Tuesday 30 May 2023

বাংলাদেশের নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা হুমকি… নেপথ্যে কি?

৩০শে মে ২০২৩

মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন যে, ‘জিসোমিয়া’ চুক্তি স্বাক্ষর করলে বাংলাদেশ অত্যাধুনিক মার্কিন প্রযুক্তির যুদ্ধ সরঞ্জাম কিনতে পারবে; যার মাঝে শুরুতেই থাকবে ‘এফ-১৬’ ফাইটার বিমান। এই চুক্তি শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তির জন্যে নয়; উভয় পক্ষের। যুক্তরাষ্ট্র প্রযুক্তিকে সামরিক তথ্যের ক্যাটাগরিতে ফেলেছে। এই চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিটা দেশের ইন্টেলিজেন্স সক্ষমতাকে নিজের কাজে লাগাবার ব্যবস্থা করেছে। অর্থাৎ এই দেশগুলি বিশ্বব্যাপী তাদের ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে যা তথ্য সংগ্রহ করবে, সেটা তারা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শেয়ার করতে বাধ্য থাকবে। 

সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনে বাধা প্রদানকারী যেকোন ব্যক্তি এবং তার পরিবর্গকে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা দেয়া হবে না। খবরটা মুহুর্তের মাঝে পুরো বাংলাদেশে আলোচনার খোরাক হয়ে গিয়েছে। কারণ বাংলাদেশে অনেক মানুষই যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের স্বপ্নের দেশ হিসেবেই দেখে। বিশেষ করে তারা অনেকেই চায় যে তাদের সন্তানরা যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করুক, অথবা সেখানে বসবাস করুক, অথবা তারা নিজেরাই কোন একদিন তল্পিতল্পা বিক্রি করে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পথে পাড়ি জমাবার স্বপ্ন দেখে থাকেন। ঠিক এই ব্যাপারটাকেই কাজে লাগিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলাফলস্বরূপ, ঘোষণার পরের দিনই ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দলীয় নেতারা একত্রে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে ভীড় করেছেন। অনেকেই ধারণা করছেন যে, এই ঘোষণার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে চাইছে। আবার অনেকেই বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী অনেক দেশের সাথেই সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে, যেখানে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের টিকিটাও নেই। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিমুখী নীতির দিকে তারা আঙ্গুল তাক করছেন। তারা অনেকেই মত দিচ্ছেন যে, সাম্প্রতিক সময়ে চীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমাতে বাংলাদেশের নির্বাচনের সুযোগটাকে ব্যবহার করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। এখানে গণতন্ত্র রক্ষার কথাগুলি ফাঁকা বুলি ছাড়া কিছুই নয়।

একটু গভীরে গেলেই দেখা যাবে যে, মূলতঃ ভিসা না দেয়ার হুমকি প্রদানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে; যাতে করে তারা বিভিন্ন খাতে বিশেষ সুবিধা আদায় করে নিতে পারে। এই সুবিধাগুলির মাঝে রয়েছে বহুদিন থেকে ঝুলে থাকা দু’টা সামরিক চুক্তি; যা কিনা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ স্বাক্ষর করতে রাজি হচ্ছিলো না। এই দু’টা চুক্তি হলো ‘আকসা’ এবং ‘জিসোমিয়া’। যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্যগুলি পুরোপুরিভাবে অনুধাবন করতে হলে এই চুক্তি দু’টার বৈশিষ্ট্যগুলি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ।

‘আকসা’ … বাংলাদেশের আকাশসীমা, সমুদ্রসীমা, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দরের ব্যবহার

