Tuesday 10 August 2021

মোজাম্বিকের সহিংসতা ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে দেখিয়ে দিচ্ছে

১১ই অগাস্ট ২০২১
জুলাই ২০২১। মোজাম্বিকের পথে রুয়ান্ডার সেনারা। গ্যাস নিয়ে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ছাড়াও মোজাম্বিক চ্যানেলের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও দ্বন্দ্ব রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা, পর্তুগাল, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও আরও অনেক দেশ এখন এই সংঘাতের অংশ; প্রত্যেকেরই রয়েছে ভিন্ন রাজনৈতিক লক্ষ্য। আফ্রিকার দেশগুলি এখানে সেনা মোতায়েন করলেও এই মিশনের অর্থনৈতিক ভার বহণের শক্তি বেশিরভাগেরই নেই; যা বলে দেয় যে, এই দেশগুলি মূলতঃ বড় শক্তিগুলির উপরেই নির্ভরশীল থাকবে।


পূর্ব আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকের চলমান গৃহযুদ্ধে রুয়ান্ডার সেনারা বড় বিজয় পেয়েছে। মোজাম্বিক সরকারের পক্ষে যুদ্ধ করতে আসা মধ্য আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডার সেনারা গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত বন্দর শহর মোচিমবোয়া দা প্রাইয়া পুনর্দখল করেছে বলে এক টুইটার বার্তায় জানায় রুয়ান্ডার সামরিক বাহিনী। মোজাম্বিকের উত্তরে মুসলিম অধ্যুষিত কাবো দেলগাদো প্রদেশে ২০১৭ সাল থেকে চলছে সহিংসতা। বার্তা সংস্থাগুলি বলছে যে, এখন পর্যন্ত এই যুদ্ধে কমপক্ষে ৩ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং ৮ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, মোজাম্বিকের সেনাবাহিনী এই যুদ্ধের জন্যে একেবারেই প্রস্তুত নয়; তথাপি নিজ দেশে বিদেশী সেনা মোতায়েনের ব্যাপারে মোটেই রাজি ছিল না মোজাম্বিক সরকার। তবে যুদ্ধের বাস্তবতার কাছে হার মেনে গত ১০ই জুলাই ১ হাজার রুয়ান্ডার সেনার প্রথম দলকে মোতায়েনের অনুমতি দেয় মোজাম্বিক সরকার। অবতরণের পর থেকেই রুয়ান্ডার সেনারা সরাসরি যুদ্ধে নামে এবং তারা সাফল্য পাচ্ছিলো বলে খবর আসছিল। বিদ্রোহী গ্রুপগুলি ২০২০এর অগাস্টে মোচিমবোয়া দা প্রাইয়া শহর দখল করে নিয়েছিল। এখন শহরটার পুনর্দখলের পর প্রশ্ন উঠছে যে, এই সাফল্য কতটা স্থায়ী।

