Wednesday 13 July 2022

শিনজো আবে জীবন দিয়ে জাপানের সংবিধান পরিবর্তনের পথকে উন্মুক্ত করে দিয়ে গেলেন

১৩ই জুলাই ২০২২
 
যুক্তরাষ্ট্র আঞ্চলিক নিরাপত্তার ব্যাপারে, বিশেষ করে চীনকে নিয়ন্ত্রণে, জাপানকে আরও কর্মক্ষম দেখতে ইচ্ছুক। ১৯৪৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রচিত জাপানের সংবিধান দেশটাকে শান্তিকামী করে রেখেছে। এখন সেই একই সংবিধানকে পরিবর্তনে অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। শিনজো আবের মৃত্যু জাপানের সংবিধান পরিবর্তনের প্রচেষ্ঠাটাকে এগিয়ে নিলেও এর মাধ্যমে আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা রয়েছে বলেই অনেকের ধারণা।


গত ৮ই জুলাই জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে এক আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। আবের হত্যাকান্ডের মাত্র দু’দিনের মাথায় জাপানের ক্ষমতাসীন ‘লিবারাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি’ বা ‘এলডিপি’ পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের নির্বাচনে বড় বিজয় পেয়েছে। অনেকেই বলছেন যে, এর ফলে জাপানের রাজনীতিতে বহুদিনের আলোচিত বিষয় সাংবিধানিক পরিবর্তন একটা ফলাফল দেখবে। কেউ কেউ বলছিলেন যে, আবের হত্যাকান্ড ক্ষমতাসীনদের বিজয়ের ব্যবধানকে বাড়িয়ে দিতে পারে; নির্বাচনের ফলাফল এখন সেদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। ২০১৯ সালের নির্বাচনে ৪৯ শতাংশ মানুষ ভোট দিলেও এবারে দিয়েছে ৫২ শতাংশ মানুষ। জাপানের ‘কিয়োদো’ বার্তা সংস্থা বলছে যে, এটা ২০১৩ সালের পর থেকে ‘এলডিপি’র সবচাইতে বড় বিজয় ছিল। বিরোধী দল ‘কন্সটিটিউশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব জাপান’, যারা সংবিধান পরিবর্তনের বিরোধী, তারা ৬টা আসন হারিয়েছে। দলের নেতা ইউকো মোরি বলছেন যে, শান্তিবাদী সংবিধানের মাধ্যমে আশেপাশের দেশগুলির সাথে জাপানের সম্পর্ক গভীর হয়েছে। এই সংবিধান পরিবর্তন করলে বিশেষ করে চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে। আঞ্চলিকভাবে অস্ত্র প্রতিযোগিতা এখানকার শান্তি বিনষ্ট করবে।

জাপানের সাংবিধানিক পরিবর্তন আঞ্চলিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৭ সালে মার্কিন সামরিক নিয়ন্ত্রণে থাকার সময় জাপানের সংবিধান লেখা হয়েছিল; যেখানে বলা হয়েছে যে, জাপান অস্বীকার করছে যে, যুদ্ধ করতে পারাটা একটা সার্বভৌম রাষ্ট্রের অধিকার। ‘আল জাজিরা’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শিনজো আবে পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে আঞ্চলিকভাবে চীনের বহির্মুখী পররাষ্ট্রনীতি এবং উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষণের প্রেক্ষিতে জাপানে সংবিধান পরিবর্তনের পক্ষে কথা বলেছিলেন। এর সপক্ষে জনমতও গড়ে উঠছিল বেশ কয়েক বছর ধরেই।

জাপানের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের নির্বাচনের আগে সকলেই মোটামুটিভাবে জানতেন যে, ক্ষমতাসীন দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন ছিল বিজয়ের ব্যবধান নিয়ে। অর্থাৎ কত বেশি আসন নিয়ে তারা পাস করবে। কারণ এর উপরেই নির্ভর করবে জাপানের শান্তিবাদী সংবিধান পরিবর্তন করা যাবে কিনা। সংবিধান পরিবর্তনে উচ্চকক্ষের ২’শ ৪৮ আসনের মাঝে দুই তৃতীয়াংশ বা প্রায় ১’শ ৬৬টা আসনের সমর্থন প্রয়োজন হবে। জাপানের ‘কিয়োদো’ সংবাদ সংস্থা বলছে যে, এবারের নির্বাচন সংবিধান পরিবর্তনের জন্যে সবচাইতে বড় বিজয় এনে দিয়েছে। কারণ ক্ষমতাসীন ‘এলডিপি’ দল এবং তাদের কোয়ালিশন দল ‘কোমেইতো’ নতুন করে মোট ৭৬টা আসন পেয়েছে। এর ফলে ক্ষমতাসীন দলের জোট ছাড়াও সংবিধান পরিবর্তনের পক্ষে বিরোধী দল ‘জাপান ইনোভেশন পার্টি’ এবং ‘ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ফর দ্যা পিপল’ মিলে মোট আসন হবে ১’শ ৭৯টা; যা কিনা দুই তৃতীয়াংশের চাইতে অনেক বেশি। এই দলগুলির ইতোমধ্যেই পার্লামেন্টের নিম্নপক্ষে দুই তৃতীয়াংশ সংগরিষ্ঠতা রয়েছে। ‘কোমেইতো’ একটা শান্তিবাদী দল হলেও মাত্র কিছুদিন আগেই তারা জাপানের সামরিক বাহিনীর সাংবিধানিক ভিত্তি পরিবর্তনের ব্যাপারে সমর্থন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

