Tuesday 12 July 2022

উজবেকিস্তানের সহিংসতার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব

১২ই জুলাই ২০২২
 
সহিংসতার পর উজবেকিস্তানের কারাকালপাকস্তান অঞ্চলের রাস্তায় ধ্বংসপ্রাপ্ত গাড়ি। পশ্চিমা বিশ্বের লিবারাল চিন্তার মানুষদের কাছে উজবেকিস্তানের রাজনৈতিক সংস্কার, বাকস্বাধীনতা এবং মুক্ত বাজার অর্থনীতিকে আলিঙ্গন করার মত উদারতা মানুষের জীবনের চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তথাপি তারা প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার মেয়াদ বৃদ্ধির ব্যাপারে খুব একটা উচ্চবাচ্য করেননি। একদিকে পশ্চিমারা ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানি নিরাপত্তা, মূল্যস্ফীতিসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত; অপরদিকে তারা সন্তুষ্ট যে, মিরিজিওইয়েভ অন্ততঃ পশ্চিমাদের সাথে ভালো সম্পর্কই রেখেছেন। সহিংসতার পরেও পশ্চিমাদের উপর মিরজিওইয়েভের নির্ভরশীলতা না কমে বরং আরও বাড়বে।


গত ১লা জুলাই মধ্য এশিয়ার দেশ উজবেকিস্তানের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের কারাকালপাকস্তান অঞ্চলে নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে বিক্ষোভকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষে কমপক্ষে ১৮ জন নিহত হয় এবং আরও কয়েক’শ আহত হয়। বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, প্রেসিডেন্ট শাভকাত মিরজিওইয়েভের প্রস্তাবিত সাংবিধানিক পরিবর্তন কারাকালপাকস্তান অঞ্চলের মানুষ মেনে নিতে পারেনি। অনেকেই মনে করেছিলেন যে, প্রস্তাবিত সাংবিধানিক পরিবর্তন মূলতঃ প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার মেয়াদ বাড়াবার একটা প্রচেষ্টা মাত্র। কিন্তু এখানে কারাকালপাকস্তানের ব্যাপারেও কিছু থাকতে পারে, তা অনেকেই চিন্তা করেননি। সোভিয়েত সময় থেকেই এই অঞ্চল উজবেকিস্তানের সাথে যুক্ত রয়েছে শায়ত্বশাসিত অঞ্চল হিসেবে। সংবিধানের নতুন প্রস্তাবে দেশের কোন অঞ্চলের বিচ্ছিন্ন হবার ক্ষমতাকে বন্ধ করা হয়েছে। তবে বড় কোন সহিংসতা এখানে এবারই প্রথম। উজবেক সরকার বলছে যে, বিদেশী ইন্ধনে বহুদিনের পরিকল্পনার মাধ্যমে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে; যার উদ্দেশ্য হলো উজবেকিস্তানের ভৌগোলিক অখন্ডতাকে চ্যালেঞ্জ করা এবং জাতিগত বৈষম্যের জন্ম দেয়া।

‘আল জাজিরা’র এক লেখায় মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ফরেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট’এর ফেলো ম্যাক্সিমিলিয়ান হেস বলছেন যে, উজবেকিস্তানের প্রেসিডেন্ট শাভকাত মিরজিওইয়েভ ২০১৬ সালে ক্ষমতা নেবার পর থেকে অনেক ধরণের সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেদেশে রুশ প্রভাব নিয়ন্ত্রণের সাথেসাথে তিনি পশ্চিমা দেশগুলি এবং চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করেছেন। তিনি সেদেশে বিদেশী বিনিয়োগ নিয়ে এসেছেন এবং সংবাদপত্রগুলিকে বেশকিছুটা স্বাধীনতাও দিয়েছেন। হেস দুশ্চিন্তা করছেন যে, কারাকালপাকস্থানের এই সহিংসতার কারণে উজবেকিস্তানের সংস্কারগুলি বুঝি আবারও বন্ধ হতে চললো। মিরিজিওইয়েভ যেভাবে বিদ্রোহ দমন করেছেন, তাতে তিনি তার পূর্বসুরী ইসলাম কারিমভের কঠোর শাসনকেই হয়তো অনুসরণ করতে যাচ্ছেন।

