Wednesday 17 August 2022

তালিবানের এক বছর… কেমন আছে আফগানিস্তান?

১৭ই অগাস্ট ২০২২
 
কান্দাহার, অক্টোবর ২০২১। মারাত্মক অপুষ্টিজনিত সমস্যায় আক্রান্ত আফগান শিশু। আফগানিস্তানের মানবিক বিপর্যয় না থামিয়ে পশ্চিমা মিডিয়াতে দেশটার নারীস্বাধীনতা নিয়ে ব্যাপক রিপোর্টিং আদর্শিক দেউলিয়াত্ব ছাড়া আর কিছুই নয়। অপরদিকে আফগান নারীদের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবার আগ পর্যন্ত আফগানিস্তানের উপর অবরোধ বজায় রাখা এবং ৭ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ আটকে রাখার মার্কিন সিদ্ধান্ত কতটা মানবিক, অথবা পশ্চিমা আদর্শের সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা আলোচনা হতেই পারে। তালিবানরা আফগানিস্তানে কোন আদর্শিক রাষ্ট্র প্রতি করতে না পারলেও পশ্চিমা আদর্শ যে আফগানিস্তানে তার দেউলিয়াত্ব প্রকাশ করেছে, তা দুই কোটির বেশি ক্ষুধার্ত আফগানের চেহারায় পরিষ্কার।

এক বছর আগে ২০২১এর অগাস্টে কাবুলে মার্কিন দূতাবাসের উপর হেলিকপ্টার ওড়া এবং এর পরবর্তীতে কাবুল বিমান বন্দরে মার্কিন সামরিক বিমানের চাকা ধরে মানুষের বিমানে আরোহণের চেষ্টার দৃশ্যগুলি তিন দশক আগে বার্লিন প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলার সাথে তুলনা করা চলে। প্রায় দুই দশক তালিবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পর সেখান থেকে মার্কিন বাহিনীর পলায়নের ঘটনাটা সাম্প্রতিক সময়ের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলির একটা ছিল। এক বছর কেমন চলছে তালিবানদের শাসন? কেমন আছে আফগানিস্তানের মানুষ?

সকল প্রতিবেদনেই আফগানিস্তানের চরম অর্থনৈতিক দুর্দশা এবং মানবিক বিপর্যয়ের কথা আসছে। ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, আফগানিস্তানের হাসপাতালে অসুস্থ্য শিশুদের অসুস্থতার মূল কারণই হলো অপুষ্টি। কারণ এই শিশুদের পরিবারগুলি সকলেই ভীষণ দরিদ্র্য। তথাপি প্রতিবেদনের প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল আফগানিস্তানে মহিলাদের অধিকার। দেশটাতে মেয়েদেরকে সেকুলার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার কথা বলা হয়। মহিলাদেরকে রাতের বেলায় রাস্তায় ঘোরার ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। বিশেষ করে তালিবানরা নিয়ম করে দিয়েছে যে, মহিলারা কোন পুরুষ সঙ্গী ছাড়া রাস্তায় ঘুরতে পারবে না। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, তালিবানরা কাতারে আলোচনার সময় যেসকল প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেগুলি তারা রাখেনি; যেমন, মহিলারা প্রেসিডেন্ট ছাড়া যেকোন অফিসে যেকোন কাজ করতে পারবে; মহিলারা ইচ্ছামতো তাদের জীবনসঙ্গী বেছে নিতে পারবে। কিন্তু এখন সেখানকার চাকুরির বাজারে মহিলাদের অংশগ্রহণ ১৬ শতাংশ কমে গেছে। সৌদি আরব, পাকিস্তান এবং ইরানকে ইসলামিক রাষ্ট্র আখ্যা দিয়ে বলা হয় যে, আফগানরাও সেই দেশগুলির মতো হতে চায়।

মার্কিন মিডিয়া ‘সিএনএন’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এক বছর আগে বিদেশী মিডিয়ার মহিলা সাংবাদিকদের যতটা কঠিন নিয়ম মেনে চলতে হয়েছে, এখন তা যথেষ্টই শিথিল করা হয়েছে। কাবুলের বেশকিছু মহিলা কাপড় পড়ার উপর তালিবানদের আরোপ করা নিয়ন্ত্রণ মানছে না। আর তালিবানরাও এখন তাদের বিরুদ্ধে ততটা কঠোর হচ্ছে না। মহিলাদেরকে তালিবানরা স্বাস্থ্য, মানবিক কাজ, শিক্ষার মতো কর্মকান্ডে জড়িত থাকতে দিচ্ছে। তবে আগে তারা সরকারি মন্ত্রণালয় এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করলেও এখন তা পারছেন না।