জাপানের সংবিধান পরিবর্তনের সাথে শুধু পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তনই নয়, সামরিক বাজেটের পরিবর্তনের কথাও উঠেছে। সামরিক বাজেট বৃদ্ধির পক্ষে জাপানে একটা শক্ত জনমত গড়ে উঠেছে বেশ কিছুদিন ধরেই। ‘এলডিপি’র নিগাতা প্রদেশের রাজনীতিবিদ কাজুহিরো কোবাইয়াশি ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’কে বলছেন যে, একসময় সংবিধান পরিবর্তনের ব্যাপারে কাউকে কিছু বলাই যেতো না; এখন মানুষ মনোযোগ দিয়েই শোনে। আপাততঃ জাপানের প্রতিরক্ষা বাজেট জিডিপির ১ শতাংশের মতো থাকলেও সরকার চাইছে তা দ্বিগুণ করে ২ শতাংশে উন্নীত করতে। ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’এর রবার্ট ওয়ার্ড ‘রয়টার্স’কে বলছেন যে, এখন প্রধানমন্ত্রী কিশিদা সামরিক বাজেট বৃদ্ধির জন্যে একটা সবুজ সংকেত পেলেন।

তবে কেউ কেউ মনে করছেন যে, কাজটা সহজ হবে না। জাপানের ‘রিতসুমেইকান এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর ইয়োইচিরো সাতো ‘আল জাজিরা’র এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বলেন যে, জাপানের সামরিক বাজেট বৃদ্ধিটা সম্ভবতঃ ধীরে ধীরেই হবে। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উভয় দিক থেকেই হঠাৎ বাজেট বৃদ্ধি করাটা কঠিন। শুধু সামরিক বাজেট নয়, জাপানের বৃদ্ধ জনগণের পেনশন, করোনা মহামারির কারণে বিভিন্ন ভর্তুকি, অর্থনীতিতে গতি আনার লক্ষ্যে নতুন ব্যবসা শুরুর ক্ষেত্রে প্রণোদনা দেয়া, ইত্যাদি ক্ষেত্রের জন্যেও অনেক অর্থায়ন প্রয়োজন হবে। এই অর্থায়ন দ্রুত আনার একটা পদ্ধতি হলো ‘কনজাম্পশন ট্যাক্স’ বা মানুষের খরচের উপর কর; যা মানুষের কাছে অত্যন্ত অপ্রিয় হবে। ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্ব যেহেতু ধীরে ধীরে দুর্বল হচ্ছে, কাজেই এই অর্থায়নগুলিকে তারা হয়তো ধীরে ধীরে বাস্তবায়নের পক্ষেই থাকবে।

জাপানের অনেকগুলি অভ্যন্তরীণ সমস্যা রয়েছে; যার মাঝে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং মানুষের আয়ে স্থবিরতা অন্যতম। কিছুদিন আগেই জাপানের সরকারি টেলিভিশন ‘এনএইচকে’র এক জরিপে বলে হয় যে, দেশের ৪২ শতাংশ জনগণই দেশের অর্থনৈতিক নীতির ব্যাপারে বেশি খেয়াল রাখছে; মাত্র ১৭ শতাংশ মানুষ দেশের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তাকে চিন্তার কেন্দ্রে রেখেছে। তদুপরি জাপানে ধীরেধীরে জনমত পরিবর্তিত হচ্ছে। ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’ বলছে যে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জাপানের জনমত অনেকটাই প্রভাবিত হয়েছে। একসময় কেউই বিশ্বাস করতো না যে চীন তাইওয়ানকে আক্রমণ করতে পারে। কিন্তু ইউক্রেনের উপর রুশ হামলার পর অনেকেই প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন যে, চীন এহেন কোন কর্মকান্ডে জড়ালে জাপান কিছু করার জন্যে প্রস্তুত কিনা। ‘এলডিপি’ জাপানের সামরিক বাজেট বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়া ছাড়াও আক্রান্ত হবার আগেই শত্রুর উপর সামরিক হামলা করার অধিকার আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠা করা পক্ষপাতি। জাপানের রাজনৈতিক পত্রিকা ‘ইনসাইডলাইন’এর প্রধান সম্পাদক তাকাও তোশিকাওয়ার মতে, দুই দশকের মাঝে এবারের নির্বাচনেই প্রথমবারের মতো পররাষ্ট্রনীতি এবং নিরাপত্তা নির্বাচনের প্রধান ইস্যু হয়েছে। তবে জাপানের নিরাপত্তা চিন্তার ক্ষেত্রে সবচাইতে বড় প্রভাবক হলো যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র আঞ্চলিক নিরাপত্তার ব্যাপারে, বিশেষ করে চীনকে নিয়ন্ত্রণে, জাপানকে আরও কর্মক্ষম দেখতে ইচ্ছুক। ১৯৪৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রচিত জাপানের সংবিধান দেশটাকে শান্তিকামী করে রেখেছে। এখন সেই একই সংবিধানকে পরিবর্তনে অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। শিনজো আবের মৃত্যু জাপানের সংবিধান পরিবর্তনের প্রচেষ্ঠাটাকে এগিয়ে নিলেও এর মাধ্যমে আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা রয়েছে বলেই অনেকের ধারণা।

No comments:

Post a Comment