Saturday 27 August 2022

ব্রিটেনের অর্থনীতিতে ধ্বস আসন্ন?

২৭শে অগাস্ট ২০২২
 
ফেব্রুয়ারি ২০২২। লন্ডনে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাবার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ব্রিটিশ নাগরিকদের অর্থনৈতিক অবস্থা হয়েছে শোচনীয়। ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ নামের ভূরাজনৈতিক উচ্চাকাংক্ষা বাস্তবায়নে ব্রিটেন যেভাবে ব্রেক্সিটের দিকে এগিয়েছে, করোনার দুর্যোগের পর বৈশ্বিক জ্বালানি সমস্যার কারণে সেই চিন্তাগুলি খুব দ্রুতই ম্লান হয়ে যাচ্ছে।


ব্রিটেনের ‘অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকস’এর এক হিসেবে বলা হচ্ছে যে, ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে জুন মাসের মাঝে দেশটার অর্থনীতি শূণ্য দশমিক ১ সঙ্কুচিত হয়েছে। অথচ এবছরের প্রথম তিন মাসে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল শূণ্য দশমিক ৮ শতাংশ। বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে ‘বিবিসি’ বলছে যে, সামনের দিনগুলিতে অর্থনীতিতে ধ্বস নামার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এর কারণ হিসেবে করোনার প্রণোদনা শেষ হয়ে যাবার সাথে সাথে খুচরা বাজারে ক্রেতাদের চাহিদা কমে যাওয়া দায়ী। ‘ব্যাংক অব ইংল্যান্ড’এর পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে যে, জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির কারণে ২০২২ সাল শেষ হবার আগেই ব্রিটেনের অর্থনীতি মন্দার মাঝে পড়তে যাচ্ছে। টানা ছয় মাস অর্থনীতির নিম্নগতিকেই অর্থনৈতিক মন্দা হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ব্রিটেনের বার ও রেস্তোঁরার মালিকরা বলছেন যে, জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির কারণে তাদের এখনই মন্দার অনুভূতি হচ্ছে। মানুষ বাড়ি থেকে কম বের হচ্ছে; জীবনযাত্রার খরচ ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। এছাড়াও পোলট্রি থেকে শুরু করে ভোজ্যতেল, সকল কিছুরই মূল্য বেড়ে গেছে; উল্টোদিকে তাদের ক্রেতারা খরচ কমাতে চাইছে। এমতাবস্থায় ব্যবসাগুলি এখন কোনমতে বেঁচে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছে।

‘এসোসিয়েটেড প্রেস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ব্রিটেনে জ্বালানির মূল্য এতটাই বেড়েছে যে, নাগরিকেরা তাদের খরচের হিসেব রাখতে হিমসিম খাচ্ছেন। তাদের জ্বালানির মিটারের ব্যালান্স দেখতে দেখতেই শূণ্যের কোঠায় চলে যাচ্ছে। রান্না করার মাঝেই কারো কারো জ্বালানি চলে যাচ্ছে। আর যারা রাষ্ট্রীয় সহায়তা নিয়ে বেঁচে আছে, তাদের হাতে এখন বিদ্যুতের বিল পরিশোধের পর বাড়িভাড়া দেয়ার অর্থও থাকছে না। ২৬শে অগাস্ট ব্রিটেনের জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বলে যে, নাগরিকদের বাৎসরিক জ্বালানি খরচ ৮০ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে যাচ্ছে। অথচ গত এপ্রিল মাসেই জ্বালানি খরচ বেড়েছে ৫৪ শতাংশ! এর ফলশ্রুতিতে গড়পড়তা একেকটা বাড়ির জ্বালানি খরচ ২ হাজার ৩’শ ডলার থেকে বেড়ে প্রায় ৪ হাজার ২’শ ডলার হতে চলেছে। সর্বশেষ এই মূল্যবৃদ্ধি অক্টোবরের প্রথম দিন থেকে কার্যকর হতে চলেছে। আর ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে এই খরচ আরও বেড়ে ৪ হাজার ৭’শ ডলার অতিক্রম করবে! ‘জি-৭’ বা বিশ্বের সবচাইতে ধনী ৭টা দেশের গ্রুপের মাঝে ব্রিটেনের মূল্যস্ফীতি সবচাইতে বেশি। আর ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সাথে সমন্বয় করে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে কয়েক মাস ধরেই দেশজুড়ে রেল শ্রমিক, ডাকবিভাগের শ্রমিক, বন্দরের শ্রমিক, আইনজীবী, এমনকি পরিচ্ছন্ন কর্মীরাও ধর্মঘটে নেমেছে। জুলাই মাসে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ব্রিটেনের মূল্যস্ফীতি গিয়ে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ১ শতাংশে; যা কিনা ৪০ বছরের মাঝে সর্বোচ্চ!

