Wednesday 16 June 2021

বাইডেন এবং পুতিনের বৈঠকের ফলাফল কি?

১৭ই জুন ২০২১
এই বৈঠক রেগ্যান এবং গরবাচেভের বৈঠকের মত কিছু ছিল না। বরং যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মূল ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মাঝে একটা সাইড বৈঠক। বৈঠকের আগেও বোঝা যাচ্ছিল যে, এখান থেকে তেমন কিছু আসবে না। বৈঠকে মুখে যা বলা হয়েছে, তা বাস্তবায়িত হবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে; কারণ এখন পর্যন্ত বাইডেন সেব্যাপারে কোন শক্ত পদক্ষেপ দেখাতে পারেননি। ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ের মতো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের ফিরে আসাটা এখন মোটেই সহজ নয়। বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান ধরে রাখতে হিমসিম খাচ্ছে। অন্য একটা দেশের অভ্যন্তরে হস্তক্ষেপ করাটা একসময় যুক্তরাষ্ট্রের একার অধিকার ছিল। এখন আরেকটা শক্তিকে একই কাজ করা থেকে বিরত করতে পারার সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে কিনা, সেব্যাপারে এখন কেউই নিশ্চিত নয়।


১৬ই জুন সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মাঝে শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। আলোচনায় তারা অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ এবং কূটনীতি নিয়ে আন্তরিক আলোচনা করেছেন। তবে ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, তারা মূলতঃ যেখানে শুরু করেছিলেন, সেখানেই বৈঠক শেষ করেছেন। অর্থাৎ মানবাধিকার, সাইবার হামলা, নির্বাচনে হস্তক্ষেপসহ বিভিন্ন বিরোধ যেখানে ছিল, সেখানেই আছে। সবচাইতে বড় অগ্রগতি ছিল যে, দুই দেশ তাদের রাষ্ট্রদূতদেরকে অপরের রাজধানীতে পাঠাবার ব্যাপারে একমত হয়েছে এবং অবশিষ্ট পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের চুক্তির ব্যাপারে তারা আবারও কাজ শুরু করতে চাইছেন। বৈঠকের পর সংবাদ সন্মেলনে বাইডেন বলেন যে, পুতিনের কর্মকান্ড পরিবর্তন হবার ব্যাপারে তিনি মোটেই আত্মবিশ্বাসী নন। তিনি বলেন যে, সারা বিশ্ব যদি পুতিনের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তবেই কেবল তার কর্মকান্ডে পরিবর্তন আসতে পারে। তবে তিনি কোনকিছুর ব্যাপারেই নিশ্চিত নন। সন্মেলনে বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রকে ন্যায়ের পক্ষে উপস্থাপন করলেও পুতিনের কর্মকান্ডকে অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি নীতি থেকে খুব বেশি আলাদা করে দেখছেন না। মার্কিন নির্বাচনে হস্তক্ষেপের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র পুতিনের বিরুদ্ধে যতটা সোচ্চার হয়েছে, নিজেদের কর্মকান্ডকে ততটাই ঢেকে রেখেছে।

সংবাদ সন্মেলনে বাইডেন প্রশ্ন করেন যে, এমন যদি হতো যে, বাকি বিশ্ব মনে করছে যে, যুক্তরাষ্ট্র এমন একটা রাষ্ট্র যা অন্য দেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে, এবং সেটা সকলে জানতো? যুক্তরাষ্ট্র যদি রাশিয়ার মতো কর্মকান্ডে জড়িত হতো, তবে কেমন হতো? বাইডেন এই মন্তব্যের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে একটা নম্র এবং ভদ্র শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইলেও বাস্তবতা অন্যরকম। ‘কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটি’র এক গবেষণাপত্রে ডোভ লেভিন বলেন যে, ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৮৯এর মাঝে যুক্তরাষ্ট্র মোট ৬২ বার বিভিন্ন দেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে। এর বেশিরভাগই ছিল গোপন অপারেশন। আর ব্যাপারটা এমন নয় যে, যে প্রার্থী বেশি গণতন্ত্রী তাকেই মার্কিনীরা সমর্থন দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র তার পক্ষেই দাঁড়িয়েছে, যে মার্কিন স্বার্থকে বেশি দেখবে। উদাহরণস্বরূপ, গায়ানাতে ১৯৬৮ সালের নির্বাচনে লিন্ডন জনসনের মার্কিন সরকার বামপন্থী গণতন্ত্রী চেড্ডি জাগানকে হারাতে গিয়ে ফোর্বস বার্নহ্যামকে সমর্থন দেয়। বার্নহ্যাম মার্কিন সহায়তায় ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচনে জেতেন এবং ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত একনায়ক হিসেবে দেশ শাসন করে যান। মূলতঃ যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থ সর্বদাই গণতন্ত্রের উপরে স্থান পেয়েছে। একারণেই বামপন্থী গণতন্ত্রীদেরকে যুক্তরাষ্ট্র ঠেকাতে চেয়েছে সর্বদা।

