Friday 22 July 2022

তেহরানে ইরান-রাশিয়া-তুরস্কের শীর্ষ বৈঠকের গুরুত্ব কতটুকু?

২৩শে জুলাই ২০২২
তেহরান বৈঠকে রাশিয়া এবং ইরান একে অপরকে কাছে টেনে মার্কিন নেতৃত্বে পশ্চিমাদের সামনে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়ার চেষ্টা করছে; তবে এই প্রশ্ন কৌশলগত কোন জোটের সম্ভাবনাকে এগিয়ে নেবে না; কারণ উভয়ের স্বার্থ যথেষ্টই ভিন্ন। অপরদিকে কঠিন অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে এরদোগান কৃষ্ণ সাগর দিয়ে ইউক্রেনের গম রপ্তানির জন্যে রাশিয়ার সম্মতি আদায়ের চেষ্টা করে আগামী নির্বাচনের আগে নিজের অবস্থানকে সংহত করতে চাইছেন। বিনিময়ে তিনি হয়তো সিরিয়াতে তুরস্কের সামরিক মিশনকে আপাততঃ মুলতুবি করতে রাজি হবেন।

জুলাইয়ের মাঝামাঝি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে প্রথমবারের মত প্রাক্তন সোভিয়েত অঞ্চলের বাইরে কোন দেশ ভ্রমণ করেছেন। তেহরানে ইরানের শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি এবং তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগানের সাথে তার বৈঠককে অনেককেই গুরুত্ব সহকারে দেখছেন। এই বৈঠক এমন সময়ে হলো, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মাত্রই মধ্যপ্রাচ্য সফর করেছেন।

বৈরুতের ‘আমেরিকান ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর আলী ফাতহুল্লাহ নেজাদ ‘ইউরোনিউজ’কে বলছেন যে, ইরান এতকাল ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে কোন পক্ষ নেয়নি। কারণ নিজেদের ভৌগোলিক অখন্ডতা রক্ষা করাটা ইরানের একটা প্রধান লক্ষ্য। তবে রুশরা ইরানের সমর্থন আদায়ের জন্যে যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করছিলো। পশ্চিমাদেরকে বাইপাস করে চীন এবং রাশিয়ার মতো শক্তির সাথে সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে ইরান নিজেদের অবস্থানকে আরও শক্ত ভিতের উপর রাখতে চাইছে। ইরান চীনের সাথে ২৫ বছরের চুক্তি করেছে; এখন রাশিয়ার সাথেও ২০ বছরের চুক্তির কথা হচ্ছে। এই চুক্তিগুলির শর্তসমূহ খুব একটা পরিষ্কার না হওয়ায় অনেকেই আশংকা করছেন যে, ইরানের নেতৃত্ব নিজেদের অবস্থানকে টিকিয়ে রাখতে বাইরের শক্তির কাছ থেকে নিশ্চয়তা আদায় করতে গিয়ে তাদের জাতীয় স্বার্থ বা সম্পদকে জ্বলাঞ্জলি দেবার ঝুঁকি নিতে পারে।

‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’এর ডিরেক্টর আলী ভাইজ ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, পুতিনের তেহরান সফরের মাধ্যমে এই দুই দেশ প্রমাণ করতে চাইছে যে, পশ্চিমা অবরোধের মাঝে তারা একা হয়ে যায়নি; এবং তারা এই অবরোধের মাঝেও বেঁচে থাকতে পারে। প্রয়োজনই ইরান এবং রাশিয়াকে একত্রিত করেছে। বিশেষ করে রাশিয়া পশ্চিমা অবরোধ এড়াতে ইরানের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে চাইছে। অপরদিকে ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর সমস্যার মাঝে ইরান তার নিজেদের ডেভেলপ করা অস্ত্রগুলিকে একটা বড় শক্তির কাছে বিক্রি করার সুযোগ কাজে লাগাতে চাইছে। ইরান যেহেতু এর আগেই লেবানন, ইয়েমেন এবং সিরিয়াতে তাদের সমর্থিত মিলিশিয়াদেরকে ড্রোন প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে, কাজেই রাশিয়ার কাছে ড্রোন বিক্রি করতে ইরানের কোন সমস্যা থাকার কথা নয়। এছাড়াও পশ্চিমাদের সাথে পারমাণবিক চুক্তির ব্যাপারে ইরান মোটামুটি সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলেছে যে, তাদেরকে মার্কিন অবরোধ কাঁধে নিয়েই এগুতে হবে। এমতাবস্থায় ইরান বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, অবরোধের মাঝেও তারা বেঁচে থাকতে পারে। এই পরিস্থিতি ইরানের উপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব অনেকটাই কমিয়ে ফেলছে। আর যদি যুক্তরাষ্ট্র প্রভাব বৃদ্ধি করতে ইরানের উপর নতুন করে চাপ সৃষ্টি করতে চায়, তাহলে সেটার ফলাফল আরও খারাপ হতে পারে। প্রফেসর আলী ফাতহুল্লাহ নেজাদ বলছেন যে, ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প নিয়ে আলোচনার ব্যাপারে রাশিয়া বরাবরই সুযোগসন্ধানী থেকেছে। ইউক্রেনে হামলার পর থেকে রাশিয়া পারমাণবিক চুক্তির আলোচনার বিরোধিতাই করেছে। কাজেই ইরানের সাথে রাশিয়ার কৌশলগত জোট কোন বাস্তব বিষয় নয়।