তবে এখানে কারাকালপাকস্তান অঞ্চলের বাস্তবতা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র প্রেসিডেন্টের সংস্কার নীতির আলোচনা যুক্তিযুক্ত নয়। কারাকালপাকস্তান অঞ্চল উজবেকিস্তানের সবচাইতে কম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলির একটা। দেশের সাড়ে ৩ কোটি জনসংখ্যার মাত্র ২০ লক্ষ থাকে এই অঞ্চলে। প্রধানতঃ মরু এই অঞ্চল বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম হ্রদ আরল সাগরের জন্যে পরিচিত। কিন্তু এখানকার পরিবেশ এবং অর্থনীতি গত কয়েক দশকের মাঝে মারাত্মক সমস্যার মুখে পতিত হয়েছে। ২০১৭ সালের অক্টোবরে নরওয়ের ‘অসলো ইউনিভার্সিটি’ এবং ‘দ্যা জার্নাল অব দ্যা নরওয়েজিয়ান মেডিক্যাল এসোসিয়েশন’এর যৌথ প্রচেষ্টায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয় যে, মধ্য এশিয়ার বিশাল হ্রদ আরল সাগর এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। সোভিয়েত সময় থেকে আরল সাগরে পতিত হওয়া নদীগুলি থেকে পানি প্রত্যাহার করে তুলার চাষ করা হয়েছে। অতিরিক্ত পানি প্রত্যাহারের ফলে এখন আরল সাগর প্রায় পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে। আর এর স্থলে এখন রয়ে গেছে লবণ এবং কীটনাশকের সমন্বয়ে তৈরি হওয়া একটা বিষাক্ত পরিবেশ; যা মানুষের শরীরে ক্যান্সার, যক্ষ্মা এবং রক্তশূণ্যতার মতো নানা রোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারাকালপাকস্তান বর্তমানে একটা অর্থনৈতিক দুর্দশার নাম। উজবেকিস্তানের সবচাইতে বেশি নবজাতক মৃত্যুর হার হলো এই অঞ্চলে। এছাড়াও শিশুদের মাঝে বক্ষব্যাধি এবং কিডনি রোগের প্রাদুর্ভাব অত্যধিক বেশি।
 
মিরজিওইয়েভ অবশ্য ইতোমধ্যেই কারাকালপাকস্তানের ব্যাপারে সাংবিধানিক পরিবর্তনের প্রস্তাব উঠিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু এটা পরিষ্কার নয় যে, তিনি কেনই বা এটা করতে চেয়েছিলেন। তিনি পশ্চিমা ধাঁচের একটা উজবেকিস্তান তৈরির পথে এগুচ্ছেন; তবে এই পথে তার নিয়ন্ত্রণ কতটুকু রয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। উজবেকিস্তানের তুলার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন দেশে তৈরি হওয়া রপ্তানিমুখী টেক্সটাইল শিল্প পশ্চিমা দেশগুলিতে তাদের পণ্য বিক্রি করে উপার্জন করছে। কিন্তু খুব কম মানুষই খোঁজ রেখেছে যে, পশ্চিমাদের জন্যে পোষাক তৈরি করতে গিয়ে আরল সাগর এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলের পরিবেশগত বিপর্জয় কত মানুষের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলেছে।

