Thursday 12 August 2021

মাদাগাস্কার ... দুই শতকের ব্রিটিশ ফরাসি দ্বন্দ্ব

১২ই অগাস্ট ২০২১
ছবিঃ ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁর সাথে মাদাগাস্কারের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোএলিনা। রাজোএলিনা মাদাগাস্কারে ফ্রান্সের স্বার্থকে দেখেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে তার বিরোধীরাও যে ব্রিটিশ মার্কিন স্বার্থ দেখেছে, তার প্রমাণও যথেষ্ট। দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন দূরে থাকুক দেশটার ভৌগোলিক অবস্থানের গুরুত্বের কারণে বড় শক্তিদের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় নিমজ্জিত রয়েছে দেশটা। বহুকাল ধরে এখানে মূল খেলোয়াড় ফ্রান্স এবং ব্রিটেন থাকলেও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, এবং আরও বিভিন্ন দেশ যুক্ত হয়েছে।


আফ্রিকার দক্ষিণ পূর্ব উপকূলের পাশে পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম দ্বীপ মাদাগাস্কার; যা মালাগাসি বলেও পরিচিত। ২ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষের দেশটা রাজনৈতিকভাবে উত্তপ্ত রয়েছে। কারণ গত ২০শে জুলাই দেশটার প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোএলিনাকে হত্যা করার একটা ষড়যন্ত্র বানচাল হয়ে গেছে বলে দেশটার সরকারি কর্মকর্তারা বলেন। ছয় ব্যক্তিকে এই ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়; যার মাঝে দু’জন ফরাসি নাগরিক। গ্রেপ্তারকৃতদের মাঝে দু’জন ফরাসি সামরিক বাহিনীতে কাজ করেছেন বলেও উল্লেখ করা হয়। অনেকেই বলছেন যে, এই ঘটনার পিছনে বিদেশী হাত রয়েছে। মাদাগাস্কারে রাজনৈতিক অস্থিরতা নতুন নয়; এবং সেখানে বিদেশী হস্তক্ষেপও নতুন নয়। দেশটার ইতিহাস জুড়েই রয়েছে বিদেশী ইন্ধনে রাজনৈতিক পালাবদল। তবে আফ্রিকার উপকূলের দরিদ্র এই দেশটার ব্যাপারে অন্যান্য দেশের এত আগ্রহই বা কেন?

মাদাগাস্কারকে নিয়ে ঔপনিবেশিক দ্বন্দ্ব

‘ফিনানশিয়াল টাইমস’এর এক লেখায় কেনিয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষক নানজালা নিয়াবোলা প্রশ্ন করছেন যে, মাদাগাস্কার আসলে উপনিবেশিক সময় পার করতে পেরেছে কিনা। তার বিশ্লেষণে দুই দশক ধরে ফ্রাঙ্কোফাইল বা ফরাসি প্রভাবে থাকা গ্রুপের সাথে এংলোফাইল বা ব্রিটিশ-মার্কিন গ্রুপের মাঝে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলছে। তবে তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে, এই দ্বন্দ্ব মূলতঃ দুই শতক ধরে ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের মাঝে চলা ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা। ২০০২ সালের নির্বাচনে জেতা প্রেসিডেন্ট রাভালোমানানা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে মাদাগাস্কারের জন্যে প্রচুর সহায়তা পান। অপরদিকে রাভালোমানানাকে উৎখাত করতে যেয়ে ২০০৯ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় পুলিশের গ্রেপ্তার এড়াতে বর্তমান প্রেসিডেন্ট রাজোএলিনা ফরাসি দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ফরাসি বার্তাসংস্থা ‘এএফপি’ বলছে যে, ফরাসিরা জাতিসংঘের নির্দেশনাতেই রাজোএলিনাকে রক্ষা করেছিল। দূতাবাসের বাইরে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রাভালোমানানার শতশত সমর্থক বিক্ষোভ করে। নিয়াবোলা বলছেন যে, দু’শ বছর ধরে মাদাগাস্কারের ভাগ্য ঠিক হয়েছে পশ্চিমা রাজধানীগুলিতে।

