Saturday 20 May 2023

ব্রিটিশরা ইউক্রেনকে দূর পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করছে কেন?

২০শে মে ২০২৩

ব্রিটিশ 'স্টর্ম শ্যাডো' ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। ইউক্রেন যাতে ব্রিটিশ ক্ষেপণাস্ত্র রাশিয়ার অভ্যন্তরে ব্যবহার না করে, সেটার গ্যারান্টি কিন্তু ওয়াশিংটনকে লন্ডনের কাছ থেকেই নিতে হবে। অর্থাৎ ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক কম বিনিয়োগ করলেও ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণের রজ্জু ব্রিটিশরা তাদের হাতে রাখতে চাইছে। রাশিয়ার সাথে পশ্চিমাদের উত্তেজনা কতটা বৃদ্ধি পাবে, সেটার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে লন্ডন এবং ওয়াশিংটনের মাঝে রয়েছে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা; যা যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে প্রভাবিত করার ব্রিটিশ প্রচেষ্টারই অংশ।

ব্রিটেন ইউক্রেনকে ‘স্টর্ম শ্যাডো’ নামের ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করার ঘোষণা দেয়ার পর তা মিডিয়াতে বেশ আলোচিত হচ্ছে। ‘সিএনএন’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা ‘হিমারস’ আর্টিলারি রকেটের পাল্লা প্রায় ৮০ কিঃমিঃ; যার তুলনায় ‘স্টর্ম শ্যাডো’র পাল্লা প্রায় আড়াই’শ কিঃমিঃ। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি যুদ্ধবিমান থেকে ছোঁড়া হয়ে থাকে। মার্কিন বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল সেডরিক লেইটন ‘সিএনএন’কে বলছেন যে, এই ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রগুলি দেড়’শ ফুটের কম উচ্চতা দিয়ে উড়ে গিয়ে টার্গেটে হামলা করে বলে এগুলি খুঁজে পাওয়া বেশ কষ্টকর। ইউক্রেনিয়রা বলছে যে, তারা এগুলিকে রাশিয়ার ভূখন্ডের ভেতর হামলায় ব্যবহার করবে না। তবে যেহেতু ব্রিটেন ক্রিমিয়া উপদ্বীপকে ইউক্রেনের অংশ বলে স্বীকৃতি দেয়, তাই এগুলি হয়তো ক্রিমিয়ায় রুশ সামরিক ঘাঁটির বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে। মার্কিনীর ইউক্রেনের অনুরোধ সত্ত্বেও ৩’শ কিঃমিঃ পাল্লার ‘এটাকমস’ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করতে রাজি হয়নি। ‘স্টর্ম শ্যাডো’র পাল্লা কিছুটা কম হলেও তা ‘এটাকমস’এর চাইতে আরও অনেক বেশি সক্ষমতার; কারণ এটাকে ধ্বংস করা বেশ কঠিন।

ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’ বা ‘রুসি’র সিনিয়র ফেলো জ্যাক ওয়াটলিং এক লেখায় ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন যে, ২০২২ সালের দ্বিতীয়ার্ধে মার্কিনীরা ইউক্রেনিয়দেরকে ‘হিমারস’ আর্টিলারি রকেট এবং এর সাথে প্রয়োজনীয় ইন্টেলিজেন্স সরবরাহ করার পর থেকে রুশ লজিস্টিকস ব্যবস্থা এবং কমান্ড সেন্টারগুলি চাপের মাঝে পড়েছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে রুশরা তাদের কমান্ড সেন্টারগুলি এবং লজিস্টিকস হাবগুলিকে ফ্রন্টলাইন থেকে ১’শ ২০ কিঃমিঃ দূরে বা রকেটের পাল্লার বাইরে নিয়ে গিয়েছে।

