Saturday 17 July 2021

চলমান সহিংসতা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, গণতন্ত্র দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণকে মুক্তি দিতে পারেনি

১৭ই জুলাই ২০২১

দক্ষিণ আফ্রিকায় লুটতরাজ ঠেকাতে গুলি ছুঁড়ছেন এক পুলিশ সদস্য। এবছরের প্রথম প্রান্তিকে বেকারত্বের হার রেকর্ড ৩২ দশমিক ৬ শতাংশে পৌঁছেছে; ২০০৮ সাল থেকে যা সর্বোচ্চ। রামাফোসার আইনের শাসন বনাম জুমার অর্থনৈতিক মুক্তির ‘জাতিগত’ কৌশল একে অপরের মুখোমুখি। ১৯৯০এর দশকে সফল গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের পরেও প্রায় তিন দশকেও দেশের মানুষ দারিদ্র্য এবং বৈষম্যের শিকার। আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার এহেন অবস্থা আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে।


মিডিয়াতে দক্ষিণ আফ্রিকায় সহিংসতা এবং লুটতরাজের ছবি দেখে বিশ্ববাসী যখন স্তম্ভিত, তখন অনেকেই এর মূল কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা চালাচ্ছেন। আটককৃত প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমার সমর্থকদের বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ২’শ ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমার রাজনৈতিক দল ‘আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস’ বা ‘এএনসি’তে তার বিরোধী গ্রুপের চাপের মুখে মেয়াদ শেষ হবার এক বছর আগেই তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। জুমার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করা হলেও তিনি আদালতের সামনে স্বাক্ষ্য দিতে অস্বীকৃতি জানালে আদালত অবমাননার জন্যে গত ২৯শে জুন তাকে ১৫ মাসের কারান্ডাদেশ দেয়া হয়। জুমার আটকের খবরের পরপরই দেশটার জনবহুল এবং অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ গুয়াতেং এবং কোয়াজুলু নাটাল প্রদেশে ব্যাপক সহিংসতা শুরু হয়। একইসাথে সেখানে চলে ভয়াবহ লুটতরাজ। প্রেসিডেন্ট সাইরিল রামাফোসার সরকার সহিংসতা বন্ধে তিন মাসের জন্যে ২৫ হাজার সৈন্য মোতায়েন করেছে; যা কিনা দেশটার বর্ণবাদী সরকারের সময়ের পর থেকে সবচাইতে বড় সামরিক মিশন।

‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, দক্ষিণ আফ্রিকায় অনেকেই মনে করছেন যে, বর্তমান বিক্ষোভ এবং লুটতরাজ দেশটার গণতন্ত্রের জন্যে সবচাইতে কালো অধ্যায়। সরকারি কর্মকর্তারা বিভিন্নভাবে এই সমস্যাকে ‘অর্থনৈতিক নাশকতা’; ‘অভ্যত্থান’ বা ‘বিদ্রোহ’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন। প্রেসিডেন্ট রামাফোসা বলছেন যে, এই সহিংসতা আগে থেকেই পরিকল্পিত ছিল। প্রথমে এই সমস্যাকে ‘জাতিগত একত্রিকরণ’ বলে আখ্যা দিলেও পরে তিনি সেই বক্তব্য থেকে সড়ে আসেন। তবে দেশটার রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতৃবৃন্দ রাস্তায় সৈন্য মোতায়েনের ব্যাপারে বা জরুরি অবস্থা ঘোষণার ব্যাপারে একেবারেই রাজি ছিল না। নিরাপত্তা সংস্থার এক বৈঠকে সামরিক কর্মকর্তারা সরাসরিই জানিয়ে দেন যে, আইন প্রয়োগ করার জন্যে সৈন্যরা রাস্তায় নামেনি; আইন প্রয়োগের দায়িত্ব হলো পুলিশের।

‘এএনসি’র উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ এবং ইন্টেলিজেন্সের সদস্যদের বরাত দিয়ে ‘ডেইলি ম্যাভেরিক’এর এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, এই সকল সহিংসতাই ছিল একটা সমন্বিত প্রচেষ্টা; যার পিছনে রয়েছে প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের ডজনখানেক সমর্থক। সহিংসতা শুরুর প্রথম দিকে কোয়াজুলু নাটাল প্রদেশে গাড়িতে আগুন দেয়া হয়। এরপর গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর ডারবানের সাথে অর্থনৈতিকভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ গুয়াতেং প্রদেশের যোগাযোগের পথ বন্ধ করে দেয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল যে, বর্তমানে ধুঁকে ধুঁকে চলা অর্থনীতিকে আরও চাপে ফেলে রামাফোসা সরকারকে সমস্যায় ফেলা। রাস্তায় সামরিক বাহিনী নামানোর উদ্দেশ্য সহিংসতা বন্ধ করা নয়; বরং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলি, যেমন ডারবান সমুদ্রবন্দর, তেলের রিফাইনারি, যোগাযোগ নেটওয়ার্ক, গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, খাবার এবং জালানির সাপ্লাই লাইন, ইত্যাদিকে রক্ষা করা।