ঊনিশ শতক থেকে মাদাগাস্কারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফরাসি আর ব্রিটিশদের প্রতিযোগিতা ভীষণ আকার ধারণ করে। ফরাসি ইঞ্জিনিয়ার জঁ লাবোরদা মাদাগাস্কারের রাজ্যের প্রধান ইঞ্জিনিয়াররূপে নিয়োগ পেয়ে যান এবং রাজ পরিবারের জন্যে রাজধানী এনটানানারিভোতে কাঠ দিয়ে ‘রোভা প্যালেস’ তৈরি করে দেন। এর প্রতিযোগিতায় স্কটিশ মিশনারি জেমস ক্যামেরন পাথর দিয়ে প্যালেস নির্মাণ করে দেন। আরেকজন ফরাসি ব্যবসায়ী জঁ ফ্রাঁসোয়াঁ ল্যামবার্ট মাদাগাস্কারের রাজার সাথে একটা বাণিজ্য চুক্তি করেন, যা পরবর্তীতে মাদাগাস্কারকে ফরাসিদের পদানত করতে ব্যবহৃত হয়েছিল। ইউরোপিয় মিশনারিদের প্রভাবে ১৮৬৯ সালে মাদাগাস্কারের রাজা খ্রিস্টধর্মকে রাজ্যের অফিশিয়াল বিশ্বাস বলে ঘোষণা করেন। ইউরোপিয়রা দেশটার শিক্ষা ব্যবস্থা ডিজাইন করে। দেশটার সেনাবাহিনীকে ট্রেনিং দেয়ার দায়িত্ব নেয় ব্রিটিশরা; উদ্দেশ্য ছিল ফরাসিরা যাতে মাদাগাস্কারের নিয়ন্ত্রণ নিতেনা পারে। ব্রিটিশ আইনের আদলে মাদাগাস্কারের আইন তৈরি করা হয়। আদালতগুলিও তৈরি করা হয় ইউরোপিয় আদলে। ১৮৮৩ সালে ল্যাম্বার্ট চার্টার ভঙ্গ করার ছুতো দেখিয়ে ফরাসিরা মাদাগাস্কারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধ প্রায় ১৩ বছর ধরে চলে। দ্বীপের উত্তরে কিছু এলাকা দখল করে সেখানে ফরাসিরা দিয়েগো সুয়ারেজ নৌঘাঁটি তৈরি করে। আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে রাজধানী এনটানানারিভো থেকে সমুদ্রে যাবার প্রধান দুই সমুদ্রবন্দর তোয়ামাসিনা এবং মহাজঙ্গ গোলাবর্ষণ করে ফরাসি নৌবাহিনী। তাতেও কাজ না হওয়ায় সেনাবাহিনী প্রেরণ করে রাজধানী এনটানানারিভোর উপর ভারি আর্টিলারি দিয়ে গোলাবর্ষণ করে রানী তৃতীয় রানাভালোনাকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে ফরাসিরা। ১৮৯৬ সালে ফরাসিরা মাদাগাস্কারকে উপনিবেশ ঘোষণা করে এবং রাজ পরিবারকে দেশত্যাগে বাধ্য করে। এভাবে মাদাগাস্কার পুরোপুরিভাবে ফরাসিদের নিয়ন্ত্রণে আসে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির হাতে ফ্রান্সের পতন হবার পর ব্রিটিশরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ফরাসিদের অধীনে থাকা এলাকাগুলির নিয়ন্ত্রণ নিতে সচেষ্ট হয়। যুক্তি ছিল যে, জার্মানরা এগুলির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে। ১৯৪২ সালে জাপানিরা মাদাগাস্কারে অবতরণ করতে পারে এই ছুতোয় ব্রিটিশরা মাদাগাস্কার দখল করে নেয়। ব্রিটিশরা ফরাসিদের হাতে দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিলেও যুদ্ধ শেষেই ১৯৪৭ সালে মাদাগাস্কারে স্বাধীনতার জন্যে আন্দোলন শুরু হয়। ফরাসিরা শক্ত হাতে এই বিদ্রোহ দমন করে এবং এর প্রায় এক দশক পর মালাগাসিরা শান্তিপূর্ণভাবে ফরাসিদের কাছ থেকে স্বাধীনতা মেনে নিতে বাধ্য হয়। ১৯৬০ সালে মাদাগাস্কারকে স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ফরাসিরাই দেশটার প্রথম প্রেসিডেন্ট ফিলিবার্ট সিরানানাকে নিয়োগ দেয়। ১২ বছর তিনিই দেশ শাসন করেন। তার সময়ে ফ্রান্সের নাগরিকেরাই মাদাগাস্কারের গুরুত্বপূর্ণ অফিসসমূহ নিয়ন্ত্রণ করতো। এর ফলশ্রুতিতে দেশটাতে ব্যাপক আন্দোলন দানা বাঁধে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত অনেকগুলি অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা যায় নৌবাহিনীর অফিসার দিদিয়ের রাতসিরাকার কাছে। রাতসিরাকা পড়াশোনা করেন প্যারিসে এবং ফরাসি নৌবাহিনীতেই তার ক্যারিয়ার শুরু হয়। তিনি দেশটাকে আপাতদৃষ্টে সমাজতন্ত্রের দিকে ধাবিত করলেও কিছুদিনের মাঝেই তিনি প্রমাণ করেন যে, তিনি ইউরোপকে কখনোই ছেড়ে যাননি। অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়ার পর বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফএর কাছ থেকে ঋণও পায় মাদাগাস্কার। ১৯৯২ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি ক্ষমতা হারালেও ১৯৯৬ সালে তিনি আবারও ক্ষমতায় ফিরে আসেন।
ছবিঃ মাদাগাস্কারের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রাভালোমানানা। মাদাগাস্কারকে ফরাসি প্রভাবের নেতৃত্ব থেকে বের করে আনার লক্ষ্যে রাভালোমানানার পিছনে বিশ্ব ব্যাংক এবং যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট বিনিয়োগ রয়েছে। ২০০২ সালে রাভালোমানানা প্রেসিডেন্ট হন। তবে ২০০৭ সাল থেকেই তিনি ফরাসি সমর্থিত প্রার্থী রাজোএলিনার ব্যাপক প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হন।