নিউ ইয়র্কের ‘সিটি ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর পিটার বেইনার্ট মার্কিন পত্রিকা ‘দ্যা আটলান্টিক’এর এক লেখায় বলছেন যে, মার্কিন জনগণ জানে না যে যুক্তরাষ্ট্র কত দেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে। তারা অনেকেই পছন্দ করবে যে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করুক। কিন্তু এই অবস্থাটা বিপজ্জনক; কারণ ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন দেশের নির্বাচনে মার্কিন হস্তক্ষেপ গণতন্ত্রকে প্রসার করার চাইতে ক্ষতিগ্রস্তই করেছে বেশি। ১৯৯৬ সালে রুশ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলেতসিন আবারও জিততে চাইছিলেন। কিন্তু মারাত্মক অব্যাবস্থাপনায় রাশিয়ায় বেকারত্ব তখন চরমে; মুদ্রাস্ফীতির কারণে নাভিশ্বাস উঠেছে জনগণের। ইয়েলেতসিনের জনসমর্থন ছিল মাত্র ৬ শতাংশ! অথচ কমিউনিজম থেকে সদ্য পরিবর্তিত রাশিয়াতে গণতন্ত্র এবং পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠা করতে বিল ক্লিনটনের মার্কিন সরকার ইয়েলেতসিনের চাইতে ভালো কোন লোক খুঁজে পায়নি। মার্কিন সরকারের লবিংএর ফলশ্রুতিতে আইএমএফ রাশিয়াকে ১০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ দেয়। ইয়েলেতসিন তার নির্বাচনী প্রচারণায় এই ফান্ড থেকেও খরচ করেছিলেন বলে জানা যায়। বিল ক্লিনটনের নির্বাচনী সহযোগী রিচার্ড ড্রেসনারসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে ওয়াশিংটন থেকে মস্কো পাঠানো হয় নির্বাচনে ইয়েলেতসিনকে সহায়তা দেয়ার জন্যে। ইয়েলেতসিন নির্বাচনে জেতেন। ‘ওইসিডি’র নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল যেন নির্বাচনে অনিয়মের কথা প্রকাশ না করে, তা নিশ্চিত করা হয়েছিল। এর অনেকদিন পর নির্বাচন পর্যবেক্ষক মাইকেল মেডোক্রফট বলেন যে, তার উপর চাপ সৃষ্টির কারণে তিনি অনিয়মের খবর প্রকাশ করতে পারেননি। ৫ লক্ষ ভোটারের চেচনিয়াতে ভোট দিয়েছিল ১০ লক্ষ মানুষ; তাও আবার সেখানে রুশদের ব্যাপক অত্যাচারের পরেও চেচেনরা নাকি ইয়েলেতসিনের পক্ষে ৭০ শতাংশ ভোট দিয়েছিল! সেসময় মস্কোতে মার্কিন দূতাবাসে কাজ করা থমাস গ্রাহাম মত দেন যে, অনিয়মের চাইতে ফলাফল বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল; তাই অনিয়মের ব্যাপারটা সকলেই এড়িয়ে গেছেন।

‘বিবিসি’ তাদের বিশ্লেষণে বলছে যে, বাইডেন বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র যা চাইছে, রাশিয়া যদি তা না করে, তবে ওয়াশিংটন এর প্রত্যুত্তর দেবে। কিন্তু কিভাবে সেই প্রত্যুত্তর আসতে পারে, সেব্যাপারে সন্দেহ রয়েই যাচ্ছে। ভ্লাদিমির পুতিনও হয়তো এই ব্যাপারটা নিয়েই চিন্তা করবেন যে, বাইডেন কথা এবং কাজের মাঝে পার্থক্য কতটা হতে পারে। বাইডেন হয়তো দুনিয়াকে একটা বার্তা দিতে চাইছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আবারো ফিরে এসেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকার থেকে তিনি নিজেকে আলাদা করতে চাইছেন। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর ‘জি জিরো মিডিয়া’র এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মাঝে বিরোধের মূল যায়গা একটাই। যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে যে, সে এখনও বৈশ্বিক সুপারপাওয়ার; অপরদিকে রাশিয়া দ্বিতীয় সাড়ির একটা শক্তি হিসেবে নিজেকে দেখতে চাইছে না। মার্কিন ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ ইয়ান ব্রেমার বলছেন যে, এই বৈঠক রেগ্যান এবং গরবাচেভের বৈঠকের মত কিছু ছিল না। বরং যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মূল ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মাঝে একটা সাইড বৈঠক। বৈঠকের আগেও বোঝা যাচ্ছিল যে, এখান থেকে তেমন কিছু আসবে না। বৈঠকে মুখে যা বলা হয়েছে, তা বাস্তবায়িত হবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে; কারণ এখন পর্যন্ত বাইডেন সেব্যাপারে কোন শক্ত পদক্ষেপ দেখাতে পারেননি। ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ের মতো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের ফিরে আসাটা এখন মোটেই সহজ নয়। বিশ্লেষকদের কথায় যে ব্যাপারটা পরিষ্কার তা হলো, বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান ধরে রাখতে হিমসিম খাচ্ছে। অন্য একটা দেশের অভ্যন্তরে হস্তক্ষেপ করাটা একসময় যুক্তরাষ্ট্রের একার অধিকার ছিল। এখন আরেকটা শক্তিকে একই কাজ করা থেকে বিরত করতে পারার সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে কিনা, সেব্যাপারে এখন কেউই নিশ্চিত নয়।

