Friday 5 August 2022

ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর… মার্কিন অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলাফল

০৫ই অগাস্ট ২০২২
 
অগাস্ট ২০২২। চীন থেকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হচ্ছে তাইওয়ানকে উদ্দেশ্য করে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের স্পীকার ন্যান্সি পেলোসিকে তাইওয়ান যেতে মানা করার এখতিয়ার না থাকলেও সামরিক বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে তিনি পেলোসির তাইওয়ান সফরে বাধা সৃষ্টি করতে পারতেন; যা তিনি করেননি। তিনি পেলোসির সাথে দ্বন্দ্ব চাননি; বরং চীনের সাথে দ্বন্দ্বকেই তিনি বেছে নিয়েছেন।

অগাস্টের প্রথম সপ্তাহে মার্কিন কংগ্রেসের স্পীকার এবং ডেমোক্র্যাট দলের প্রবীণ নেতা ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ান সফর করার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের উত্তেজনা চরমে উঠেছে। চীনা সামরিক বাহিনী তাইওয়ানকে ঘিরে বিশাল আকারের সামরিক মহড়া শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই চীন কয়েক দশকে প্রথমবারের মতো তাইওয়ানের উপর দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে। বেশিরভাগ রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরাই যেকোন যুদ্ধ না হবার ব্যাপারে মত দিলেও উত্তেজনা সংক্রমিত হবার ব্যাপারটাকে সকলেই ভীতির চোখে দেখছেন।

জাপান সফরের সময় তিনি তার তাইওয়ান সফরের পক্ষে এই বলে যুক্তি দেন যে, যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে একঘরে করে ফেলার চীনা পরিকল্পনার বিরোধী। তার তাইওয়ান সফরের মাধ্যমে তিনি প্রমান দিতে চাইছেন যে, চীন মার্কিনীদেরকে তাইওয়ান সফরে বাধা দিতে পারবে না। তবে তিনি অত্র অঞ্চলের স্থিতি পরিবর্তনের পক্ষে নন। ‘বিবিসি’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, চীন এখন যেধরনের সামরিক উত্তেজনা তৈরি করেছে, সেটা যদি তারা পরবর্তী সময়েও করতে থাকে, তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, অত্র অঞ্চলের স্থিতাবস্থায় পরিবর্তন আসবে। বিশেষ করে তাইওয়ানের আকাশসীমায় আন্তর্জাতিক জাহাজ এবং বিমানের চলাচল বন্ধ করে অবরোধের মহড়া সত্যিকার অর্থেই একটা বড় পরিবর্তন। আর এই মহড়া চলছে পৃথিবীর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবাণিজ্য রুটের উপর; যেখান থেকে দুনিয়ার বেশিরভাগ সেমিকন্ডাকটরের সরবরাহ আসে। ব্যবসার সাথে জড়িত যেকেউই চাইবে যাতে এধরনের উত্তেজনা বেশিদিন স্থায়ী না হয়।

পেলোসির তাইওয়ান সফর ছিল ২৫ বছরের মাঝে সেখানে সর্বোচ্চ মার্কিন রাজনৈতিক সফর। অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এবং থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘এশিয়া সোসাইটি’র প্রধান কেভিন রাড ‘এবিসি নিউজ’কে বলছেন যে, পেলোসির সফরের ফলে তাইওয়ানের নিরপত্তা বৃদ্ধি পেলো কিনা, সেব্যাপারে তিনি একেবারেই নিশ্চিত নন। বিশেষ করে এই সফরের পর চীন সামরিক ও অর্থনৈতিক যেসব পদক্ষেপ নেবে, তা তাইওয়ানের জন্যে ভালো কিছু বয়ে আনবে না। এছাড়াও পেলোসির সফরের কারণে অত্র অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ব্যাহত হয়েছে। তিনি হয়তো তাইওয়ানের সাথে একাত্মতা এবং মানবাধিকার বিষয়ে তার বক্তব্যগুলিকে তুলে ধরতে সেখানে যেতে পারেন; যেগুলি তার ব্যক্তিগত আদর্শিক রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে তার তাইওয়ান সফর ছিল অবিবেচকের কাজ। আজকের এই উত্তেজনাগুলি একসময় যুক্তরাষ্ট্রকে চীনের সাথে সামরিক সংঘাতের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। আর ঠিক একারণেই চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে কৌশলগত প্রতিযোগিতাকে নিয়ন্ত্রণ করাটা জরুরি।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর প্রধান ইয়ান ব্রেমার ‘জি-জিরো মিডিয়া’র এক বিশ্লেষণে বলছেন যে, এই মুহুর্তে কেউই হয়তো তাইওয়ান ইস্যু নিয়ে কথা হোক সেটা চাননি। নিঃসন্দেহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও চাননি। অন্ততঃ এখন তো নয়ই; বিশেষ করে এই বছরেই যখন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে শি জিনপিং তৃতীয়বারের মতো দায়িত্ব পাবার চেষ্টা করছেন। ন্যান্সি পেলোসি প্রথমে তার এশিয়া সফরসূচিতে তাইওয়ানের নামটা লিখিত আকারে দেয়া থেকেও বিরত ছিলেন। সফরের দুই সপ্তাহ আগে হোয়াইট হাউজ জানতে পারে যে, পেলোসি তাইওয়ান সফর করতে চাইছেন। এই খবরটা তখনও মিডিয়াতে আসেনি। তবে হোয়াইট হাউজ থেকে পেলোসির কাছে চিঠি দিয়ে তাইওয়ান সফরের ব্যাপারে মানা করার ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে যায়। বাইডেন হয়তো সমস্যায় পড়েছেন যে, পেলোসিকে যেতে দেয়ার অর্থ হলো দলের উপর বাইডেনের প্রভাব নেই; অপরদিকে পেলোসিকে যেতে মানা করার অর্থ হলো বাইডেন তাইওয়ান নীতিতে দুর্বল। এছাড়াও চীনের দিক থেকে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, পেলোসির সফরের ব্যাপারে চীনকে একটা শক্ত প্রত্যুত্তর দিতেই হবে; নাহলে চীনা নেতৃত্ব তাদের জনগণের সামনে হেয় হবে। একারণেই চীন বারংবার এই সফরের বিরোধিতা করেছে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র বারংবার চীনকে হুমকি দিয়েছে যাতে চীন মার্কিন নীতির বিরুদ্ধে না যায়। উদাহরণস্বরূপ, দু’মাস আগেই যুক্তরাষ্ট্র চীনকে হুমকি দিয়েছে যাতে চীন রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ না করে এবং রাশিয়ার উপর অবরোধ না ভাঙ্গে। চীন এই হুমকিতে অত্যন্ত অখুশি হলেও তারা মোটামুটিভাবে মার্কিনীদের কথা শুনেছে। তবে তাইওয়ানের ইস্যু চীনের কাছে পুরোপুরিভাবে আলাদা।