একুশ শতকে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা

২০০১ সালের নির্বাচনে রাজধানী এনটানানারিভোর মেয়র মার্ক রাভালোমানানা ক্ষমতায় আসেন। রাভালোমানানা গরীব ঘর থেকে উঠে আসা একজন প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান; যেখানে মাদাগাস্কারের প্রয়ায় সকল রাজনীতিবিদেরাই মূলতঃ ক্যাথোলিক। মাদাগাস্কারের প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ মূলত ব্রিটিশদেরই প্রতিষ্ঠা করা। তিনি তার পড়াশোনা করেন প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চের চালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ার এনজিওগুলির সুবাদে তিনি ইউরোপে পড়াশোনা করেন। দেশে ফিরে তিনি ডেইরির ব্যবসা করেন এবং বিশ্বব্যাঙ্কের ঋণের সুবাদে মাদাগাস্কারের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ীদের একজন বনে যান। ইউরোপিয় এবং আমেরিকানরা তার ব্যবসায় ব্যাপক বিনিয়োগ করে। তার রাজনৈতিক আকাংক্ষা প্রকাশ পেতে থাকার পরেই রাতসিরাকার সরকারের সাথে তার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। রাভালোমানানা ১৯৯৯ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজধানী এনটানানারিভোর মেয়র হন। এরপর ২০০১ সালে ৫১ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট হন। হেরে যাওয়া রাতসিরাকা পেয়েছিলেন ৩৬ শতাংশ ভোট। ২০০৬ সালে দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার সময় তিনি ৫৫ শতাংশ ভোট পান। তার ব্যবসায়িক শক্তিকে তিনি নির্বাচনে পুরোপুরিভাবে ব্যবহার করেন। অনেকেই মনে করেন যে, রাভালোমানানা মাদাগাস্কারকে ফরাসি প্রভাব থেকে বের করে ব্রিটিশ মার্কিন বলয়ে নেবার চেষ্টা করেছিলেন।

তবে এখানে বাধা হয়ে দাঁড়ান আন্দ্রি রাজোএলিনা। বিলবোর্ড ব্যবসায়ী রাজোএলিনা তার ব্যবসায়িক শক্তিকে ব্যবহার করে রাজনীতিতে ঢোকেন। ২০০৭ সালে ‘ভিভা’ টেলিভিশন কিনে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করতে শুরু করেন। মাত্র ৩৩ বছর বয়সে তিনি রাজধানী এনটানানারিভোর মেয়র বনে যান। ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট রাভালোমানানা ‘ভিভা’ টেলিভিশন বন্ধ করে দেন। কিছুদিনের মাঝেই রাজোএলিনা মাদাগাস্কারের বিরোধী রাজনীতিবিদদের একত্রিত করে হাজারো মানুষকে রাস্তায় আন্দোলনে নামান। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে এক জনসভায় রাজোএলিনা ঘোষণা দেন যে, তিনি এখন থেকে মাদাগাস্কারের নেতৃত্ব দেবেন। মার্চ মাসে সেনাবাহিনী রাজোএলিনার পক্ষ নিলে প্রেসিডেন্ট রাভালোমানানা ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে আশ্রয় নেন। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, দক্ষিণ আফ্রিকার এক রেডিওর সাক্ষাৎকারে রাভালোমানানা অভিযোগ করেন যে, রাজোএলিনার মাধ্যমে ফ্রান্স মাদাগাস্কারের নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে। ২০০৮ সালের জুলাই মাসে রাভালোমানানা প্রেসিডেন্ট থাকার সময় ফরাসি রাষ্ট্রদূত গিলদাস লে লিডেককে দেশ থেকে বের করে দিয়েছিলেন।

