Sunday 7 May 2023

ব্রিটিশ রাজের গুরুত্ব আসলে কতটুকু?

০৭ই মে ২০২৩

০৬ই মে ২০২৩। ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠান। ব্রিটেনের রাজার কাজ নয় শাসন করা; বরং রাজার কাজ হলো রাষ্ট্রের পরিচয় বহণ করা; এবং একইসাথে ব্রিটিশ কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলিকে ব্রিটিশ পরিচয় দেয়া। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলিকে ব্রিটেনের সাথে যুক্ত রাখার কৌশলটাই হলো ব্রিটিশ রাজ প্রথা। ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ‘প্রজাতন্ত্রী ইংল্যান্ড’এর সাথে এই দেশগুলির সেই সম্পর্ক থাকবে না; যতটা না রয়েছে ব্রিটিশ রাজের সাথে।

ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যু, অথবা রাজা তৃতীয় চার্লসের অভিষেকের মতো ঘটনাগুলি ব্রিটিশ রাজের কাজ, উদ্দেশ্য এবং প্রয়োজন নিয়ে প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসে। একুশ শতকে এসে অনেকেই ব্রিটেনের রাজ পরিবারের এই প্রথাগুলিকে বাতিল বলেই মনে করছেন। রাজা তৃতীয় চার্লসের অভিষেকের সময় কিছু মানুষের রাজ প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঘটনা সেই আলোচনাকেই আবারও সামনে নিয়ে আসছে। তবে প্রায় দু’শ বছর ধরে দুনিয়ার কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে ধরে রেখে পুরো বিশ্বের নিয়মগুলিকে নিজেদের মতো তৈরি করা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সুপারপাওয়ারের অবস্থান হারাবার পরেও বিশ্বব্যাপী প্রভাব ধরে রাখার পিছনে ব্রিটেনের রাজ প্রথার যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, তা অনস্বীকার্য।

ব্রিটিশ রাজা আসলে কি করেন?

ব্রিটিশ রাজের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হচ্ছে যে, রাজা থাকার মূল উদ্দেশ্য হলো জাতীয় পরিচয়, ঐক্য এবং গর্বকে জিইয়ে রাখা। এছাড়াও ব্রিটিশ রাজ রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতাকে তুলে ধরে; জনগণের সাফল্য এবং ভালো কাজকে স্বীকৃতি দেয়; স্বেচ্ছায় আত্মনিয়োগকে সমর্থন দেয়। এই কাজে রাজার সাথে থাকে রাজার কাছের পরিবারবর্গ। ‘ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ব্রিটেনের রাজা ক্ষমতায় থাকলেও শাসন করেন না; কারণ শাসনকাজ পরিচালনার দায়িত্ব সরকারের। সরকার যা উপদেশ দেবে, সংবিধান অনুযায়ী রাজা তা মানতে বাধ্য। প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য মন্ত্রীদের নিয়োগ দেয়া, পার্লামেন্টের সভা শুরু করা, নতুন কোন আইনে সম্মতি দেয়ার মতো ইত্যাদি আনুষ্ঠানিকতাতেই তার বেশিরভাগ কাজ সীমাবদ্ধ। বিদেশী রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাৎ করা এবং জ্যেষ্ঠ বিচারপতিদের নিয়োগ দেয়ার মতো কাজ রাজার হলেও এসকল ক্ষেত্রে সরকারের উপদেশ তিনি মানতে বাধ্য। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করে থাকেন এবং বিভিন্ন পত্রে স্বাক্ষর করেন। তবে যে ব্যাপারটা ব্রিটিশ রাজকে পৃথিবীর অন্য সকল রাজা থেকে আলাদা করছে তা হলো, ব্রিটিশ রাজ বিশ্বের আরও ১৪টা দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। এই দেশগুলির মাঝে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা এবং ক্যারিবিয়ানের বৃহৎ দ্বীপ জামাইকা। এছাড়াও রাজা হলেন কমনওয়েলথের প্রধান। কমনওয়েলথ হলো প্রধানতঃ প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশ এবং ব্রিটেনের উপর নির্ভরশীল থাকা ৫৪টা দেশের একটা সংস্থা।

