Sunday 31 July 2022

বিন সালমানের প্যারিস সফর পশ্চিমা আদর্শের দেউলিয়াত্বকেই তুলে ধরে

০১লা অগাস্ট ২০২২
 
বিন সালমানের প্যারিস সফর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ইস্যুগুলিতে আরব দেশগুলির পশ্চিমমুখীতাকে আবারও তুলে ধরলো। অপরদিকে আবারও প্রমাণ হলো যে, মধ্যপ্রাচ্য ইউরোপের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কঠিন বাস্তবতায় নিজেদের স্বার্থকে সমুন্নত রাখতে আদর্শকে জ্বলাঞ্জলি দেয়ার ঘটনাটা পশ্চিমাদের আদর্শিক দেউলিয়াত্বকে আরও একবার আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।


শুধু বাইডেন এবং এরদোগানই নয়, এবারে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁও সৌদি যুবরাজ এবং সৌদি আরবের বাস্তবিক শাসনকর্তা মোহাম্মদ বিন সালমানকে কাছে টেনে নিলেন। বিন সালমানের প্যারিস সফরকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা লিবারাল মিডিয়াতে ব্যাপক সমালোচনা চলমান রয়েছে; যা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফর এবং বিন সালমানের ইস্তাম্বুল সফরের পর থেকে অব্যাহত রয়েছে। ‘বিবিসি’ বলছে যে, ২৮শে জুলাই প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ এবং বিন সালমানের নৈশভোজের ফাঁকে আলোচনার পটভূমি ছিল জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজারে ভয়াবহ অস্থিরতা এবং ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প নিয়ে মধ্যপ্রাচের দেশগুলির দুশ্চিন্তা। ২০১৮ সালে ইস্তাম্বুলে সৌদি কনসুলেটের ভেতরে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকান্ড নিয়ে পশ্চিমা মানবাধিকার সংস্থাগুলির হাহাকারের মাঝেই পশ্চিমা নেতৃত্ব বিন সালমানের সাথে বৈঠক করে যাচ্ছেন। ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’এর বেনেডিক্টে জনেরদ বলছেন যে, প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ মানবাধিকারের ব্যাপারে শক্ত অবস্থান না নিয়ে বিন সালমানের চরিত্রকে ‘হোয়াইটওয়াশ’ করে তাকে আন্তর্জাতিকভাবে পুনর্বাসনের ঝুঁকি নিচ্ছেন! ফ্রান্সের অবস্থানকে যুক্তিযুক্ত করতে গিয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র বলেন যে, সৌদি যুবরাজের সাথে আলোচনায় মানবাধিকার ইস্যুকে সাধারণভাবে আলোচনা করা হলেও পুরো ইউরোপের সমস্যা সমাধানে ফ্রান্সের সকল বন্ধুদের সাথেই আলোচনায় বসতে হচ্ছে। ফরাসি প্রধানমন্ত্রী এলিজাবেথ বোর্ন বলছেন যে, তিনি মনে করেন না যে, ফরাসি জনগণ সরকারের এই ব্যাপারটাকে অনুধাবন করতে পারবে; এমনকি রুশ গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ করে দেবার হুমকির মাঝে প্রেসিডেন্ট যদি তেল উৎপাদনকারী দেশগুলির সাথে বৈঠক নাও করেন।

‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বিন সালমানের প্যারিস সফরের মূলে রয়েছে সৌদি আরবকে তেলের উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্যে প্রভাবিত করা; যে উদ্দেশ্যে ম্যাক্রঁ এবং জো বাইডেন উভয়েই চেষ্টা চালাচ্ছেন। ফ্রান্স এবং ইইউ চাইছে তাদের জ্বালানির উৎসকে আরও প্রসারিত করতে। পশ্চিমা দেশগুলি এখন রাজনৈতিক বাস্তবতাকে আদর্শের উপরে স্থান দিচ্ছে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘মিডলইস্ট ইন্সটিটিউট’এর স্কলার ফাতিমা আবি আল-আসরার ‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’কে বলছেন যে, পশ্চিমা নেতারা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির কাছে ধর্না দিয়ে তেলের বাজারের অস্থিরতা কাটাতে চাইছেন মূলতঃ তাদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ স্বার্থকে মাথায় রেখেই। সর্বক্ষেত্রেই দ্বিমুখী নীতি অনুসরণ করা হয়েছে। মানবাধিকারের ক্ষেত্রে চীন এবং রাশিয়ার ক্ষেত্রেই শুধু নয়; যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম অনুসরণ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে গুয়ান্তানামো বে কারাগারে মানবাধিকার লঙ্ঘন, অভিবাসী নিয়ে বৈরী নীতি, আর বর্ণবাদী সমস্যা তো রয়েছেই। এমতাবস্থায় সৌদিদের সাথে আলোচনা করাটা পশ্চিমাদের নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসা নয়; কারণ ঐতিহাসিকভাবেই সৌদি আরবের সাথে ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সুসম্পর্ক রয়েছে। কাজেই সৌদি আরবকে বিপক্ষ বা প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখার কিছুই নেই।

