Saturday 13 August 2022

ইউক্রেনের খাদ্যশস্য রপ্তানির সমঝোতা কি দুনিয়ার জন্যে স্বস্তি বয়ে নিয়ে আসবে?

১৩ই অগাস্ট ২০২২
 
ইউক্রেনের বন্দরে অপেক্ষা করছে খাদ্যশস্যবাহী জাহাজ। যেহেতু কৃষ্ণ সাগরের খাদ্যশস্য রপ্তানির সমঝোতার কারণে খাদ্যশস্যের আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা এখনই দূরীভূত হয়ে যাচ্ছে না এবং রাশিয়া যেহেতু এই সমঝোতার দীর্ঘমেয়াদী নিশ্চয়তা দেয়নি, তাই যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্বের জন্যে এখনই উল্লসিত হবার মতো কিছু ঘটেনি। অপরদিকে দরিদ্র দেশগুলির জনগণের সামনে ব্যাপক মূল্যস্ফীতির চাপ ও ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের মাঝে কৃষ্ণ সাগরের শস্য রপ্তানির সমঝোতা খুব কমই অর্থ বয়ে আনবে।


গত ২২শে জুলাই ইস্তাম্বুলে তুরস্ক এবং জাতিসংঘের মধ্যস্ততায় ইউক্রেনের আটকে পড়া খাদ্যশস্য বিশ্বের বাজারে রপ্তানি করার জন্যে রাশিয়ার সাথে সমঝোতা হয়। এই সমঝোতা অনুযায়ী চার মাসের জন্যে ইউক্রেনের খাদ্যশস্য রপ্তানি করা সম্ভব হবে। ইউক্রেনের বন্দরগুলিতে অনেকগুলি জাহাজ প্রায় ৫ লক্ষ টন শস্য এবং ভোজ্যতেল নিয়ে অপেক্ষা করছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, প্রথমতঃ এই সমঝোতার ফলে ইউক্রেন শস্য বিক্রি করে অতি দরকারী অর্থ পাবে; দ্বিতীয়তঃ এই শস্য দুনিয়ার সবচাইতে দারিদ্রপীড়িত অঞ্চলগুলিতে সরবরাহ করা যাবে; তৃতীয়তঃ এটা ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝে প্রথম কূটনৈতিক পদক্ষেপ। অনেকেই এই চুক্তিকে বিশাল একটা বিজয় হিসেবে দেখতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে তুরস্কের ক্ষমতাসীন দল ‘একে পার্টি’ এবং ওয়াশিংটনে জো বাইডেনের মার্কিন প্রশাসন এই পদক্ষেপকে বৈশ্বিক মানবতার জন্যে একটা বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখতে চাইছে। তবে অনেকেই এই সমঝোতাকে দ্রুত সফল হিসেবে দেখানোর ব্যাপারে প্রশ্ন তুলছেন।

সমঝোতার ঠিক আগে আগেই যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ রাশিয়ার উপর অবরোধের ব্যাপ্তিকে পরিবর্তন করেছে। ১৪ই জুলাই মার্কিন বাণিজ্য দপ্তর খাদ্যশস্য, কৃষি যন্ত্রপাতি, ঔষধ ও মেডিক্যাল যন্ত্রপাতির উপর থেকে অবরোধ তুলে নেয়। এর পাঁচদিন পর ইইউ কিছু ব্যাংকের উপর থেকে অবরোধ সরিয়ে নেয়, যারা রাশিয়ার সাথে খাদ্যশস্য, সার ও অন্যান্য কৃষিজ দ্রব্যের বাণিজ্যের সাথে জড়িত।

ব্রাসেলস ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’ বা ‘আইসিজি’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ২৩শে জুলাই ইউক্রেনের ওডেসা বন্দরে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, এই শস্য রপ্তানির সমঝোতাকে রাশিয়া তার যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে দেখতে চায় না। আর এই সমঝোতায় রাজি হবার পুরষ্কার হিসেবে জাতিসংঘ রাশিয়ার সাথে আলাদাভাবে আরেকটা চুক্তি করেছে, যা মোতাবেক রাশিয়াও তার শস্য এবং রাসায়নিক সার পশ্চিমা অর্থনৈতিক অবরোধ এড়িয়ে বিশ্ব বাজারে বিক্রি করতে পারবে। ক্রেমলিন এই চুক্তিকে রাশিয়ার জন্যে একটা বড় বিজয় হিসেবেই দেখছে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর এক লেখায় ইউক্রেনের পার্লামেন্ট সদস্য ওলেকসি গোঞ্চারেঙ্কো বলছেন যে, এই সমঝোতার পরেও সকলকে রুশ ‘ব্ল্যাকমেইল’ মোকাবিলা করতেই হবে। তার মতে, যদি পশ্চিমারা হুমকি দেয় যে, শস্য রপ্তানি বন্ধ করে দিতে চাইলে পশ্চিমারা কৃষ্ণ সাগরের রুশ নৌবহরকে ধ্বংস করে দেবে, শুধুমাত্র তাহলেই রাশিয়া হয়তো এই সমঝোতাকে বাস্তবায়িত হতে দেবে। তিনি ইউক্রেনের জন্যে পশ্চিমাদের আরও অস্ত্র সরবরাহের মাঝেই শস্য রপ্তানির সমুদ্রপথ খোলা রাখার সমাধান দেখছেন। ‘কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পীস’এর এক লেখায় রুশ বিশ্লেষক আলেক্সান্দ্রা প্রোকোপেঙ্কো বলছেন যে, এই সমঝোতা রাশিয়ার জন্যে অনেক সুবিধা বয়ে আনলেও রাশিয়া বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, একটা বিষয়ে ছাড় দেয়ার অর্থ এই নয় যে, তারা পুরো ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থানকে নরম করেছে। মস্কো যেকোন সময়েই এই সমঝোতা থেকে বের হয়ে যেতে পারে। তবে অবরোধকে বাইপাস করার মাধ্যমে রাশিয়া তার নিজস্ব কৃষিখাতের জন্যে যন্ত্রপাতি আমদানির চেষ্টা করতে পারে। ২০২১ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার ৭৫ শতাংশ কৃষি যন্ত্রপাতি জার্মানি ও নেদারল্যান্ডস থেকে আসতো।

