Thursday 26 August 2021

আলজেরিয়া এবং মরক্কোর দ্বন্দ্ব ... এখন কেন?

২৬শে অগাস্ট ২০২১
পশ্চিম সাহারার অবস্থান উল্টোদিকে মরক্কোর দক্ষিণে; যেখানে ব্যস্ত থেকে জিবরালটার থেকে দূরে রয়েছে মরক্কোর সেনাবাহিনী। জিবরালটারের গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবাণিজ্যপথ মরক্কোর পররাষ্ট্রনীতি থেকে দূরে থাকবে ততদিন, যতদিন পশ্চিম সাহারার দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখবে ইউরোপ এবং আলজেরিয়া। এই দ্বন্দ্ব তুরস্ক এবং ইস্রাইলের মত দেশগুলিকেও যুক্তরাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় পশ্চিম আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় টেনে আনছে। একইসাথে এই দ্বন্দ্বের কারণে মরক্কো মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ধরে রাখার জন্যে একটা ‘দরজা’ হিসেবে ব্যবহৃত হবে।



গত ২৪শে অগাস্ট আলজেরিয়ার সরকার মরক্কোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। এই সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা প্রদান করতে গিয়ে আলজেরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রামদানি লামামরা সাংবাদিকদের বলেন যে, মরক্কো আলজেরিয়ার কর্মকর্তাদের উপর ‘পেগাসাস’ সফটওয়্যার ব্যবহার করে গোয়েন্দাগিরি করছে। একইসাথে মরক্কো আলজেরিয়ার অভ্যন্তরে একটা বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপকে সমর্থন দিচ্ছে এবং পশ্চিম সাহারার ব্যাপারে মরক্কো যে প্রতিশ্রুতিগুলি দিয়েছে, সেগুলি তারা রাখছে না। লামামরা বলেন যে, মরক্কো কখনোই আলজেরিয়ার বিরুদ্ধে শত্রুতাপূর্ণ আচরণ বন্ধ করেনি। আলজেরিয়ার এই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া হিসেবে মরক্কোর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক টুইটার বার্তায় বলে যে, আলজেরিয়ার এই সিদ্ধান্ত দুঃখজনক এবং অহেতুক। ‘রয়টার্স’ জানাচ্ছে যে, দুই দেশের মাঝে সীমানা ১৯৯৪ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে। এর আগে দুই দেশের দ্বন্দ্বে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হলেও ১৯৮৮ সালে তা আবারও পূর্বাবস্থায় আনা হয়েছিল। তবে সেই সময় থেকে এবারই প্রথম কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা হলো। মরক্কো দুই দেশের মাঝে সীমানা খুলতে চাইলেও নিরাপত্তার কথা বলে আলজেরিয়া সীমানা বন্ধ রেখেছে।

এর এক সপ্তাহ আগেই আলজেরিয়ার সরকার বলে যে, সেদেশে ভয়াবহ দাবানলে ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন লাগানোর পিছনে দু’টা গ্রুপ জড়িত; যাদেরকে আলজেরিয়া কিছুদিন আগেই সন্ত্রাসী বলে ঘোষণা দিয়েছে। আলজেরিয়ার পূর্বাঞ্চলে কাবাইলি অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘এমএকে’ এই দুই গ্রুপের একটা। এই গ্রুপকে মরক্কো এবং ইস্রাইল সহায়তা দিচ্ছে বলে অভিযোগ করে আলজেরিয়ার সরকার। দাবানলে ঐ অঞ্চলই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আলজেরিয়া সরকার আগুন লাগাবার এবং একজন নিরপরাধ মানুষকে দোষী অপবাদ দিয়ে গণপিটুনি দিয়ে খুন করে মরদেহ পুড়িয়ে ফেলার অভিযোগে ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করে; যাদের কয়েকজন নিজেদেরকে ‘এমএকে’এর সদস্য বলে স্বীকার করে। আলজেরিয়ার টেলিভিশনে তাদের স্বীকারোক্তি প্রচার করা হয়। একইসাথে নিরপরাধ গায়ক জামাল বেন ইসমাইলের মৃত্যুকে সরকারের সিদ্ধান্তের পিছনে জনসমর্থন আদায়ে ব্যবহার করা হয়।

এর আগে গত ১৮ই জুলাই আলজেরিয়ার সরকার মরক্কো থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে নেয়। অভিযোগ ছিল যে, নিউ ইয়র্কে মরক্কোর রাষ্ট্রদূত ওমর হিলালি জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের এক বৈঠকে আলজেরিয়ার বিচ্ছন্নতাবাদীদের পক্ষে কথা বলেছেন। হিলালি বলেন যে, যদি পশ্চিম সাহারার জনগণের নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অধিকারের ব্যাপারে আলজেরিয়া এতটা সোচ্চার থাকে, তাহলে তাদের নিজেদের দেশে কাবাইলি অঞ্চলের জনগণকেও নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অধিকার দেয়া উচিৎ। হিলালির কথাগুলি দুই দেশের বহু বছরের দ্বন্দ্বকে তুলে ধরে। ১৯৭০এর দশক থেকেই মরক্কোর দক্ষিণে পশ্চিম সাহারা অঞ্চলে ‘পলিসারিও ফ্রন্ট’ স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধ করছে। পলিসারিওকে সরাসরি সহায়তা দিচ্ছে আলজেরিয়া। অপরদিকে মরক্কো এই অঞ্চলকে নিজের অঞ্চল বলে মনে করে। ১৯৯১ সালে যুদ্ধ শেষ হলেও অনেক বছর ঠান্ডা থাকার পর ২০২০ সালের শেষ দিকে পশ্চিম সাহারার ইস্যু আবারও গরম হয়ে উঠতে শুরু করে, যখন গত নভেম্বরে পলিসারিও ঘোষণা দেয় যে, তারা আবারও সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করতে যাচ্ছে। এরপর অবশেষে গত ডিসেম্বরে ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম সাহার উপর মরক্কোর সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেয়।
 