‘বিবিসি’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, বিদ্রোহীরা খুব সম্ভবতঃ শহর ছেড়ে পালিয়েছে; যার অর্থ হলো, তারা গ্রামাঞ্চলে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখবে এবং আবারও কখনও সুযোগ পেলে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে। এটা ভাবলে ভুল হবে যে, বিদ্রোহীদের যুদ্ধ করার সক্ষমতা ধ্বংস হয়ে গেছে। ‘ডয়েচে ভেলে’ আবার মনে করিয়ে দিয়েছে অত্র অঞ্চলে রুয়ান্ডার সেনা মোতায়েনের ভূরাজনৈতিক জটিলতা। মোজাম্বিক হলো ‘সাউদার্ন আফ্রিকা ডেভেলপমেন্ট কমিউনিটি’ বা ‘এসএডিসি’ নামের আঞ্চলিক সংগঠনের সদস্য। ‘এসএডিসি’ যখন মোজাম্বিকে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছিল, ঠিক সেসময়েই রুয়ন্ডার সেনারা মোজাম্বিকে নামতে শুরু করে; যা কিনা ‘এসএডিসি’ পছন্দ করেনি। রুয়ান্ডা ১৬ সদস্যের ‘এসএডিসি’র সদস্য নয়। দক্ষিণ আফ্রিকার ‘সিগনাল রিস্ক’এর নিরাপত্তা বিশ্লেষক রায়ান কামিংস বলছেন যে, রুয়ান্ডার সাথে মোজাম্বিকের সামরিক চুক্তি হয়েছিল ২০১৮ সালে। কাজেই মোজাম্বিকে রুয়ান্ডার সেনা মোতায়েনে অবাক হবার কিছু নেই। মোজাম্বিকের প্রেসিডেন্ট ফিলিপ নাইয়ুসি বলেন যে, রুয়ান্ডার সেনারা আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট পল কাগামি প্রশংসিত হয়েছেন। তবে কামিংস বলছেন যে, রুয়ান্ডার সেনারা ‘এসএডিসি’র নেতৃত্ব মানবে না; তবে ‘এসএডিসি’ এবং ইইউএর সাথে সমন্বয় করে চলবে। মোজাম্বিক চাইছে ‘এসএসডিসি’র সেনারা যেন মোজাম্বিক সরকারের নিয়ন্ত্রের বাইরে চলে না যায়।

‘এসএডিসি’ ১৫ই জুলাই মোজাম্বিকে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয়। ২১শে জুলাই থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার স্পেশাল ফোর্সের সেনারা মোজাম্বিকে নামতে শুরু করে। ‘রয়টার্স’ জানাচ্ছে যে, ২৮শে জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সাইরিল রামাফোসা মোট ১ হাজার ৪’শ ৯৫ জন সেনা মোজাম্বিকে মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ১৫ই অক্টোবর পর্যন্ত তিন মাসের এই মিশনে প্রায় ৬৬ মিলিয়ন ডলার খরচ হবে বলে জানান রামাফোসা। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার সকলে এত খরচ করে মোজাম্বিকে সেনা মোতায়েনের পক্ষপাতি নন; বিশেষ করে দেশটার অর্থনীতি যখন ধুঁকে ধুঁকে চলছে এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দলে যখন রাস্তায় ২৫ হাজার সেনা মোতায়েন করতে হয়েছে। বিরোধী দল ‘ডেমোক্র্যাটিক এলায়েন্স’এর কোবুস মারাইস বলছেন যে, এই মিশন তিন মাসের বেশি স্থায়ী হলে তো খরচ তো আরও বেড়ে যাবে। তিনি সেনা হতাহত হবার আশংকা প্রকাশ করে মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে মোতায়েন করা সেনাদের কথা মনে করিয়ে দেন। সেখানে বাঙ্গুইএর যুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার ১৫ জন সেনা নিহত হয়েছিল।

‘ভয়েস অব আমেরিকা’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২৬শে জুলাই বতসোয়ানার ২’শ ৯৬ জন সেনা বিমানে করে মোজাম্বিকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। ২৭শে জুলাই এঙ্গোলার পার্লামেন্টে ২০ জন সেনা এবং একটা সামরিক পরিবহণ বিমান মোজাম্বিকে প্রেরণের জন্যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তিন মাসের এই মিশনে এঙ্গোলার প্রায় ৫ লক্ষ ৭৫ হাজার ডলার খরচ হবে বলে বলেন এঙ্গোলার মন্ত্রী ফ্রানচিস্কো পেরেইরা ফুরতাদো। ২৯শে জুলাই জিম্বাবুয়ের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অপা মুচিংগুরি কাশিরি জানান যে, জিম্বাবুয়ে মোজাম্বিকে ৩’শ ৪ জন সেনা পাঠাচ্ছে। নেদারল্যান্ডসের পৃষ্ঠপোষকতায় চলা মোজাম্বিকের এনজিও ‘আইএমডি’র রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডারসিও আলফাজিমা বলছেন যে, ‘এসএডিসি’র কাছে এখন গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই সংঘাত যেন মোজাম্বিকের সীমানা পেরিয়ে আশেপাশের দেশগুলিতে চলে না যায়।
মোজাম্বিকের কাবো দেলগাদোর অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যা অনেক পুরাতন; যার সমাধান কেউ দেয়নি। বিশাল গ্যাসের খনির কাজ শুরু হবার পরপরই এখানে সহিংসতা শুরু হয়। এই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের অর্থনৈতিক বঞ্চনার কারণে সহিংসতার পরিবেশ আরও আগ থেকেই প্রস্তুত হয়েই ছিল। তবে পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থা এখানে স্ফুলিঙ্গ তৈরি করেছে। 


