Saturday 29 April 2023

সুদানের সংঘাত আরও ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা

২৯শে এপ্রিল ২০২৩
 
যুক্তরাষ্ট্র সুদানের রাজনীতিকে তাদের মিত্রদের কাছে ‘আউটসোর্স’ করেছে। এর ফলশ্রুতিতে দুই জেনারেলের কেউই ক্ষমতা ছেড়ে দিতে চাইছেন না; যা কিনা দেশটার সংঘাতকে আঞ্চলিক সংঘাতে পরিণত করতে চলেছে। ‘আরএসএফ’এর প্রধান জেনারেল হামেদতি যখন বলছেন যে, ক্ষমতার মালিক জনগণ অথবা এই সংঘাত হলো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে, তখন কথাগুলি কারুর কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। আবার এটাও ঠিক যে, জেনারেল বুরহানের অধীনে সেনাবাহিনী জানে যে, বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে তারা ক্ষমতা হারাবে। আর ‘আরএসএফ’এর জয়লাভ করার অর্থ হলো, ‘আরএসএফ’ সেনাবাহিনীর স্থলাভিষিক্ত হবে। কাজেই সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের ক্ষমতা ধরে রাখার একমাত্র পথ হলো সামরিক শাসন বজায় রাখা।

এপ্রিলের মাঝামাঝি সুদানের সেনাবাহিনী এবং মিলিশিয়ার মাঝে সংঘর্ষ শুরু হবার পর থেকে এপর্যন্ত কমপক্ষে ৫’শ মানুষের প্রাণ গেছে এবং আরও ৪ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছে বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ। সুদান থেকে বিশ্বের অনেক দেশের নাগরিকদের সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। সাময়িক যুদ্ধবিরতির কথা বলা হলেও সেটার বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। সংঘাতের একপক্ষে রয়েছেন সুদানের সামরিক সরকারের প্রধান জেনারেল আব্দেল ফাত্তাহ আল-বুরহান; যিনি দেশটার প্রেসিডেন্টও। আর তার বিরোধী পক্ষে রয়েছে সুদানের মিলিশিয়া ‘র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স’ বা ‘আরএসএফ’; যার প্রধান হলেন জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালো, যিনি হামেদতি নামেও সমধিক পরিচিত। যুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত হামেদতি ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। ২০১৯ সালে দুইজন একত্রে একনায়ক ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন। তবে পশ্চিমাদের প্রচেষ্টায় সুদানে বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টাকে তারা দু’জনেই বারংবার বাধাগ্রস্ত করেছেন। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করলেও সুদানের সামরিক শাসকের সাথে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলি সুসম্পর্ক রেখে চলেছে। ‘আল জাজিরার’র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ২০২১ সালের অক্টোবরে সুদানের সামরিক অভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনী চেয়েছিল বেসামরিক নেতৃত্বের সাথে ‘আরএসএফ’ মিলিশিয়ার ক্ষমতাও খর্ব করতে। কাজেই অভ্যুত্থানের পর বুরহানের সাথে হামেদতির যে দ্বন্দ্ব শুরু হবে, তা প্রায় জানাই ছিল।

সুদনের সাথে সাতটা দেশের সীমানা রয়েছে; যেকারণে অনেকেই আশংকা করছেন যে, সুদানের এই সংঘাত আঞ্চলিক সংঘাতে রূপ নিতে পারে। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, লোহিত সাগর, আফ্রিকার সাহেল অঞ্চল এবং ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ অঞ্চলের মাঝে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থিত হবার কারণে সুদানের গুরুত্ব অনেক। এখানকার কৃষি সম্পদের কারণে আঞ্চলিক শক্তিরা সর্বদাই সুদানের রাজনীতিতে জড়িয়েছে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত এখানে তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে সুদানে রুশ নৌঘাঁটি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সুদানে বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন আঞ্চলিক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরবকে সাথে নিয়ে ‘কোয়াড’ নামের একটা জোট গঠন করেছিল। সুদানের পার্শ্ববর্তী লিবিয়া, ইথিওপিয়া, দক্ষিণ সুদান, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক এবং শাদ রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝ দিয়ে গিয়েছে। সুদানের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও আশেপাশের দেশগুলিকে প্রভাবিত করতে পারে।

