Friday 29 July 2022

রুশ গ্যাস ছাড়া শীতকাল পার হতে পারবে জার্মানি?

৩০শে জুলাই ২০২২

একসময় কিছু দেশ অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়ে জার্মানির লেকচার শুনেছে। এখন এই দেশগুলিকেই অনুরোধ করা হচ্ছে, তারা যেন গ্যাসের ব্যবহার কমিয়ে জার্মানিকে ‘গ্যাসের দেউলিয়াত্ব’ থেকে উদ্ধার করে! ইইউএর মাঝে থেকেও জার্মানি নিজস্ব নীতিকে অনুসরণ করতে চেয়েছে; প্রয়োজনে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলিকে জার্মানির তৈরি করে দেয়া নীতি অনুসরণ করতে বাধ্যও করেছে। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইউরোপের বাকি দেশগুলির সাথে জার্মানির নীতিগত সংঘর্ষ আরও প্রবল হয়েছে।

রাশিয়া থেকে জার্মানি পর্যন্ত ‘নর্ড স্ট্রিম ১’ গ্যাস পাইপলাইনে রুশ কোম্পানি ‘গ্যাজপ্রম’ গ্যাস সরবরাহ ব্যাপকভাবে কমিয়ে দেয়ার ঘোষণা দেবার পরপরই জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে ইইউ সমঝোতায় পৌঁছে যে, তারা আগামী শীতের মাঝে অগাস্ট থেকে মার্চ পর্যন্ত স্বেচ্ছায় তাদের গ্যাসের ব্যবহার ১৫ শতাংশ কমাবে। আর রাশিয়া যদি ইউরোপে গ্যাস রপ্তানি পুরোপুরিভাবে বন্ধ করে দেয়, তাহলে জরুরি ভিত্তিতে বাধ্যতামূলকভাবে গ্যাস ব্যবহার কমাতে হবে। তবে এই জরুরি অবস্থা কখন কিভাবে ঘোষণা হতে পারে, সেব্যাপারে সমঝোতা হয়নি। তথাপি ইইউএর গ্যাস নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত নয় বা এই নেটওয়ার্কের উপর নির্ভরশীলতা কম, এমন দেশগুলি এই সমঝোতার বাইরে থাকতে পারবে; যার মাঝে পড়বে দ্বীপ দেশ আয়ারল্যান্ড, সাইপ্রাস এবং মাল্টা; তিনটা বল্টিক রাষ্ট্র লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়া; এবং দক্ষিণ ইউরোপের দেশ স্পেন, পর্তুগাল, ইতালি ও গ্রিস। প্রস্তাবের পক্ষে জোরেসোরে কাজ করা চেক রিপাবলিকের মন্ত্রী জোসেফ সিকেলা সাংবাদিকদের বলেন যে, এই সমঝোতা বেশ কঠিন ছিল; তবে এর দরকার সকলেই বুঝতে পেরেছে। এখন সকলে মিলে কষ্ট ভাগাভাগি করে নেবে তারা। জার্মান মন্ত্রী রবার্ট হাবেক স্বীকার করেন যে, রুশ গ্যাসের উপর নির্ভরশীল হয়ে জার্মানি কৌশলগত ভুল করেছে। তবে এখন এটা শুধু জার্মানির সমস্যা নয়। ফরাসি মন্ত্রী আগনেস পানিয়ে-রানুশে বলেন যে, এখানে পুরো ইউরোপের অর্থনীতির স্বাস্থ্য প্রশ্নের মুখে পড়েছে; কারণ ইইউএর শিল্পগুলি একে অপরের উপর নির্ভরশীল। জার্মানির কেমিক্যাল শিল্পে সমস্যা হলে সারা ইউরোপের শিল্পই সমস্যায় পড়ে যাবে।

ইইউএর মাঝে হাঙ্গেরি এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। তারা এর আগেও রাশিয়ার তেল আমদানি বন্ধের ইইউ সিদ্ধান্তের সাথে একমত হয়নি। স্পেনের মন্ত্রী তেরেসা রিবেরা জার্মানিকে উদ্দেশ্য করে বলেন যে, তারা তাদের জ্বালানির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার সময় তো অন্য কারুর উপদেশ নেয়নি; তাহলে স্পেন কেন তাদের জন্যে কষ্ট সহ্য করবে? তিনি এই ভাষা ব্যবহার করেছেন, কারণ স্পেন তার বেশিরভাগ গ্যাস আফ্রিকা থেকে আমদানি করে।

