Saturday 2 July 2022

রাশিয়া কি ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের ডনবাসে যুদ্ধ জিততে চলেছে?

০২রা জুলাই ২০২২

 
ইউক্রেনের পূর্বের শহর সেভেরোডোনেতস্কের উপর রুশ আর্টিলারির হামলা হচ্ছে। আপাততঃ ডনবাসের যুদ্ধ দীর্ঘ করার মার্কিন লক্ষ্যকে মেনে নেয়া ছাড়া ইউক্রেনিয়ানদের সামনে কোন পথ খোলা নেই। তবে সেই পথে সেভেরোডোনেতস্কের মতো শহরের পতন দেখিয়ে দেয় যে, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পরেও রাশিয়া হয়তো ধীরে ধীরে পুরো ডনবাস দখলে নিয়ে নিতে পারে; যার পরবর্তীতে যুদ্ধের ইতি টানার একটা পদক্ষেপ হয়তো ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে দেখা যেতে পারে; যা মার্কিন নীতির বিরুদ্ধ।


গত ২৫শে জুন রাশিয়া ঘোষণা দেয় যে, তাদের সেনারা ইউক্রেনের পূর্বের ডনবাস অঞ্চলের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর সেভেরোডোনেতস্ক পুরোপুরিভাবে দখল করে নিয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই রুশ বাহিনীর মূল টার্গেট ছিল এই শহর; আর্টিলারি এবং বিমান হামলায় এখন এই শহরের খুব কমই অবশিষ্ট রয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেন্সকি এক বার্তায় শহরটা হারাবার কথা স্বীকার করেন এবং বলেন যে, দিনটা ইউক্রেনের মনোবল এবং আবেগের জন্যে খুবই কঠিন একটা দিন। ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সেভেরোডোনেতস্ক শহর দখলের মাধ্যমে ইউক্রেনের ডনবাস অঞ্চলে রাশিয়ার কৌশলগত লক্ষ্য বাস্তবায়ন আরও এগিয়ে গেলো। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ এবং উত্তরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহর ছেড়ে আসতে বাধ্য হবার পর থেকে ডনবাসের নিয়ন্ত্রণ নেয়াই রাশিয়ার মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ডনবাস অঞ্চল ডোনেতস্ক এবং লুহানস্ক নামে দু’টা ভাগে বিভক্ত। এই দু’টার যেকোন একটার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার একটা বড় বিজয় বলে দেখাতে পারবেন। অন্ততঃ যুদ্ধ শুরুর পর থেকে নানা বিপর্জয়ের মাঝে রুশ বাহিনীর জন্যে সত্যিকারের যেকোন বিজয় অতি গুরুত্বপূর্ণ। সেভেরোডোনেতস্ক শহরের নিয়ন্ত্রণ নেবার পর রাশিয়ার জন্যে পুরো লুহানস্ক এলাকা নিয়ন্ত্রণ নেয়াটা আরও একধাপ এগিয়ে গেলো। তবে পুরো লুহানস্কের নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার জন্যে নিশ্চিত হচ্ছে না অত তাড়াতাড়ি। এই মুহুর্তে তাদের পথে রয়েছে ইউক্রেনের আরেক শহর লিসিচানস্ক। সেভেরোডোনেতস্ক শহর থেকে পিছু হটে ইউক্রেনিয়ান সেনারা খুব সম্ভবতঃ লিসিচানস্কেই গিয়েছে।