‘একুইজিশন ক্রস সার্ভিসিং এগ্রিমেন্ট’ বা ‘আকসা’ চুক্তির মাঝে বলা হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্য যে দেশ এই চুক্তি করবে, তারা একে অপরের সামরিক বাহিনীকে বিভিন্ন প্রকারের লজিস্টিক সহায়তা দেবে। এসব সহায়তার মাঝে রয়েছে খাবার, পানি, কাপড়চোপড়, পরিবহণ, ট্রেনিং, পেট্রোলিয়াম, গোলাবারুদ, মেইনটেন্যান্স, মেডিক্যাল সার্ভিস, ইত্যাদি। মার্কিন কর্মকর্তারা উদাহরণ দিয়ে বলছেন যে, এই চুক্তি মোতাবেক একটা মার্কিন যুদ্ধজাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসে জ্বালানি নিতে পারে; যার বিনিময়ে বাংলাদেশ পেমেন্ট পাবে। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরে তো অনেক দেশের যুদ্ধজাহাজই আসে। এখানে চুক্তির প্রয়োজন কেন? এখানেই আসল ফাঁকিটা রয়ে যাচ্ছে। এই চুক্তি মোতাবেক কোন মার্কিন যুদ্ধজাহাজ বা যুদ্ধবিমান বাংলাদেশে আসলে তাকে বাংলাদেশ মানা করতে পারবে না। অর্থাৎ এতদিন বাংলাদেশে যেসকল মার্কিন সামরিক বিমান এবং যুদ্ধজাহাজ এসেছে, সেগুলি এসেছে বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে। ‘আকসা’ চুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশের আমন্ত্রণ ছাড়াও তারা যেকোন সময়ে আসতে পারবে। এবং যদি তারা আসে, তাহলে বাংলাদেশ তাদেরকে এই দেশের বিমানবন্দর এবং সমদ্রবন্দরে ঢুকতে দিতে বাধ্য। চুক্তি মোতাবেক এই যুদ্ধবিমান বা জাহাজগুলি তেল নেয়া বা অন্য যেকোন সার্ভিস নেবার অজুহাতে বাংলাদেশে আসতে পারবে।

পুরো ব্যাপারটা অনেক জটিল হয়ে যাবে যদি এখানে সম্ভাব্য যুদ্ধ পরিস্থিতিকে যোগ করা হয়। যেমন, ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের সময়ে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রকে তার বিমান ঘাঁটি এবং আকাশসীমা ব্যবহারে আপত্তি জানিয়েছিল। কারণ ইরাক যুদ্ধের জন্যে তুরস্কে জনসমর্থন ছিলো না। যুক্তরাষ্ট্র তখন অভিনব উপায়ে তুরস্ককে সহযোগিতা করতে বাধ্য করেছিল। একটা মার্কিন সামরিক বিমান উত্তর ইরাকে উড়তে গিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে তুরস্কের বিমান ঘাঁটিতে অবতরণ করে। এরপর থেকে তুরস্কের পুরো আকাশসীমাই মার্কিনীদের সামরিক মিশনের জন্যে খুলে যায়।

বাংলাদেশ যদি তার আকাশসীমা চীনের বিরুদ্ধে কোন যুদ্ধে ব্যবহার করতে দিতে ইচ্ছুক না হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্র ‘আকসা’ চুক্তিকে কাজে লাগাবে এবং যেকোন অজুহাতে তাদের বিমান বাংলাদেশে অবতরণ করাবে বা অবতরণ না করিয়েই বাংলাদেশের আকাশসীমা ব্যবহার করবে। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরে কোন মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ থেকে ওড়া ‘ইএ-১৮জি গ্রাওলার’ ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার বিমান বা ‘ই-২ডি হকআই’ এয়ারবোর্ন রাডার বিমান বা ট্যাংকার বিমান জ্বালনি খরচ কমাতে বাংলাদেশের আকাশসীমা ব্যবহার করবে।

