Tuesday 1 June 2021

‘ওয়ান চাইল্ড’ থেকে ‘থ্রি চাইল্ড’ ... কোন পথে চীন?

০২রা জুন ২০২১ 
‘ওয়ান চাইল্ড’ নীতির কারণে চীনে যেমন অবিবাহিত মধ্যবয়সী পুরুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি শহরাঞ্চলে বেশি খরচের ভয়ে মহিলারা একের বেশি সন্তান নিতে না চাওয়ায় ‘টু চাইল্ড’ এবং ‘থ্রি চাইল্ড’ নীতির সফলতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। অর্থনীতিকে এতটা প্রাধান্য দেয়ার পরেও চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ব্যাপারে কেউই নিশ্চিত নয়। মানুষের প্রবৃত্তিকে এড়িয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়ার ফলশ্রুতিতে সমাজ, অর্থনীতি এবং রাজনীতি, সবগুলিই এখন ঝুঁকির মাঝে পড়েছে; যা সামনের দিনগুলিতে চীনের ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করবে।


গত ৩১শে মে চীন ঘোষণা করেছে যে, চীনা দম্পতিরা এখন থেকে সর্বোচ্চ তিনজন সন্তান গ্রহণ করতে পারবেন। চীনা বার্তা সংস্থা ‘শিনহুয়া’ জানাচ্ছে যে, পলিটব্যুরোর বৈঠকে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এব্যাপারে সম্মতি দিয়েছেন। মে মাসের শুরুতে প্রকাশিত আদম শুমারিরতে দেখা যায় যে, ২০২০ সালে চীনে প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ শিশু জন্ম নিয়েছে; যা কিনা ২০১৬ সালে ছিল ১ কোটি ৮০ লক্ষ। ১৯৬০এর দশকের পর থেকে এটা সর্বনিম্ন সংখ্যা। ২০১৬ সালে চীনা সরকার তাদের ‘ওয়ান চাইল্ড’ নীতিতে পরিবর্তন এনে দম্পতিদেরকে দু’টা সন্তান গ্রহণ করতে অনুমতি দেয়। সেই অনুমতির পর থেকে দুই বছরের জন্যে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও তা আবারও অবনতির দিকে যেতে থাকে। চার বছরের মাথায়ই চীনা সরকার সেই নীতিতে দ্বিতীয়বারের মতো পরিবর্তন আনলো। ১৯৭৯ সালে চীনা সরকার নিয়ম করেছিল যে, চীনা দম্পতিরা একটার বেশি সন্তান গ্রহণ করতে পারবে না। যে পরিবার এই নিয়ম মানেনি, তাদেরকে জরিমানা এবং চাকুরিচ্যুত করা ছাড়াও গর্ভপাতে বাধ্য করা হয়েছিল। বারংবার নীতি পরিবর্তনের একদিকে যেমন অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে, তেমনি তা চীনের তথা বিশ্বের ভূরাজনীতিতেও ভূমিকা রাখবে।

‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, চীনের ‘ওয়ান চাইল্ড’ নীতির কারণে দেশটাতে পুরুষ মহিলার অনুপাতে মারাত্মক ধরনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। বেশিরভাগ পরিবারই একটা সন্তান নেবার ব্যাপারে ছেলে সন্তানকে গুরুত্ব দিতে থাকে। ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর’এর প্রফেসর মু ঝেং বলছেন যে, চীনা সরকারের এই নীতির ফলে আর্থসামাজিক দিক থেকে অপেক্ষাকৃত নিচের ঘরে জন্ম নেয়া পুরুষরা বিয়ের জন্যে পাত্রী পেতে ব্যর্থ হয়। বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা ‘রয়টার্স’ বলছে যে, পরিবর্তিত নিয়ম চীনের একেক অঞ্চলে একেকভাবে প্রতিফলিত হবে। বড় শহরগুলিতে জীবনযাত্রার খরচ বেশি হওয়ায় অনেক মহিলাই আরেকটা সন্তান গ্রহণ করতে দু’বার চিন্তা করবে; অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলের মানুষ খরচের চাইতে পরিবারের রীতিকেই বেশি গুরুত্ব দেবে। এতে নতুন ধরনের আর্থসামাজিক সমস্যার জন্ম হতে পারে। অনেকেই মনে করছেন যে, যেহেতু কয়েক দশকে চীনের অর্থনীতির আকার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, তাই চীনের জনসংখ্যা কমে যাবার ব্যাপারটা সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে। কারণ চীনের অর্থনীতিকে বড় করতে যথেষ্ট সংখ্যক নবীন জনগণ পাওয়া যাবে না; বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা বাড়বে প্রতিনিয়ত। ২০১০ সালে যেখানে জনসংখ্যার ৯ শতাংশ ছিল ৬৫ বছরের উপর; সেখানে ২০২০ সালে তা দাঁড়িয়েছে সাড়ে ১৩ শতাংশে। চীনা সরকার জনগণের অবসরে যাবার বয়স বাড়িয়ে এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে পারে।

‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, চীনের বাজারভিত্তিক অর্থনীতি সেদেশে ব্যাপকহারে বেশ্যাবৃত্তির জন্ম দিয়েছে। যদিও চীনে বেশ্যাবৃত্তি বেআইনী, তথাপি জনসংখ্যার মাঝে মহিলার সংখ্যা কম হওয়ায় এবং বহু মানুষ শহরের শিল্পাঞ্চলে কাজের জন্যে চলে আসার কারণে বেশ্যাবৃত্তিকে থামানো যাচ্ছে না। ‘হাফিংটন পোস্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ‘হ্যাপি এনডিং’এর নামে সেখানে বেশ্যাবৃত্তি চলছে। কিছু শহরে ম্যাসাজ পার্লারের নামে চলছে বেশ্যাবৃত্তি। ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, সোশাল মিডিয়া ব্যবহার করে বেশ্যাবৃত্তির ব্যাপক প্রসার হচ্ছে। চীনে এখন মানুষ বিক্রি না হলেও মানুষ ভাড়ায় পাওয়া যাচ্ছে!
 
২০১৬ সালে উইঘুরে প্রতি এক লক্ষ জনগণের মাঝে ৫০ জনকে বন্ধ্যা করে ফেলা হচ্ছিল; ২০১৮ সাল নাগাদ তা পাঁচ গুণ বেড়ে প্রতি লক্ষে ২’শ ৪৩এ গিয়ে দাঁড়ায়! অথচ পুরো চীনের জন্যে এই সংখ্যা হলো এক লক্ষে মাত্র ৩৩ জন! অর্থাৎ পুরো চীনের তুলনায় উইঘুরে বন্ধ্যাত্ব ৭ গুণেরও বেশি! চীনা সরকারের জনহার নিয়ন্ত্রণের নীতি পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দিলে উইঘুরের মত বিদ্রোহী অঞ্চলগুলিতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সরকারি চেষ্টাকে বৈধতা দেয়া কঠিন হবে।


