Wednesday 24 May 2023

বাখমুতের যুদ্ধ কেন গুরুত্বপূর্ণ?

২৪শে মে ২০২৩

১৯শে মে ২০২৩। বাখমুত শহরের ধ্বংসাবশেষ। বাখমুত শহরের যুদ্ধক্ষেত্রের ছবিগুলি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিখা-যুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে আনে। শহরের তেমন কিছুই অবশিষ্ট নেই। আর এখানে কত সেনার মৃত্যু হয়েছে, তা এখনও কেউই বলতে পারে না। বাখমুতের যুদ্ধটা যতটা সামরিক, তার চাইতে বেশি রাজনৈতিক। রাশিয়ায় জনমতের জন্যে এই বিজয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অপরদিকে এই শহরের নিয়ন্ত্রণ হারাবার খবরটা ইউক্রেনিয়দের মনোবলকে আঘাত করবে এবং একইসাথে ইউক্রেনের বন্ধু দেশগুলির মাঝে দুশ্চিন্তার জন্ম দেবে।

গত ২০শে মে এক বিবৃতিতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের বাখমুত শহর জয় করার জন্যে রুশ সেনা এবং ওয়াগনার গ্রুপের ভাড়াটে সেনাদের অভিনন্দন জানান। পরদিন ইউক্রেনের সেনাপ্রধান কর্নেল জেনারেল আলেক্সান্দর সিরসকি বলেন যে, ইউক্রেনিয় সেনারা শহরটাকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে। আর ইউক্রেনের উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী হানা মালইয়ার বলেন যে, ইউক্রেনিয় সেনারা শহরের আশপাশ থেকে অগ্রসর হচ্ছে, এবং তারা শহরটার অনেকটাই ঘিরে ফেলেছে।

‘দ্যা নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলছে যে, ইউক্রেনিয়রা যখন বলছিল যে, বাখমুতের আশেপাশের অঞ্চলগুলির দখল নিয়ে রুশদের সাথে ইউক্রেনিয়দের যুদ্ধ চলছে, তখন এটা মোটামুটি বোঝা গিয়েছে যে, ১০ মাসের ভয়াবহ যুদ্ধের পর বাখমুত শহর অবশেষে রুশদের হাতে চলে গেছে। ইউক্রেনিয়দের হাতে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে খারকিভ এবং নভেম্বরে বন্দর শহর খেরসনের পতনের পর অনেকেই মনে করতে শুরু করেছিল যে, ইউক্রেনিয়রা যুদ্ধে জিততে চলেছে। বাখমুতের জনগণের মাঝে কেউ কেউ আশা করতে শুরু করেছিল যে, এই শহরটাও ইউক্রেনিয়দের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। কিন্তু এই পুরো সময়ে রুশরা একবারের জন্যেও বাখমুতের দিক থেকে চোখ সরায়নি। ডিসেম্বর মাসে ইউক্রেনিয় প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেন্সকি বাখমুত শহর পরিদর্শনে গিয়ে শহরটার নিয়ন্ত্রণকে রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য হিসেবে তুলে ধরেন। হয়তো তখনই শহরটার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল যে, ইউক্রেনিয়রা শেষ পর্যন্ত এই শহরের জন্যে যুদ্ধ করবে। ‘বিবিসি’ বলছে যে, ডিসেম্বরে ওয়াশিংটন সফরে জেলেন্সকি বাখমুতকে ইউক্রেনের ‘মনোবলের দুর্গ’ বলে আখ্যা দেন এবং বলেন যে, বাখমুতের ফলাফল পুরো যুদ্ধের দিক পরিবর্তন করে দেবে।

‘আল জাজিরা’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, পুরো ডনবাসের নিয়ন্ত্রণ নেবার জন্যে বাখমুত শহরের দখল রাশিয়ার জন্যে প্রয়োজন ছিল। কিন্তু উভয় পক্ষ এই শহরটাকে যতটা গুরুত্ব দিয়েছে, তা এর কৌশলগত গুরুত্বকে বহুগুণে ছাপিয়ে গেছে। এই শহরের নিয়ন্ত্রণ ইউক্রেনিয়দের মনোবল ধরে রাখার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। অপরদিকে যুদ্ধের শুরুর দিকে ইউক্রেনের বড় অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিলেও পরবর্তীতে ইউক্রেনিয় প্রতি-আক্রমণে দখলকৃত অঞ্চল হারাবার ফলে রুশদের জন্যে বাখমুতের দখল একটা সন্মানের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একারণেই ইয়েভগেনি প্রিগোঝিনের ওয়াগনার গ্রুপকে সেখানে মোতায়েন করা হয় যুদ্ধের মোড় ঘোরাবার জন্যে। বাখমুতের বিজয় হয়তো প্রিগোঝিনের বিজয় হিসেবেই পরিচিতি পাবে; এবং একইসাথে তা ক্রেমলিনে প্রিগোঝিনের অবস্থানকে সুসংহত করতে পারে।