ঠিক এরকম একটা ব্যাপার যদি ভারত-চীনের অরুণাচল প্রদেশ সীমানায় ঘটে, তাহলে কি হতে পারে? ভারত-চীন সম্ভাব্য সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র যে ভারতকে সামরিক সহায়তা দেবে, তা নিশ্চিত। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এমন কিছু সহায়তা ভারতকে দেবে, যা ভারতের নেই; যার মাঝে থাকতে পারে গোয়েন্দা বিমান এবং ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার বিমানের সহায়তা। এই বিমানগুলি সহজে অরুণাচল পর্যন্ত পৌঁছাতে গেলে বাংলাদেশের আকাশসীমা ব্যবহার করতে চাইবে। এখন বাংলাদেশ যদি তার আকাশসীমা চীনের বিরুদ্ধে কোন যুদ্ধে ব্যবহার করতে দিতে ইচ্ছুক না হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্র ‘আকসা’ চুক্তিকে কাজে লাগাবে এবং যেকোন অজুহাতে তাদের বিমান বাংলাদেশে অবতরণ করাবে বা অবতরণ না করিয়েই বাংলাদেশের আকাশসীমা ব্যবহার করবে। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরে কোন মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ থেকে ওড়া ‘ইএ-১৮জি গ্রাওলার’ ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার বিমান বা ‘ই-২ডি হকআই’ এয়ারবোর্ন রাডার বিমান বা ট্যাংকার বিমান জ্বালনি খরচ কমাতে বাংলাদেশের আকাশসীমা ব্যবহার করবে। ভারত মহাসগরে মার্কিন বিমান ঘাঁটি দিয়েগো গার্সিয়া থেকে উড়ে আসা ‘বি-৫২’, ‘বি-১বি’ অথবা ‘বি-২’ বোমারু বিমানও বাংলাদেশের আকাশসীমা ব্যবহার করতে চাইবে। একইসাথে তাদের যুদ্ধজাহাজগুলিও বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা এবং সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করবে। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের একটা সামরিক মহড়ায় কোলকাতার কাছাকাছি কালাইকুন্ড বিমান ঘাঁটিতে ‘এফ-১৫ই’ ফাইটার বিমান ও ‘বি-১বি’ বোমারু বিমান মোতায়েন তাদের এই পরিকল্পনাটাকেই তুলে ধরে। মোটকথা, যুক্তরাষ্ট্র ‘আকসা’ চুক্তির মাধ্যমে খুব সহজেই বাংলাদেশের বিমান ঘাঁটি, সমুদ্রবন্দর, আকাশসীমা এবং সমুদ্রসীমা চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে। এখানে বাংলাদেশের বলার কিছুই থাকবে না।

এখন যে কোন দেশই বলতে পারে যে, তারা যুক্তরাষ্ট্রকে এসকল লজিস্টিক্যাল সুবিধা দিতে ইচ্ছুক নয়। এরকম একটা দেশকে যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে রাজি করাবে চুক্তি করতে? এই কাজটা তারা বাস্তবায়িত করছে সামরিক ক্ষেত্রে নির্ভরশীলতা তৈরির মাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলছেন যে, বাংলাদেশ খুব সহজেই এই চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত ‘মেটাল শার্ক’ বোটগুলির স্পেয়ার পার্টস পাবে এবং বাংলাদেশের সামরিক সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে ট্রেনিং পাবে। গত দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী, বিশেষ করে স্পেশাল ফোর্সকে ট্রেনিং এবং অস্ত্র দিয়েছে। এখন সেই ট্রেনিং এবং অস্ত্র অব্যাহত রাখতে তারা বলছে যে, ‘আকসা’ চুক্তি করতে হবে। বাংলাদেশে কেউ কেউ এই ‘সুযোগ’ হাতছাড়া করতে চাইছে না। তারা হয়তো মনে করতে পারেন যে, এই চুক্তি না করলে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী এসকল আধুনিক প্রযুক্তি ও ট্রেনিং থেকে বঞ্চিত হবে। ঠিক এই নির্ভরশীলতাটাই যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করে এবং চুক্তি স্বাক্ষরের জন্যে ব্যবহার করে। স্পেয়ার পার্টস এবং ট্রেনিং পেতে হলে বাংলাদেশের বিমান ঘাঁটি, সমুদ্রবন্দর এবং আকাশসীমাকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে উন্মুক্ত করে দিতে হবে। এটাই হলো ‘আকসা’ চুক্তি।