তবে ‘বিবিসি’র প্রতিবেদনে এটাও বলা হয় যে, যুদ্ধের কারণে দেশটার গ্রামাঞ্চলে যেখানে মানুষ বহুকাল ধরে দৈনন্দিন কোন কর্মকান্ডই সম্পাদন করতে পারেনি, সেখানে এখন স্বস্তি ফিরে এসেছে। যদিও দেশটার অর্থনৈতিক দুর্দশার ব্যাপারে সকলেই একমত, তথাপি দেশটার গ্রামাঞ্চলের মানুষের মাঝে তালিবানদের যথেষ্ট সমর্থন রয়েছে। ‘সিএনএন’বলছে যে, এক বছর আগে কাবুলে যেমন অস্থিরতা এবং নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছিল, সেটা এখন নেই; জীবনযাত্রা অনেকটাই স্বাভাবিক। তবে মানুষের জীবনযাত্রার মান যথেষ্টই নিচে নেমে গেছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, আফগানিস্তানের অর্ধেক মানুষই চরম ক্ষুধার মাঝে রয়েছে। আর ২০২২ সালের দ্বিতীয়ার্ধে দেশটার ৯০ শতাংশেরও বেশি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে থাকবে বলে সেখানে বলা হয়। এর কারণ হিসেবে রয়েছে দেশটার উপর অর্থনৈতিক অবরোধ; দেশটার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ যুক্তরাষ্ট্র আটকে দিয়েছে; এছাড়াও রয়েছে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি। কাবুলের বাজারে অনেক পণ্য রয়েছে; কিন্তু বেশিরভাগ মানুষেরই তা কেনার সামর্থ্য নেই।

‘সিএনএন’ বলছে যে, আফগানিস্তানের গ্রামাঞ্চলের জনগণ যথেষ্টই খুশি যে মার্কিনীরা দেশ ছেড়ে চলে গেছে; এবং যুদ্ধ বন্ধ হয়েছে। গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাছে নারীস্বাধীনতার মতো ইস্যুগুলি ততটা গুরুত্বপূর্ন নয়। তবে প্রতিবেদনে তালিবানদের অধীনে মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে অত্যন্ত অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা বলা হয়। কেউ কেউ লুকিয়ে লুকিয়ে সেকুলার শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। দুই দশক ধরে মার্কিনীরা যখন আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণে ছিল, তখন জনগণ মার্কিনীদেরকে দখলদারি বাহিনী হিসেবে দেখেছে; কিন্তু সেসময় মহিলারা ইচ্ছামতো তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারতো। নারীস্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা কর্মীদেরকে গত এক বছরের মাঝে দেশত্যাগ করতে হয়েছে। তালিবানরা এখন পশ্চিমা মিডিয়াকে রিপোর্টিং করতে দিচ্ছে, কারণ তারা দেখাতে চাইছে যে, সেখানে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রয়েছে; জননিরাপত্তা রয়েছে। এছাড়াও তারা বলতে চাইছে যে, সেখানে দারিদ্র্য এখন মারাত্মক একটা ইস্যু; যাতে করে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের রিজার্ভের অর্থ ফেরত দেয়; এবং সেখানে যেন স্বাধীনভাবে আন্তর্জাতিক সহায়তা পৌঁছাতে পারে।

মারাত্মক আর্থিক সমস্যা ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ। গত ১৫ই মার্চ বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, আফগানিস্তানের শহরাঞ্চলে কর্মসংস্থান কমেছে; কিন্তু নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নয়নের কারণে গ্রামাঞ্চলে তা বেড়েছে। ২০১৯ সালের তুলনায় প্রাথমিক স্কুলে ছেলে এবং মেয়ে উভয়ের উপস্থিতিই বেড়েছে। বিশেষ করে নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্যে গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বেড়েছে। যাদের জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজন, বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার সহায়তায় তাদের মাঝে প্রায় ৯৪ শতাংশ সেবা পাচ্ছে।