রাজোএলিনা ক্ষমতা নিলেও ‘আফ্রিকান ইউনিয়ন’ বা ‘এইউ’ এবং ‘সাউদার্ন আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট কমিউনিটি’ বা ‘এসএডিসি’ এটাকে অভ্যুত্থান বলে আখ্যা দেয়। যুক্তরাষ্ট্র তার মাদাগাস্কার দূতাবাস খালি করতে শুরু করে। আইএমএফ মাদাগাস্কারের ঋণ মুলতুবি করে। ‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, মোজাম্বিকের রাজধানী মাপুতোতে ‘এসএডিসি’র মধ্যস্ততা মেনে নিতে বাধ্য হন রাজোএলিনা; তিনি হন অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট। গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান পরিবর্তন করে প্রেসিডেন্ট হবার বয়স ৪০ বছর থেকে নামিয়ে ৩৫ করা হয়, যাতে রাজোএলিনা পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। তবে রাভালোমানানার পক্ষের গ্রুপের বাধার কারণে রাজোএলিনা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। ২০১৪ সালে রাজোএলিনার সমর্থনে হেরি রাজাওনারিমামপিয়ানিয়া ৫৪ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট হন। তবে ২০১৮ সালে রাজোএলিনা নির্বাচনে অংশ নেন। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ব্রিটিশ এবং মার্কিনীদের পছন্দের প্রার্থী রাভালোমানানা। প্রথম ধাপে ৩৯ শতাংশ এবং দ্বিতীয় ধাপে ৫৬ শতাংশ ভোট পেয়ে রাজোএলিনা প্রেসিডেন্ট হন। রাভালোমানানা পেয়েছিলেন ৪৪ শতাংশ ভোট।

মাদাগাস্কারে ফরাসি প্রভাব এখনও প্রবল

‘ওয়ার্ল্ড কালচার এনসাইক্লোপেডিয়া’র এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, ঊনিশ শতক থেকেই মাদাগাস্কারের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ফরাসি সংস্কৃতিতে আসক্ত হয়ে পড়ে। দেশটার মানুষ মালাগাসি ভাষায় কথা বললেও ১৮৯৬ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত ঔপনিবেশিক সময়ের প্রভাবের কারণে দেশটার অফিশিয়াল ভাষা হলো ফরাসি। বিভিন্ন সময়ে ফরাসি ভাষাকে সরিয়ে দেবার অনেক চেষ্টাই বিফলে গেছে।

‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ১৯৪৭ সালে মাদাগাস্কারের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ফরাসিরা বিদ্রোহীদের উপরে প্রচন্ড নির্যাতন চালায়; যার ক্ষত এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে অনেকে। প্রায় ৯০ হাজার মানুষ সেই আন্দোলনে ফরাসি এবং তাদের ঔপনিবেশিক সেনাদের হাতে মৃত্যুবরণ করে। অত্যাচারের শারীরিক ক্ষত নিয়ে বেঁচে ছিল বাকিরা। অনেকেই মনে করছেন যে, ৬০ বছর পরেও ফ্রান্সের হাত থেকে মুক্ত হতে পারেনি মাদাগাস্কার। ‘লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস’এর ২০১৮ সালের গবেষণায় ‘ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, ডেভিস’এর ওমার গার্সিয়া পনসা এবং ‘প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি’র লেনার্ড ওয়ান্টচেকন ১৯৪৭ সালের ফরাসি অত্যাচারের প্রভাব খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। তারা বলেন যে, ১৯৪৭ সালের ফরাসি অত্যাচারের কারণে মাদাগাস্কারের জনগণের মাঝ থেকে কথা বলার সাহস হারিয়ে গেছে। অর্থাৎ মাদাগাস্কারের জনগণের সংস্কৃতিটাই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। মানুষের মনে যুদ্ধে অংশ নেয়া বীরদের স্মৃতি নয়, বরং ফরাসি বর্বরতাটাই গেঁথে গেছে।

