Saturday 25 June 2022

ভারতের নতুন সামরিক রিক্রুটমেন্ট প্রকল্পের উদ্দেশ্য কি?

২৫শে জুন ২০২২

নতুন দিল্লীতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্যারেড। সামরিক ট্রেনিং পাওয়া এহেন জনগণ একটা দেশের জন্যে মারাত্মক হতে পারে, যেখানে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতা মারাত্মক আকার নিচ্ছে। ১৯৪৭ সালেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ট্রেনিংপ্রাপ্তরা জাতিগত সহিংসতায় লিপ্ত হয়েছিল। বিভিন্ন গবেষণা বলছে যে, যখন একটা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠরা সামরিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত হয় এবং সংখ্যালঘুরা নেতৃত্বশূণ্য থাকে, তখনই গণহত্যা সবচাইতে প্রকট আকার নেয়। প্রকৃতপক্ষে বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদী নীতি পুরো দক্ষিণ এশিয়ার বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে; পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় যার ফলাফল হবে সুদূরপ্রসারী।


গত ১৪ই জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘অগ্নিপথ’ নামে দেশের সামরিক বাহিনীর জন্যে নতুন রিক্রুটিং প্রকল্পের ঘোষণা দেন। এই প্রকল্পের অধীনে সাড়ে ১৭ বছর থেকে ২১ বছর বয়সের ব্যক্তিরা ৪ বছরের জন্যে বাহিনীতে যোগদান করবে। এর মাঝে এক চতুর্থাংশকে সামরিক বাহিনীকে স্থায়ীভাবে রেখে দেয়া হবে; বাকিদেরকে এককালীন ১১ লক্ষ ৭০ হাজার রুপির বিনিময়ে সামরিক বাহিনী থেকে বিদায় দেয়া হবে। ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’ বলছে যে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে বহু স্থায়ী সদস্যপদকে অস্থায়ী সদস্যপদের মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত করে এবছরের মাঝেই ৪০ হাজার সেনা রিক্রুট করা হবে; যা সামনের বছরগুলিকে ৫০ হাজারে ওঠানো হবে। সরকারের এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ চলছে। হাজার হাজার মানুষ রাস্তা আটকে বিক্ষোভ করা ছাড়াও সরকারি অফিসে হামলা এবং মোটরগাড়ি ও রেলগাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। পুলিশের সাথে সংঘর্ষে কমপক্ষে একজনের মৃত্যু ছাড়াও হাজারো মানুষকে আটক হয়েছে। এই বিক্ষোভের মাধ্যমে ভারতের চরম বেকারত্ব পরিস্থিতি আবারও সামনে এলো। ‘নিকেই এশিয়া’র এক খবরে বলা হচ্ছে যে, ভারতের একটা বড় সংখ্যক মানুষের কাছে সামরিক বাহিনীর স্থায়ী চাকুরি একটা গুরুত্বপূর্ণ কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার আশা; যেখানে অবসরের পর পেনশনের ব্যবস্থাও রয়েছে। বিক্ষোভকারীরা বলছে যে, তাদেরকে চার বছর পর আবারও নতুন করে চাকুরি খুঁজতে হবে। ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল ‘এনডিটিভি’কে একজন সম্ভাব্য রিক্রুট বলেন যে, তাদের জীবনের পুরো আশাটাকেই সরকার ধ্বংস করে দিয়েছে। আরেকজন বলছেন যে, চার বছর পর তারা আর ‘অগ্নিসেনা’ থাকবে না; তাদেরকে তখন বলা হবে ‘বাতিল সেনা’!

ভারতের কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার বলছে যে, তারা নতুন এই প্রকল্পের মাধ্যমে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের গড় বয়স কমাবে; যার মাধ্যমে দেশ শারীরিক দিক থেকে আরও সবল সেনাদের পাবে। ২১শে জুন ভারতীয় সংবাদ সংস্থা ‘এএনআই’কে কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল বলেন যে, একটা নবীন রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী প্রবীন হতে পারে না। আগামী দিনের জন্যে প্রস্তুতি নিতে গেলে পরিবর্তন অবশ্যই প্রয়োজন।

তবে অনেকেই মনে করছেন যে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার সেনাদের বেতন ও পেনশনের পিছনে খরচ কমিয়ে তা সামরিক বাহিনীর আধুনিকীকরণের পিছনে ব্যয় করতে চাইছে। ভারতীয় থিংকট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ’এর সিনিয়র ফেলো সুশান্ত সিং গত ২১শে জানুয়ারি এক প্রতিবেদনে বলেন যে, ভারতের ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সামরিক বাজেটের দিকে সকলের দৃষ্টি থাকলেও এর ৫২ শতাংশ খরচই যে বেতনাদির পিছনে যায়, সেখানকার সমস্যাগুলি সরকার সমাধান করতে পারছে না; বরং সাম্প্রতিক সময়ে এই সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে। দেশের গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝ থেকেই সামরিক রিক্রুট বেশি আসে। এদের মাঝেই এখন অর্থনীতি নিয়ে হতাশা সবচাইতে বেশি। অপরদিকে সামরিক সদস্যরা অভিযোগ করছে যে, তাদের দুই তৃতীয়াংশের বেশি অস্ত্রসস্ত্রই খুবই পুরোনো এবং ব্যবহারের অনুপযোগী। এর আগের কিছু প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, যেকোন সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্যে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর মাত্র ১০ দিন যুদ্ধ চালিয়ে নেবার মতো রসদ রয়েছে।