‘জিসোমিয়া’ … বাংলাদেশের ইন্টেলিজেন্সকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে কাজে লাগানো

‘জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফর্মেশন এগ্রিমেন্ট’ বা ‘জিএসওএমআইএ’ বা ‘জিসোমিয়া’ চুক্তি হলো গোপন সামরিক তথ্য আদানপ্রদানের চুক্তি। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন যে, ‘জিসোমিয়া’ চুক্তি স্বাক্ষর করলে বাংলাদেশ অত্যাধুনিক মার্কিন প্রযুক্তির যুদ্ধ সরঞ্জাম কিনতে পারবে; যার মাঝে শুরুতেই থাকবে ‘এফ-১৬’ ফাইটার বিমান এবং ‘এএইচ-৬৪ এপাচি’ এটাক হেলিকপ্টার। তারা বলছেন যে, এই চুক্তির মাধ্যমে সংবেদনশীল মার্কিন প্রযুক্তিকে সুরক্ষা দেয়া হবে। মার্কিনীরা তাদের প্রযুক্তিকে সুরক্ষা দিতে চাইতেই পারে। তারা বলতে পারে যে, বাংলাদেশ যেন তাদের প্রযুক্তি মার্কিনীদের প্রতিদ্বন্দ্বী, যেমন চীন বা রাশিয়াকে সরবরাহ না করে। কিন্তু এখানে সুকৌশলে কিছু ব্যাপার আলোচনায় আনা হচ্ছে না।

এই চুক্তি শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তির জন্যে নয়; উভয় পক্ষের। তাহলে বাংলাদেশ কি যুক্তরাষ্ট্রকে কোন প্রযুক্তি সরবহার করবে? না। একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন যে, চুক্তির নামের মাঝেই রয়েছে ‘মিলিটারি ইনফর্মেশন এগ্রিমেন্ট’ অথবা সামরিক তথ্যের ব্যাপারে সমঝোতা; এখানে প্রযুক্তির কথা বলাই হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র প্রযুক্তিকে সামরিক তথ্যের ক্যাটাগরিতে ফেলেছে। এই চুক্তির মাঝে ইন্টেলিজেন্স তথ্যও থাকবে; যেমন স্যাটেলাইট ছবি বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক ইন্টেলিজেন্স সক্ষমতা, যা কিনা শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের কাছেই রয়েছে। এখন এই সামরিক তথ্য যখন দুই পক্ষের ক্ষেত্রে বলা হবে, তখনই বোঝা যাবে যে, যুক্তরাষ্ট্র শুধু বাংলাদেশকেই তথ্য দিচ্ছে না; বাংলাদেশ থেকে তথ্য নেবেও। কি তথ্য চাইছে যুক্তরাষ্ট্র?

পৃথিবীর বহু দেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ‘জিসোমিয়া’ চুক্তি করেছে। এই চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিটা দেশের ইন্টেলিজেন্স সক্ষমতাকে নিজের কাজে লাগাবার ব্যবস্থা করেছে। অর্থাৎ এই দেশগুলি বিশ্বব্যাপী তাদের ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে যা তথ্য সংগ্রহ করবে, সেটা তারা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শেয়ার করতে বাধ্য থাকবে। কারণ এই চুক্তিতে তথ্য সরবরাহের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অন্য কথায় বলতে গেলে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী তার সামরিক প্রযুক্তি বিক্রয়ের মাধ্যমে বহু দেশের ইন্টেলিজেন্সকে নিজের কাজে লাগাবার ব্যবস্থা করেছে। এটা সত্যিই অভিনব চতুর একটা পদ্ধতি!

