Sunday 8 August 2021

ব্যাক্তিস্বাধীনতার ফরাসি সংজ্ঞা আসলে কি?

০৮ই অগাস্ট ২০২১

ব্যক্তিস্বাধীনতার সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেকরকম। নবীকে অপমান করাটা ব্যক্তিস্বাধীনতার মাঝে পড়লেও প্রেসিডেন্টকে অপমান করাটা রাষ্ট্রের কাছে অপরাধ হিসেবে ঠেকেছে। রাষ্ট্রের অঙ্গগুলি, তথা সরকার, আদালত এবং জনগণের মাঝে চিন্তার দৃশ্যমান ফারাক ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় ভিত্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ এবং দুর্বল করে ফেলছে।


চার সপ্তাহ ধরে ফ্রান্সের রাস্তায় হাজারো মানুষের বিক্ষোভ। ৭ই অগাস্ট ফ্রান্স জুড়ে প্রায় দুই লক্ষ মানুষ প্রতিবাদ করেছে। তাদের দাবি হলো ফরাসি সরকারের করোনাভাইরাস ‘হেলথ পাস’এর ঘোষণা বাতিল করা। ফরাসি সরকারের প্রজ্ঞাপণ অনুযায়ী জনগণকে বেশিরভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যেতে হলে বা গণপরিবহণে উঠতে হলে করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত, এই মর্মে একটা ‘হেলথ পাস’ দেখাতে হবে। এরপর গত ২৯শে জুলাই ফরাসি সরকারের আরেক নির্দেশনায় বলা হয় যে, জনগণকে যেকোন পর্যটন স্থানে বা ৫০ জনের বেশি জমায়েত হয় এমন কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যেতে হলে ‘হেলথ পাস’ দেখাতে হবে। এর আগে থেকেই সিনেমা হল, কনসার্ট হল, থিম পার্কের মতো স্থানে পাস লাগছে। ৯ই অগাস্ট থেকে যেকোন বার, রেস্তোরাঁ বা শপিং মলে যেতে হলে অথবা দূরপাল্লার বিমান, রেলগাড়ি বা বাসে ভ্রমণ করতে হলে এই পাস লাগবে। এই পাসে এমন তথ্য থাকতে হবে, যাতে বহণকারী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নয়, সেব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়। এতে ভ্যাকসিন নেবার সার্টিফিকেট ছাড়াও মুচলেকা থাকবে যে, গত ৪৮ ঘন্টার মাঝে করোনা পরীক্ষায় তিনি নেগেটিভ ফলাফল পেয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি গত ৬ মাসের মাঝে করোনায় আক্রান্ত হননি; অথবা আক্রান্ত হয়ে থাকলেও গত ১৫ দিনের আগেই তিনি সুস্থ্য হয়ে উঠেছেন। ফরাসি সরকারের এই সিদ্ধান্ত কতটা যুক্তিযুক্ত, সেব্যাপারে যেমন আলোচনা চলছে, তেমনি এর মাধ্যমে ফ্রান্সের ব্যক্তিস্বাধীনতার সংস্কৃতি কতটা আক্রান্ত হয়েছে, সেটাও আলোচনায় আসছে।

গত ৫ই অগান্সট ফ্রান্সের সর্বোচ্চ আদালতে রায় দেয়া হয় যে, ফরাসি সরকারের ‘হেলথ পাস’এর সিদ্ধান্ত সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। একইসাথে আদালত এই সিদ্ধান্তও দেয় যে, ফ্রান্সের পার্লামেন্টে পাস করা আইনের মাধ্যমে জনগণের উপর যে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে, তা মানুষের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে “ব্যালন্সে রেখেছে”; অর্থাৎ এখানে ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব হবার বিষয়ে খুব বেশি চিন্তিত হবার কিছু নেই। ‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’ বলছে যে, প্যারিসে আদালতের বাইরে কয়েক’শ মানুষ এই রুলিংএর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। প্রতিবাদকারীরা সরকারের এই সিদ্ধান্তকে ‘হেলথ ডিক্টেটরশিপ’ বা ‘স্বাস্থ্যবিষয়ক একনায়কতন্ত্র’ বলছে। একজন প্রতিবাদকারী জুলিয়েন বেইলি বলছেন যে, তিনি ভ্যাকসিন নিয়েছেন। তবে ভ্যাকসিন নেবার ব্যাপারটা হওয়া উচিৎ ছিল স্বেচ্ছায়; সরকারের চাপে পড়ে নয়। তিনি আশংকা করে বলেন যে, কিছুদিন পর হয়তো সকল কর্মকান্ডের জন্যে ‘কিউআর কোড’ দেখাতে হবে। এটা ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর নজিরবিহীন আঘাত।

