Sunday 3 July 2022

এরদোগান কেন বিন সালমানকে আলিঙ্গন করছেন?

০৩রা জুলাই ২০২২
 
বিন সালমান আঙ্কারা এসে এরদোগানের নিঃশর্ত আত্মসমপর্নকেই যেন গ্রহণ করলেন! এটা প্রমাণ করে যে, এরদোগান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণভাবে কতটা চাপের মাঝে রয়েছেন। তবে আঞ্চলিকভাবে আরব দেশগুলি এবং ইস্রাইলের আরও কাছাকাছি যাবার কারণে তুরস্কের সাথে ইরানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে টানাপোড়েন আরও বাড়তে পারে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থানে এটা নতুন আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক সমীকরণ।


গত ২২শে জুন সৌদি যুবরাজ এবং সৌদি আরবের বাস্তবিক শাসক মোহাম্মদ বিন সালমান তুরস্ক সফরে যান। সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের সম্পর্কে বহুমাত্রিক উত্তেজনার পর বিন সালমানের এই সফরকে অনেকেই গুরুত্ব সহকারে দেখছেন। বিশেষ করে ২০১৮ সালে ইস্তাম্বুলের সৌদি কনসুলেটের ভেতর সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকান্ডের পর সৌদি আরবের ব্যাপারে তুরস্কের শক্ত অবস্থানের ক্ষেত্রে এই সফর যথেষ্টই বড় পরিবর্তন। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগানের এহেন নীতি পরিবর্তন অনেককেই অবাক করেছে। ২০২০ সাল থেকে সৌদি আরব তুর্কি পণ্যের উপর অনানুষ্ঠানিক অবরোধ বজায় রেখেছিল এবং দুই বছরের ধরে সৌদি নাগরিকদের তুরস্ক ভ্রমণের উপরে নিষেধাজ্ঞা ছিল। বিন সালমানের সফরের পর দুই দেশের পক্ষ থেকে এই সফরকে সম্পর্কের নতুন অধ্যায় বলে আখ্যা দেয়া হয়। একইসাথে বাণিজ্য সহজীকরণ, কর্মকর্তাদের নিয়মিত বৈঠকের আয়োজন এবং সম্ভাব্য মুদ্রা বিনিময় নিয়েও আলোচনা হয়েছে।

‘ব্লু-বে এসেট ম্যানেজমেন্ট’এর জ্যেষ্ঠ কৌসুলী টিমথি এশ ‘ভয়েস অব আমেরিকা’কে বলছেন যে, এরদোগানের এই নীতি পরিবর্তন মূলতঃ অর্থনৈতিক বাস্তবতার কারণেই। আগামী বছরের জুনে তুরস্কে নির্বাচন। এর আগে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা মোটেই ভালো নয়। মূল্যস্ফীতি ৭০ শতাংশে ঠেকেছে; বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমে গেছে; তুর্কি মুদ্রা লিরা গত এক বছরের মাঝে অর্ধেকের বেশি মূল্য হারিয়েছে। এর মুহুর্তে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত তার দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে এরদোগের প্রয়োজন বৈদেশিক মুদ্রা।

লন্ডন ভিত্তিক আরব মিডিয়া ‘দ্যা নিউ এরাব’এর এক লেখায় কাতারের ‘ইবনে খালদুন সেন্টার ফর হিউম্যানিটিজ এন্ড সোশাল সায়েন্সেস’এর গবেষক আলী বাকির এবং লন্ডনের ‘কিংস কলেজ’এর ‘ইন্সটিটিউট অব মিডল ইস্টার্ন স্টাডিজ’এর ফেলো এইরুপ এরসয় বলছেন যে, দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ যথেষ্ট এগুলেও সম্পর্ককে পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যাবার জন্যে কিছু ঘটেনি। কথা নয়, বরং সামনের দিনগুলিতে দুই দেশের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপগুলিই বলে দেবে যে এই সম্পর্ক কতটা আন্তরিক। এক যৌথ বিবৃতিতে অনেক কিছুই বলা হলেও বিবৃতিটা যতটা না সুনির্দিষ্ট কর্মপদ্ধতি, তার চাইতে বরং সহযোগিতার অভিব্যক্তি। মাত্র এক ঘন্টার ব্যবধানে বিবৃতির দুইটা ভার্সন সাংবাদিকদের দেয়া হয়। দুই নেতার যৌথ বিবৃতিতে যতটা পরিবর্তন করতে হয়েছে, তাতে বোঝা যায় যে, সম্পর্কের ভিত্তি এখনও বিশ্বাসের উপরে ভিত্তি করে নয়; বরং স্বার্থের উপর। দুই দেশের মাঝে পর্যটন বাড়াবার কথা বলা হলেও শেষ মুহুর্তে বিবৃতি থেকে পারস্পরিক ফ্লাইট বৃদ্ধি করার বাক্যটা কেটে দেয়া হয়। আর বিবৃতিতে কারুর কোন স্বাক্ষরও নেই। লেখায় বলা হচ্ছে যে, সৌদিরা তাদের চুক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল না থাকার রেকর্ড রয়েছে। যৌথ বিবৃতিতে বেশকিছু অংশই ছিল পূর্বে স্বাক্ষরিত চুক্তিকে বাস্তবায়ন করা ব্যাপারে; বিশেষ করে প্রতিরক্ষা বিষয়ক সহযোগিতার ক্ষেত্রে।

