Monday 15 August 2022

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মুক্তি কি শুধুই সোনার হরিণ?

১৫ই অগাস্ট ২০২২

 
অগাস্ট ২০২২। সিয়েরা লিওনের রাস্তায় বিক্ষোভ। সিয়েরা লিওন ও ইকুয়েডরের বিক্ষোভের খবরগুলি জনগণের অস্থিরতা প্রকাশের একটা মাধ্যমের কথা বলছে, যার ফলশ্রুতিতে সরকারগুলি আইন শৃংখলা বজায় রাখতে হিমসিম খাচ্ছে। অপরদিকে তা শ্রীলঙ্কাতে সরকারের পতন ডেকে এনেছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের একদিকে যেমন কেউ সমাধান দিতে পারছে না, অপরদিকে সমস্যার কারণ হিসেবে করোনাভাইরাস বা ইউক্রেন যুদ্ধের উল্লেখও মানুষকে স্বস্তি দিতে পারছে না। অর্থনৈতিক মুক্তি এখন সোনার হরিণ ছাড়া আর কিছুই নয়।


গত ১০ই অগাস্ট পশ্চিম আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিওনের রাজধানী ফ্রীটাউনের রাস্তায় বিক্ষোভকারীদের সাথে নিরাপত্তারক্ষীদের মারাত্মক সংঘর্ষে ৬ জন পুলিশসহ কমপক্ষে ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে বিভিন্ন মিডিয়ার খবরে বলা হচ্ছে। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ ছিল ব্যাপক মূল্যস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি। সংঘর্ষের পর থেকে দেশটায় কারফিউ জারি করা হয়েছে এবং ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। ফ্রীটাউনের একজন ব্যবসায়ী ‘সিএনএন’কে বলছেন যে, সরকারের ভাষ্য হলো, অর্থনৈতিক দৈন্যতার জন্যে করোনা মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধই দায়ী। কিন্তু দেশটায় বেকারত্বও তো অত্যধিক। যুবকদের মাঝে অসন্তোষ অনেক বেশি।

সিয়েরা লিওনের এই বিক্ষোভ সেই দেশের বা আফ্রিকার কোন সমস্যাও নয়; একটা বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্বের অনেক দেশেই অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণে মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে শ্রীলঙ্কার খবরগুলি দুনিয়াব্যাপী প্রচার হয়েছে। জুন মাস থেকে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ইকুয়েডরে পুলিশের সাথে বিক্ষোভকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, বিক্ষোভকারীদের মূল দাবি ছিল জ্বালানির মূল্য কমানো এবং কৃষিজ দ্রব্যের মূল্যের উপর লাগাম টানা। বিক্ষোভের মূল আয়োজক ছিল দেশটার আদিবাসীদের সংগঠন ‘কনফেডারেশন অব ইন্ডিজেনাস ন্যাশনালিটিজ অব ইকুয়েডর’। রাজধানী কুইটোতেও হাজারো মানুষ বিক্ষোভ করেছে। বিক্ষোভকারীরা টায়ার জ্বালিয়ে এবং গাছের গুঁড়ি ও মাটি ফেলে রাজধানী শহরে ঢোকার রাস্তা আটকেছে। ২০২০ সাল থেকে দেশটায় ডিজেলের মূল্য প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। করোনা মহামারি থেকে বাঁচতে গিয়ে দেশটা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ‘আইএমএফ’এর কাছ থেকে সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়। তদুপরি দেশটায় অস্থিরতা চরমে উঠেছে।

জাতিসংঘের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও জলবায়ুগত উন্নয়ন বিষয়ক অঙ্গসংগঠন ‘ইকোসক’এর প্রেসিডেন্ট কলিন কেলাপাইল ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’এর সাথে এক সাক্ষাতে বলেন যে, করোনা মহামারি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দুনিয়াব্যাপী জাতিসংঘের দারিদ্র্য দূরীকরণ ও শিশুদের জন্যে শিক্ষা নিশ্চিতের কর্মকান্ড যতটুকু সফলতা পেয়েছিল, তা এখন উল্টো দিকে ধাবিত হচ্ছে; যা এর আগে কখনও ঘটেনি। পশ্চিমা দেশগুলি এখন ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থায়ন করছে; একারণে ২০৩০ সালের মাঝে জাতিসংঘ বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য দূরীকরণের যে টার্গেট নির্ধারণ করেছিল, তার জন্যে অর্থায়ন পাওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন যে, দারিদ্রের মতো চ্যালেঞ্জগুলি আরও আগে থেকেই ছিল। তিনি মনে করিয়ে দেন যে, একজন ক্ষুধার্ত মানুষ হলো একজন উত্তেজিত মানুষ। শ্রীলঙ্কার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন যে, খাদ্য এবং জ্বালানি না পাওয়ার কারণে জনগণের ক্রোধ সামনে চলে আসতে পারে। তবে কেলাপাইল স্বীকার করেন যে, করোনা মহামারির আগে থেকেই বৈশ্বিক উন্নয়ন কর্মকান্ডে অর্থায়ন কমছিল; এবং উন্নয়নশীল দুনিয়াতে প্রযুক্তি, বিশেষ করে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সংযোগের অপ্রতুলতা বিদ্যমান ছিল। বিশ্বের দরিদ্র্ দেশগুলি আরও বেশি করে ঋণের বোঝার নিচে তলিয়ে যাচ্ছে।