4 comments:

  1. মুনীর16 June 2021 at 23:46

    আমেরিকা ইউরোপের এজিটেশনকে আরো কমাতে চাইতেছে। EUr সামরিক শক্তি ন্যাটোকে ইউনিফাইড পলিটিকাল মেসেজ দিল চায়নাকে। তবে ন্যাটোকে কতটুকু ফিজিক্যালি সামনে পাবা এটা EU এর ইন্টার্নাল পাওয়ার ফ্রান্স জার্মানীর নিজস্ব নিরাপত্তা চিন্তার উপর নির্ভর করবে। রাশিয়াকে আমেরিকা চাইবে চায়নার বিপরীতে ব্যাবহার করতে। সেই ক্ষেত্রে EUকে সন্তুষ্ট রাখা পসিবল হবেনা আমেরিকার কারণে বাইডেন আসলেও আগের জায়গায় নেই আমেরিকা। বাই পোলারাইজেশোনের সর্বোচ্চ স্বার্থ কেদ্রিক বিশ্ব বাস্তবতা এখন। ব্রিটেন শিয়ালের মত তাকিয়ে আছে এই সুযোগটা নেওয়ার জন্য। ভূ রাজনীতির ভাইটাল স্পেইস দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া হলেও আমেরিকার দূর্বলতার কারণে আগের নিয়ন্ত্রিত স্পেইস গুলো থেকে উঠে আসতে পারছেনা সে। এইটা চায়না জন্য সুযোগ সৃষ্টি করেছে। পুরো ইম্ব্যালেন্স এই বিশ্ব বাস্তবতায় আদর্শিক কোন শক্তির উত্থান ঘটলে ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদী ব্যাবস্থা আসলেই মুখ তুবড়ে পড়বে। ইসরাইল ইস্যুর কারণে মুসলিম বিশ্বের শাসকদের আরোবেশী জনগণ থেকে আলাদা হওয়ার বাসতবতা আর জণগণের সামগ্রিক আদর্শিক সচেতনতা সেই বাস্তবতা ঘটার দিকেই কিন্তু ধাবিত করছে মনে হচ্ছে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে রাশিয়া এবং চীনের মাঝে দূরত্ব তৈরি করতে ইউরোপ যেতে হবে না। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই এটা করা শুরু করেছে মধ্য এশিয়াতে। মধ্য এশিয়া মার্কিনীরা যা কিছুই করুক না কেন, সেটা রাশিয়া এবং চীনকে কিছু একটা করতে বাধ্য করবে। আফগানিস্তান হলো সেই খেলারই অংশ। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে পাকিস্তান এবং তুরস্ককে যুক্ত হতে দিয়েছে; এর ফলশ্রুতিতে রাশিয়া নিরাপত্তাহীনতায় পড়বে; কিন্তু চীনের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে।

      ইতোমধ্যেই কিরগিজস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি রাশিয়াকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছে। চীনেরও সেখানে স্বার্থ রয়েছে; কারণ সেটা উইঘুরের ঠিক পাশেই; এবং উইঘুরের সকল খবরাখবর সেই পথেই আসে। কিরগিজস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাটা রাশিয়া এবং চীন উভয়ের জন্যেই অনেক বড় হুমকি। কিন্তু এরা কেউই একে অপরের কাছ থেকে সাহায্য চাইবে না কিরগিজস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে।

      Delete
  2. কিরগিজস্তানের ভু-রাজনৈতিক গুরুত্ব সম্পর্কে যদি বলেন তো খুব ভাল হয়।

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই ব্লগের লেখাগুলি পড়লে বেশিরভাগ প্রশ্নেরই উত্তর পাবার কথা।

      https://koushol.blogspot.com/2020/10/kyrgyzstan-unrest-new-geopolitical-game-central-asia.html

      Delete