্লিনে তিউনিসিয়ার রাষ্ট্রদূতের সাথে কথা বলবেন বলে বলেন। মিশরের সরকার তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তকে ‘ব্রাদারহুড সন্ত্রাসী’দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলে আখ্যা দেয়। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান তিউনিসিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন করে দেশটার নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়ন আশা করেন। শুধুমাত্র তুরস্কই তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্টের সরাসরি সমালোচনা করেছে। ক্ষমতাসীন ‘একে পার্টি’র মুখপাত্র ওমের চেলিক এক টুইটার বার্তায় তিউনিসিয়ার ঘটনাকে অভ্যুত্থান বলে আখ্যা দেন। ‘একে পার্টি’র সাথে তিউনিসিয়ার ‘এননাহদা পার্টি’র সম্পর্ক বরাবরই ভালো; যা কিনা ‘ফ্রি দেস্তুরিয়ান পার্টি’সহ অনেকে তিউনিসিয়াতে তুরস্কের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা বলে দেখে। লিবিয়ার যুদ্ধে তুরস্কের হস্তক্ষেপের পর থেকে এই আলোচনা তিউনিসিয়াকে বিভক্ত করেছে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর ‘জি জিরো মিডিয়া’র এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, তিউনিসিয়ার মানুষ মনে করছে যে, বর্তমানের রাজনীতিবিদেরা আগের একনায়ক বেন আলি সরকারের রাজনীতিবিদদের মতোই দুর্নীতিবাজ। তারা সকলেই গণতন্ত্রের দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সাধারণ নাগরিকদের জন্যে উন্নততর জীবন দিতে ব্যর্থ হয়েছে। পার্লামেন্টে অনেকগুলি দল থাকার কারণে ভঙ্গুর কোয়ালিশনের মাধ্যমে রাজনীতিবিদেরা দেশ চালিয়েছেন; যার ফলশ্রুতিতে পার্লামেন্টে সিদ্ধান্তহীনতা এবং জনজীবনে অর্থনৈতিক স্থবিরতা দেয়া দিয়েছে; এবং পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপরেই জনগণের আস্থা ধ্বসে পড়েছে। গত এক বছর ধরেই তিউনিসিয়ার জনগণ থেকে থেকে রাস্তায় নেমেছে। রাস্তায় মানুষের সংখ্যা গত এক দশকের মাঝে ছিল সর্বোচ্চ। স্থবির অর্থনীতি, বাড়তে থাকা অসমতা, অপ্রতুল জনসেবা এবং চাকুরির সুযোগ কমে যাওয়া মানুষের অসন্তোষের মূল কারণ ছিল। মহামারি শুরু হবার আগেই তিউনিসিয়াতে যুবকদের মাঝে বেকারত্বের হার ছিল ৩৬ শতাংশ! খুব স্বাভাবিকভাবেই তরুণরাই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে। করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। তিউনিসিয়ার অর্থনীতিতে পর্যটন একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে বহু মানুষের কর্মসংস্থান ছিল। মহামারির কারণে তা পুরোপুরি ধ্বসে পড়েছে। তিউনিসিয়া থেকে হাজারো মানুষ সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ওপাড়ে ইতালিতে যাচ্ছে; উদ্দেশ্য ইউরোপে কাজ খোঁজা। ২০২০ সালে এরকম অভিবাসী প্রত্যাশীর সংখ্যা পাঁচ গুণ বেড়ে গেছে।

