Saturday 6 May 2023

ইউরোপজুড়ে মে দিবসের বিক্ষোভ শ্রমিকদের অপূর্ণ অধিকারকেই তুলে ধরে

০৬ মে ২০২৩

ফ্রান্সে মে দিবসে শ্রমিকদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ। ‘আইএলও’ প্রধান তার হতাশা ব্যক্ত করে বলেন যে, এখনও নীতির ঘুরপাকেই পড়ে থাকতে হচ্ছে; যেখানে বৈষম্য এবং অস্থিরতাই স্বাভাবিক। ‘আইএলও’ প্রধানের হতাশার কথাগুলি ইউরোপের লিবারাল পুঁজিবাদী দেশগুলির রাস্তায় শ্রমিক বিক্ষোভের মাঝেই প্রতিফলিত হচ্ছে। ন্যায্য বেতন, জীবনযাত্রার মান, ছুটি, ইত্যাদি ইস্যুতে শ্রমিকদের বিক্ষোভ দেখিয়ে দেয় যে, ইউরোপের উন্নত দেশগুলি শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতে যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা রক্ষা করতে মোটেই মনোযোগী হয়নি।

‘ডয়েচে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এবারের মে দিবসে পুরো ইউরোপজুড়ে শ্রমিক ইউনিয়নগুলি বহু বিক্ষোভের আয়োজন করেছে। বিশেষ করে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতির কারণে যে মানুষগুলি অর্থনৈতিকভাবে বেশি চাপের মাঝে পড়েছে, তারাই বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। ‘জার্মান ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন’ বা ‘ডিজিবি’ বলছে যে, তাদের আয়োজিত ৩’শ ৯৮টা মিছিলে ২ লক্ষ ৮৮ হাজার মানুষ যোগ দিয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা, বিমান পরিবহণ, সড়ক পরিবহণ, রেলওয়ে, ডাকবিভাগ, পরিচ্ছন্নকর্মী ছাড়াও বিভিন্ন সেক্টরের শ্রমিকরা এবছরে জার্মানিতে ন্যায্য পারিশ্রমিক এবং কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন সুবিধা বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘট পালন করেছে। বার্লিনে এক মিছিলে জার্মান শিল্পভিত্তিক ট্রেড ইউনিয়ন ‘আইজি মেটাল’এর নেতা জোর্গ হফমান ঘোষণা দেন যে, তারা ধর্মঘট করার অধিকারের উপর কোন প্রকারের নিয়ন্ত্রণ সহ্য করবেন না।

তবে ফ্রান্সের রাস্তাগুলি ছিল সবচাইতে উত্তপ্ত। পুরো ফ্রান্সজুড়ে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁর নতুন পেনশন আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে। অবসরের বয়স ৬২ বছর থেকে বাড়িয়ে ৬৪ বছর করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ফরাসি শ্রমিক ইউনিয়নগুলি ৩’শর বেশি মিছিলের ডাক দিয়েছিল। দিন যত গড়িয়েছে, বিক্ষোভগুলি ক্রমেই সহিংস হয়েছে এবং পুলিশের সাথে শ্রমিকদের সংঘর্ষ হয়েছে। ফরাসি বার্তাসংস্থা ‘এএফপি’ বলছে যে, বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে বিভিন্ন বস্তু ছুঁড়ে মেরেছে এবং রাস্তার পাশের বিভিন্ন দোকানপাট ও ব্যাংকের জানালার গ্লাস ভাংচুর করেছে। লিয়ঁ শহরে পুলিশ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড ডারমারিন এক সংবাদ সন্মেলনে বলেন যে, সহিংসতায় ১’শ ৮ জন পুলিশ আহত হয়েছে এবং দেশজুড়ে ২’শ ৯১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ৮ লক্ষাধিক মানুষ এই বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিল। ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, একদিকে শ্রমিকরা যেখানে বলছে যে, সরকারের নতুন আইনে তাদের অধিকার খর্ব হচ্ছে, সেখানে সরকার বলছে যে, দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে এটা প্রয়োজন; কারণ ফ্রান্সের জনগণের গড় বয়স বেড়ে যাচ্ছে। এবারে বামপন্থীদের সাথে যোগ দিয়েছিল সাধারণ জনগণ; যারা অর্থনৈতিক সুবিচার চায় এবং প্রেসিডেন্টের ব্যবসায়ী-বান্ধব নীতির বিরোধী।

এদিকে ইতালিতে ডানপন্থী সরকার কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি হবে এই লক্ষ্য নিয়ে দরিদ্রদের জন্যে সামাজিক সুরক্ষা কমিয়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি এক বিবৃতিতে ঘোষণা দেন যে, চার বছর আগে চালু করা দরিদ্রদের সুরক্ষা আইনে পরিবর্তন আনা হয়েছে; যাতে করে কারা কাজ করতে পারে, আর কারা কাজ করতে পারে না, তাদের মাঝে আলাদা করা যায়। অর্থাৎ যাদেরকে এই সুবিধা দেয়া হবে, তাদের সংখ্যা কমিয়ে আনা হচ্ছে। ইতালির বিরোধী দলগুলি ক্ষমতাসীনদের সামাজিক সুরক্ষা কমিয়ে ফেলার নীতির ব্যাপক সমালোচনা করছে। ‘ডয়েচে ভেলে’ বলছে যে, ইতালির উত্তরের তুরিন শহরে বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির পাপেট নিয়ে মিছিল করে, যেখানে মেলোনি ফ্যাসিস্ট স্যালুট দিচ্ছেন বলে দেখানো হয়।

