Saturday 20 August 2022

জলবায়ু পরিবর্তনের যাতাকলে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে ইউরোপ

২১শে অগাস্ট ২০২২

০৯ই অগাস্ট ২০২২। জার্মানির বিনগেনের কাছে প্রায় শুকিয়ে যাওয়া রাইন নদী। ইউরোপ, বিশেষ করে জার্মানি এবং ফ্রান্স এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছে। দু’টা ব্যাপারে কেউই এখন নিশ্চিত নয়; এর প্রথমটা হলো আবহাওয়া; আর দ্বিতীয়তা হলো সামাজিক স্থিতি। জ্বালানির মূল্যস্ফীতির সাথে যুক্ত হয়েছে পরিবেশগত বিপর্যয়, যা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির মূল স্তম্ভ অর্থনীতিকে আঘাত করেছে। সামনের শীতকালে জার্মান সরকারের জ্বালানি ব্যবস্থাপনা সকলেই পরিমাপ করবে। আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবার কারণে সরকারের কার্যক্রম কতটা ভালো হলে মানুষের চোখে তা ভালো ঠেকবে, তা বলা কঠিন। কারণ যে কেউ যে কোন সুযোগে সরকারের সমালোচনা করতে পারে, অথবা রাজনৈতিক অসন্তোষের জন্ম দিতে পারে।


‘ডয়েচে ভেলে’ বলছে যে, ইউরোপের রাইন নদীর পানি রেকর্ড নিচে নেমে গেছে। আর ব্রিটেনে চলছে ৮০ বছরের মাঝে সবচাইতে মারাত্মক খরা; যেখানে টেমস নদীর উৎস শুকিয়ে গেছে। ইউরোপের নদীপথগুলি খুবই নাজুক অবস্থায় পতিত হয়েছে। একজন ডাচ ক্যাপ্টেন পিটার ক্লীরেবুটস বলছেন যে, সাধারণতঃ যেখানে জাহাজের নিচে ২ মিটারের বেশি পানি থাকে, সেখানে এখন কিছু স্থানে মাত্র ৪০ সেন্টিমিটার পানি থাকছে। এমতাবস্থায় জাহাজ নদীতে আটকে যাওয়ার ভয় থাকছে। একারণে জাহাজের মালামাল কমিয়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মাল বহণ করতে হচ্ছে।

পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন যে, ইউরোপের এবারের খরা ৫’শ বছরের মাঝে সবচাইতে মারাত্মক খরা হিসেবে দেখা দিতে পারে। ইতালি থেকে ব্রিটেন পর্যন্ত ইউরোপের প্রায় ৪৭ শতাংশ ভূমিই এই খরার মাঝে পড়েছে। এর মাঝে ১৭ শতাংশ মারাত্মক খরার মাঝে রয়েছে। ফ্রান্সের মৎস্য সম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা স্টেফানে মার্টি ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, একটা ব্যাপার আরেকটার সাথে যুক্ত। এবছরে পাহাড়ে তুষার কম পড়ার কারণে পাহাড় থেকে উৎপন্ন হওয়া নদীগুলিতেও পানি কম। পীরেনীজ পর্বতমালায় পানিবিদ্যুত উৎপাদন করার জন্যে তৈরি করা হ্রদগুলি থেকে পানি ছেড়ে দেয়া হয়েছে যাতে করে নদীগুলিতে কিছু পরিমাণ পানি অন্ততঃ থাকে। বিশ্বের বাকি সকল এলাকার তুলনায় ইউরোপে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে সবচাইতে বেশি হারে। বৃষ্টি না হবার কারণে ফ্রান্সে ভুট্টার আবাদ গত বছরের তুলনায় সাড়ে ১৮ শতাংশ কম হবার সম্ভাবনা রয়েছে। ফরাসি আবহাওয়া বিভাগ বলছে যে, জুলাই মাসে স্বাভাবিকের চাইতে ৮৪ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। জার্মানির ‘টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব মিউনিখ’এর প্রফেসর মিরান্ডা শ্রুয়ার্স ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, ২০১৮ সালের খরাকে অনেকেই ৫’শ বছরে একবার হবার মতো খরা বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। এখন এরকম খরা দ্বিতীয়টা হাজির হয়েছে। সেই খরার কারণে কৃষিখাতে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতি হয়েছিল। করোনা মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের উপর এই খরা হাজির হবার অর্থ হলো কয়লা, তেল, গ্যাসের মূল্যের সাথেসাথে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যও আরও বৃদ্ধি পাবে। ইউরোপ শুধু জ্বালানি নিয়ে চিন্তা করেছে; কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে যে, পানি ব্যবস্থাপনাতে অনেকটাই ঘাটতি রয়ে গেছে। আর যেহেতু এখন বোঝা যাচ্ছে যে, এধরণের খরা খুব ঘনঘনই আসার সম্ভাবনা রয়েছে, তাই ইউরোপকে নতুন করে চিন্তা করতে হবে।