‘টাইম’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, ব্রিটিশ রাজ প্রথার বিরুদ্ধে যখন বেশকিছু জনগণ বিক্ষোভ করছে, তখন এটা খতিয়ে দেখতেই হয় যে, রাজ প্রথা বাতিল করে দেয়া আসলেই কতটা সহজ হতে পারে। ব্রিটিশ রাজার প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতা খুবই সীমিত। তিনি নিজে রাজা থাকবেন কি থাকবেন না, সেই ক্ষমতা প্রকৃতপক্ষে তার হাতেই নেই। মন্ত্রীদের নিয়োগ দিলেও কারা মন্ত্রী হচ্ছেন, সেব্যাপারে রাজার কোন কিছুই বলার নেই। পার্লামেন্টের তৈরি করা আইনে সম্মতি দিলেও আইন তৈরিতে রাজার কোন ভূমিকাই নেই। ব্রিটিশ সমাজে রাজার অবস্থান হলো নিরপেক্ষতা; যা কিনা দলীয় রাজনীতিতে ছাড় দেয়ার নীতির বাইরে। রাজা শুধুমাত্র রাষ্ট্রকেই তার সেবা দিয়ে থাকেন। ‘ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন’এর প্রফেসর রবার্ট হেজেল ‘টাইম’কে বলছেন, রাজার থাকার অর্থই হলো তিনি কি কাজ করেন সেটা; এখানে তার বাছবিচারের কোন সুযোগই নেই। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথকে ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন রাষ্ট্রনেতার সাথে সাক্ষাৎ করতে হয়েছে; যাদের মাঝে ছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে এবং রোমানিয়ার একনায়ক নিকোলাই চসেস্কু। যদি রাজাকে বিলুপ্ত করতেই হয়, তাহলে সরকারকে প্রথমে গণভোটের আয়োজন করতে হবে; যা কিনা ব্রেক্সিটের সময় করা হয়েছিল। এরপর সেটা পার্লামেন্টে আইন আকারে পাস হতে হবে; সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে। এর আগে গণভোটের মাধ্যমে ইতালি এবং গ্রিসে রাজার অবস্থানকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হলেও বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, লুক্সেমবার্গ, নরওয়ে এবং স্পেনের মতো দেশগুলিতে রাজ প্রথাকে ধরে রাখা হয়েছে। এই মুহুর্তে ব্রিটেনে রাজ প্রথার পক্ষে জনসমর্থন বেশি থাকলেও ভবিষ্যতে তা না-ও থাকতে পারে। কারণ ২০২২ সালের এক জরিপে বলা হয় যে, ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মাঝে রাজ প্রথার পক্ষে সমর্থন ২০১১ সালে ৫৯ শতাংশ থেকে কমে মাত্র ৩৩ শতাংশে নেমে এসেছে।

রবার্ট হেজেল বলছেন যে, যদি রাজ প্রথা বিলুপ্ত হয়, তাহলে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাজার স্থানটা নেবেন প্রেসিডেন্ট। তবে রাজা যেখানে বংশানুক্রমিকভাবে রাজা হন, প্রেসিডেন্ট হবেন জনগণের ভোটে নির্বাচিত। তথাপি প্রেসিডেন্টের মতো একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান একইসাথে সাংবিধানিক আম্পায়ারের দায়িত্ব পালন করবেন; যা কিনা একজন রাজার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়।

 
কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলির অনেকগুলিই এখনও ব্রিটিশ আইনে চলে; তাদের সংবিধানও ব্রিটিশদের অনুসরণে তৈরি করা। চিন্তাগত দিক থেকে সেসব দেশের অনেক প্রভাবশালী মানুষ এখনও ব্রিটেনের কাছাকাছি থাকতে চায়; যদিও পরিবর্তিত বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত বিশ্বে তারা ঔপনিবেশিক সময় থেকে সরে আসার কথাই বলে থাকেন। ব্রিটিশ রাজের অবস্থান হয়তো এই ধোঁয়াশায় থাকা চিন্তার উপরেই - উপনিবেশও নয়; আবার পুরোপুরিভাবে প্রজাতন্ত্রও নয়; যা কিনা ব্রিটিশ চিন্তাটাকে ওয়াশিংটন-নিয়ন্ত্রিত বিশ্বে ভিন্নতা দিয়েছে।

অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা এবং ব্রিটিশ কমনওয়েলথ

খুব সম্ভবতঃ ব্রিটিশ রাজের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলির রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে অবস্থান ধরে রাখা। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, ক্যারিবিয়ানের বিভিন্ন দ্বীপ এবং সাবেক উপনিবেশ থাকা দেশগুলির উপরে ব্রিটিশ প্রভাব ধরে রাখার একটা পদ্ধতি হলো রাজ প্রথা। কিন্তু অনেকদিন ধরেই প্রশ্ন উঠছে যে, এই দেশগুলির ব্রিটিশ প্রভাবের অন্তর্ভুক্ত থাকার সময় ঘনিয়ে আসছে কিনা। ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, রাজা তৃতীয় চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠানের ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়দের মাঝে কোন আগ্রহই নেই। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী এন্থনি এলবানেসি একসময় বলেছিলেন যে, অস্ট্রেলিয়ার প্রজাতন্ত্র হয়ে যাওয়াটা অবশ্যম্ভাবী। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ক্রিস হিপকিন্সও বলছেন যে, নিউজিল্যান্ডও একদিন প্রজাতন্ত্র হবে। ২৫ বছর আগে এক গণভোটে অস্ট্রেলিয়ার জনগণ ব্রিটেনের সাথে রাষ্ট্রীয় এই সম্পর্ককে কর্তন করার বিপক্ষে রায় দিলেও আরও একবার গণভোট হয়তো বেশি দূরে নয়। তবে সাম্প্রতিক জনমত জরিপ বলছে যে, প্রজাতন্ত্রের পক্ষে মত এখনও গণভোটে পাস করার মতো যথেষ্ট নয়। এছাড়াও ব্রিটিশ রাজ থেকে আলাদা হতে হলে দেশের ছয়টা প্রদেশের মাঝে কমপক্ষে চারটার সম্মতি পেতে হবে।