নতুন আইনে রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে ‘হেলথ পাস’ লাগবে। রেস্তোরাঁ মালিকরা বলছেন যে, ক্রেতাদের পাস আছে কিনা, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তো রেস্তোরাঁর হতে পারে না। হাসপাতালে রুগীকে দেখতে গেলেও পাস লাগবে; অথবা অতি জরুরি নয় এমন কোন মেডিক্যাল সেবা নিতে গেলেও। স্বাস্থ্যকর্মীরা এখন ভ্যাকসিন নিতে বাধ্য। তবে আদালত এই আইনের মাঝে কিছু অংশ বাতিল করেছে; যেমন সরকার চেয়েছিল যে, ‘হেলথ পাস’ না থাকলে চাকুরিদাতা কর্মচারীকে হঠাত করেই বরখাস্ত করতে পারবে; যা আদালত অনুমোদন দেয়নি। তবে অনেক মানুষের সাথে কাজ করতে হয় এমন কোন চাকুরিতে থাকলে চাকুরিদাতা তার কর্মচারিকে বরখাস্ত করতে পারবে। ফরাসি থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইন্সটিটিউট মনটেইন’এর করা এক জনমত জরিপে বলা হচ্ছে যে, ফ্রান্সের ৩৭ শতাংশ জনগণ ‘হেলথ পাস’এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের পক্ষে রয়েছে; অন্যদিকে ৪৮ শতাংশ রয়েছে বিপক্ষে। অর্থাৎ একটা বড় সংখ্যক মানুষ এই আইনের বিপক্ষে। আর ৫২ শতাংশ জনগণ প্রতিবাদকারীদের বিপক্ষে নয়। ফরাসি সরকারের হিসেবে দেশের ৫৪ শতাংশ জনগণের এখন পর্যন্ত করোনার টিকা দেয়া সম্পন্ন হয়েছে।

ফ্রান্সে ব্যক্তিস্বাধীনতার সংজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এমন একটা সময়ে, যখন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁর ব্যাঙ্গাত্মক ছবি বিলবোর্ডে ছাপাবার কারণে মামলা হয়েছে। গত ২৮শে জুলাই বিলবোর্ডের ব্যবসায় থাকা মিশেল অঙ্গে ফ্লোরি এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, ফরাসি প্রেসিডেন্টের অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে টুলঁ শহরের পুলিশ ডেকে পাঠিয়েছে। তিনি ফ্রান্সকে ‘ম্যাক্রনিয়া’ আখ্যা দিয়ে বলেন যে, এই দেশে নবীকে অপমান করে ছবি আঁকলে সেটাকে ‘স্যাটায়ার’ হিসেবে মেনে নেয়া হয়, কিন্তু প্রেসিডেন্টকে একনায়ক বললে ‘ব্লাসফেমি’ হয়ে যায়। ম্যাক্রঁ যে বিলবোর্ডের ব্যাপারে চিন্তিত, ‘ইউরোনিউজ’ তার বর্ণনা দিয়ে বলছে যে, সেখানে ম্যাক্রঁর একটা ছবিকে পরিবর্তিত করে হিটলারের মতো করে দেখানো হয়েছে এবং ম্যাক্রঁর দলের লোগো পরিবর্তিত করে হিটলারের নাজি পার্টির স্বস্তিকা লোগোর মতো করে আঁকা হয়েছে। এর সাথে লেখা হয়েছে যে, “সকলে আদেশ মান্য কর; ভ্যাকসিন নাও”। টুলঁ শহরে ঢোকার পথে রাস্তার পাশেই দু’টা বিলবোর্ডে ম্যাক্রঁর এই ব্যাঙ্গচিত্র প্রদর্শিত হয়।

ফ্লোরি এমন একটা ইস্যুকে সামনে নিয়ে এসেছেন, যা শুধু ব্যক্তিস্বাধীনতা নয়, ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় চিন্তাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ফ্রান্সের সেকুলার চিন্তাকে রক্ষা করার কথা বলে সেদেশের মুসলিম জনগণকে আইন করে ইসলাম পালনে বাধা দেয়া হচ্ছে। গত জুলাই মাসে ফরাসি সরকারি সংস্থা ‘এসজি সিআইপিডিআর’এর এক টুইটার বার্তায় নতুন করে সেকুলারিজমের উপর একটা মন্ত্রিসভা কমিটি গঠন করার কথা ঘোষণা দেয়া হয়। অনেকেই মনে করছেন যে, এর মাধ্যমে ফ্রান্সের মুসলিম জনগণকে রিপাবলিককে কিভাবে ভালোবাসতে হবে, সেটা শিক্ষা দেয়া হবে। গত ডিসেম্বরে ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড ডারমারিন এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন যে, ফরাসি রিপাবলিকে মানুষ আল্লাহর ইবাদত করতে পারবে এবং রিপাবলিককে ভালোবাসতে পারবে। কিন্তু এক মুহুর্তের জন্যেও আল্লাহ রিপাবলিকের উপরে নয়।