‘দ্যা নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যে কেন একটা অগুরুত্বপূর্ণ শহর, যার নাম বেশিরভাগ মানুষই শোনেনি, সেটার দখল নেবার জন্যে উভয় পক্ষই এতটা মরিয়া হলে গেলো। গত মার্চ মাসে পশ্চিমা সাংবাদিকদের মিছিল দেখে বাখমুতে ইউক্রেনিয় এক সেনা মন্তব্য করেছিল যে, মনে হচ্ছে যেন সকল শকুন এক জায়গায় চলে এসেছে। বাখমুত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবার আগে এই সাংবাদিকেরা কোথায় ছিল? বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, যুদ্ধের সময় অনেক স্থানই হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়; যখন উভয় পক্ষের কেউই সেটা ছাড়তে চায় না; যখন উভয়েই নিজেদের সন্মান এবং মনোবল রক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। উদাহরণস্বরূপ, ঊনিশ শতকে যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ হবার আগে গেটিসবার্গ শহরের নাম কেউই জানতো না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে প্রশান্ত মহাসাগরের ছোট্ট দ্বীপ আইওজিমা-র নামও কেউ শোনেনি; যার দখল নেবার জন্যে বহু জাপানি ও মার্কিন সেনা হতাহত হয়েছিল। একুশ শতকে ইরাক যুদ্ধের আগেও ফালুজা শহরের নাম বেশিরভাগ মানুষ শোনেনি; যেখানে মার্কিনীরা বেশ কষ্ট করে শহরটার দখল নিয়েছিল।


‘আল জাজিরা’ বলছে যে, জাপানে ‘জি৭’ বৈঠকে জেলেন্সকি যখন বলেন যে, বাখমুত শহরের কিছুই অবশিষ্ট নেই, তখন তিনি হয়তো বোঝাতে চাইছিলেন যে, ইউক্রেন যদি বাখমুতের নিয়ন্ত্রণ হারায়, তাহলে রাশিয়া এই শহরের দখল নিয়ে তেমন কোন সুবিধা পাবে না। এই শহরের নিয়ন্ত্রণ হারাবার খবরটা ইউক্রেনিয়দের মনোবলকে আঘাত করবে এবং একইসাথে ইউক্রেনের বন্ধু দেশগুলির মাঝে দুশ্চিন্তার জন্ম দেবে। গত মার্চে প্রেসিডেন্ট জেলেন্সকি বলেছিলেন যে, যদি বাখমুতের পতন হয়, তবে রুশরা হয়তো যুদ্ধ বন্ধে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করতে পারে; যার মাধ্যমে ইউক্রেয়নিদেরকে হয়তো অগ্রহণীয় কোন প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য করা হতে পারে। অপরদিকে এই বিজয় রুশদের মনোবল বৃদ্ধি করবে; যারা গত ১০ মাসে বড় কোন বিজয় পায়নি। এখন রুশরা হয়তো আরও পশ্চিমে, বিশেষ করে ৫০ কিঃমিঃ দূরে ক্রামাটোরস্ক শহরের দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করতে পারে। গত ডিসেম্বরে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা দপ্তর বলে যে, বাখমুতের দখল নিতে পারলে রুশরা ক্রামাটোরস্ক এবং স্লোভিয়ানস্কএর মতো বড় শহরগুলির নিয়ন্ত্রণ নিতে চেষ্টা করতে পারে।

বাখমুত শহরের যুদ্ধক্ষেত্রের ছবিগুলি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিখা-যুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে আনে। শহরের তেমন কিছুই অবশিষ্ট নেই। আর এখানে কত সেনার মৃত্যু হয়েছে, তা এখনও কেউই বলতে পারে না। ‘বিবিসি’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, বাখমুতের যুদ্ধটা যতটা সামরিক, তার চাইতে বেশি রাজনৈতিক। রাশিয়ায় জনমতের জন্যে এই বিজয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একইসাথে ওয়াগনার গ্রুপের ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন এই যুদ্ধে তার পুরো সন্মানকে বিনিয়োগ করেছেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে, তার ভাড়াটে বাহিনী রুশ সেনাবাহিনীর চাইতে বেশি পারদর্শী। প্রিগোঝিন জনসন্মুখে রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু-র সমালোচনা করেছেন। কাজেই বাখমুতে বিজয় অর্জন ছাড়া প্রিগোঝিনের সামনে কোন পথই খোলা ছিল না। এই দুই ব্যক্তির মাঝে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হয়েছে বাখমুত। অস্ট্রেলিয় সেনাবাহিনীর প্রাক্তন মেজর জেনারেল মিক রায়ান ‘বিবিসি’কে বলছেন যে, বাখমুত ছাড়ার পর ইউক্রেনিয়রা ক্রামাটোরস্ক রক্ষা করার চেষ্টা করবে। আর যেহেতু এই এলাকাটার প্রতিরক্ষা বৃদ্ধি করতে তারা অনেক সময় পেয়েছে এবং শহরটা অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় অবস্থিত, তাই বাখমুতের চাইতে ক্রামাটোরস্ক রক্ষা করা অপেক্ষাকৃত সহজ হবে; যার অর্থ হলো ক্রামাটোরস্কের যুদ্ধ বাখমুতের যুদ্ধের মতো বা তার চাইতেও বেশি রক্তক্ষয়ী হতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, বাখমুতের যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে রুশরা দ্রুতই তাদের পরবর্তী আক্রমণে যেতে পারবে কিনা; অথবা ইউক্রেনিয়রা যত ক্ষতির সন্মুখীন হয়েছে, তাতে ইউক্রেনিয়দের বসন্তের বহুল প্রতিক্ষীত প্রতি-আক্রমণের ধার কমে যাবে কিনা।

No comments:

Post a Comment