গত ২৪শে এপ্রিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক’ ঘোষণা করার পর থেকে অনেকেই বলতে শুরু করেছেন যে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের দিকে হেলে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের উপ-সহকারি সচিব আফরিন আখতার বলেন যে, ওয়াশিংটন আশা করছে যে, আগামী কয়েক মাসের মাঝেই তারা ‘জিসোমিয়া’ চুক্তি স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে। একইসাথে তিনি বাংলাদেশের সদ্য ঘোষিত ‘ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক’এর প্রশংসা করে বলেন যে, এটা যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ বা ‘আইপিএস’এর সাথে যথেষ্টই সামঞ্জস্যপূর্ণ।


বাংলাদেশ কি যুক্তরাষ্ট্রের দিকেই হেলে যাচ্ছে?

ইতোমধ্যেই অনেকেই বলতে শুরু করেছেন যে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের দিকে হেলে যাচ্ছে। বিশেষ করে এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক’ ঘোষণা করার পর থেকে এই ধারণাই করছেন অনেকে। নির্বাচনের বছরে বাংলাদেশের উপরে চাপ প্রয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্র তার ভূরাজনৈতিক স্বার্থগুলিকে বাস্তবায়ন করে ফেলতে উদ্যোগী হয়েছে। বিশেষ করে যে সামরিক চুক্তিগুলি বহুদিন থেকে ঝুলে ছিল, সেগুলি এক ঝটকায় স্বাক্ষর করিয়ে ফেলতে চাইছে ওয়াশিংটন। নির্বাচনের বছরের এই সুযোগখানা যুক্তরাষ্ট্র হাতছাড়া করতে চাইছে না। আর বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলের সদস্যরাই যে যুক্তরাষ্ট্রের আশীর্বাদ ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়া যায় না বলে মনে করেন, সেটা সকল দলের রাজনীতিকের একত্রে মার্কিন দূতাবাসে ধর্না দেয়ার মাঝেই ফুটে ওঠে। কিছুদিন আগেই ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘৬ষ্ঠ ইন্ডিয়ান ওশান কনফারেন্স’এ যোগ দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের উপ-সহকারি সচিব আফরিন আখতার। তিনি এক সাক্ষাতে বলেন যে, ওয়াশিংটন আশা করছে যে, আগামী কয়েক মাসের মাঝেই তারা ‘জিসোমিয়া’ চুক্তি স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে। একইসাথে তিনি বাংলাদেশের সদ্য ঘোষিত ‘ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক’এর প্রশংসা করে বলেন যে, এটা যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ বা ‘আইপিএস’এর সাথে যথেষ্টই সামঞ্জস্যপূর্ণ।

যে ব্যাপারটা পরিষ্কার তা হলো, ‘আকসা’ এবং ‘জিসোমিয়া’ চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের যতটুকুইবা ছিলো, তার প্রায় পুরোটাই কেড়ে নিতে চাইছে। এই চুক্তিগুলি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী এবং ইন্টেলিজেন্সকে এমন কিছু সুযোগ বাংলাদেশের মাটিতে করে দেবে, যার মাধ্যমে বাংলাদেশকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার বেশিরভাগ কাজটাই বাস্তবায়িত হয়ে যাবে। বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি ছাড়াই এদেশের আকাশসীমা, সমুদ্রসীমা, বিমানবন্দর এবং সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে পারার মতো একটা মারাত্মক চুক্তি বাস্তবায়ন করতে পারলে ওয়াশিংটন বঙ্গোপসাগরে, তথা ভারত মহাসাগরে চীনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারার দিক থেকে অনেকটাই এগিয়ে যাবে। একইসাথে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ইন্টেলিজেন্স সক্ষমতাকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে কাজে লাগাবার মতো সুযোগও পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র; যা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীলতা থেকে বাঁচার কোন পদ্ধতিই থাকবে না। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব তখন পুরোপুরিভাবে ওয়াশিংটনের হাতে চলে যাবে।