‘লন্ডন এনার্জি ক্লাব’ এবং ‘গ্লোবাল রিসোর্সেস পার্টনার্স’এর চেয়ারম্যান মেহমেত ওগুটচু ‘ভয়েস অব আমেরিকা’কে বলছেন যে, দুই দেশের মাঝে এখনও আস্থার ঘাটতি রয়েছে। উভয় দেশই অঞ্চলিকভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। এবং তারা একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখে। তবে নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষা বিষয়টাকে অনেকেই দুই দেশের মাঝে সমঝোতার জায়গা বলে মনে করছেন। ইরানের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা উভয় দেশেরই সমস্যা। ওগুটচু বলছেন যে, সৌদিরা বুঝতে পারছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের এখন মূল ফোকাস হলো চীন। কাজেই মার্কিনীরা সামনের দিনগুলিতে সৌদিদের সাথে থাকবে না। এমতাবস্থায় রিয়াদের নেতৃত্ব তুরস্ককে ইরানের বিরুদ্ধে ব্যালান্সিং শক্তি হিসেবে দেখছে। তবে এই সম্পর্ক পারস্পরিক দেয়ানেয়ার উপর নির্ভরশীল হবে। কাজেই এখানে উভয় দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তার স্বার্থ জড়িত। তথাপি ২০২৩ সালের নির্বাচনের আগে সৌদি যুবরাজ এরদোগানকে আর্থিক দিক থেকে সহায়তার হাত বাড়াবেন কিনা, সেব্যাপারে কোন সমঝোতা দুই দেশের মাঝে হয়নি।

মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর তুর্কি ধারার ডেপুটি ডিরেক্টর পিনার দোস্ত ‘সিএনবিসি’কে বলছেন যে, সৌদিদের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ব্যাপারটাকে আঞ্চলিকভাবে অনেক দেশের সাথেই তুরস্কের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার অংশ হিসেবে দেখতে হবে। সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইস্রাইলের সাথে তুরস্ক ইতোমধ্যেই সম্পর্কোন্নন করেছে; মিশরের সাথেও তুরস্ক কথা চালাচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। আঞ্চলিকভাবে তুরস্ক তার একাকীত্ব ঘোচাতে চাইছে। যেমন পূর্ব ভূমধ্যসাগরে প্রাকৃতিক গ্যাস প্রকল্প নিয়ে কয়েকটা দেশ সহযোগিতা করলেও সেখানে তুরস্ককে বাদ রাখা হয়েছে। তুরস্ক আঞ্চলিকভাবে তার অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে আরও বাড়াতে চাইছে। সৌদি আরবকে তুরস্ক তার পণ্য এবং পর্যটনের জন্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ বাজার হিসেবে দেখে। তুরস্কের পণ্যের উপর সৌদিদের অনানুষ্ঠানিক অবরোধ তুরস্কের অর্থনীতিকে সহায়তা দেবে। প্রায় দুই বছর পর গত মে মাসে তুরস্ক এবং সৌদি আরবের মাঝে ফ্লাইট পুনরায় চালু হয়েছে। তবে একইসাথে পিনার দোস্ত মনে করছেন যে, এই সফরের মাধ্যমে ইরান বিরোধী আরব-ইস্রাইলি জোটের আরও কাছাকাছি গিয়েছে তুরস্ক।

‘সিএনবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বিন সালমানের তুরস্ক সফর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফরের আগেই এলো। বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা এতদিন সৌদিদের মানবাধিকার বিষয়ে সমালোচনা করলেও এখন সৌদিদের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করা ছাড়া তাদের আর গত্যন্তর নেই। অনেকেই বলছেন যে, বাইডেনের এই সফরের মূল উদ্দেশ্য হবে আন্তর্জাতিক তেলের বাজারে মূল্যস্ফীতি লাগামে আনতে সোদিদেরকে তেলের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে অনুরোধ করা; এবং একইসাথে ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে অনুপ্রেরণা যোগানো। বাইডেনের আসন্ন সফরের বাস্তবতায় তুর্কি নীতি পরিবর্তনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে টিমথি এশ বলছেন যে, বিন সালমান আঙ্কারা এসে এরদোগানের নিঃশর্ত আত্মসমপর্নকেই যেন গ্রহণ করলেন! এটা প্রমাণ করে যে, এরদোগান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণভাবে কতটা চাপের মাঝে রয়েছেন। অর্থনৈতিক চাপ এড়াতে আশেপাশের যেসব দেশের সাথে সম্পর্কে উত্তেজনা ছিল, তাদের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইছে তুরস্ক। ইউক্রেনের বন্দরগুলি থেকে জরুরি খাদ্যপণ্যগুলি রপ্তানির অনুমতি দিতে রাশিয়ার সাথে কথা বলছে তুরস্ক। তবে আঞ্চলিকভাবে আরব দেশগুলি এবং ইস্রাইলের আরও কাছাকাছি যাবার কারণে তুরস্কের সাথে ইরানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে টানাপোড়েন আরও বাড়তে পারে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থানে এটা নতুন আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক সমীকরণ।

No comments:

Post a Comment