বৈশ্বিক দারিদ্র্যের কথা বললে ভারতকে বাদ দিয়ে আলোচনা সম্ভব নয়। ২০২১ সালে ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’এর এক গবেষণায় বলা হয় যে, করোনা মহামারির ফলশ্রুতিতে ভারতে দৈনিক ২ ডলারের কম আয়ের মানুষের সংখ্যা সাড়ে ৭ কোটি বৃদ্ধি পেয়েছে! এই সংখ্যাটা পুরো বিশ্বের দারিদ্র্য বৃদ্ধির সংখ্যার ৬০ শতাংশ! সেই গবেষণায় আরও বলা হয় যে, ভারতের মধ্যবিত্তের সংখ্যা ৩ কোটি ২০ লক্ষ কমে গেছে। এটাও সারা দুনিয়ার ৬০ শতাংশ। ভারতের ৭৫তম স্বাধীনতা দিবসে ডেনমার্কের ‘রসকিল্ডা ইউনিভার্সিটি’র এসোসিয়েট প্রফেসর সোমদীপ সেন ‘আল জাজিরা’র এক লেখায় মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, স্বাধীনতা দিবসে ভারতের উল্লসিত হবার কিছুই নেই। একদিকে যেমন দেশটার হিন্দুত্ববাদী সরকারের ইসলাম বিদ্বেষী নীতি মানবাধিকার ইস্যুকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তেমনি ভুল নীতি অনুসরণ করার কারণে নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। করোনা মহামারির আগেই ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ১৯৭৫-৭৬ সালের পর থেকে সর্বনিম্ন। জুন মাসে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী যুবকদের মাঝে বেকারত্বের হার ছিল প্রায় ৪৪ শতাংশ। দেশটার মুদ্রা রুপীর মূল্যমানের পতনও আমদানি-নির্ভর সেক্টরগুলি দুর্দশার কারণ হতে যাচ্ছে।

কিন্তু অর্থনৈতিক দুর্দশা শুধুমাত্র দরিদ্র্ দেশগুলিতেই নয়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলির জনগণও অর্থনৈতিক দৈন্যতার মাঝে রয়েছে। ব্রিটেনের ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বলছে যে, ব্রিটেনের ট্রেড ইউনিয়ন, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, ভাড়াটিয়াদের সংগঠন এবং রাজনীতিবিদেরা একত্রিত হয়ে দেশব্যাপী আন্দোলনে নেমেছে। তাদের অভিযোগ হলো সরকার জনগণের জীবনধারণের খরচ কমাতে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তারা ইতোমধ্যেই ৩ লক্ষ স্বাক্ষর যোগাড় করেছে; এবং দেশব্যাপী ৫০টা র‍্যালী করবে তারা। যোগাযোগ শ্রমিকদের সংগঠনের জেনারেল সেক্রেটারি ডেইভ ওয়ার্ড বলছেন যে, রাষ্ট্রের সামনে কোন না কোন একটা সমস্যা থাকবেই; আর সবসময়ই শ্রমিকদেরকেই সর্বোচ্চ মূল্য দিতে হয়। ধনীরা সর্বদাই চেষ্টা করছে যাতে করে শ্রমিকদের কাছ থেকে কম খরচে বেশি কাজ আদায় করে নেয়া যায়। এই ধনীরাই এখন অর্থনৈতিক সমস্যার মাঝ থেকে মুনাফা করে নিতে চাইছে; যখন লাখো মানুষ দারিদ্র্যের মাঝে পতিত হচ্ছে।

 
বৈরুতের ব্যাংকের অভ্যন্তরে বন্দুক হাতে বাসাম আল-শেখ হুসেইন। লেবাননে ব্যাংকারদের জিম্মি করার ঘটনা এবং সেই কাজের পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন দেখিয়ে দেয় যে, প্রচলিত আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা কতটা কমেছে। দারিদ্রের ফলস্বরূপ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে অসন্তোষ এবং আইনের শাসনে ধ্বস পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থাকে শুধুমাত্র মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মাঝেই ফেলেনি, অনেক ক্ষেত্রেই অকার্জকর করে ফেলেছে; যা মানুষের মাঝে পরিবর্তনের আকাংক্ষাকে বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছে।