সূত্র -
‘Announcement of Visa Policy to Promote Democratic Elections in Bangladesh’ STATEMENT BY SECRETARY ANTONY J. BLINKEN, US Embassy in Bangladesh, 24 May 2023
‘মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির বৈঠক’ in Prothom Alo, 25 May 2023
‘Cope India 2023: India-US Joint Air Exercise Ends With Spectacular Aerial Manoeuvres At Bengal's Kalaikunda’ in Outlook India, 25 April 2023
‘US wants 2 defence deals with Bangladesh’, The Daily Star, 18 October 2019
‘The Acquisition and Cross Servicing Agreement: An Old Tool for the Modern Military’ by William M. Stephens in National Defense University Press, 14 May 2019
‘Dhaka’s relations with Beijing, Moscow don’t influence US-BD ties: State Dept official’, The Business Standard, 17 May 2023
‘Bangladesh in no hurry to sign proposed defence agreements with US’ in The Financial Express, 02 April 2022
‘Drawing South Asia into the US defence perimeter’ by P K Balachandran, in BDNews24, 21 July 2022
‘Bangladesh Tilts Toward the U.S. in the Indo-Pacific’ by Michael Kugelman in Foreign Policy, 30 March 2023
‘Bangladesh tilts toward US Indo-Pacific Strategy: media report’, The New Age, 01 April 2023
‘Above or Beyond: Overflight Considerations for U.S. Military Aircraft’ by Graham William Jenkins in National Defense University Press, 29 December 2021
‘এডিটরস গিল্ড আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠক’ Editors Guild, Ekattor TV, 27 May 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=6js21Tn58t4)
‘যুক্তরাষ্ট্র নাকি চীন, কার দিকে ঝুঁকছে বাংলাদেশ?’ in BBC Bangla, 04 May 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=kIIZRTwpNJo&t=96s)
‘বাংলাদেশের ইন্দোপ্যাসিফিক আউটলুক ঘোষণা’ in Channel 24, 24 April 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=Ex8enRnpmeM)
‘ইন্দো-প্যাসিফিক ‘রূপরেখা’ জানাল বাংলাদেশ, যা আছে এতে’ in BDNews24, 24 April 2023

4 comments:

  1. তাইলে বাংলাদেশের ভবিষ্যতে কি হতে চলেছে

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভবিষ্যতে কি হবে, সেটা কোন মানুষের পক্ষে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়; যদি না সে নিজে নবী বা রাসূল হয়ে থাকেন। তবে সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরা পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করতে পারি মাত্র। আমরা মানুষ কে কি চায়, সেটা নিয়ে কথা বলতে পারি; আর সেই চাওয়াগুলি বাস্তবতা দ্বারা কতটা প্রভাবিত হতে পারে, সেটা নিয়ে কথা বলতে পারি। একইসাথে বাস্তবতা পরিবর্তিত হবার সম্ভাবনা কতটুকু, সেটাও আলোচনা করতে পারি। কিন্তু এই সকল কিছু মিলে কোন একটা ফলাফল হবে, সেটা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়।

      এই লেখাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে তথা বঙ্গোপসাগরে কি চাইছে, তার স্বল্পমেয়াদী একটা ধারণা দেয়া হয়েছে। মধ্যম বা দীর্ঘ মেয়াদে তার উদ্দেশ্য হলো চীনকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা।

      এখন বর্তমান বাস্তবতায় এটা বোঝা যাচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সেই ক্ষমতার যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কারণ ইতোমধ্যেই সকলেই বুঝতে পারছেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার যতটা ক্ষতি যুক্তরাষ্ট্র করতে চেয়েছিল, ততটা হয়নি। এছাড়াও বিশ্বের জ্বালানির বাজারে অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার কারণে এবং চীনকে নিয়ন্ত্রণ করার চাপ অনুভব করার কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিতে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড় দিতে হয়েছে; যা কিনা ওয়াশিংটনের বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রণকে যথেষ্টই দুর্বল করেছে। কাজেই যুক্তরাষ্ট্র যেটা চায়, সেটাই হয়ে যাবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