‘হামবুর্গ পোর্ট কনসালটিং’এর হার্টমুট বেয়ার জার্মানির অভ্যন্তরীণ নৌপথ নিয়ে কাজ করছেন। তিনি ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলেন যে, ২০১৮ সালে রাইন নদীর পানি এরকমই নিচে নেমে গিয়েছিল। তখনকার মতো এবারও বিভিন্ন বিকল্প পদ্ধতিতে রাইনের নৌপরিবহণের কাজ করতে হবে। একটা জাহাজের মালামাল তিনি-চারটা জাহাজে করে বহণ করতে হবে। ইউরোপের বহু শিল্প নদীপথের সুবিধা নেয়ার জন্যে রাইন নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে। কয়লা, খনিজ, তেল, বিল্ডিং ম্যাটেরিয়াল, ইত্যাদি নদীপথেই পরিবাহিত হয়। রাইনে পানি কমে যাবার কারণে শিল্পগুলি এখন তিন থেকে চারগুণ বেশি খরচে কাঁচামাল পরিবহণ করতে বাধ্য হচ্ছে। আর যেহেতু সীমিত সংখ্যক জাহাজ দিয়েই পরিবহণ করতে হচ্ছে, সেকারণে পরিবহণের জন্যে যথেষ্ট সংখ্যক জাহাজও পাওয়া যাচ্ছে না। খরচের হিসেব করলে নদীপথে যদি ১ ইউরো খরচ হয়, রেলপথে খরচ হবে ২ ইউরো, আর সড়কপথে ৪ ইউরো।

‘আল জাজিরা’ বলছে যে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপের অনেক কোম্পানি রুশ কয়লা বাদ দিয়ে সমুদ্রপথে কয়লা আমদানি করছে; যা কিনা পরবর্তীতে নদীপথে শিল্পাঞ্চল পর্যন্ত যাচ্ছে। রাইন নদী দিয়ে বছরে ৩০ কোটি টন পণ্য পরিবাহিত হয়। জার্মানির ৮০ শতাংশ নৌপরিবহণ রাইন দিয়ে হয়।

‘ডয়েচে ভেলে’র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, জার্মানির নদীপথে যখন যথেষ্ট পানি থাকে, তখন বড় আকারের জাহাজগুলি ৫ হাজার টন পর্যন্ত মালামাল বহণ করতে পারে। তুলনামূলকভাবে, রেলপথে একটা রেলগাড়ি গড়ে ৩ হাজার টন পর্যন্ত মাল বহণ করতে পারে; আর একটা ট্রাক বহণ করতে পারে গড়ে মাত্র ২৩ টন। আর এই মুহুর্তে জার্মানিতে নদীপথের বিকল্প হিসেবে রেলপথ এবং সড়কপথের অতিরিক্ত মালামাল বহণের সামর্থও নেই। এছাড়াও করোনা মহামারির পর থেকে ট্রাকের ড্রাইভারের সংকট চলছে; আর সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেনিয়ান ট্রাক ড্রাইভাররা অনেকেই যুদ্ধের কারণে দেশে ফেরত চলে গেছে।

হার্টমুট বেয়ার বলছেন যে, ২০১৮ সালের খরার সময়ে অনেকেই মনে করেছিলেন যে, এরকম খরা হয়তো ১০ বছরে একবার আসতে পারে। কিন্তু ৪ বছরের মাথাতেই এরকম খরা আবারও হাজির হয়েছে। সামনের দিনগুলিতে জাহাজ কোম্পানিগুলি হয়তো নদীতে পানির গভীরতার কথা চিন্তা করে অপেক্ষাকৃত কম ‘ড্রাফট’ বা গভীরতার জাহাজ তৈরি করবে। উৎপাদন খরচ কমাবার জন্যে এতকাল শিল্পগুলি কাঁচামাল জমা করে রাখতো না; দরকার হলে সাথেসাথে অর্ডার করতো। এখন খুব সম্ভবতঃ তাদেরকে বেশকিছু কাঁচামাল জমা করে রাখার দিকে যেতে হবে। আর জার্মান সরকারও হয়তো নদীগুলিকে আরও বেশি করে ড্রেজিং করার উদ্যোগ নেবে; যাতে করে খরার মাঝেও নদীতে যথেষ্ট পরিমাণ পানি থাকতে পারে। তবে এই কাজটা করতে যেমন সময় লাগবে, তেমনি বাজেট নিয়ে টানাপোড়েনও থাকবে। এছাড়াও পরিবেশের ব্যাপারটাও চিন্তা করতে হবে।

ইউরোপ, বিশেষ করে জার্মানি এবং ফ্রান্স এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছে। জ্বালানির মূল্যস্ফীতির সাথে যুক্ত হয়েছে পরিবেশগত বিপর্যয়, যা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির মূল স্তম্ভ অর্থনীতিকে আঘাত করেছে। ‘স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি অব বার্লিন’এর প্রফেসর আলরিক ব্রুকনার ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, দু’টা ব্যাপারে কেউই এখন নিশ্চিত নয়; এর প্রথমটা হলো আবহাওয়া; আর দ্বিতীয়তা হলো সামাজিক স্থিতি। বর্তমান জার্মান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় জনগণ চেয়েছিল যে, জার্মানি খনিজ জ্বালানির ব্যবহার থেকে বের হয়ে আসবে। কিন্তু জার্মানির নীতি প্রণয়ণে দীর্ঘসূত্রিতা রয়েছে। কাজেই সামনের শীতকালে জার্মান সরকারের জ্বালানি ব্যবস্থাপনা সকলেই পরিমাপ করবে। আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবার কারণে সরকারের কার্যক্রম কতটা ভালো হলে মানুষের চোখে তা ভালো ঠেকবে, তা বলা কঠিন। কারণ যে কেউ যে কোন সুযোগে সরকারের সমালোচনা করতে পারে, অথবা রাজনৈতিক অসন্তোষের জন্ম দিতে পারে।

No comments:

Post a Comment