‘বিবিসি’র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, সেভেরোডোনেতস্ক এবং লিসিচানস্ক উভয় শহরই সিভার্স্কি ডোনেতস নদীর তীরে অবস্থিত। একমাস আগে এই নদীটা একবার অতিক্রম করতে গিয়ে রুশরা পুরো একটা ব্যাটালিয়ন হারায়। সেই ব্যর্থ মিশনে ইউক্রেনের আর্টিলারি হামলায় কয়েক’শ রুশ সেনা প্রাণ হারায় এবং কয়েক ডজন সাঁজোয়া যান ধ্বংস হয়। এই নদীর উপর সকল সেতু ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। এখন লিসিচানস্ক শহর দখলে নিতে হলে রুশদেরকে এই নদীই অতিক্রম করতে হবে। কাজেই এই নদী এখন রুশদের সামনে একটা বড় প্রাকৃতিক বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, লিসিচানস্ক শহরটা একটা পাহাড়ের উপর অবস্থিত হওয়ায় এই শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়াটা খুব সহজ কাজ হবে না।

 
পুরো লুহানস্কের নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার জন্যে নিশ্চিত হচ্ছে না অত তাড়াতাড়ি। এই মুহুর্তে তাদের পথে রয়েছে ইউক্রেনের আরেক শহর লিসিচানস্ক। সেভেরোডোনেতস্ক এবং লিসিচানস্ক উভয় শহরই সিভার্স্কি ডোনেতস নদীর তীরে অবস্থিত। একমাস আগে এই নদীটা একবার অতিক্রম করতে গিয়ে রুশরা পুরো একটা ব্যাটালিয়ন হারায়। এখন লিসিচানস্ক শহর দখলে নিতে হলে রুশদেরকে এই নদীই অতিক্রম করতে হবে। এখন রাশিয়ার সামনে করণীয় হলো এই শহরটাকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করা।

‘ইন্সটিটিউট ফর দ্যা স্টাডি অব ওয়ার’ যুদ্ধের প্রথম থেকেই প্রতিদিন ব্রিফিং দিচ্ছে। ২৪শে জুন তাদের বিশ্লেষণে বলা হয় যে, এটা এখন বোধগম্য যে, ইউক্রেনের সেনারা লিসিচানস্কের উঁচু ভূমিতে অবস্থান নেবে; যেখান থেকে তারা হয়তো বেশ কিছু সময় রুশ হামলা প্রতিহত করতে পারবে। এখন রাশিয়ার সামনে করণীয় হলো এই শহরটাকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করা। সেই লক্ষ্যে রুশরা লিসিচানস্ক শহরকে দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণের চেষ্টা চালাচ্ছে। রুশ সমর্থিত ইউক্রেনিয়ানদের মুখপাত্র আন্দ্রেই মরোচকো সাংবাদিকদের বলেন যে, তারা এখন যে গতিতে এগুচ্ছেন, তাতে তারা শিগগিরই পুরো লুহানস্ক অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে সক্ষম হবেন। তাদের অবস্থান থেকে তারা এখন লিসিচানস্কে ইউক্রেনিয়ান সেনাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম বলে বলেন তিনি।