ব্রিটেনের ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এক দশক আগে দক্ষিণ ইউরোপের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময় জার্মানি সেই দেশগুলির ঋণে জর্জরিত হয়ে যাবার সমালোচনায় বলেছিল যে, তারা তাদের নিজেদের ঘরের কাজগুলি করেনি। এখন রুশ গ্যাসের উপর নির্ভরশীলতা কমাবার ক্ষেত্রে বাস্তবতা হলো, জার্মানি ক্লাসের সবচাইতে খারাপ ছাত্র। স্পেনের মন্ত্রী রিবেরা এবার জার্মানিকে ঐ একই কথাগুলি ফেরত দিয়ে বলেছেন যে, এলএনজি আমদানির অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করে স্পেন নিজেদের ঘরের কাজগুলি করেছে। তিনি প্রকৃতপক্ষে জার্মানির সমালোচনাই করেছেন; কারণ জার্মানি রুশ গ্যাসের উপর নির্ভরশীল থেকে এলএনজি আমদানির কোন অবকাঠামোই তৈরি করেনি। জার্মান পত্রিকা ‘সুডশে জাইটুং’ প্রায় একইভাবে বলছে যে, একসময় কিছু দেশ অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়ে জার্মানির লেকচার শুনেছে। এখন এই দেশগুলিকেই অনুরোধ করা হচ্ছে, তারা যেন গ্যাসের ব্যবহার কমিয়ে জার্মানিকে ‘গ্যাসের দেউলিয়াত্ব’ থেকে উদ্ধার করে! আরেক জার্মান পত্রিকা ‘ফ্রাংকফুটার আলেমাইনে’ বলছে যে, ‘নর্ড স্ট্রিম ১’ পাইপলাইন তৈরি করার সময় জার্মানরা পোল্যান্ড ও পূর্ব ইউরোপের বাকি দেশগুলির জ্বালানি এবং নিরাপত্তার প্রশ্নকে উপেক্ষা করেছিল। আর জার্মানরা সর্বদাই দাবি করেছে যে, তারা বাকিদের চাইতে বেশি জানে!

‘ডয়েচে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে বিশ্লেষণ করা হয়েছে যে, জার্মানি কি কি পদ্ধতিতে এই সংকট কাটাবার চেষ্টা করতে পারে। প্রথমতঃ এলএনজিএর মাধ্যমে অন্যান্য সূত্র থেকে সমুদ্রপথে গ্যাস আমদানি করতে পারে তারা। দ্বিতীয়তঃ নিজ দেশে গ্যাসের ব্যবহার কমাতে চেষ্টা করতে পারে। তৃতীয়তঃ কয়লার ব্যবহার বাড়িয়ে দিতে পারে। চতুর্থতঃ তারা ক্ষমতাসীন কোয়ালিশনে থাকা ছোট দল ‘ফ্রি ডেমোক্র্যাট’এর কথা শুনে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলিকে আরও বেশি সময়ের জন্যে সার্ভিসে রাখার চেষ্টা করতে পারে। ২০২২ সালের মাঝেই জার্মানির সর্বশেষ তিনটা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়ার কথা রয়েছে। জার্মানি ইতোমধ্যেই পারমাণবিক বিদ্যুতের জন্যে জ্বালানি কেনা বন্ধ করে দিয়েছে; নতুন করে কিনতে গেলে সেটা ২০২৩ সালের শরতকালের আগে সম্ভব হবে না। শীতকালে চালু রাখলে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলি থেকে কম উৎপাদন আসবে। এছাড়াও সমস্যা হলো পারমাণবিক বিদ্যুতের জন্যে ইউরেনিয়ামের ২০ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে; আরও ২০ শতাংশ আসে রাশিয়ার বন্ধু দেশ কাজাখস্থান থেকে। তথাপি পারমাণবিক বিদ্যুৎ জার্মানির মোট বিদ্যুতের তুলনায় তেমন কিছুই নয়; বায়ুশক্তি থেকেই আসে এর চাইতে তিনগুণ বিদ্যুৎ। আর গ্রীষ্মে বেশি গরম পড়লে নদীর উষ্ণ পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুল্লি ঠান্ডা করার কাজে ব্যবহার করা যাবে না। বায়ুশক্তি বৃদ্ধি করার ১০ হাজার মেগাওয়াটের প্রকল্প রয়েছে জার্মানির; তবে প্রথম টার্বাইন থেকে বিদ্যুৎ আসতেও ৬ বছর লেগে যাবে। এছাড়াও পরিবেশ রক্ষার আইনের কারণে সোলার এবং বায়োগ্যাস থেকে দ্রুতই অতিরিক্ত বিদ্যুৎ আশা করা যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় পরিবেশ রক্ষার ব্রতকে আপাততঃ ভুলে গিয়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলির উৎপাদন বৃদ্ধি এবং গ্যাসের ব্যবহার কমানোই জার্মানির সামনে খোলা পথ।