অর্থনৈতিক সমস্যা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সংকটের মাঝে সরকার সামরিক বাহিনীর দাবিগুলি কিভাবে মোকাবিলা করবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ভারতের গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, প্রতিমাসে ভারতের অর্থনীতিতে ১০ লক্ষ কর্মক্ষম মানুষ যোগ হচ্ছে। কিছুদিন আগেও বেকারত্বের হার ইতিহসাসের সর্বোচ্চ হলেও এই জুন মাসে তা ৭ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে প্রায় ৯০ কোটি ভারতীয় এখন চাকুরি খোঁজাই ছেড়ে দিয়েছে! অর্থনৈতিক দৈন্যতার সাথে সাথে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের অপ্রতুলতাও দেশটাকে পেয়ে বসেছে। ক্ষমতায় আসার আগে নরেন্দ্র মোদি বছরে ২ কোটি চাকুরি তৈরি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ২০২০ সালে ‘ম্যাককিনসি গ্লোবাল ইন্সটিটিউট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ২০৩০ সাল নাগাদ ভারতে কৃষিকাজের বাইরে নতুন ৯ কোটি চাকুরি তৈরি করতে হবে। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে মোদির সরকারের সামনে এটা বিশাল চ্যালেঞ্জ।

ভারতের সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেঃ জেনারেল দীপেন্দ্র সিং হুদা ‘নিকেই এশিয়া’কে বলছেন যে, নতুন প্রকল্পের সেনাদের সাথে পুরোনো সেনাদের সম্পর্ক যেমন নিশ্চিত নয়, তেমনি নতুনদেরকে কতটা প্রশিক্ষণ দেয়া হবে, সেটাও কিন্তু নিশ্চিত নয়। কারণ সামরিক বাহিনীতে একজন সেনাকে পরিপূর্ণভাবে প্রশিক্ষণ দিতে ৩ বছর লেগে যায়। আর যদি এই নতুন প্রকল্প সামরিক ক্যারিয়ারের আকর্ষণ কমিয়ে ফেলে, তাহলে সবচাইতে ভালো রিক্রুটগুলি থেকে সামরিক বাহিনী বঞ্চিত হতে পারে।

‘আল জাজিরা’র এক লেখায় সুশান্ত সিং বিজেপি সরকারের নতুন প্রকল্পের সম্ভাব্য ফলাফল আলোচনা করেছেন। বিজেপির গত ৮ বছরের শাসনামলে সামরিক বাহিনীর ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বাজেট চাহিদা অপূর্ণ রাখা হয়েছে। এই অপূর্ণ বাজেটের প্রায় ৫৩ শতাংশই হলো ‘ক্যাপিটাল বাজেট’; যা ব্যবহার করার কথা বাহিনীর প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পিছনে। এই সময়ের মাঝে সামরিক বাহিনীর দুর্বলতা তুলে ধরার চাইতে বাহিনীর সদস্যদের প্রশংসা করাতেই মগ্ন ছিল মোদি সরকার। নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে আগামী দুই বছরের মাঝে ১ লক্ষ নতুন চাকুরি তৈরি করতে চাইছে সরকার। মোদি সরকার এই প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে পার্লামেন্টে কারুর সাথে কোন আলোচনাই করেনি; যা সকলকেই অবাক করেছে।

মোদির হিন্দুত্ববাদী সরকার ভারতকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে; যেখানে জাতিগত ও ধর্মীয় সহিংতার সম্ভাবনা আরও প্রবল হচ্ছে। সুশান্ত সিংএর সবচাইতে বড় দুশ্চিন্তা হলো ৪ বছর পর এই রিক্রুটরা কি করবে? তিনি চিন্তিত যে, সামরিক ট্রেনিং পাওয়া এহেন জনগণ একটা দেশের জন্যে মারাত্মক হতে পারে, যেখানে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতা মারাত্মক আকার নিচ্ছে। ১৯৪৭ সালেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ট্রেনিংপ্রাপ্তরা জাতিগত সহিংসতায় লিপ্ত হয়েছিল। বিভিন্ন গবেষণা বলছে যে, যখন একটা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠরা সামরিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত হয় এবং সংখ্যালঘুরা নেতৃত্বশূণ্য থাকে, তখনই গণহত্যা সবচাইতে প্রকট আকার নেয়। প্রকৃতপক্ষে বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদী নীতি পুরো দক্ষিণ এশিয়ার বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে; ধ্বংসপ্রাপ্ত বিশ্বব্যবস্থায় যার ফলাফল হবে সুদূরপ্রসারী।

No comments:

Post a Comment