সৌদি যুবরাজের অফিস থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, ফরাসি প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা দেয়ার কারণে বিন সালমান তার গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। আলোচনার ফলে দুই দেশের কৌশলগত সহযোগিতা আরও নিশ্চয়তা পেলো। আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে উভয় দেশের সাধারণ স্বার্থকে এগিয়ে নেবার ক্ষেত্রে এই আলোচনা ভূমিকা রাখবে। ‘আল আরাবিয়া’র এক প্রতিবেদনে ‘সৌদি প্রেস এজেন্সি’ এবং ফরাসি প্রেসিডেন্টের অফিসের বরাত দিয়ে বলা হয় যে, দুই দেশের মাঝে সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ এবং হাইড্রোজেন শক্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয় যে, উভয় নেতা বৈশ্বিক জ্বালানির বাজারে স্থিতি ফিরিয়ে আনার গুরুত্ব এবং বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্য, বিশেষ করে গমের সরবরাহ নিশ্চিত করার ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও বাকি বিশ্বের উপর ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে দুই দেশের মাঝে সহযোগিতা বৃদ্ধি নিয়ে কথা হয়েছে। ইউরোপের দেশগুলির জ্বালানির উৎস বাড়ানোর বিষয়টার উপরেই ফরাসি প্রেসিডেন্ট বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যে উভয় দেশের স্বার্থের প্রতি হুমকির বিষয়গুলিকে আলোচনায় এনে আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার ব্যাপারেও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়; বিশেষ করে লেবাননের সমস্যা নিরসরণে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের ব্যাপারে ঐকমত্য ছাড়াও সেখানে দুই দেশের যৌথ কর্মপদ্ধতির সফলতা যাচাই করা হয়। ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক হতে না দেয়ার বিষয়ে আলোচনার অগ্রগতি এবং সিরিয়ায় শান্তির ফিরিয়ে আনার ব্যাপারও দুই দেশের মাঝে আলোচিত হয়েছে। ইয়েমেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অগ্রগতি নিয়েও তারা আলোচনা করেছেন।

বিন সালমানের প্যারিস সফরের আরেকটা দিক ছিল ইরানের সাথে পশ্চিমাদের পারমাণবিক ইস্যুতে আলোচনা। আল-আসরার বলছেন যে, গত চার বছর ধরে বিন সালমানকে পশ্চিমারা বয়কট করে এসেছে। কাজেই যুবরাজ নিশ্চয়ই তার এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্যে উৎসুক ছিলেন; বিশেষ করে তিনি আঞ্চলিক দিক দিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে সৌদিদের অবস্থানকে সুসংহত করতে চাইছেন এবং বাকি বিশ্বের কাছে তার এই অবস্থানকে জানান দিতে চাইছেন। আর ইরানের আঞ্চলিক প্রভাবকে, বিশেষ করে ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াগুলিকে সামরিক দিক থেকে হারাতে না পেরে বিন সালমান এখন পশ্চিমাদের কাছ থেকে কূটনৈতিক সমর্থন আদায় করতে চাইছেন; যাতে ইরান ইচ্ছামতো তার নীতি বাস্তবায়ন করতে না পারে। ফ্রান্স সর্বদাই ইরানের সাথে পারমাণবিক ইস্যুতে চুক্তি করতে আগ্রহী ছিল; তবে সৌদিরা এতে আগ্রহী নয়। সৌদিরা দুশ্চিন্তায় রয়েছে যে, পশ্চিমারা যদি ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি করে, সেক্ষেত্রে পশ্চিমারা হয়তো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির মতামত না নিয়েই সেদিকে ধাবিত হতে পারে। সৌদিরা চাইছে না যে, পশ্চিমারা যে চুক্তি করবে, সেটা তাদেরকে চুপচাপ মেনে নিতে হবে।

বিন সালমানের প্যারিস সফর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ইস্যুগুলিতে আরব দেশগুলির পশ্চিমমুখীতাকে আবারও তুলে ধরলো। লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরান ইস্যুতে সৌদিরা প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্সকে বাদ দিয়ে চিন্তা করতে পারছে না। নিঃসন্দেহে ম্যাক্রঁ মধ্যপ্রাচ্যে ইউরোপের অবস্থান ধরে রাখার নেতৃত্ব চাইছেন। অপরদিকে আবারও প্রমাণ হলো যে, মধ্যপ্রাচ্য ইউরোপের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাপক মূল্যস্ফীতির মাঝে জ্বালানি বিপর্যয় মোকাবিলা করাটা ফ্রান্স, তথা ইউরোপের যেকোন দেশের ক্ষমতাসীনদের জন্যেই বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কঠিন বাস্তবতায় নিজেদের স্বার্থকে সমুন্নত রাখতে আদর্শকে জ্বলাঞ্জলি দেয়ার ঘটনাটা পশ্চিমাদের আদর্শিক দেউলিয়াত্বকে আরও একবার আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।

No comments:

Post a Comment