মাদাগাস্কারের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের প্রায় সকলেই ফ্রান্সে পড়াশোনা করেছেন; নতুবা ফ্রান্সের সাথে তাদের ব্যবসা রয়েছে; নতুবা ফ্রান্সের কোন সংস্থার অধীনে তারা কাজ করেছে। দেশটার স্বাধীনতার ৬১ বছরের মাঝে ৪৮ বছর ক্ষমতা ছিল মাত্র চারজন প্রেসিডেন্টের হাতে। ১২ বছর ক্ষমতায় থাকা দেশটার প্রথম প্রেসিডেন্ট ফিলিবার্ট সিরানানা ফ্রান্সে পড়াশোনা করেন এবং ১৯৫০এর দশকে ফরাসি পার্লামেন্টে মাদাগাস্কারের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে ক্ষমতা নেয়া প্রেসিডেন্ট দিদিয়ের রাতসিরাকা ছিলেন ফরাসি নৌবাহিনীর অফিসার। তার বাবাও ফরাসি উপনিবেশের কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ২১ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। এরপর বাকি ১৫ বছর ভাগাভাগি করেছেন ব্রিটিশ মার্কিনপন্থী রাভালোমানানা এবং ফরাসি প্রভাবে থাকা রাজোএলিনা।
ছবিঃ ভাস্কো দা গামার ভারত মহাসাগরে আসার পথ। ১৯৭০এর দশকের পর থেকে সুয়েজ খালের অপারেশন স্বাভাবিক থাকার কারণে যারা ভাস্কো দা গামার অতিক্রম করা আফ্রিকার দক্ষিণের এই সমুদ্রপথের কথা ভুলেই গিয়েছিলেন, তারা সুয়েজ খালে কনটেইনার জাহাজ ‘এভার গিভেন’এর আটকে যাবার পর বাস্তবতায় ফিরেছেন। তবে গত কয়েক দশকে দক্ষিণ আমেরিকা এবং পশ্চিম আফ্রিকার সাথে চীনের বাণিজ্য বৃদ্ধিও এই সমুদ্রপথকে ব্যস্ত করেছে।



মাদাগাস্কারের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব

মাদাগাস্কার একটা দরিদ্র দেশ; যার মাথাপিছু গড় আয় ১৮’শ ডলারেরও কম। তৈরি পোষাক, মাছ, মসলা, ইত্যাদি দেশটার রপ্তানি পণ্য। বেশিরভাগ শিল্পপণ্য, ভোগ্যপণ্য এবং খাদ্যদ্রব্য আমদানি করেই চলে তাদের। একসময় সবচাইতে বেশি বাণিজ্য ফ্রান্সের সাথে হলেও এখন চীনাদের কাছ থেকেই তারা সবচাইতে বেশি আমদানি করে থাকে। তবে ফ্রান্স এখনও মাদাগাস্কারের পণ্যের সবচাইতে বড় ক্রেতা। দেশের মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ বিদ্যুতের আওতায় রয়েছে বলে বলছে বিশ্বব্যাংক। দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন দূরে থাকুক দেশটার ভৌগোলিক অবস্থানের গুরুত্বের কারণে বড় শক্তিদের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় নিমজ্জিত রয়েছে দেশটা। বহুকাল ধরে এখানে মূল খেলোয়াড় ফ্রান্স এবং ব্রিটেন থাকলেও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, এবং আরও বিভিন্ন দেশ যুক্ত হয়েছে।

১৪৯৮ সালে আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে ভাস্কো দা গামার ভারত মহাসাগরে আসার সাথেসাথেই দক্ষিণ আফ্রিকার আশেপাশের অঞ্চলগুলি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। কারণ এটাই ছিল ইউরোপ থেকে ভারত মহাসাগরে আসার পথ। এই পথের উপরে যেকোন বাণিজ্য, লজিস্টিক্যাল বা সামরিক ঘাঁটি ইউরোপ এবং এশিয়ার মাঝে বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যোড়শ এবং সপ্তদশ শতকে পর্তুগীজরা পূর্ব আফ্রিকার মাদাগাস্কার, তাঞ্জানিয়া ও কেনিয়ার উপকূলে উপনিবেশ স্থাপন করে। ডাচরা দক্ষিণ আফ্রিকায় বসতি স্থাপন করে ১৬৫২ সালে। ১৭১৫ সালে ফ্রান্স মাদাগাস্কারের পূর্বে মরিশাস দ্বীপ দখল করে। ১৮০৬ সালে ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধের ছুতোয় ব্রিটিশরা দক্ষিণ আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপন করে। এরপর ১৮১০ সালে ব্রিটিশরা ফরাসিদের কাছ থেকে মরিশাস পুনর্দখল করে। লা রিউনিয়ন দ্বীপ দখল করলেও পরে তা ছেড়ে দেয়; যা আজও ফ্রান্সের হাতে রয়েছে। ১৮৮৬ সালে ফরাসিরা মোজাম্বিক চ্যানেলে কমোরুস দ্বীপ দখল করে। আর শেষ পর্যন্ত ১৮৯০এর দশকে ফরাসিরা মাদাগাস্কার দখল করে। ততদিনে অবশ্য সুয়েজ খাল তৈরি হয়ে যাওয়ায় আফ্রিকা ঘুরে বাণিজ্যপথের গুরুত্ব কমে আসে।