তালিবানরা এক বছরে কতটা সফল হয়েছে সেটা হিসেব করতে হলে মার্কিনীর দুই দশকে কতটা সফল হয়েছে, সেটাও তুলনায় নিয়ে আসতে হবে। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, মার্কিন নিয়ন্ত্রণের সময়ে একটা বড় অংশ মানুষ চাকুরি করতো সরকারি সংস্থা এবং নিরাপত্তা সেক্টরে; যখন দেশে জানমালের নিশ্চয়তা ছিল না একেবারেই। এখন সেই চাকুরিগুলি নেই। সেসময় প্রতি বছর প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার বিদেশ থেকে আসতো; যা কিনা বাজেটের প্রায় ৭৫ শতাংশ ছিল। এই সাহায্য হঠাত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অর্থনীতিতে ধ্বস নেমেছে। ভুলে গেলে চলবে না যে, তালিবানরা এমন একটা দেশ পেয়েছে, যা ছিল যুদ্ধের কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং বিদেশী সহায়তার উপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল। মার্কিনীরা আফগানিস্তান ত্যাগের সময় আফগান মহিলাদেরকে তাদের ভাগ্যের উপর ছেড়ে এসেছিল। কাজেই আফগানিস্তানের মানবিক বিপর্যয় না থামিয়ে পশ্চিমা মিডিয়াতে দেশটার নারীস্বাধীনতা নিয়ে ব্যাপক রিপোর্টিং আদর্শিক দেউলিয়াত্ব ছাড়া আর কিছুই নয়। অপরদিকে আফগান নারীদের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবার আগ পর্যন্ত আফগানিস্তানের উপর অবরোধ বজায় রাখা এবং ৭ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ আটকে রাখার মার্কিন সিদ্ধান্ত কতটা মানবিক, অথবা পশ্চিমা আদর্শের সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা আলোচনা হতেই পারে। তালিবানরা আফগানিস্তানে কোন আদর্শিক রাষ্ট্র প্রতি করতে না পারলেও পশ্চিমা আদর্শ যে আফগানিস্তানে তার দেউলিয়াত্ব প্রকাশ করেছে, তা দুই কোটির বেশি ক্ষুধার্ত আফগানের চেহারায় পরিষ্কার।

3 comments:

  1. তালিবানের ফিরে আসা, অবশ্যই আমেরিকার দুনিয়ার একমাত্র সুপারপাওয়ার ইমেজে ক্ষতর সৃষ্টি করেছে।
    তবে তারা শাসনে কতটা সফল হতে পারবে এব্যাপারে সময়ই উত্তর দেবে।
    তবে তারা যদি লিবরাল বিশ্বব্যাবস্থার বিপরীতে আইডিয়োলজিক্যাল পলিটির উপহার দিতে সক্ষম হয়, তবে এই দুনিয়ায় নতুন এক বিশ্বব্যবস্থার সন্ধান পাওয়া যাবে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. তালিবানদের সফলতার মাপকাঠিটা কি হবে? পুঁজিবাদী আদর্শের মাপকাঠি নাকি ইসলামের মাপকাঠি?

      এক বছর আগে তালিবানদের নিয়ে লেখাটা পড়তে পারেন।

      "তালিবানরা বলছে যে, তারা ইসলামিক আমিরাত তৈরি করতে যাচ্ছে। তারা শরীয়াহর কিছু আইন বাস্তবায়নও করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। তবে আফগানিস্তানের আন্তর্জাতিক বাউন্ডারিগুলি মেনে নিয়ে তারা মূলতঃ জাতিরাষ্ট্রের চিন্তাকেই ভিত হিসেবে তুলে ধরেছে। ... আলোচনার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র যে ব্যাপারগুলি নিশ্চিত করেছে তার মাঝে রয়েছে আইনের ব্যাপারে তালিবানকে কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দিতে রাজি করানো এবং আন্তর্জাতিক সীমানা অমান্য করে খিলাফত ঘোষণা করা থেকে বিরত থাকা। হেরে গিয়েও যুক্তরাষ্ট্র তালিবানদেরকে দিয়ে তাদের উদ্দেশ্য কিছুটা হলেও বাস্তবায়িত করিয়ে নিয়েছে। তবে তা যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্ব ধরে রাক্ষার জন্যে যথেষ্ট নাও হতে পারে।"
      https://koushol.blogspot.com/2021/08/taliban-again.html

      তালিবানরা যেহেতু একবার ছাড় দিয়েছে, সেকারণে তাকে আরও ছাড় দিতে হতে পারে। অন্ততঃ পশ্চিমারা এটাই নিশ্চিত করতে চাইবে। কারণ তারা বুঝে ফেলেছে যে তালিবানরা ছাড় দেয়; এবং হয়তো ভবিষ্যতেও দেবে। তারা যুদ্ধটা যত ভালো বোঝে, রাজনীতি ততটা বোঝে না। একারণেই তারা সমস্যায় পড়তে থাকবে।

      Delete
  2. আমার বিশ্বাস যত দিন না এই বিশ্বব্যবস্থা পুরোপুরি ভাবে ভেঙে পড়ছে ততদিন এই রকম পলিটি সফল হতে পারবে না।
    'সফল' - আইডিওলজিক্যাল সফলতা

    ReplyDelete