রুশ কমান্ড সেন্টারগুলি এখন শক্তিশালী বাংকারের ভেতরে স্থাপন করা হয়েছে; যা রকেটের পক্ষে ধ্বংস করা সম্ভব নয়। তবে ‘স্টর্ম শ্যাডো’র ওয়ারহেড এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যাতে করে তা শক্তিশালী বাংকার ধ্বংস করতে পারে। রুশরা তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থাও যথেষ্ট উন্নত করেছে; যার ফলে ইউক্রেনিয়রা আক্রমণে গেলেই রুশ আর্টিলারি তাদের মারাত্মক চাপের মাঝে ফেলছে। রুশরা তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ব্যাপকভাবে শক্তিশালী করেছে। তবে ‘স্টর্ম শ্যাডো’ ক্ষেপাস্ত্রগুলি আকাশ প্রতিরক্ষা রাডারের পক্ষে খুঁজে বের করা বা ধ্বংস করা কষ্টকর।

ওয়াটলিং বলছেন যে, এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ইউক্রেনের হাতে যাবার কারণে রাশিয়া তার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখতে বাধ্য হবে। আর ক্রিমিয়া উপদ্বীপের রুশ বিমান ঘাঁটিগুলিতে এই ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা করলে সেই ঘাঁটির বিমানগুলি ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সময়ের জন্যে বাধা দিতে পারবে না। একইসাথে ইউক্রেনিয়রা এই ক্ষেপণাস্ত্রকে নিজেদের হাতে রেখে দিয়েই রুশদেরকে মানসিকভাবে চাপের মাঝে ফেলতে পারে।



ব্রিটেনের ‘এক্সপ্রেস’ পত্রিকার সাথে সাক্ষাতে ‘রুসি’র ডিরেক্টর নীল মেলভিন বলছেন যে, ‘স্টর্ম শ্যাডো’ ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ইউক্রেনের সক্ষমতাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে এবং যুদ্ধক্ষেত্রকে তারা যথেষ্টই প্রভাবিত করতে পারবে। তবে কোন একটা অস্ত্র পুরো যুদ্ধের মোড় পরিবর্তন করতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিনীরা ইউক্রেনকে ‘হিমারস’ আর্টিলারি রকেট দেয়ার পর থেকে রুশরা সেই অনুযায়ী নিজেদের কর্মকান্ডকে পরিবর্তন করেছে; যা কিনা যুদ্ধক্ষেত্রে ‘হিমারস’এর প্রভাবকে অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। কাজেই যুদ্ধক্ষেত্রে কৌশলগত পরিবর্তন আনতে হলে ইউক্রেনকে পশ্চিমাদের কাছ থেকে পাওয়া সাঁজোয়া যান, ক্ষেপণাস্ত্র, মাইন অপসারণ প্রযুক্তি, যুদ্ধবিমান, ব্রিজ তৈরির সরঞ্জাম, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, পদাতিক বাহিনীর ট্রেনিং, ইন্টেলিজেন্স এবং লজিস্টিকসের সমন্বয় ঘটাতে হবে; যোগাযোগের যথেষ্ট ব্যবহার করতে হবে এবং নিজেদের পক্ষে একটা ভরবেগ তৈরি করতে হবে। ইউক্রেনের হাতে এই ক্ষেপণাস্ত্রের অর্থ হলো, রুশরা কমান্ড সেন্টার, রসদের মজুত বা জ্বালানির ডিপোর মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলিকে এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লার বাইরে সরিয়ে নিতে বাধ্য হবে। এতে যুদ্ধক্ষেত্রে রুশদের সমন্বয় কিছুটা হলেও চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়বে।