গবেষণা সংস্থা ‘গ্রো ইন্টেলিজেন্স’এর জ্যেষ্ঠ গবেষক জনাথন হাইন্স ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’কে বলছেন যে, প্রথম জাহাজে করে লেবাননে যে ২৬ হাজার টন ভুট্টা রপ্তানি করা হয়েছে, তা প্রকৃতপক্ষে ২ কোটি টন শস্যের তুলনায় নিতান্তই তুচ্ছ। তুচ্ছ পরিমাণ সরবরাহের অর্থ হলো এর ফলশ্রুতিতে বিশ্বের বাজারে খাদ্যশস্যের মূল্য কমে যাচ্ছে না; অথবা বৈশ্বিক খাদ্য সমস্যার সমাধানও দ্রুতই হয়ে যাচ্ছে না। আর ইউক্রেনে আটকে পড়া বেশিরভাগ শস্যই হলো জীবজন্তুর খাবার; মানুষের খাবার নয়। এই পরিস্থিতি আফগানিস্তান এবং সোমালিয়ার মতো অঞ্চলের মানুষের ক্ষুধাকে দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দেবে। ঐসব দেশে মূল্যস্ফীতির কারণে খাদ্য এবং জ্বালানি মানুষের সামর্থের বাইরে চলে গেছে। লেবাননের ‘বেকা ফারমার্স এসোসিয়েশন’এর প্রধান ইব্রাহিম তারচিচি বলছেন যে, ইউক্রেনের শস্য হয়তো এখানকার বাজারে শস্যের সরবরাহ বৃদ্ধি করবে। কিন্তু ২০১৯ সালের পর থেকে লেবাননের অর্থনীতি কমপক্ষে ৫৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে! দেশের নিজস্ব মুদ্রার মান এতটাই কমে গেছে যে, এখানকার তিন চতুর্থাংশ মানুষই এখন দারিদ্র সীমার নিচে অবস্থান করছে। আর এর মূলে রয়েছে দেশটার রাজনৈতিক কোন্দল এবং মারাত্মক দুর্নীতি। এমতাবস্থায় ইউক্রেনের শস্য আমদানি এখানকার অর্থনীতিতে তেমন কোন প্রভাব ফেলবে না। তারচিচি মনে করছেন যে, ব্যবসার খরচ যতদিন বৃদ্ধি পাবে, আর মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমতে থাকবে, ততদিন এই সমস্যার সমাধান হবে না। মানবাধিকার সংস্থা ‘মার্সি কোর’ বলছে যে, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে আটার মূল্য ২’শ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে! বিশ্বব্যাংকের ১’শ ৫০ মিলিয়ন ডলারের ঋণের উপর ভর করে দেশটা ৬ থেকে ৯ মাসের জন্যে শস্য কিনছে। ইউক্রেনের শস্য রপ্তানি কোন চ্যারিটি নয়। কাজেই মানবিক চাহিদা নয়, বরং যেখানে ভালো মূল্য পাওয়া যাবে, সেখানেই এই শস্য বিক্রি হবে। একারণেই প্রথমে শস্য পাওয়াটা নির্ভর করবে মানবিকতার উপর নয়, বরং ব্যবসায়িক স্বার্থের উপর।

ইউক্রেন এবং রাশিয়া উভয়েই শস্য রপ্তানির সমঝোতা থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ এড়াবার সুবিধা নিতে চাইছে; কেউই এখানে চ্যারিটি করছে না। অপরদিকে ‘আইসিজি’র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, তুরস্কের ক্ষমতাসীন ‘একে পার্টি’ আশা করছে যে, ২০২৩ সালের নির্বাচনের আগে ইউক্রেনের শস্য রপ্তানির সমঝোতা তাদের জন্যে ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে। তবে অন্যরা মনে করছে যে, প্রেসিডেন্ট এরদোগান পররাষ্ট্রনীতির সফলতা দেখিয়ে অর্থনৈতিক দৈন্যদশা থেকে মানুষের দৃষ্টি সড়াতে চাইছেন। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ তাদের নিজ অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে রাশিয়াকে ছাড় দিয়েছে। কিন্তু যেহেতু এই সমঝোতার কারণে খাদ্যশস্যের আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা এখনই দূরীভূত হয়ে যাচ্ছে না এবং রাশিয়া যেহেতু এই সমঝোতার দীর্ঘমেয়াদী নিশ্চয়তা দেয়নি, তাই যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্বের জন্যে এখনই উল্লসিত হবার মতো কিছু ঘটেনি। অপরদিকে দরিদ্র দেশগুলির জনগণের সামনে ব্যাপক মূল্যস্ফীতির চাপ ও ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের মাঝে কৃষ্ণ সাগরের শস্য রপ্তানির সমঝোতা খুব কমই অর্থ বয়ে আনবে।

No comments:

Post a Comment