কেউ কেউ সেভেরোডোনেতস্ক নিয়ন্ত্রণে যাওয়াকে একটা প্রতীকী বিজয় হিসেবে দেখছেন; যার কৌশলগত গুরুত্ব অপেক্ষাকৃত কমই। ইউক্রেনের সাবেক জেনারেল ইহর রোমানেঙ্কো ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, সেভেরোডোনেতস্ক তার দায়িত্ব পালন করেছে। সামরিক দিক থেকে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটা শহরের গুরুত্ব খুব কমই। রুশরা অনেক শক্তি ক্ষয় করেছে; যা সামনের দিনের যুদ্ধে তাদের সাফল্যের সম্ভাবনাকে কমিয়ে দেবে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইন্সটিটিউট ফর ওয়ার’এর হিসেবে এই শহরের পতন যুদ্ধক্ষেত্রে কোন কিছুই নিশ্চিত করেনি। আরেক মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘জেমসটাউন ফাউন্ডেশন’এর বিশ্লেষক পাভেল লুজিন ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, ইউক্রেনের সেনারা অনেকদিন ধরেই একটা বড় রুশ বাহিনীকে আটকে রেখে পরবর্তীতে পিছু হটেছে। রাশিয়ার কাছে সময় গুরুত্বপূর্ণ; কারণ রাশিয়ার সামরিক সক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিস্থাপনযোগ্য নয়। এই মুহুর্তে লুহানস্ক অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার কাছে চলে যেতে পারে বলে মনে হচ্ছে। লুহানস্কের গুরুত্বপূর্ণ কারখানা এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক স্থাপনাগুলি ২০১৪ সাল থেকে রুশ সমর্থিত মিলিশিয়াদের হাতেই রয়েছে। তবে ডোনেতস্ক অঞ্চল, যা লুহানস্কের চাইতে অনেক বড়, সেটার ৪০ শতাংশ ভূমি এখনও ইউক্রেনের অধীনেই রয়েছে। আর যেহেতু সেই অঞ্চলে ইউক্রেনিয়ানরা ২০১৪ সাল থেকে সামরিক স্থাপনা তৈরি করে আসছে, তাই সেটা দখলে নেয়াটা রুশদের জন্যে আরও অনেক কঠিন হবে। ইউক্রেনের বিশ্লেষক লিস্ট আলেক্সেই কুশ্চএর মতে, মারিউপোল শহর হারানোটা ইউক্রেনের জন্যে অনেক বড় ক্ষতি ছিল; কারণ সেটা ছিল সমুদ্রবন্দর এবং সেখানে ইউক্রেনের বেশিরভাগ লৌহজাত পণ্য তৈরি হতো।

যুদ্ধের শুরুতেই রাশিয়া মারাত্মক ভুল করেছে এই ভেবে যে, ইউক্রেনের সামরিক সক্ষমতাকে রুশরা হয়তো খুব সহজেই ধ্বংস করে ফেলতে পারবে। আর ইউক্রেনকে যে পশ্চিমারা সামরিক সহায়তা দেবে, সেটাও হয়তো পুতিন হিসেবের মাঝে নেননি। হয়তো ইউক্রেনের যুদ্ধ খুব দ্রুত শেষ হয়ে যাবে ধারণা করেই তিনি এমনটা মনে করেছিলেন। মার্কিন নেতৃত্বও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথমে নিশ্চিত ছিল না যে, ইউক্রেনের সেনাবাহিনী টিকতে পারবে কিনা। সেকারণে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে সামরিক সহায়তার ঘোষণা আসতে বেশ সময় লেগেছে। তথাপি ইউক্রেনের হারানো ভূমি পুনরুদ্ধার করার জন্যে যেসব অস্ত্র প্রয়োজন ছিল, সেগুলি মার্কিনীরা সরবরাহ করতে যথেষ্ট গরিমসি করেছে। ডনবাসে রুশদের লক্ষ্য নির্ধারিত হবার পরেই মার্কিনীরা ইউক্রেনকে ট্যাংক এবং আর্টিলারির মতো অস্ত্র দিতে শুরু করে। তবে সেগুলির সংখ্যা যেমন অপ্রতুল, তেমনি পশ্চিমারা ইউক্রেনকে কোন যুদ্ধবিমান সরবরাহ না করায় রুশ শক্তির বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে জয়লাভ করা ইউক্রেনিয়ানদের জন্যে প্রায় অসম্ভবই ঠেকছে। আপাততঃ ডনবাসের যুদ্ধ দীর্ঘ করার মার্কিন লক্ষ্যকে মেনে নেয়া ছাড়া ইউক্রেনিয়ানদের সামনে কোন পথ খোলা নেই। তবে সেই পথে সেভেরোডোনেতস্কের মতো শহরের পতন দেখিয়ে দেয় যে, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পরেও রাশিয়া হয়তো ধীরে ধীরে পুরো ডনবাস দখলে নিয়ে নিতে পারে; যার পরবর্তীতে যুদ্ধের ইতি টানার একটা পদক্ষেপ হয়তো ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে দেখা যেতে পারে; যা মার্কিন নীতির বিরুদ্ধ।

No comments:

Post a Comment