‘সিএনএন’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, কিছু সমালোচক প্রশ্ন করছেন যে, চীনা সরকার কেন তাদের দম্পতিদের সর্বোচ্চ তিনটা সন্তান নিতে অনুমতি দিচ্ছে? কেন তারা এটা পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দিচ্ছে না? এর উত্তর হয়তো চীনের পশ্চিমের মুসলিম অধ্যুষিত শিনজিয়ান বা উইঘুর প্রদেশের নীতিতে পাওয়া যাবে। সেখানে চীনা সরকার মুসলিমদের জন্ম হার মারাত্মকভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। ২০১৬ সালে উইঘুরে প্রতি এক লক্ষ জনগণের মাঝে ৫০ জনকে বন্ধ্যা করে ফেলা হচ্ছিল; ২০১৮ সাল নাগাদ তা পাঁচ গুণ বেড়ে প্রতি লক্ষে ২’শ ৪৩এ গিয়ে দাঁড়ায়! অথচ পুরো চীনের জন্যে এই সংখ্যা হলো এক লক্ষে মাত্র ৩৩ জন! অর্থাৎ পুরো চীনের তুলনায় উইঘুরে বন্ধ্যাত্ব ৭ গুণেরও বেশি! শিনজিয়াং সরকারের হিসেবে ২০১৭ সালে সেখানে জন্ম হার ছিল প্রতি হাজারে প্রায় ১৬ জন; ২০১৮ সালে তা কমে গিয়ে দাঁড়ায় প্রতি হাজারে প্রায় ১১ জনেরও কম। অর্থাৎ এক বছরের মাঝে জন্মহার প্রায় ৩৩ শতাংশ কমে গেছে! শিনজিয়াং সরকার বলছে যে, এটা তাদের জন্মনিয়ন্ত্রণ নীতি বাস্তবায়নের ফলাফল। অনেকেই বলছেন যে, চীনা সরকারের জনহার নিয়ন্ত্রণের নীতি পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দিলে উইঘুরের মত বিদ্রোহী অঞ্চলগুলিতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সরকারি চেষ্টাকে বৈধতা দেয়া কঠিন হবে।

‘ওয়ান চাইল্ড’ নীতির কারণে চীনে যেমন অবিবাহিত মধ্যবয়সী পুরুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি শহরাঞ্চলে বেশি খরচের ভয়ে মহিলারা একের বেশি সন্তান নিতে না চাওয়ায় ‘টু চাইল্ড’ এবং ‘থ্রি চাইল্ড’ নীতির সফলতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। অধিক সংখ্যক বৃদ্ধ মানুষ এবং কমসংখ্যক নবীন কর্মক্ষম মানুষ চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আগের মতো এগিয়ে নিতে পারবে কিনা, সেব্যাপারে কেউই নিশ্চিত নয়। অর্থনৈতিক ব্যাপারগুলিকে প্রাধান্য দিয়েই ১৯৭৯ সালে ‘ওয়ান চাইল্ড’ নীতিতে যায় চীন; আবার ২০২১ সালে এসে অর্থনৈতিক কারণেই ‘থ্রি চাইল্ড’ নীতির সফলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। অর্থনীতিকে এতটা প্রাধান্য দেয়ার পরেও চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ব্যাপারে কেউই নিশ্চিত নয়। সন্তান নেবার ক্ষেত্রে শহর এবং গ্রামাঞ্চলের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য যেমন নতুন সামাজিক অসঙ্গতির জন্ম দেবে, তেমনি উইঘুরের মতো মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে বৈষম্যমূলক নীতি বাস্তবায়নের কারণে রাজনৈতিক সমস্যাও কম হবে না। অর্থনৈতিক কারণেই চীনারা পুরুষ সন্তানকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে; এখন বিয়ের জন্যে কনে পাবার সম্ভাবনা কমে যাওয়ায় এবং প্রবৃত্তিকে পরিতৃপ্ত করার আর কোন আইনী পদ্ধতি না থাকায় সেদেশে বেশ্যাবৃত্তি থামানো যাচ্ছে না। মানুষের প্রবৃত্তিকে এড়িয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়ার ফলশ্রুতিতে সমাজ, অর্থনীতি এবং রাজনীতি, সবগুলিই এখন ঝুঁকির মাঝে পড়েছে; যা সামনের দিনগুলিতে চীনের ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করবে।

1 comment:

  1. ধন্যবাদ ❗
    এই ভাবে চিনারা কোনোক্রমে বেঁচে যেতে চাইছে❕
    তবে তারা কতটুকু সামলাতে পারবে, সেটা সময়ই বলবে।
    এখানে অনেকগুলি ফ্যাক্টর কাজ করবে, যেমন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধি।

    ReplyDelete