‘বিবিসি’ বলছে যে, রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের জন্যে অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডাতে যতটা জনসমর্থন ছিলো, তৃতীয় চার্লসের জন্যে ততটা নেই। সাম্প্রতিক জনমত জরিপ বলছে যে, কানাডাতেও অর্ধেকের বেশি জনগণ ব্রিটিশ রাজের সাথে দূরত্ব তৈরি করার পক্ষপাতি। প্রায় ৪০ শতাংশ কানাডিয় রাজার অভিষেকের ব্যাপারে আগ্রহী নয়। বিশেষ করে কানাডার কুইবেক এবং ফরাসি ভাষাভাষি অন্যান্য অঞ্চলে ব্রিটিশ রাজের সাথে সম্পর্ককে একেবারেই ভালো চোখে দেখা হয় না। তবে ব্রিটিশ রাজ থেকে আলাদা হতে হলে কানাডার পার্লামেন্টের উচ্চ এবং নিম্নকক্ষের সম্মতি ছাড়াও দেশটার ১০টা রাজ্যের সবগুলির সর্বসম্মতি থাকতে হবে; যা অনেকেই মনে করেন প্রায় অসম্ভব।

‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তা এবং ব্রিটিশ রাজ

নিজেদের অর্থনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতা না থাকার পরেও ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ নামক চিন্তার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ব্রিটিশ প্রভাবকে ধরে রাখার যে চিন্তার উপর ভিত্তি করে ব্রিটিশরা ব্রেক্সিটের মাধ্যমে ইইউ থেকে আলাদা হয়েছিল, সেই চিন্তার মূলে রয়েছে কমনওয়েলথভুক্ত অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং কানাডাকে ব্রিটেনের আরও কাছাকাছি নিয়ে আসা। ব্যাপক সম্পদশালী এই দেশগুলি ভৌগোলিকভাবে ব্রিটেনের প্রভাবকে দুনিয়াব্যাপী ধরে রাখার হাতছানি দিচ্ছে। আর এই দেশগুলিকে ব্রিটেনের সাথে যুক্ত রাখার কৌশলটাই হলো ব্রিটিশ রাজ প্রথা। ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ‘প্রজাতন্ত্রী ইংল্যান্ড’এর সাথে এই দেশগুলির সেই সম্পর্ক থাকবে না; যতটা না রয়েছে ব্রিটিশ রাজের সাথে। ব্রিটেনের রাজার কাজ নয় শাসন করা; বরং রাজার কাজ হলো রাষ্ট্রের পরিচয় বহণ করা; এবং একইসাথে ব্রিটিশ কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলিকে ব্রিটিশ পরিচয় দেয়া। যে ব্যাপারটা নিশ্চিত তা হলো, অস্ট্রেলিয়া বা কানাডার মতো দেশগুলি আলাদাভাবে দুনিয়াতে যতটা প্রভাব রাখতে সক্ষম হবে, তা ব্রিটিশ পরিচয়ের ধারেকাছেও নয়। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলির অনেকগুলিই এখনও ব্রিটিশ আইনে চলে; তাদের সংবিধানও ব্রিটিশদের অনুসরণে তৈরি করা। চিন্তাগত দিক থেকে সেসব দেশের অনেক প্রভাবশালী মানুষ এখনও ব্রিটেনের কাছাকাছি থাকতে চায়; যদিও পরিবর্তিত বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত বিশ্বে তারা ঔপনিবেশিক সময় থেকে সরে আসার কথাই বলে থাকেন। ব্রিটিশ রাজের অবস্থান হয়তো এই ধোঁয়াশায় থাকা চিন্তার উপরেই - উপনিবেশও নয়; আবার পুরোপুরিভাবে প্রজাতন্ত্রও নয়; যা কিনা ব্রিটিশ চিন্তাটাকে ওয়াশিংটন-নিয়ন্ত্রিত বিশ্বে ভিন্নতা দিয়েছে।

No comments:

Post a Comment