‘ভোক্স’ ম্যাগাজিনের সাথে এক সাক্ষাতে মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস’এর সিনিয়র ফেলো সারাহ ইয়ার্কিস তিউনিসিয়ার রাজনৈতিক কলহের একটা ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেন। ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় তিউনিসিয়ার একনায়ন জেইন এল আবেদিন বেন আলি সরকারের পতন হলে সেদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের আবির্ভাব হয়। পার্লামেন্টে মাত্র এক চতুর্থাংশ আসন নিয়ে সবচাইতে বড় দল ‘এননাহদা’ পার্টি; যারা মূলতঃ মুসলিম ব্রাদারহুডের চিন্তা বহণ করে। গত এক দশকে তারা সর্বোচ্চ ভোট পেলেও সরকার গঠন করার জন্যে তাদেরকে কোয়ালিশনে যেতে হয়েছে। তাদের বিরোধী হিসেবে রয়েছে প্রাক্তন একনায়ক বেন আলির সমর্থকদের দল ‘ফ্রি দেস্তুরিয়ান পার্টি’, যারা ফ্রান্সের সাথে তিউনিসিয়ার সুসম্পর্কের পক্ষে। আবির মুসির নেতৃত্বে থাকা এই দল পুরোপুরি সেকুলার এবং ‘এননাহদা’র মতো ইসলামিক দলের পুরোপুরি বিপক্ষে। এছাড়াও সেখানে রয়েছে ‘আল কারামা কোয়ালিশন’; যারা ইসলামিক দল এবং তারা মনে করে যে ‘এননাহদা’ যথেষ্ট ইসলামিক নয় এবং রাষ্ট্রে ইসলামের অস্তিত্ব নিয়ে ‘এননাহদা’ যথেষ্ট চিন্তিত নয়। প্রেসিডেন্ট কাইস সাইয়েদ আবার কোন দলের অংশ নন। তিনি প্রথম থেকেই ‘এননাহদা’র বিপক্ষে থাকলেও তিনি পুরোপুরি সেকুলার দলগুলির অংশও নন। তিউনিসিয়ার রাজনীতিতে ইসলামিক দল বনাম পুরোপুরি সেকুলার দলগুলির প্রতিযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমদিকে পার্লামেন্টের দলগুলির মাঝে সমঝোতা করে কোয়ালিশন করার প্রবণতা থাকলেও পরবর্তীতে পার্লামেন্টারিয়ানরা হাতাহাতি মারামারি শুরু করে। একারণেই আবির মুসির নেতৃত্বে চরম সেকুলার ‘ফ্রি দেস্তুরিয়ান’ এবং ‘আল কারামা’র মতো ইসলামিক দল গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গিয়েছে।

ভূমধ্যসাগর উপকূলে আন্তর্জাতিক সমুদ্র বাণিজ্যপথের উপর অবস্থিত তিউনিসিয়ার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব যথেষ্ট। লিবিয়ার যুদ্ধে তুরস্কের জড়াবার পর থেকে তিউনিসিয়ার গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে ফ্রান্সের সাথে তুরস্কের দ্বন্দ্ব চরমে উঠেছে। তিউনিসিয়ার প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্স এখানে তুরস্কের প্রভাব দেখতে চায় না। সেকারণে প্রেসিডেন্ট কাইস সাইয়েদের ক্ষমতা নেয়াটা ফ্রান্সের কাছে চিন্তার বিষয় নয়, বরং ‘এননাহদা’র সমর্থকদের রাস্তায় দেখতে চাইছে না ফ্রান্স। তবে এখানে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ একইসাথে সাইয়েদের সমালোচনা করা থেকে বিরত থেকেছে, যা ‘এননাহদা’ এবং তুরস্কের মাঝে সম্পর্কোন্নয়নকে নিরুৎসাহিত করছে। লিবিয়াতে তুরস্কের হস্তক্ষেপ পশ্চিমারা মেনে নিলেও তিউনিসিয়ার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। আরব বসন্তের পর তিউনিসিয়ার তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক সফলতা’ নয়, বরং ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাই দেশটার ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ পশ্চিমা গণতন্ত্রের আদর্শিক চিন্তার বাস্তবয়নের চাইতে ভূকৌশলগত নিরাপত্তাই এখন পশ্চিমা দেশগুলির কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

No comments:

Post a Comment