‘আল জাজিরা’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, সুদানের উপরে মধ্যপ্রাচ্যের দুইটি দেশ সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের কতটা প্রভাব রয়েছে, তা ফুটে উঠতে শুরু করেছে ২০১৯ সালে দেশটার একনায়ক ওমর আল-বশিরের ক্ষমতাচ্যুতির পর থেকে। ২০২২ সালে সুদানের সামরিক সরকার এবং আমিরাতের দু’টা কোম্পানির মাঝে ৬ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি মোতাবেক কোম্পানিদু’টা লোহিত সাগরের তীরে ‘আবু আমামা’ নামের একটা সমুদ্রবন্দর তৈরি করবে। সুদানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক জিহাদ মাশামুন ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, আমিরাতিরা লোহিত সাগরের বন্দরগুলির নিয়ন্ত্রণ চায়। লোহিত সাগরে তাদের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে; আর মধ্য এবং পশ্চিম আফ্রিকাতেও তাদের এই প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। লন্ডনের ‘কিংস কলেজ’এর এসোসিয়েট প্রফেসর আন্দ্রেয়াস ক্রীগ ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, কিছুদিন আগ পর্যন্তও আমিরাতিরা সুদানের দুই জেনারেলকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু এখন তারা তাদের নীতিতে পরিবর্তন আনতে পারে। কারণ একসাথে দুইজনকে সমর্থন দিয়ে যাওয়াটা একসময় না একসময় সমস্যার জন্ম দিতো। যদিও সুদানকে সকলেই আফ্রিকার দেশ বলেই বোঝে, তথাপি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি সুদানকে আরব দেশ বলে গণ্য করে। কাজেই সুদানে যেকোন সংঘাতের একটা আঞ্চলিক চেহাড়া রয়েছে।

জিহাদ মাশামুন বলছেন যে, সুদানের উত্তরের দেশ মিশর সুদানের সেনাবাহিনীকে মিশরের সেনাবাহিনীর প্রতিচ্ছবি মনে করে। তাদের ধারণা সুদানে স্থিতিশীলতা ধরে রাখার একমাত্র চাবি সেনাবাহিনীর হাতে। অপরদিকে হামেদতিকে তারা ভাড়াটে সেনা হিসেবে দেখে। আন্দ্রেয়াস ক্রীগ বলছেন যে, লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে আমিরাত এবং মিশর উভয়েই জেনারেল খলিফা হাফতারের পক্ষে থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে তাদের মাঝে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। এছাড়াও ইথিওপিয়ার সংকটে কে কোন পক্ষ নেবে, সেখানেও তাদের মাঝে দ্বন্দ্ব ছিল। এখন সেখানে সুদান যোগ হলো। তবে এখানে উল্লেখযোগ্য হলো যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান। যুক্তরাষ্ট্র সুদানে তার মিত্র দেশ আমিরাত এবং সৌদি আরবকে পাশে রেখেছে সুদানের সামরিক নেতাদের নিয়ন্ত্রণ করতে। কিন্তু এখানেই প্রকাশ পেয়ে যায় যে, আফ্রিকায় যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি তার প্রভাব ধরে রাখতে পারছে না; বরং এই কাজে ওয়াশিংটন তার মিত্রদের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছে।

ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’ বা ‘রুসি’র এসোসিয়েট ফেলো স্যামুয়েল রামানি ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, যদি সংঘাতে হামেদতি সমস্যা পড়ে যান, তাহলে আমিরাতিরা হয়তো ‘আরএসএফ’এর পক্ষ নিতে পারে। সেক্ষেত্রে সরাসরি সহায়তা না দিয়ে তারা হয়তো লিবিয়াতে তাদের এজেন্ট জেনারেল হাফতারের হাত দিয়ে সহায়তা পাঠাতে পারে। হামেদতির সোশাল মিডিয়ার পেইজগুলি আমিরাত থেকেই পরিচালিত হচ্ছে। সেগুলিতে তারা আমিরাতের রাজনৈতিক দর্শনকেই প্রতিফলিত করছে এবং আমিরাতিরা যেধরণের কথা বলে, সেগুলিই তারা ব্যবহার করছে সুদানের সামরিক শাসক জেনারেল বুরহানের বিরুদ্ধে।

যুক্তরাষ্ট্রের দুই মিত্র দেশ আমিরাত এবং মিশর লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে একই পক্ষে থাকলেও এখন তারা দুই পক্ষ হয়ে সুদানে রক্তপাত ঘটাতে ইন্ধন যোগাচ্ছে। সুদান বিশ্লেষক জিহাদ মাশামুনের কথায়, যুক্তরাষ্ট্র সুদানের রাজনীতিকে তাদের মিত্রদের কাছে ‘আউটসোর্স’ করেছে। এর ফলশ্রুতিতে দুই জেনারেলের কেউই ক্ষমতা ছেড়ে দিতে চাইছেন না; যা কিনা দেশটার সংঘাতকে আঞ্চলিক সংঘাতে পরিণত করতে চলেছে। কানাডাভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক এন্ড্রু ম্যাকগ্রেগর মার্কিন থিঙ্কট্যাংক ‘জেমসটাউন ফাউন্ডেশন’এর এক লেখায় বলছেন যে, ‘আরএসএফ’এর প্রধান জেনারেল হামেদতি যখন বলছেন যে, ক্ষমতার মালিক জনগণ অথবা এই সংঘাত হলো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে, তখন কথাগুলি কারুর কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। আবার এটাও ঠিক যে, জেনারেল বুরহানের অধীনে সেনাবাহিনী জানে যে, বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে তারা ক্ষমতা হারাবে। আর ‘আরএসএফ’এর জয়লাভ করার অর্থ হলো, ‘আরএসএফ’ সেনাবাহিনীর স্থলাভিষিক্ত হবে। কাজেই সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের ক্ষমতা ধরে রাখার একমাত্র পথ হলো সামরিক শাসন বজায় রাখা।

No comments:

Post a Comment