Tuesday 9 May 2023

রাজা চার্লসের অভিষেকে সামরিক প্যারেড… অর্থহীন প্রথা, নাকি অন্য কিছু?

০৯ই মে ২০২৩

ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া কমনওয়েলথ সেনাদের একাংশ। ক্রমেই ক্ষুদ্র হওয়া ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী যখন ব্যাপক রিক্রুটমেন্ট সমস্যায় পতিত, তখন প্রথাগত সামরিক প্যারেড নতুন জেনারেশনের ব্রিটিশ যুবকদের মনে তেমন একটা দাগ না-ও কাটতে পারে। একারণেই হয়তো রাজার অভিষেকে সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে আসা সেনাদের উপস্থিতি বেশি গুরুত্ব বহণ করে। ব্রিটিশ রাজের অস্তিত্বের প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে সামরিক প্যারেডে বহুদূর থেকে আসা কমনওয়েলথের বহু বর্ণের সেনাদের অংশগ্রহণের মাঝেই।

ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে অনেক আলোচনাই মিডিয়াতে এসেছে। একদিকে ব্রিটেনের রাজ প্রথাকে অনেকেই যেমন একুশ শতকে বাতিল বলে মনে করছে, তেমনি কেউ কেউ অভিষেক অনুষ্ঠানের সামরিক কুচকাওয়াজের অর্থ খুঁজছেন।

গত ৬ই মের অভিষেক অনুষ্ঠানের প্যারেড ছিল ৭০ বছরের মাঝে ব্রিটেনে সবচাইতে বড় সামরিক কুচকাওয়াজ। ব্রিটিশ পত্রিকা ‘মিরর’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ব্রিটিশ সেনা, নৌ, বিমান বাহিনী এবং কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলির ৪ হাজারের বেশি সামরিক সদস্য এই কুচকাওয়াজে অংশ নেয়। এছাড়াও আরও ১১’শ সেনা পুরো কুচকাওয়াজের পথে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল। ১৯৫৩ সালে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের অভিষেক অনুষ্ঠানের পর থেকে সর্ববৃহৎ এই সামরিক প্যারেডের প্রস্তুতি নিতে প্রায় ছয় মাস সময় লেগেছিল। কুচকাওয়াজে পতাকা বহণকারী প্রথম কনটিনজেন্টের প্রধান লে কর্নেল জেমস শ-এর কথায়, সেনাবাহিনী রাজার অভিষেকে গত এক হাজার বছর ধরে প্যারেড করে আসছে। কাজেই এটা কোন নতুন ঘটনা নয়। রাজা হলেন কর্নেল-ইন-চীফ; তার সাথে সেনাবাহিনীর একটা গভীর বন্ধন রয়েছে।

যদিও কর্নেল জেমস শ বলছেন যে, ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর জন্যে এই প্যারেড নতুন নয়, তথাপি এই প্যারেড যে খুব একটা নিয়মিত হয়, সেটা কিন্তু নয়। ব্রিটেনের ‘এক্সপ্রেস’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, অনেক ইউনিটই কিছুটা মানসিক চাপের মাঝে ছিল, কারণ তারা অল্প কিছুদিন আগেই বিদেশের মিশন থেকে দেশে ফিরেছে এই অনুষ্ঠানে অংশ নেবার জন্যে। কিছু ইউনিট মাত্র দুই সপ্তাহের প্রস্তুতির সময় পেয়েছে; যা তারা খুবই অল্প মনে করছেন। এদের মাঝে কেউ কেউ এসেছে সাইপ্রাস বা কেনিয়া থেকে; আবার কেউ কেউ কিছুদিন আগ পর্যন্তও ইংল্যান্ডের মাটিতে ইউক্রেনিয় সেনাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলো। কর্নেল জেমস শ ইউটিউবে ১৯৫৩ সালের অভিষেক প্যারেড খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন কিছু শিক্ষা পাবার জন্যে। তিনি চাইছিলেন যাতে করে প্যারেডটা দৃষ্টিনন্দন হয়; বিশেষ করে সেনাদের লাল, হলুদ, কালো, সাদা এবং নীল রঙের পোষাকের মাঝে দর্শকেরা হারিয়ে যায়। প্যারেডে ৩৩টা কমনওয়েলথ দেশ এবং বর্তমানে ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে থাকা ৬টা উপনিবেশকে প্রতিনিধিত্ব করে ৬’শরও বেশি সেনা। এদের মাঝে ক্যারিবিয়ানের বিভিন্ন দ্বীপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং ফকল্যান্ড দ্বীপের সেনা প্রতিনিধিরা ছিল।

‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর ৬০টা বিমানের ফ্লাইপাস্ট এই অনুষ্ঠানের অংশ থাকলেও শেষ পর্যন্ত আবহাওয়ার কারণে কয়েকটা হেলিকপ্টার এবং ‘রেড এরোজ’ এরোব্যাটিক্স বিমানের মাঝেই ফ্লাইপাস্টকে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, পুরো অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রায় ৯ হাজার সামরিক সদস্যের অংশগ্রহণ ছিল; যা কিনা পুরো ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর প্রায় ৫ শতাংশ। ‘অপারেশন গোল্ডেন অর্ব’ নামের এই রাজকীয় সামরিক কুচকাওয়াজে যত সেনা জড়িত ছিল, তা বিশ্বব্যাপী বেশিরভাগ ব্রিটিশ সামরিক মিশনের চাইতে বড় ছিল। সামরিক বিশ্লেষক ইয়াইন ওভারটন প্রশ্ন করছেন যে, একুশ শতকে এহেন অনুষ্ঠান ব্রিটিশ জনগণের সামনে গুরুত্ববহ কোন বার্তা দেয় কিনা। যখন ড্রোনের মতো হাইটেক অস্ত্র যুদ্ধক্ষেত্রে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, তখন অতি পুরোনো প্যারেডের প্রথা ব্রিটিশ যুবকদের কতটা আগ্রহী করবে? ২০২২ সালে সামরিক বাহিনীতে রিক্রুটমেন্ট টার্গেটের চাইতে ২৩ শতাংশ কম ছিল। এমনকি ইউক্রেন যুদ্ধও রিক্রুটমেন্ট বাড়াতে ভূমিকা রাখেনি। যদিও সরকার রাশিয়ার আগ্রাসন ঠেকাতে ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে, তথাপি ইরাক বা আফগানিস্তানের মতো যুদ্ধে জড়াতে কেউই ইচ্ছুক নয়। একজন তরুণ প্রোগ্রামার হয়তো প্রথাগত এই প্যারেড দেখে সামরিক সার্ভিসের ব্যাপারে তেমন আগ্রহী হবে না।

‘দ্যা গার্ডিয়ান’এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ব্রিটেন সাধারণতঃ সামরিক প্যারেডে নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্রের মতো শক্তিগুলি প্রদর্শন করে না। কারণ ব্রিটিশরা মনে করে যে, এগুলি একনায়কদের কর্মকান্ড। তথাপি এবারের অভিষেক কুচকাওয়াজে ‘ইউরোফাইটার টাইফুন’সহ সামরিক বিমানের বড়সড় ফ্লাইপাস্টের পরিকল্পনা ঠিকই করা হয়েছিল। ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘আইআইএসএস’এর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার বেন ব্যারি মত দিচ্ছেন যে, ফ্লাইপাস্ট যোগ করা গেলে সেটা বেশ আধুনিকই ঠেকতো। তবে ফর্মেশনে ড্রোন ওড়ানো হয়তো কঠিন হতো।

পুরো প্যারেডের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশটা হয়তো ছিল ব্রিটিশ কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলির সামরিক কনটিনজেন্ট; যারা এসেছে প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশের দেশগুলি থেকে। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলিতে রাজার অভিষেকের ব্যাপারে তেমন কেন আগ্রহই নেই। ‘আফ্রিকানিউজ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ব্রিটেনের প্রাক্তন উপনিবেশগুলিতে মানুষ এখনও ব্রিটিশ শাসনের তিক্ততা ভুলতে পারেনি। অভিষেক অনুষ্ঠানের দু’দিন আগে ১২টা কমনওয়েলথভুক্ত দেশের প্রতিবাদকারীরা রাজার কাছে চিঠি লেখে; যেখানে ব্রিটেনকে ঔপনিবেশিক শাসনের জন্যে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান করা হয়। অস্ট্রেলিয়ার সিনেটর লিডিয়া থর্প বলছেন যে, রাজা চার্লসের উচিৎ ব্রিটিশদের শাসনের জন্যে ক্ষতিপূরণ দেয়া; যার মাঝে রয়েছে চুরি করা সম্পদ। ‘ইউনিভার্সিটি অব নাইরোবি’র প্রফেসর হেরমান মানিওরা বলছেন যে, ১৯৫০এর দশকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ‘মাউ মাউ’ আন্দোলন ব্রিটিশরা কঠোর হস্তে দমন করেছিল। সেই সময়ের স্মৃতিগুলি এখনও কেনিয় জনগণ ভুলতে পারেনি। তবে উগান্ডার রাজনৈতিক বিশ্লেষক আসুমান বিসিকা বলছেন যে, উগান্ডাসহ পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলিতে ব্রিটিশ সাংস্কৃতিক প্রভাব এখনও যথেষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকার যুবকরা ইংলিশ ফুটবল দলগুলির খেলা দেখার জন্যে পাগল। ‘এনপিআর’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, অভিষেক অনুষ্ঠানে কমনওয়েলথভুক্ত অনেকগুলি দেশ অংশ নিলেও ব্রিটিশ রাজকে নিজেদের রাষ্ট্রপ্রধান বলে স্বীকৃতি দেয়া কিছু দেশ তাদের অবস্থান থেকে সরে আসছে। ২০২১ সালে ক্যারিবিয়ানের দ্বীপ বার্বাডোস ব্রিটিশ রানী এলিজাবেথের স্থলে একজন প্রেসিডেন্টকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ঘোষণা দেয়। জামাইকাও সেই পথেই এগুচ্ছে। তবে প্যারেডে অংশ নেয়া প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশগুলির বেশিরভাগই বর্তমানে প্রজাতন্ত্র।

ক্রমেই ক্ষুদ্র হওয়া ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী যখন ব্যাপক রিক্রুটমেন্ট সমস্যায় পতিত, তখন প্রথাগত সামরিক প্যারেড নতুন জেনারেশনের ব্রিটিশ যুবকদের মনে তেমন একটা দাগ না-ও কাটতে পারে। একারণেই হয়তো রাজার অভিষেকে সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে আসা সেনাদের উপস্থিতি বেশি গুরুত্ব বহণ করে। ব্রিটিশ রাজের অস্তিত্বের প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে সামরিক প্যারেডে বহুদূর থেকে আসা কমনওয়েলথের বহু বর্ণের সেনাদের অংশগ্রহণের মাঝেই।

No comments:

Post a Comment