গত কয়েক বছর ধরেই বিশ্ব মিডিয়াতে লেবাননের অস্থিরতার খবর এসেছে নিয়মিত। ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, লেবাননের নিজস্ব মুদ্রা ৯০ শতাংশ মূল্য হারিয়েছে। জাতিসংঘের হিসেবে দেশটার ৮০ শতাংশ মানুষ এখন দারিদ্র্যের মাঝে রয়েছে। এরকমই একটা পরিস্থিতিতে গত ১১ই অগাস্ট লেবাননের রাজধানী বৈরুতের একটা ব্যাংকে বাসাম আল-শেখ হুসেইন নামের এক ব্যক্তি অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করে নিজের একাউন্ট থেকে অর্থ উঠাবার দাবি করে। ‘বিবিসি’ বলছে যে, লেবাননের ব্যাংকগুলির উপর সরকার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে বলে দিয়েছে যে, মানুষ ব্যাংক থেকে কত অর্থ তুলতে পারবে। হুসেইনের ভাই বলেন যে, তার ব্যাংক একাউন্টে ২ লক্ষ ১০ হাজার ডলার রয়েছে। অথচ তার বাবার চিকিৎসার খরচ সে বহণ করতে পারছিল না। কারণ ব্যাংকাররা তাকে অর্থ দিতে গড়িমসি করছিল। তাই হুসেইন এই কাজ করতে বাধ্য হয়েছে। শেষ পর্যন্ত হুসেইনকে ৩৫ হাজার ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। লেবাননের জনগণের মাঝে সেই ব্যক্তি হিরো হিসেবে আখ্যা পেয়েছে। ‘সিএনএন’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, অনেকেই মনে করছে যে, তাদের সংসার চালাতে তাদেরকেও হুসেইনের মতোই কাজ করতে হবে। এখন কোন ঘটনা এটাকে উস্কে দেবে, সেটাই দেখার বিষয়।

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের একদিকে যেমন কেউ সমাধান দিতে পারছে না, অপরদিকে সমস্যার কারণ হিসেবে করোনাভাইরাস বা ইউক্রেন যুদ্ধের উল্লেখও মানুষকে স্বস্তি দিতে পারছে না। অর্থনৈতিক মুক্তি এখন সোনার হরিণ ছাড়া আর কিছুই নয়। মুক্ত বাজার অর্থনীতি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে বহুগুণে বৃদ্ধি করলেও বিশ্বের বেশিরভাগ দেশকেই আন্তর্জাতিক বাজারের উপর নির্ভরশীল করেছে। এর ফলশ্রুতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে যেকোন অস্থিরতাই বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক দৈন্যতার জন্ম দিয়েছে। দেশে দেশে বিক্ষোভ এবং সহিংসতা বৃদ্ধির সাথে সাম্প্রতিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও জ্বালানি সমস্যার সম্পর্ক থাকলেও শুধুমাত্র এগুলিই যে অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণ নয়, তা জাতিসংঘের কর্তাব্যক্তিদের কথায় পরিষ্কার। একদিকে ভারতের দারিদ্রের পরিসংখ্যানগুলি যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ঔপনিবেশিক শাসন-পরবর্তী গত সাত দশকের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, তেমনি ব্রিটেনের শ্রমিকদের ধনী শ্রেণীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়ে দেয় যে, আয় বৈষম্য নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছে। সিয়েরা লিওন ও ইকুয়েডরের বিক্ষোভের খবরগুলি জনগণের অস্থিরতা প্রকাশের একটা মাধ্যমের কথা বলছে, যার ফলশ্রুতিতে সরকারগুলি আইন শৃংখলা বজায় রাখতে হিমসিম খাচ্ছে। অপরদিকে তা শ্রীলঙ্কাতে সরকারের পতন ডেকে এনেছে। তবে লেবাননে ব্যাংকারদের জিম্মি করার ঘটনা এবং সেই কাজের পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন দেখিয়ে দেয় যে, প্রচলিত আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা কতটা কমেছে। দারিদ্রের ফলস্বরূপ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে অসন্তোষ এবং আইনের শাসনে ধ্বস পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থাকে শুধুমাত্র মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মাঝেই ফেলেনি, অনেক ক্ষেত্রেই অকার্জকর করে ফেলেছে; যা মানুষের মাঝে পরিবর্তনের আকাংক্ষাকে বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছে।

No comments:

Post a Comment