মোজাম্বিকে প্রায় চার বছর ধরে যুদ্ধ চললেও সেনা মোতায়েনের ব্যাপারটা হঠাতই সামনে আসে গত মার্চে, যখন কাবো দেলগাদোর সর্বউত্তরে তাঞ্জানিয়ার সীমানার কাছে পালমা শহর বিদ্রোহীদের দখলে চলে যায়। মাত্র ২’শ বিদ্রোহী সেনা শহরটা দখল করলেও শহরটা ফরাসি তেল কোম্পানি ‘টোটাল’এর প্রকল্পের কাছাকাছি হওয়ায় কোম্পানি তাদের কর্মকান্ড থামিয়ে দেয়। কাবো দেলগাদো মোজাম্বিকের সবচাইতে দরিদ্র এলাকা, যেখানে ৫৩ লক্ষ মুসলিমের বাস। মার্কিন সরকারের হিসেবে এই অঞ্চলেরই উপকূলে পাওয়া গিয়েছে প্রায় ১’শ ৮০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিটের বিশাল গ্যাস খনি। ফরাসি কোম্পানি ‘টোটাল’এর নেতৃত্বে এখানে ২০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল এলএনজি প্ল্যান্টের কর্মকান্ড চলমান। ইতালিয়ান কোম্পানি ‘এনি’ এবং মার্কিন কোম্পানি ‘এক্সন মোবিল’ও এখানে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছে। তবে সকলেই তাকিয়ে আছে ‘টোটাল’এর প্রকল্পের সাফল্যের দিকে। মোজাম্বিকের প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তি পর্তুগাল ইতোমধ্যেই মোজাম্বিকের সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রও প্রশিক্ষণে যুক্ত হয়েছে; ইইউও জড়িত হতে যাচ্ছে।

মোজাম্বিকের কাবো দেলগাদোর অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যা অনেক পুরাতন; যার সমাধান কেউ দেয়নি। বিশাল গ্যাসের খনির কাজ শুরু হবার পরপরই এখানে সহিংসতা শুরু হয়। এই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের অর্থনৈতিক বঞ্চনার কারণে সহিংসতার পরিবেশ আরও আগ থেকেই প্রস্তুত হয়েই ছিল। তবে পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থা এখানে স্ফুলিঙ্গ তৈরি করেছে। গ্যাস নিয়ে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ছাড়াও মোজাম্বিক চ্যানেলের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও দ্বন্দ্ব রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা, পর্তুগাল, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও আরও অনেক দেশ এখন এই সংঘাতের অংশ; প্রত্যেকেরই রয়েছে ভিন্ন রাজনৈতিক লক্ষ্য। আফ্রিকার দেশগুলি এখানে সেনা মোতায়েন করলেও এই মিশনের অর্থনৈতিক ভার বহণের শক্তি বেশিরভাগেরই নেই; যা বলে দেয় যে, এই দেশগুলি মূলতঃ বড় শক্তিগুলির উপরেই নির্ভরশীল থাকবে।

No comments:

Post a Comment