Sunday 28 May 2023

তুরস্কের নির্বাচন… জাতীয়তাবাদই জয়ী

২৯শে মে ২০২৩

আঙ্কারা। ৩০শে এপ্রিল ২০২৩। একদিকে এরদোগান যেমন জনগণের ইসলামিক আবেগকে বুঝতে পেরে তার পররাষ্ট্র ও আঞ্চলিক নীতিতে উসমানি খিলাফতের সময়ের ‘প্যান-ইসলামিক’ ইতিহাসকে ব্যবহার করেছেন, তেমনি অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে তুর্কি জাতীয়তাবাদের সাথে ইসলামকে সংমিশ্রিত করেছেন। ফলাফল হিসেবে তুর্কি নির্বাচনে অর্থনৈতিক দৈন্যতাকে ছাপিয়ে জাতীয়তাবাদের প্রাধান্য এরদোগানের রাজনৈতিক তীক্ষ্ণতাকেই তুলে ধরে। তথাপি মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং এশিয়ার মুসলিম দেশগুলির সাথে অর্থনৈতিক এবং সামরিক সম্পর্কোন্নয়ন এবং পূর্ব ইউরোপের সাবেক উসমানি এলাকাগুলিতে প্রভাব বিস্তার তুরস্কের জনগণের আকাংক্ষারই অংশ।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যখন দ্বিতীয় পর্যায়ে গড়ায়, তখনই অনেকেই ধারণা করেছিলেন যে, প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগানই জয়লাভ করবেন; কারণ নেতৃত্বের দিক দিয়ে তিনি অধিকতর বলিষ্ঠ এবং নির্বাচন জেতার ক্ষেত্রে তার অভিজ্ঞতাও বেশি। এরদোগানের জয়লাভ তুরস্কের অভ্যন্তরীণ সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের জন্যে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও যথেষ্ট গুরুত্ববহ। কারণ এরদোগানের জন্যে সবচাইতে চ্যালেঞ্জিং এই নির্বাচনে সর্বাধিক ব্যবহৃত চিন্তাটা ছিল তুর্কি জাতীয়তাবাদ।

এরদোগান প্রথম পর্যায়ের নির্বাচনে ৪৯ শতাংশের বেশি ভোট পাবার পর ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, তুরস্কে মুদ্রাস্ফীতি ৪৩ শতাংশ হবার পরেও কেউ কেউ বলেছেন যে, আলু এবং পিঁয়াজের মূল্য বাড়ুক বা কমুক, এরদোগান তাদের আশা হিসেবেই থাকবেন। নির্বাচনের আগে জনমত জরিপের ফলাফলে এরদোগান সর্বদাই পিছিয়ে থাকলেও তা শেষ পর্যন্ত ভুল প্রমাণিত হলো। ‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সমস্যা এবং ভূমিকম্প-পরবর্তী সরকারি উদাসীনতার অভিযোগের পরেও এরদোগানের পক্ষে এই ফলাফল অনেকেই আশা করেননি। এরদোগানের বিরোধীরা অর্থনীতিকেই ব্যবহার করেছেন নির্বাচনী প্রচারণায়।

‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’ বলছে যে, তুরস্কের অনেক ভোটারই এরদোগানের সমর্থক না হলেও তারা তাকে পরিবর্তন করতে চাননি। কারণ তারা এরদোগানের প্রতিদ্বন্দ্বী সম্পর্কে তেমন কিছু জানেনই না। তবে যে ব্যাপারটাতে তারা একমত তা হলো, নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে এরদোগান নিঃসন্দেহে অগ্রগামী। প্যারিস-ভিত্তিক এনজিও ‘আরএসএফ’ বলছে যে, গত এপ্রিল মাসে তুরস্কের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল ‘টিআরটি’তে এরদোগান তার প্রতিদ্বন্দ্বীর চাইতে ৬০ গুণ বেশি কভারেজ পেয়েছেন। এর আগে ২০১৮ সালে তুরস্কের মিডিয়া এবং আদালতের স্বাধীনতাকে উল্লেখ করে ‘ফ্রিডম হাউজ’ নামের পশ্চিমা আরেকটা এনজিও তুরস্কের গণন্ত্রকে ‘আংশিক স্বাধীন’ থেকে নামিয়ে ‘স্বাধীন নয়’ ক্যাটাগরিতে স্থান দিয়েছে।

‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যারা এরদোগানের সমর্থক না হয়েও তাকে ভোট দিয়েছেন, তারা বলেছেন যে, এরদোগানের প্রতিদ্বন্দ্বী কেমাল কিলিচদারোগলু যেসকল প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেগুলি তিনি কতটা বাস্তবায়ন করতে পারবেন, সেব্যাপারে তারা নিশ্চিত নন। অপরদিকে এরদোগানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে তারা নিশ্চিত নন; কারণ তিনি সেতু এবং মসজিদ তৈরি করেছেন। এবং তিনি তুর্কি জাতিকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাবার কথা বলেছেন; যা কিনা তুর্কিদের জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিয়েছে। অপরদিকে পশ্চিমা স্বাধীনচেতা ধ্যানধারণায় অধিকতর বিশ্বাসীরা অনেকেই এরদোগানের বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন; যাদের মাঝে রয়েছেন নারীবাদী এবং সমকামিতার সমর্থকেরা। নির্বাচনের আগে আগে ‘ডয়েচে ভেলে’র সাথে এক সাক্ষাতে এরদোগানের প্রতিদ্বন্দ্বী কেমাল কিলিচদারোগলু বলেন যে, তিনি নির্বাচনে জিতলে তুরস্ককে পশ্চিমাদের আরও কাছে নিয়ে যাবেন; কারণ তারা কথায়, সেটাই তুরস্কের ভবিষ্যৎ।

‘বিবিসি’ বলছে যে, তুরস্কের নির্বাচনে যে ব্যাপারটা সকলেই ব্যবহার করেছেন, তা হলো জাতীয়তাবাদ। কে কার চাইতে বেশি জাতীয়তাবাদী, সেটা প্রমাণ করেই সকলে ভোট চেয়েছেন। তুরস্কের এবারের পার্লামেন্ট ইতিহাসের সবচাইতে বেশি জাতীয়তাবাদী পার্লামেন্ট। এরদোগান প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তিনি নির্বাচনে জয়ী হলে নতুন ‘তুর্কি শতাব্দী’র সূচনা করবেন। তার সমর্থকেরা বলছেন যে, এরদোগান আরও উন্নয়ন এবং আরও শক্তিশালী তুরস্ক উপহার দেবেন। অপরদিকে কিলিচদারোগলু প্রথমদিকে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারকে গুরুত্ব দিলেও কিছুদিন আগেই নির্বাচনী জনসভায় ঘোষণা দেন যে, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে সকল সিরিয় শরণার্থীকে দেশে ফেরত পাঠাবেন। কিলিচদারোগলুর এরূপ জাতীয়তাবাদী বক্তব্য তুরস্কে অনেকেই পছন্দ করেছে। প্রথম পর্যায়ের নির্বাচনে জয়ী না হবার পর তিনি ডানপন্থীদের আকৃষ্ট করতে আরও বেশি সচেষ্ট হয়েছেন।

ইস্তাম্বুল। ২৯শে মে ২০১৬। কন্সটানটিনোপল বিজয়ের ৫৬৩তম বার্ষিকীতে এরদোগান। এরদোগানের প্রতিটা কর্মকান্ডের মাঝেই ছিল শক্তিশালী জাতি, ইসলামিক আবেগ এবং ঐতিহাসিক গৌরবের ইঙ্গিত। ১৪৫৩ সালের ২৮শে মে তৎকালীন বাইজ্যানটাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্সটানটিনোপলের উপর সুলতান দ্বিতীয় মেহমেত চুড়ান্ত আক্রমণ শুরু করেছিলেন; যার ফলশ্রুতিতে এর পরদিন মুসলিম সেনাবাহিনীর হাতে শহরটার পতন হয় এবং সুলতান মেহমেত বিজয়ীর বেশে শহরে প্রবেশ করেন। এই শহরটার নামই এখন ইস্তাম্বুল। এবারের নির্বাচনেও এরদোগান সেরকমই পরিকল্পনা করেছেন- বিজয়ী হলে ২৯শে মে কন্সটানটিনোপল বিজয়ের ৫’শ ৭০তম বার্ষিকীতে তিনি বিজয়ীর বেশে ইস্তাম্বুলে প্রবেশ করবেন।