      আর সর্বশেষ কথা হলো, বাস্তবতা পরিবর্তনের সম্ভাবনা কতটুকু। এই বাস্তবতা হলো পশ্চিমা চিন্তার উপরে ভিত্তি করে চলা বিশ্বব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার বেহাল দশাই হলো বাস্তবতার পরিবর্তন। ইতোমধ্যেই বর্তমান অবস্থা ভালো নয়। কারণ বিশ্বের বহু ক্ষেত্রেই পশ্চিমা ব্যবস্থা বাইপাস হচ্ছে; যা কেউ বাধা দিতে পারছে না, অথবা অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেটা মেনে নিচ্ছে। বাস্তবতা পরিবর্তনের সম্ভাবনা নির্ভর করবে বর্তমান পরিস্থতির উপর। যদি পরিস্থিতি খুব বেশি অস্থির হয়ে যায়, তাহলে মানুষের পরিবর্তনের আকাংক্ষা বৃদ্ধি পাবে। আর সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যদি নিজের সামর্থের বাইরে গিয়ে শক্তি প্রয়োগ করতে যায়, তাহলে তার নিয়ন্ত্রণ আরও ছুটে যেতে পারে। ফলশ্রুতিতে বর্তমান পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্ব ব্যবস্থার উপর তার নিয়ন্ত্রণ যতটুকু রয়েছে, ততটুকুও প্রশ্নের মাঝে পড়বে এবং বৈশ্বিক ব্যবস্থার উপরে মানুষের আস্থা শূণ্যের কোঠায় চলে আসবে। এরকম একটা পরিস্থতি বাস্তবতা পরিবর্তন হবার জন্যে ইন্ধন যোগাবে।

      Delete
  2. আমার মনেহয় না যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ভারতের হয়ে যুদ্ধে এভাবে নেমে যাবে। তারা চাইবে ভারতকে উস্কানী দিয়ে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লাগাতে।বলবে পিছনে আমরা আছি। কিন্তু পরে সরে যাবে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে কিছু সহায়তা না দিলে ভারত চীনের সাথে প্রযুক্তির দিক থেকে হেরে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য অর্জিত হবে না। বরং ভারত-চীন সংঘাত জিইয়ে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রকে কিছু প্রযুক্তি সরবরাহ করতেই হবে। আর যেই প্রযুক্তিগুলি যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে দিতে ইচ্ছুক নয়, সেগুলি নিজেরাই অপারেট করবে।

      যাই হোক, যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে কতটা সহায়তা দেবে, সেটার উপর 'আকসা' এবং 'জিসোমিয়া' নির্ভর করবে না। আর বাংলাদেশের উপরে যুক্তরাষ্ট্রের চাপও বন্ধ হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশ তার ভূমিকে ভারতের সামরিক বাহিনীর ট্রানজিটের জন্যে উন্মুক্ত না করবে। এই সমর্থনটা বাংলাদেশ না দিলে ভারত নিঃসন্দেহে অরুণাচল প্রদেশ হারাবে এবং দ্রুতই সংঘাত বন্ধ হয়ে যাবে এবং চীনারা হিমালয়ে তাদের সামরিক শক্তি কমিয়ে ফেলতে পারবে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য বাস্তবায়িত হবে না। কারণ যুক্তরাষ্ট্র চাইছে হিমালয়ে চীন সর্বোচ্চ পরিমাণ সামরিক শক্তি মোতায়েন রাখুক, যাতে করে তাইওয়ান নিয়ে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে অপেক্ষাকৃত কম চীনা সামরিক শক্তিকে মোকাবিলা করতে হয়।

      Delete