‘এসএন্ডপি গ্লোবাল মার্কেট ইন্টেলিজেন্স’ এবং ‘সিবিআই’এর যৌথ এক গবেষণায় বলা হচ্ছে যে, জুলাই থেকে অগাস্ট মাসের মাঝে ব্রিটেনের ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টর যতটা দ্রুত উৎপাদন হারিয়েছে, তা ২০০৯ সালের পর থেকে দেখা যায়নি। ‘এসএন্ডপি’এর এসোসিয়েট ডিরেক্টর ‘দ্যা গার্ডিয়ান’কে বলছেন যে, ২০২০ সালের মে মাসে করোনার লকডাউনের পর থেকে উৎপাদন সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। অগাস্ট মাসে ব্রিটেনের বেসরকারি খাত অর্থনৈতিক স্থবিরতার আরও কাছাকাছি গিয়েছে। দেশটার সেবা খাত সামান্য ভালো করায় পুরো অর্থনীতি এখনও ধ্বসে যায়নি। ‘সিবিআই’এর অর্থনীতিবিদ আলপেশ পালেহা বলছেন যে, কারখানাগুলি যখন কাঁচামালের উচ্চমূল্য, সরবরাহ পেতে দেরি হওয়া ইত্যাদি সমস্যার মাঝে রয়েছে, তখন অর্থনৈতিক মন্দা হাজির হয়েছে; কাজেই বছরের বাকি মাসগুলিতে উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়াটাই স্বাভাবিক হবে। জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি এখন ব্যাংকের উচ্চ সুদের মাঝেও পড়তে হচ্ছে কারখানাগুলিকে। সুদের হার বর্তমানে ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ২০২৩ সালের বসন্তে ৪ শতাংশ হবার পূর্বাভাস দিচ্ছে কেউ কেউ।

ব্রিটিশ এনজিও ‘ক্রিশ্চিয়ান্স এগেইনস্ট পভার্টি’র জন টেইলর ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’কে বলছেন যে, যে মানুষগুলি কখনোই ঋণদায়গ্রস্ত ছিল না, এখন তারা ঋণের মাঝে পড়ে যাচ্ছে। অনেকেই তাদের কাছের মানুষকে হারিয়েছে; মানসিক বিপর্যয়ের মাঝে রয়েছে; তারা জানে না যে কিভাবে তারা তাদের পরবর্তী বিল পরিশোধ করবে, অথবা কিভাবে তারা বেঁচে থাকার জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য ক্রয় করতে পারবে। ‘জোসেফ রাউনট্রি ফাউন্ডেশন’এর গত মে মাসের গবেষণায় বলা হচ্ছে যে, ১০ লক্ষ ব্রিটিশ পরিবার জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে নতুন করে অতিরিক্ত ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছে। ফাউন্ডেশনের প্রধান অর্থনীতিবিদ রেবেকা ম্যাকডোনাল্ড বলছেন যে, এরকম দারিদ্র্য পরিস্থিতি তারা গত কয়েক দশকে দেখেননি। ব্রিটিশ সরকার বলছে যে, তারা আসছে শীতে সকল পরিবারকে ৪’শ ৭০ ডলার করে দেবে; কিন্তু অনেকেই বলছেন যে, এটা অন্ততঃ এর দ্বিগুণ পরিমাণ হওয়া উচিৎ।

‘দ্যা টেলিগ্রাফ’ বলছে যে, কয়েক শতকের জনসংখ্যা বৃদ্ধির পর এখন জন্মহার কমে যাওয়ায় ব্রিটেনের অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে যাচ্ছে। সামনের দিনগুলিতে করদাতার সংখ্যাও কমতে যাচ্ছে। এর সাথে যোগ হয়েছে নতুন সমস্যাগুলি। জ্বালানি কোম্পানি ‘ইডিএফ’এর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ফিলিপ কোমারেট ‘বিবিসি’কে বলছেন যে, ব্রিটিশ সরকার যদি জনগণকে জ্বালানি খরচ পোষাতে আরও সহায়তা না দেয়, তাহলে ব্রিটেনের অর্ধেক মানুষ শীতকালে ‘জ্বালানি দারিদ্র্য’র মাঝে পড়বে। এর অর্থ হলো, জ্বালানির খরচ পরিবারের ব্যয়ের ১০ শতাংশের বেশি হয়ে যাবে। নতুন হিসেব বলছে যে, করোনার লকডাউনের কারণে ২০২০ সালে ব্রিটেনের অর্থনীতিতে ৩’শ বছরের মাঝে সবচাইতে বড় ধ্বস নেমেছিল। এখন ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ৪০ বছরের মাঝে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে। এমতাবস্থায় প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের পদত্যাগের পর পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব অনেক কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ নামের ভূরাজনৈতিক উচ্চাকাংক্ষা বাস্তবায়নে ব্রিটেন যেভাবে ব্রেক্সিটের দিকে এগিয়েছে, করোনার দুর্যোগের পর বৈশ্বিক জ্বালানি সমস্যার কারণে সেই চিন্তাগুলি খুব দ্রুতই ম্লান হয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে নিতে বিপুল সামরিক সহায়তা দিচ্ছে ব্রিটেন। তবে আসন্ন অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ২০২৩ সালে আফ্রিকায় আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধি, মধ্যপ্রাচ্য ও ইন্দোপ্যাসিফিকে সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি, উত্তর ও পূর্ব ইউরোপের নিরাপত্তায় নেতৃত্ব দেয়া, ইত্যাদির মতো ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর ভূরাজনৈতিক চিন্তাগুলি বাস্তবায়নের উপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, সেটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

No comments:

Post a Comment