আলী ভাইজ বলছেন যে, অর্থনৈতিক দিক থেকে দুই দেশের সহযোগিতার ক্ষেত্র সীমিত; কারণ উভয় দেশই তেল বিক্রি করে আয় করে; বিশেষ করে চীনের জ্বালানির বাজার ধরার ক্ষেত্রে তারা একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। রাশিয়ার সাথে ইরানের বাণিজ্য এখন প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার; যা খুব বেশি বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা কম। অপরপক্ষে চীনের সাথে ইরানের বাণিজ্য প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার। বাস্তবিকপক্ষে রাশিয়ার সাথে ইরানের অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির অনেকটাই কথাসর্বস্ব। জার্মান থিংকট্যাঙ্ক ‘কারপো’র আদনান তাবাতাবাই ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, ইরান এবং রাশিয়ার মাঝে আলোচনার সময়টা গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়ার উপর পশ্চিমাদের কঠোর অবরোধের কারণেই এখন ইরানের সাথে রাশিয়ার বাণিজ্য রুবলে হবার কথা হচ্ছে; যা কিনা এই আলোচনার গুরুত্বকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’এর জেফরি ম্যানকফ ‘সিএনবিসি’কে বলছেন যে, যে ব্যাপারটা তিন দেশের স্বার্থের সাথে জড়িত, তা হলো সিরিয়ার সংঘাত। তুরস্ক চাইছে উত্তর সিরিয়াতে কুর্দিদের বিরুদ্ধে আরেকটা সামরিক মিশন শুরু করতে। সিরিয়ার সরকারকে রাশিয়া এবং ইরান সমর্থন দিচ্ছে; এবং সিরিয়ার কুর্দিরাও অনেক ক্ষেত্রেই একই স্বার্থের সাথে যুক্ত। রাশিয়া এবং ইরান উভয়েই তুরস্কের সামরিক মিশনের বিরোধী।

আলী ভাইজ বলছেন যে, তেহরান বৈঠকে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সময় খুব একটা ভালো কাটেনি। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি মোটামুটি সরাসরিই উত্তর সিরিয়াতে তুরস্কের প্রস্তাবিত সামরিক মিশনের বিরোধিতা করেছেন। তিনি এই মিশনের ফলাফল ভালো হবে না বলে হুমকিও দিয়েছেন। তবে কৃষ্ণ সাগর ব্যবহার করে ইউক্রেনের জমে থাকা শস্যকে বিদেশে রপ্তানি করার ব্যাপারে রুশ সম্মতি আদায়ের ক্ষেত্রে এরদোগান যে চেষ্টাটা করছেন, সেটা তার সিরিয়ার ব্যাপারে ব্যর্থতাকে ঢাকতে সহায়তা করবে।

জেফরি ম্যানকফ বলছেন যে, এমতাবস্থায় তুরস্কের সামনে ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানি পুনরায় চালু করাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ইউক্রেনের শস্যের ব্যাপারটা সারা দুনিয়ার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা এরদোগানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থানের জন্যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তুরস্কের অর্থনীতি ভালো অবস্থানে নেই; আর আগামী বছরের নির্বাচনের আগে এরদোগানের রাজনৈতিক অবস্থানও বেশ দুর্বল। কাজেই তুরস্কের আন্তর্জাতিক অবস্থানকে গুরুত্বপূর্ণ দেখাতে পারলে এরদোগান সেটার সুবিধা পেতে পারেন। তবে ইউক্রেনের শস্য রপ্তানিতে রুশ সম্মতি আদায় করতে এরদোগানের সামনে উত্তর সিরিয়ায় তুর্কি সামরিক অপারেশনের ইচ্ছা ত্যাগ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। কাজেই ইউক্রেন এবং সিরিয়ার সংঘাত বেশ অঙ্গাঙ্গিভাবেই জড়িত।

তেহরান বৈঠকের মাধ্যমে রাশিয়া এবং ইরান তাদের পারস্পরিক বাণিজ্যকে খুব বেশি এগিয়ে নিতে না পারলেও নিজেদের কঠিন সময়ে তারা একে অপরকে কাছে টেনে মার্কিন নেতৃত্বে পশ্চিমাদের সামনে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়ার চেষ্টা করছে; তবে এই প্রশ্ন কৌশলগত কোন জোটের সম্ভাবনাকে এগিয়ে নেবে না; কারণ উভয়ের স্বার্থ যথেষ্টই ভিন্ন। অপরদিকে কঠিন অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে এরদোগান কৃষ্ণ সাগর দিয়ে ইউক্রেনের গম রপ্তানির জন্যে রাশিয়ার সম্মতি আদায়ের চেষ্টা করে আগামী নির্বাচনের আগে নিজের অবস্থানকে সংহত করতে চাইছেন। বিনিময়ে তিনি হয়তো সিরিয়াতে তুরস্কের সামরিক মিশনকে আপাততঃ মুলতুবি করতে রাজি হবেন; যদিও এই সিদ্ধান্ত হয়তো তিনি আগেই নিয়েছেন। তেহরান বৈঠক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফরের একটা প্রত্যুত্তর হিসেবে এলেও এর ভূরাজনৈতিক ফায়দা লোটার সক্ষমতা সকলের সামনেই সীমিত।

No comments:

Post a Comment