কারাকালপাকস্তান অঞ্চলের কিছু মানুষ বিচ্ছিন্নতাবাদী অন্দোলন করলেও বেশিরভাগ মানুষেরই ধারণা আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে বাঁচার সম্ভাবনা তাদের যথেষ্টই কম। পুরো অঞ্চলের জনসংখ্যার মাত্র এক তৃতীয়াংশ হলো জাতি হিসেবে কারাকালপাক; বাকিরা কাজাখ এবং উজবেক। কারাকালপাকদের নিজস্ব ভাষা, লাইব্রেরি এবং সংস্কৃতিও রয়েছে। তবে উজবেক সরকার এই অঞ্চলকে ভুলে যায়নি। ২০২২ সালেই সরকারি এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, কারাকালপাকস্তান অঞ্চলে এবছরের মাঝেই ৭’শ ৩১টা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই সেখানে ২’শ ৫৬টা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে ১৮ হাজার ৬’শ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ২০২১ সালে কারাকালপাকস্তান এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চল খোরেজমে ৭’শ ৬৬ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে মোট ৮৩টা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে; যার মাঝে একটা বড় অংশ ছিল বিদেশী বিনিয়োগ। এর আগে ২০১৭ সালে ১’শ কিঃমিঃ পাইপলাইনের মাধ্যমে সেখানে প্রায় ২৫ হাজার মানুষের জন্যে বিশুদ্ধ্ব খাবার পানির ব্যবস্থা করা হয়। উজিবেক পত্রিকা ‘গ্যাজেটা’র এক খবরে বলা হয় যে, দৈনিক ৭ হাজার কিউবিক মিটার পানির সরবরাহ প্রকল্পের মাধ্যমে শুকিয়ে যাওয়া আমু দড়িয়া নদী এবং কূপগুলির পানিকে প্রতিস্থাপিত করা হয়। ২০২০ সালের অগাস্টে ‘ইউরেশিয়ানেট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, উজবেক সরকার কারাকালপাকস্তান অঞ্চলের শহর ময়নাকের সাথে ৩০ বছর পর বিমান যোগাযোগ চালু করেছে; যার মাধ্যমে সরকার সেখানে পর্যটন এবং বিনিয়োগ নিয়ে যেতে চাইছে। শহরটার বিমানবন্দরের উন্নয়নে সরকার ৩০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। আরল সাগর শুকিয়ে যাবার কারণে একসময়কার মৎস্যবন্দর এই শহরের জনসংখ্যা ৩০ হাজার থেকে কমে ১১ হাজার হয়ে গেছে।

‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় ‘ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গ’এর এসোসিয়েট প্রফেসর জেনিফার ব্রিক মুরতাজাসভিলি বলছেন যে, এই সহিংসতার ফলে কারাকালপাকস্তান অঞ্চলের মানুষের সাথে দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের বিশ্বাস নষ্ট হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলি হয়তো এখন উজবেক সরকারের উপর ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত করার ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ করবে।

মিরজিওইয়েভ অবশ্য ইতোমধ্যেই কারাকালপাকস্তানের ব্যাপারে সাংবিধানিক পরিবর্তনের প্রস্তাব উঠিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু এটা পরিষ্কার নয় যে, তিনি কেনই বা এটা করতে চেয়েছিলেন। তিনি পশ্চিমা ধাঁচের একটা উজবেকিস্তান তৈরির পথে এগুচ্ছেন; তবে এই পথে তার নিয়ন্ত্রণ কতটুকু রয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। উজবেকিস্তানের তুলার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন দেশে তৈরি হওয়া রপ্তানিমুখী টেক্সটাইল শিল্প পশ্চিমা দেশগুলিতে তাদের পণ্য বিক্রি করে উপার্জন করছে। কিন্তু খুব কম মানুষই খোঁজ রেখেছে যে, পশ্চিমাদের জন্যে পোষাক তৈরি করতে গিয়ে আরল সাগর এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলের পরিবেশগত বিপর্জয় কত মানুষের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। তবে পশ্চিমা বিশ্বের লিবারাল চিন্তার মানুষদের কাছে উজবেকিস্তানের রাজনৈতিক সংস্কার, বাকস্বাধীনতা এবং মুক্ত বাজার অর্থনীতিকে আলিঙ্গন করার মত উদারতা মানুষের জীবনের চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তথাপি তারা প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার মেয়াদ বৃদ্ধির ব্যাপারে খুব একটা উচ্চবাচ্য করেননি। একদিকে পশ্চিমারা ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানি নিরাপত্তা, মূল্যস্ফীতিসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত; অপরদিকে তারা সন্তুষ্ট যে, মিরিজিওইয়েভ অন্ততঃ পশ্চিমাদের সাথে ভালো সম্পর্কই রেখেছেন। সহিংসতার পরেও পশ্চিমাদের উপর মিরজিওইয়েভের নির্ভরশীলতা না কমে বরং আরও বাড়বে।

No comments:

Post a Comment