জ্যাক ওয়াটলিং বলছেন যে, যুদ্ধের মাঝে বিশেষ কিছু অস্ত্র নিয়ে এত বেশি আলোচনা হচ্ছে যে, যুদ্ধকৌশলের গুরুত্বটা সকলেই ভুলে যাচ্ছেন; যা কিনা যুদ্ধের মোড় ঘোরাবার জন্যে সবচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ‘স্টর্ম শ্যাডো’ ক্ষেপণাস্ত্রগুলির একেকটার মূল্য প্রায় ১০ লক্ষ ডলার। ব্রিটেন ইউক্রেনকে যুদ্ধের মোড় ঘোরাবার মতো যথেষ্ট সংখ্যক ‘স্টর্ম শ্যাডো’ ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করতে পারবে না। কিন্তু যদি ইউক্রেন এগুলিকে চতুরতার সাথে ব্যবহার করে, তাহলে যুদ্ধক্ষেত্রে কিছু ফাঁকা ক্ষেত্র তারা তৈরি করতে সক্ষম হতে পারে; যা কিনা তাদেরকে যুদ্ধের মোড় ঘোরাবার মতো সুযোগ করে দিতে পারে।

মার্কিন কর্নেল সেডরিক লেইটন বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র চাইছে না যে তাদের সরবরাহকৃত অস্ত্র রাশিয়ার ভূখন্ডের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হোক। কারণ ওয়াশিংটন মনে করছে যে, এতে রাশিয়ার সাথে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পাবে। তাই তারা হয়তো ইউক্রেনের উপর চাপ অব্যাহত রাখবে যাতে করে ইউক্রেন ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে রুশ ভূখন্ডের বিরুদ্ধে ব্যবহার না করার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। জ্যাক ওয়াটলিং ব্রিটিশ সিদ্ধান্তকে সমর্থন দিয়ে বলছেন যে, ‘স্টর্ম শ্যাডো’র মাধ্যমে যুদ্ধের পরিধি বেড়ে গেছে চিন্তা না করে বরং বুঝতে হবে যে, যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনের কিছু সক্ষমতার ঘাটতি পূরণে এগুলি ব্রিটিশরা তাদেরকে দিচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতামতগুলি দেখিয়ে দেয় যে, ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে ব্রিটিশ এবং মার্কিন চিন্তার পার্থক্য দৃশ্যমান। মার্কিনীরা চিন্তিত যে, ‘স্টর্ম শ্যাডো’ ক্ষেপাস্ত্রের কারণে রুশদের সাথে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পাবে কিনা। ইউক্রেন যাতে ব্রিটিশ ক্ষেপণাস্ত্র রাশিয়ার অভ্যন্তরে ব্যবহার না করে, সেটার গ্যারান্টি কিন্তু ওয়াশিংটনকে লন্ডনের কাছ থেকেই নিতে হবে। অর্থাৎ ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক কম বিনিয়োগ করলেও ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণের রজ্জু ব্রিটিশরা তাদের হাতে রাখতে চাইছে। এর আগে ইউক্রেনকে ট্যাংক দেবার ক্ষেত্রে ব্রিটিশরা সবচাইতে অগ্রগামী ভূমিকা নিয়েছিল। ইউক্রেনকে পশ্চিমা যুদ্ধবিমান সরবরাহ করার ব্যাপারেও ব্রিটিশরা সবচাইতে বেশি কথা বলছে। আবার রুশরাও ২০২২এর অক্টোবরে অভিযোগ করে যে, ব্রিটিশরা বল্টিক সাগরের ‘নর্ড স্ট্রিম’ পাইপলাইনে হামলায় জড়িত ছিল; এবং ব্রিটিশরা সেভাস্তোপোল বন্দরে রুশ নৌবাহিনীর উপর হামলায় ইউক্রেনিয়দেরকে সহায়তা দিয়েছে। মোটকথা, রাশিয়ার সাথে পশ্চিমাদের উত্তেজনা কতটা বৃদ্ধি পাবে, সেটার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে লন্ডন এবং ওয়াশিংটনের মাঝে রয়েছে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা; যা যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে প্রভাবিত করার ব্রিটিশ প্রচেষ্টারই অংশ।

No comments:

Post a Comment