ফ্রান্সের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা তাদের রাষ্ট্রীয় চিন্তাকে রক্ষা করতে ক্রমাগতভাবেই জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। একারণেই ফ্রান্সের বড় একটা অংশ এখন রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তগুলিকে একনায়কোচিত বলে আখ্যা দিচ্ছে। মুসলিমদের ইসলাম পালনের বিরুদ্ধে সরকারের সিদ্ধান্তগুলির পরপরই এখন ‘হেলথ পাস’এর ইস্যু নিয়ে জনগণের মাঝে ক্ষোভ দানা বাঁধছে। ব্যক্তিস্বাধীনতার সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেকরকম। ফ্লোরি যেভাবে বলেছেন যে, নবীকে অপমান করাটা ব্যক্তিস্বাধীনতার মাঝে পড়লেও প্রেসিডেন্টকে অপমান করাটা রাষ্ট্রের কাছে অপরাধ হিসেবে ঠেকেছে। রাষ্ট্রের অঙ্গগুলি, তথা সরকার, আদালত এবং জনগণের মাঝে চিন্তার দৃশ্যমান ফারাক ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় ভিত্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ এবং দুর্বল করে ফেলছে।

4 comments:

  1. মহান ব্যক্তি স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ কি

    ReplyDelete
    Replies
    1. ব্যক্তিস্বাধীনতা কোন দিকে যাচ্ছে, তার একটা সম্যক ধারণা আপনি পাবেন পশ্চিমা দেশগুলিতে ডানপন্থীদের উত্থানে। নিজেকে নিয়ে একটা মানুষ যখন বেশি চিন্তিত হয়ে যায়, তখন সমাজ উপেক্ষিত হবে। মানুষ এখন ফেইসবুকে স্ট্যাটাস এবং সেটার লাইকের সংখ্যা নিয়েই বেশি চিন্তিত। জাপানের নৌবাহিনী তরুণদের জন্যে যুদ্ধজাহাজে ওয়াইফাইএর ব্যবস্থা করতে বাধ্য হচ্ছে; কারণ এটা না দিলে নৌবাহিনীর জন্যে রিক্রুট পাওয়া যাচ্ছে না। ব্রিটেনের অবস্থা আরও খারাপ; অন্য দেশ থেকে লোক নিয়ে আসতে হচ্ছে সামরিক বাহিনীর সংখ্যা ধরে রাখতে।

      ব্যক্তিস্বাধীনতা হলো ক্যাপিটালিজমের একটা আউটপুট। ক্যাপিটালিজমের একটা আউটপুট আরেকটার সাথে সাংঘর্ষিক। তাই এখন যেসব দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে পশ্চিমা সমাজে, সেগুলিতে অবাক হবার কিছু নেই।

      Delete
  2. এই দ্বন্দ্ব কতটা মারাত্মক

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই ব্লগের আগের লেখাগুলি পড়ে থাকলে একটা ধারণা পাবেন যে, ফরাসি রিপাবলিক দুর্বল হচ্ছে ক্রমাগত। এই রাষ্ট্র অভ্যন্তরীণভাবে যেমন দুর্বল হচ্ছে, তেমনি তার বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যও হুমকির মাঝে পড়েছে অন্যান্য শক্তিদের কাছ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বীতা কারণে।

      ফ্রান্স তার রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে সেকুলারিজমকে যতটা শক্তভাবে ধারণ করতে চায়, তা ব্রিটিশ লিবারাল সেকুলার চিন্তা ঠিক ততটাই উদার। ফ্রান্স রাজনৈতিকভাবে ব্রিটেনের মতো অতটা ধূর্ত নয়; তাই সেকুলারিজমকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তারা অনেককেই শত্রু বানিয়ে ফেলছে। এই শক্ত হাতে সেকুলারিজমকে রক্ষা করতে গিয়েই তারা একপ্রকার উগ্রবাদী সেকুলার চিন্তার জন্ম দিয়েছে। মূলতঃ সেকুরালিজমই যেহেতু বিশ্বব্যাপী একটা ক্রাইসিসের মাঝ দিয়ে যাচ্ছে, তাই ফ্রান্স এই চিন্তাটার শেষ রক্ষা করা দায়িত্ব নেবার মতো কাজ করছে। একারণেই তারা অতি রক্ষণশীলভাবে সেকুলারিজমকে প্রতিষ্ঠিত রাখতে গিয়ে নানা সমস্যার মাঝে পড়ছে। তারা বুঝতে পারছে না যে, গায়ের জোরে একটা চিন্তাকে বাঁচানো সম্ভব নয়। মানুষ সেই চিন্তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করতে থাকলে সেটা স্বাভাবিকভাবেই ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়।

      Delete