 
অগাস্ট ২০২২। মার্কিন কংগ্রেসের স্পীকার ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ানে। ৮২ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদের অভিজ্ঞতা নিতান্তই কম নয়। কিন্তু রশ্ন হলো, স্পীকার নিজে কি তার সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে চিন্তাভাবনা করেননি? উচ্চ পদে আসীন হয়ে তার বোঝা উচিৎ ছিল যে, তাইওয়ান সফর করাটা তাইওয়ানের দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তার জন্যে ভালো হবে কিনা; অথবা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাইওয়ানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভালো হবে কিনা। পেলোসি এই ব্যাপারগুলি চিন্তা করেননি।

ন্যান্সি পেলোসির জন্ম ১৬ই মার্চ ১৯৪০। ৮২ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদের অভিজ্ঞতা নিতান্তই কম নয়। জন্মের পর থেকেই তিনি রাজনীতি দেখছেন। তার বাবা থমাস দালেস্রান্দো জুনিয়র ছিলেন ডেমোক্র্যাট দলের একজন কংগ্রেসম্যান। ১৯৭৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটির সদস্য নির্বাচিত হবার মাধ্যমে পেলোসির নির্বাচিত হওয়া শুরু। ১৯৮৭ সালে ৪৭ বছর বয়সে তিনি নির্বাচিত হয়ে কংগ্রেসে পদার্পণ করেন। ২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো এবং ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বারের মতো তিনি কংগ্রেসের স্পীকার নির্বাচিত হন।

মার্কিন রাজনীতিতে এক ব্যক্তি কি ইচ্ছে করলেই অন্য দেশের সাথে উত্তেজনা বৃদ্ধি করতে পারেন? এখানে প্রেসিডেন্টের কি কিছুই করার ছিল না; নাকি তিনি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তার অবস্থান ধরে রাখতে গিয়ে বৈশ্বিক অস্থিরতার মাঝে আরেকটা অস্থিরতাকে মেনে নিয়েছেন? কেভিন রাড বলছেন যে, মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থা অনুযায়ী কংগ্রেসের স্পীকার যেকোন স্থানে যেতে পারেন। এখানে হোয়াইট হাউজের বাধা দেয়ার তেমন কিছুই নেই। বরং এখানে প্রশ্ন হলো, স্পীকার নিজে কি তার সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে চিন্তাভাবনা করেননি? উচ্চ পদে আসীন হয়ে তার বোঝা উচিৎ ছিল যে, তাইওয়ান সফর করাটা তাইওয়ানের দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তার জন্যে ভালো হবে কিনা; অথবা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাইওয়ানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভালো হবে কিনা। পেলোসি এই ব্যাপারগুলি চিন্তা করেননি। ব্রেমার বলছেন যে, বাইডেনের পেলোসিকে তাইওয়ান যেতে মানা করার এখতিয়ার না থাকলেও সামরিক বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে তিনি পেলোসির তাইওয়ান সফরে বাধা সৃষ্টি করতে পারতেন; যা তিনি করেননি। তিনি পেলোসির সাথে দ্বন্দ্ব চাননি; বরং চীনের সাথে দ্বন্দ্বকেই তিনি বেছে নিয়েছেন। অপরদিকে চীন খুব সম্ভবতঃ তাদের পার্টি কংগ্রেসে তাইওয়ানে কে যেতে পারবে এবং কি করতে পারবে, সেব্যাপারে তাদের নীতির পরিবর্তন করবে; যা আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধিতে অনেক বেশি প্রভাব রাখবে। ফলাফলস্বরূপ, সম্ভাব্য সামরিক সংঘাতের ক্ষেত্রগুলিকে তা আরও অনেক বেশি বাড়িয়ে দেবে। অন্ততঃপক্ষে রাশিয়ার সাথে ঠান্ডা যুদ্ধের মাঝে কেউই এমনটা চায়নি।

No comments:

Post a Comment