ইইউ বলে যে, মরক্কোর সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর সহায়তাতেই শরণার্থীরা স্প্যানিশ ছিটমহলে ঢুকে পড়ে; উদ্দেশ্য ছিল স্পেনের উপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা। অনেকেই মনে করেছেন যে, স্পেনের সেউতা ছিটমহলে শরণার্থীদের প্রেরণ করা ছিল মূলতঃ পশ্চিম সাহারার পলিসারিওর নেতাকে স্পেনে ঢুকতে দেয়ার প্রতিশোধমূলক কর্মকান্ড।


মরক্কোর সাথে আলজেরিয়া নতুন করে দ্বন্দ্ব এমন এক সময়ে এলো, যখন ইউরোপের সাথে মরক্কোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। গত ১০ই জুন ইইউ পার্লামেন্টে পাস করা এক রেজোলিউশনে বলা হয় যে, গত মে মাসে মরক্কোর মূল ভুখন্ডে স্প্যানিশ ছিটমহল সেউতাতে ১০ হাজার শরণার্থী ঢুকে যাবার পিছনে মরক্কো সরকারের হাত ছিল। ইইউ বলে যে, মরক্কোর সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর সহায়তাতেই শরণার্থীরা স্প্যানিশ ছিটমহলে ঢুকে পড়ে; উদ্দেশ্য ছিল স্পেনের উপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা। অনেকেই মনে করেছেন যে, স্পেনের সেউতা ছিটমহলে শরণার্থীদের প্রেরণ করা ছিল মূলতঃ পশ্চিম সাহারার পলিসারিওর নেতাকে স্পেনে ঢুকতে দেয়ার প্রতিশোধমূলক কর্মকান্ড।

পলিসারিওর সাথে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সবসময় মরক্কোর পক্ষে থেকেছে এবং প্রচুর অস্ত্র দিয়ে সহায়তা দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ের উত্তেজনার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র কিনছে মরক্কো। গত ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র মরক্কোর কাছে ১ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির প্রতিশ্রুতি দেয়। এই অস্ত্রের মাঝে ছিল ৪টা ‘এমকিউ ৯ রীপার’ অস্ত্রবাহী ড্রোন এবং লেজার গাইডেড বোমা। ‘ডিফেন্স ওয়ার্ল্ড’ বলছে যে, ২০১৯এর নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র মরক্কোর কাছে ২৪টা ‘এএইচ ৬৪ এপাচি’ এটাক হেলিকপ্টার এবং প্রায় আড়াই হাজার ‘টো ২এ’ এন্টিট্যাঙ্ক ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই চুক্তির মূল্যমান ছিল ৪ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার। এর মাঝে ‘ম্যান আনম্যানড টিমিং’ নামে একটা প্রযুক্তিও বিক্রি করা হচ্ছে; যার মাধ্যমে এপাচি হেলিকপ্টারের পাইলট একটা ড্রোন নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে এবং ড্রোনের পাঠানো ভিডিও সরাসরি দেখতে পাবে। এর মাধ্যমে মরক্কোর সামরিক সক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পাবে। এর আগে ২০১৯এর মার্চে যুক্তরাষ্ট্র মরক্কোকে ২৫টা নতুন ‘এফ ১৬’ যুদ্ধবিমান বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয়। এছাড়াও গত এপ্রিলে মরক্কো তুরস্কের ‘বায়কার মাকিনা’ কোম্পানির কাছ থেকে ৭০ মিলিয়ন ডলারে ১৩টা ‘বায়রাকতার টিবি ২’ ড্রোন কিনছে বলে বলা হয়। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির স্যামুয়েল রামানি ‘ডিফেন্স নিউজ’কে বলছেন যে, গত এপ্রিল মাসে মরক্কো প্রথমবারের মতো ড্রোন ব্যবহার করে পলিসারিওর উপর হামলা করে। যুক্তরাষ্ট্র এবং তুরস্ক একত্রে মরক্কোর সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করছে। একইসাথে ইস্রাইলের সাথে মরক্কোর সম্পর্ক স্বাভাবিক হবার কারণে ইস্রাইলও হয়তো মরক্কোকে সামরিক সহয়তা দেবে; বিশেষ করে ড্রোন প্রযুক্তি দিয়ে।

মরক্কোর কৌশলগত অবস্থান পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। মরক্কোর উত্তরে রয়েছে কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ জিবরালটার প্রণালি। সেউতা ছিটমহলের অবস্থানও ঠিক তার দক্ষিণে। অপরদিকে পশ্চিম সাহারার অবস্থান উল্টোদিকে মরক্কোর দক্ষিণে; যেখানে ব্যস্ত থেকে জিবরালটার থেকে দূরে রয়েছে মরক্কোর সেনাবাহিনী। জিবরালটারের গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবাণিজ্যপথ মরক্কোর পররাষ্ট্রনীতি থেকে দূরে থাকবে ততদিন, যতদিন পশ্চিম সাহারার দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখবে ইউরোপ এবং আলজেরিয়া। এই দ্বন্দ্ব তুরস্ক এবং ইস্রাইলের মত দেশগুলিকেও যুক্তরাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় পশ্চিম আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় টেনে আনছে। একইসাথে এই দ্বন্দ্বের কারণে মরক্কো মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ধরে রাখার জন্যে একটা ‘দরজা’ হিসেবে ব্যবহৃত হবে।

No comments:

Post a Comment