১৯৬৭ সালে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ হলে সুয়েজ খাল বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আট বছর বন্ধ থাকে এই খাল। এসময়ে ইউরোপ এবং এশিয়ার মাঝে যাতায়াত করা সকল বাণিজ্য এবং যুদ্ধজাহাজ দক্ষিণ আফ্রিকা ঘুরে যাতায়াত করে। ২০২১ সালের ২৩শে মার্চ ‘এভার গিভেন’ নামের বিশাল কনটেইনার জাহাজ সুয়েজ খালে আটকে গেলে প্রায় এক সপ্তাহের জন্যে খাল বন্ধ হয়ে যায়। এসময়ে অনেক জাহাজ খালের দু’পাশে আটকে থাকে; কিছু জাহাজ দক্ষিণ আফ্রিকা ঘুরে যাত্রা করে। এই ঘটনা দেখিয়ে দেয় যে, সুয়েজ খালের আশেপাশে যেকোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কারণে দক্ষিণ আফ্রিকা ঘুরে সমুদ্রপথের গুরুত্ব বেড়ে যেতে পারে। এই মুহুর্তে দক্ষিণ আমেরিকা এবং পশ্চিম আফ্রিকার সাথে চীনের সমুদ্র বাণিজ্যপথ হলো এটা।

মাদাগাস্কারের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোএলিনাকে হত্যাচেষ্টা আফ্রিকার দক্ষিণের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ নিয়ন্ত্রণের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকেই তুলে ধরে। এই ঘটনা এমন সময়ে ঘটলো, যখন দ্বীপ দেশটার অদূরে মোজাম্বিকের কাবো দেলগাদো অঞ্চলে মুসলিম বিদ্রোহ দমনে বিভিন্ন দেশের সেনারা অবতরণ করছে। মোজম্বিকের উপকূলের গ্যাস খনিগুলি নতুন করে অত্র অঞ্চলের গুরুত্ব বাড়ালেও সমুদ্রপথ হিসেবে এর গুরুত্ব সবসময়েই প্রধান ছিল। ১৯৭০এর দশকের পর থেকে সুয়েজ খালের অপারেশন স্বাভাবিক থাকার কারণে যারা ভাস্কো দা গামার অতিক্রম করা আফ্রিকার দক্ষিণের এই সমুদ্রপথের কথা ভুলেই গিয়েছিলেন, তারা সুয়েজ খালে কনটেইনার জাহাজ ‘এভার গিভেন’এর আটকে যাবার পর বাস্তবতায় ফিরেছেন। তবে গত কয়েক দশকে দক্ষিণ আমেরিকা এবং পশ্চিম আফ্রিকার সাথে চীনের বাণিজ্য বৃদ্ধিও এই সমুদ্রপথকে ব্যস্ত করেছে। দু’শ বছরের ব্রিটিশ ফরাসি দ্বন্দ্বে এখন আরও অনেকেই জড়িত।

2 comments:

  1. আফগানিস্তান নিয়ে আপনার এনালাইসিস আমরা কবে পাবো

    ReplyDelete
    Replies
    1. নতুন করে খুব বেশি কিছু বলার নেই। তিন মাস আগে যা বলেছিলাম, সেখান থেকে খুব বেশি একটা পরিবর্তন হয়নি। গতিপ্রকৃতি একইদিকে রয়েছে। কারণ প্রকৃতপক্ষে নতুন ব্যাপার খুব কমই ঘটেছে। সাধারণ মানুষের কাছে এটা নতুন ঠেকছে যদিও।

      https://koushol.blogspot.com/2021/05/afghanistan-after-america.html

      একটা আপডেট আসলেও আসতে পারে।

      Delete