ক্ষমতাসীন ‘এএনসি’র মাঝে এখন দু’টা গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে। এক গ্রুপ বলছে যে, জুমার অধীনে এক দশকের দুর্নীতির রাজত্ব থেকে দেশের কাঠামো এবং জবাবদিহিতাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করছেন রামাফোসা। আরেক গ্রুপ জুমার সময়ে বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়েছিল; এখন রামাফোসার অধীনে তাদের অবস্থান আবারও হুমকির মাঝে পড়েছে। ‘বিবিসি’ বলছে যে, একসময় ‘এএনসি’র ইন্টেলিজেন্সের দেখাশুনা করা জুমার সাথে দেশটার ইন্টেলিজেন্সে যোগাযোগ ভালো। জুমার বিরুদ্ধে বলা হচ্ছে যে, তিনি একটা সমান্তরাল ইন্টেলিজেন্স সংস্থা তৈরি করেছিলেন। ২০১৮ সালে এক প্রতিবেদনে জুমার এই ইন্টেলিজেন্স সংস্থার উল্লেখ করা হয়। তবে এব্যাপারে রামাফোসার সরকার তেমন কিছু করতে পেরেছে কিনা, সেব্যাপারে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করছেন। অপরপক্ষে জুমার সমর্থকরা বলছেন যে, সরকার দরিদ্রদের অবস্থার উন্নয়ন করতে না পেরে রাজনৈতিক বিভেদ বা সমান্তরাল ইন্টেলিজেন্সের কথাগুলি বলছে এবং একইসাথে সহিংসতার ব্যাপারে ভবিষ্যতবাণী করছে।

দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনীতিতে জাতিগত বিভেদের ব্যাপারটা খুব বেশি আলোচিত নয়। দেশটার কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার রক্ষার আন্দোলনের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার সময়েও এই বিভেদ ছিল। দেশটার সবচাইতে বড় জাতিগোষ্ঠি হলো জুলু; যাদের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১০ লক্ষ। মোঙ্গোসুটু বুথেলেজি ১৯৭০এর দশকে ‘ইনকাথা ফ্রিডম পার্টি’ নামে প্রধানতঃ জুলুদের একটা দল গঠন করেন। ‘ইনকাথা’র সাথে ‘এএনসি’র দ্বন্দ্ব সেই সময় থেকেই। ‘এএনসি’র আন্দোলনে ‘ইনকাথা’ জড়িত ছিল না। ১৯৯০এর দশকে দেশটার রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময় ‘ইনকাথা’ নির্বাচনে অংশ নেবার শর্ত হিসেবে জুলুদের রাজাকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে চেয়েছিল। তবে তাদের এই দাবির বাস্তবায়ন ছাড়াই তারা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেয়। ১৯৯৪ সালের নির্বাচনে ‘ইনকাথা’ তাদের মূল ঘাঁটি কোয়াজুলু নাটাল প্রদেশে ৫০ শতাংশ ভোট পায়। অথচ আর কোন প্রদেশে তারা ৪ শতাংশ ভোটও পায়নি। কোয়াজুলু নাটালে ‘এএনসি’ পেয়েছিল ৩২ শতাংশ ভোট। তবে পরবর্তী নির্বাচনগুলিতে কোয়াজুলু নাটালে ‘এএনসি’র ভোট বাড়তে থাকে। ২০০৪ সালে ‘এএনসি’ সেখানে ৪৭ শতাংশ ভোট পায়। আর ২০০৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম জুলু প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমার নির্বাচনের সময় ‘এএনসি’ সেখানে ৬৩ শতাংশ ভোট পায়। জুমা ক্ষমতা হারাবার পর ২০১৯ সালের নির্বাচনে কোয়াজুলু নাটালে ‘এএনসি’র ভোট ৫৪ শতাংশে নেমে আসে। শিল্পভিত্তিক দক্ষিণ আফ্রিকার জুলু অঞ্চলগুলি মূলতঃ কৃষিভিত্তিক। ‘স্ট্যাটস সাউথ আফ্রিকা’র হিসেবে কোয়াজুলু নাটালের মাথাপিছু আয় দক্ষিণ আফ্রিকার নয়টা প্রদেশের মাঝে ৭ম। অথচ জনসংখ্যার দিক থেকে প্রায় ২০ শতাংশ জনগণ নিয়ে কোয়াজুলু নাটাল দ্বিতীয়। ২৫ শতাংশ নিয়ে সর্বোচ্চ হলো গুয়াতেং; যেখানে রয়েছে জোহান্সবার্গ এবং প্রিটোরিয়া। বর্তমানে সহিংসতা হচ্ছে এই দুই প্রদেশেই; যেখানে সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছে।

‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সহিংসতা যেসব অঞ্চলে হচ্ছে, সেসব অঞ্চলই করোভাইরাস এবং লকডাউনে অর্থনৈতিকভাবে সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লুটতরাজ চালানো অনেকেই বলছেন যে, তারা তাদের পরিবারকে বাঁচাতে লুটতরাজ চালাচ্ছেন। দেশটার সরকারের বরাত দিয়ে ‘রয়টার্স’ জানাচ্ছে যে, এবছরের প্রথম প্রান্তিকে বেকারত্বের হার রেকর্ড ৩২ দশমিক ৬ শতাংশে পৌঁছেছে; ২০০৮ সাল থেকে যা সর্বোচ্চ। রামাফোসার আইনের শাসন বনাম জুমার অর্থনৈতিক মুক্তির ‘জাতিগত’ কৌশল একে অপরের মুখোমুখি। ১৯৯০এর দশকে সফল গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের পরেও প্রায় তিন দশকেও দেশের মানুষ দারিদ্র্য এবং বৈষম্যের শিকার। আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার এহেন অবস্থা আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে।

No comments:

Post a Comment