এদিকে ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, স্পেনের শ্রমিক ইউনিয়নগুলি ৭০টার বেশি মিছিলের আয়োজন করে; যেখানে বলা হয় যে, মুদ্রাস্ফীতির সাথেসাথে শ্রমিকদের বেতন না বাড়লে সামাজিক দ্বন্দ্ব তৈরি হবে। মাদ্রিদের ‘ইলাসট্রিয়াস কলেজ অব ল’ইয়ার্স’এর আইনজীবিরাও রাস্তায় মিছিল করে। তাদের দাবি ছিল ছুটির। স্পেনের আইন অনুযায়ী একজন আইনজীবিকে বছরে ৩৬৫ দিনই কাজের জন্যে প্রস্তুত থাকতে হয়। এমনকি তাদের কাছের কোন ব্যক্তির যদি মৃত্যুও হয়, অথবা তারা নিজেরা যদি অসুস্থও হয়, তাহলেও তাদেরকে কাজের ডিউটি দিতে হয়। তারা বলছেন যে, করোনা মহামারির সময়ে আইনজীবিরা হাসপাতাল থেকে টুইটারে ছবি পোস্ট করেছিলেন, যেখানে তারা বলছিলেন যে, স্যালাইন দেওয়া অবস্থায় তারা কাজ করছিলেন।

‘আনাদোলু এজেন্সি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে হাজারো শ্রমিক রাস্তায় বিক্ষোভ করেছে। মূলতঃ বামপন্থী সংগঠনগুলির আয়োজন করা এই বিক্ষোভে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতির মাঝে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান রক্ষা করার কষ্টটাকেই তুলে ধরা হয়। একই দিনে গ্রিসে রেল শ্রমিক, জাহাজ ও বন্দর শ্রমিকরা ধর্মঘট করে। ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, মেসিডোনিয়ায় মন্ত্রীদের বেতন ৭৮ শতাংশ বৃদ্ধি করার প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়েছে। সে দেশে শ্রমিকদের বেতন সাড়ে ৩’শ ডলার হলেও মন্ত্রীদের বর্তমান বেতন বাড়িয়ে ২ হাজার ৫’শ ৩০ ডলার করা হয়েছে।

ইউরোপের রাস্তায় বিক্ষোভগুলি যে বিশ্বব্যবস্থার সমস্যা, তা ‘আইএলও’ প্রধানের বক্তব্যতেই পরিষ্কার হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ‘আইএলও’এর ডিরেক্টর জেনারেল গিলবার্ট হুংবো মে দিবস উপলক্ষে এক বার্তায় বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের জন্যে সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। একইসাথে তিনি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও জলবায়ুগত নীতিতে পরিবর্তন আনার আহ্বান জানান; যাতে করে সকলের অধিকার নিশ্চিত করা যায়। তিনি তার হতাশা ব্যক্ত করে বলেন যে, করোনা মহামারির সময়ে শ্রমিকদেরকে যেসকল প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, সেগুলি বাস্তবায়িত হয়নি। বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের সত্যিকারের বেতন কমে গেছে, দারিদ্র্য বেড়ে যাচ্ছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য আগের চাইতেও আরও মারাত্মকভাবে যেঁকে বসেছে। শ্রমিকরা মনে করছে যে, করোনা মহামারির সময় তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে কাজগুলি করেছে, সেগুলির পুরষ্কার কেন, স্বীকৃতিই দেয়া হয়নি। এগুলির কারণে শ্রমিকদের মাঝে মারাত্মক আকারের অবিশ্বাস দেখা দিয়েছে।

‘আইএলও’ প্রধান মনে করিয়ে দেন যে, ১৯৪৪ সালে ‘আইএলও’ প্রতিষ্ঠার সময়ে বলা হয়েছিল যে, বিশ্ব অর্থনীতি শুধুমাত্র প্রবৃদ্ধি এবং কিছু পরিসংখ্যান টার্গেটের পিছনেই ছুটবে না; বরং সেখানে মানুষের চাহিদা এবং ইচ্ছাকে প্রধান্য দেবে। অর্থাৎ বৈষম্য দূরীকরণ, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সামাজিক সুরক্ষা বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল; বিশেষ করে জনগণের জন্যে এমন ধরণের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, যাতে করে মানুষ নিজেদের দায়িত্ব নিজেরাই নিতে পারে। কিন্তু তিনি তার হতাশা ব্যক্ত করে বলেন যে, এখনও নীতির ঘুরপাকেই পড়ে থাকতে হচ্ছে; যেখানে বৈষম্য এবং অস্থিরতাই স্বাভাবিক। ‘আইএলও’ প্রধানের হতাশার কথাগুলি ইউরোপের লিবারাল পুঁজিবাদী দেশগুলির রাস্তায় শ্রমিক বিক্ষোভের মাঝেই প্রতিফলিত হচ্ছে। ন্যায্য বেতন, জীবনযাত্রার মান, ছুটি, ইত্যাদি ইস্যুতে শ্রমিকদের বিক্ষোভ দেখিয়ে দেয় যে, ইউরোপের উন্নত দেশগুলি শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতে যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা রক্ষা করতে মোটেই মনোযোগী হয়নি।

No comments:

Post a Comment