গত ২৩শে এপ্রিল তুরস্কের নৌবাহিনীর প্রথম বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘আনাদোলু’র উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেন যে, তিনি আশা করছেন যে, এই যুদ্ধজাহাজ বিশ্বে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্কের নাম তুলে ধরতে সহায়তা করবে। ‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’এর বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, এরদোগানের প্রতিটা কর্মকান্ডের মাঝেই ছিল শক্তিশালী জাতি, ইসলামিক আবেগ এবং ঐতিহাসিক গৌরবের ইঙ্গিত। আর এই ইঙ্গিতটাই এরদোগানকে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে আলাদা করেছে বারংবার। ১৪৫৩ সালের ২৮শে মে তৎকালীন বাইজ্যানটাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্সটানটিনোপলের উপর সুলতান দ্বিতীয় মেহমেত চুড়ান্ত আক্রমণ শুরু করেছিলেন; যার ফলশ্রুতিতে এর পরদিন মুসলিম সেনাবাহিনীর হাতে শহরটার পতন হয় এবং সুলতান মেহমেত বিজয়ীর বেশে শহরে প্রবেশ করেন। এই শহরটার নামই এখন ইস্তাম্বুল। এবারের নির্বাচনেও এরদোগান সেরকমই পরিকল্পনা করেছেন- বিজয়ী হলে ২৯শে মে কন্সটানটিনোপল বিজয়ের ৫’শ ৭০তম বার্ষিকীতে তিনি বিজয়ীর বেশে ইস্তাম্বুলে প্রবেশ করবেন।

‘দ্যা নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এরদোগান ক্ষমতাসীন থাকার সময় তুরস্কের সংস্কৃতিতে অটোমান বা উসমানি খিলাফতের সময়ের ঐতিহ্যকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। উসমানি সময়ের বিভিন্ন স্থাপনা উন্মুক্ত করা এবং সেই সময়ের আদলে নতুন করে মসজিদ তৈরি করা ছাড়াও ঐতিহাসিক টেলিভিশন সিরিয়াল বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে এরদোগান তার ইমেজকে যতটা না ইসলামিক দেখিয়েছেন, তার চাইতে বেশি জাতীয়তাবাদের মোড়কে সাজিয়েছেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বীরাও সেটাই করেছেন; ঠিক যে ব্যাপারটা যুক্তরাষ্ট্রেও দেখা গিয়েছে। তুরস্কে সাম্প্রতিক সময়ে আর্মেনিয় বা কুর্দি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ধরপাকড় চলেছে; অনেকের উপরে আক্রমণও হয়েছে; যা কিনা ডানপন্থী জাতীয়তাবাদের উত্থানকেই দেখিয়ে দিচ্ছে। একসময়ের কেমালিস্টরাও জাতীয়তাবাদকে তুলে ধরতে কেমাল আতাতুর্কের অর্জনগুলিকে তুলে ধরেছে। আর এরদোগানের সময়ের জাতীয়তাবাদীরা এর সাথে ইসলামকে সংমিশ্রিত করেছে। সেই আলোকেই ইস্তাম্বুলে ‘প্যানোরামা ১৪৫৩ হিস্টোরি মিউজিয়াম’ তৈরি করা হয়েছে; যেখানে সুলতান মেহমেতের কন্সটানটিনোপল বিজয়কে হাইলাইট করা হয়েছে।

একদিকে এরদোগান যেমন জনগণের ইসলামিক আবেগকে বুঝতে পেরে তার পররাষ্ট্র ও আঞ্চলিক নীতিতে উসমানি খিলাফতের সময়ের ‘প্যান-ইসলামিক’ ইতিহাসকে ব্যবহার করেছেন, তেমনি অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে তুর্কি জাতীয়তাবাদের সাথে ইসলামকে সংমিশ্রিত করেছেন। ফলাফল হিসেবে তুর্কি নির্বাচনে অর্থনৈতিক দৈন্যতাকে ছাপিয়ে জাতীয়তাবাদের প্রাধান্য এরদোগানের রাজনৈতিক তীক্ষ্ণতাকেই তুলে ধরে। তথাপি মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং এশিয়ার মুসলিম দেশগুলির সাথে অর্থনৈতিক এবং সামরিক সম্পর্কোন্নয়ন এবং পূর্ব ইউরোপের সাবেক উসমানি এলাকাগুলিতে প্রভাব বিস্তার তুরস্কের জনগণের আকাংক্ষারই অংশ। তবে একইসাথে তা সিরিয়া, লিবিয়া এবং আজেরবাইজানের মতো আঞ্চলিক সংঘাতে জড়ানো ছাড়াও গ্রিস, আর্মেনিয়া এবং ফ্রান্সের মতো দেশের সাথে উত্তেজনা বৃদ্ধি করেছে; যার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব এই নির্বাচনের ফলাফলে আরও বৃদ্ধি পেলো।

No comments:

Post a Comment