রুশ গ্যাসের সরবরাহ বন্ধের কাছাকাছি চলে যাওয়ার পর জার্মানির হ্যানোভার শহর সরকারি ভবনগুলিতে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গরম পানির সরবরাহ বন্ধ ঘোষণা করেছে। ঝরণাগুলি বন্ধ থাকবে; রাতের বেলায় সরকারি ভবনগুলিতে আলো জ্বলবে না। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও তাপমাত্রা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। ‘বিবিসি’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, এই ব্যবস্থাগুলি আসছে শীতকালের আগে গ্যাসের মজুত বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে। জার্মানির জ্বালানি কোম্পানিগুলিকে দেউলিয়াত্ব থেকে বাঁচাতে জার্মান পরিবারগুলিকে বছরে অতিরিক্ত ৫’শ ইউরো গুণতে হতে পারে। ইইউএর মাঝে থেকেও জার্মানি নিজস্ব নীতিকে অনুসরণ করতে চেয়েছে; প্রয়োজনে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলিকে জার্মানির তৈরি করে দেয়া নীতি অনুসরণ করতে বাধ্যও করেছে। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইউরোপের বাকি দেশগুলির সাথে জার্মানির নীতিগত সংঘর্ষ আরও প্রবল হয়েছে। জাতীয়তাবাদের উত্থানের বাস্তবতার মাঝে ইইউএর চিন্তাটাই যখন প্রশ্নবিদ্ধ, তখন বিশাল অর্থনৈতিক শক্তি হবার পরেও জার্মানির অসহায়ত্ব এখন সকলের সামনে পরিষ্কার। এহেন দুর্বলতা জার্মানির জাতীয় গর্বের উপর আঘাত; যা দেশটার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী রাজনৈতিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করার বীজ হতে পারে।

2 comments:

  1. Why is it necessary for Germany to singlehandedly face the consequences while EU took the decision to follow American policy without question as a whole??
    They can easily threat to deescalate the situation with Russia!
    Europeans shall start thinking independently. They are fighting American wars for last eight decades and only Americans are benefitted, both financially and ideologically.

    ReplyDelete
    Replies
    1. Thats an excellent observation!

      To make sense of it all, its needs to be remembered how nation states within Europe were created since the 17th century. Western ideology by default nurtures nationalism, which ultimately solidifies the inherent unrest with their system. As a result, there are obvious differences among nation states, which ultimately allowed an outside power (United States) to intervene; even though the US was the creation of the same European ideology.

      Anyway, the US has just followed the same British policy of keeping Europe divided; so that there is no single leadership in control of entire Europe. Such a possibility has kept Britain constantly at work since the 16th century. Yet, the creation of Germany has undermined the whole effort. Not only that, while Britain led the effort to destroy and distribute the Ottoman Caliphate during WWI, a counter ideological force got itself established at Moscow.

      So, in the end, Britain's own effort resulted in the creation of an ideological competitor. And then, in order to counter that ideological threat, Britain ended up encouraging another nationalist power in Germany that tried to unite whole of Europe under a single leadership. This, again, resulted in another bloody war that took the Western ideological leadership away from Britain.

      In summary, even though Britain has led the ideology of the Western Civilization, the 'trial & error' characteristics of it all, or in other words, the inherent flaws of that ideology have given birth to bloody competition and regular unrest. The tension with Russia, control of Germany and intervention of US in Europe are not just part of an American policy; these are byproducts of Western ideology itself.

      Delete