Sunday 13 June 2021

টুইটারের সাথে বিরোধ … নাইজেরিয়ার আস্তিত্বের সংকট?

১৩ই জুন ২০২১

২০১৭ সাল। নাইজেরিয়ার দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের বায়াফ্রা অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আন্দোলন। পশ্চিম আফ্রিকায় নাইজেরিয়া সবচাইতে বড় এবং সম্পদশালী দেশ হলেও তার কৃত্রিম সীমানা তাকে অভ্যন্তরীণভাবে দুর্বল করে রেখেছে। এই দুর্বলতা তাকে পশ্চিমাদের উপর নির্ভরশীল রেখেছে; যা আজও দৃশ্যমান। পশ্চিম আফ্রিকা জুড়ে দেশটার আশেপাশের অস্থিরতা নাইজেরিয়াকে টেনে নিলেও অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার কারণে নাইজেরিয়া ভূরাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়নি; বরং পশ্চিমাদের নিজস্ব দ্বন্দ্বের শিকারে পরিণত হয়েছে।

 
১২ই জুন নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদু বুহারি ‘গণতন্ত্র দিবস’ উপলক্ষে এক টিভি ভাষণে দেশের উত্তর পূর্বে এবং দক্ষিণ পূর্বে নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবণতির কথা স্বীকার করেন। ‘সিএনএন’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, গত ডিসেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত ৮’শর বেশি স্কুল ছাত্রীকে অপহরণ করা হয়েছে। বুহারি একইসাথে দেশের দারিদ্র্য এবং যুবকদের বেকারত্বের কথা উল্লেখ করেন এবং এসব সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেন। তবে বুহারির সমস্যা কমছে না; বরং বাড়ছে। ‘গণতন্ত্র দিবস’ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে বুহারির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে; যেখানে ‘বুহারিকে অবশ্যই যেতে হবে’ লেখা প্লাকার্ড দেখায় মানুষ। প্রতিবাদকারীরা বুহারির কর্মপদ্ধতির সমালোচনা করে; বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘টুইটার’কে নাইজেরিয়াতে বন্ধ করার সমালোচনা করে তারা। গত ৪ঠা জুন নাইজেরিয়ার সরকার সেদেশে টুইটার বন্ধ করে এই বলে যে, টুইটারকে ব্যবহার করে এমন কিছু কর্মকান্ড চালানো হচ্ছে, যা কিনা নাইজেরিয়ার অস্তিত্বকেই বিপন্ন করতে পারে।

অনেকেই ধারণা করছেন যে, নাইজেরিয়ায় টুইটারকে বন্ধ করার পিছনে ১লা জুনের বুহারির টুইট বার্তার সম্পর্ক থাকতে পারে। সেই বার্তায় প্রেসিডেন্ট বুহারি দেশের দক্ষিণ পূর্বের বিচ্ছন্নতাকামী সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবার হুমকি দেন, যারা সেখানে নির্বাচন অফিসসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়েছে। টুইটার বুহারির এই বার্তা মুছে ফেলে বলে যে, এই বার্তা টুইটারের নিয়মকানুন লঙ্ঘন করেছে। বুহারি ১৯৬০এর দশকে দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে ‘বায়াফ্রা’ অঞ্চলে ঘটে যাওয়া গৃহযুদ্ধের কথাই স্মরণ করেছিলেন; এবং সেই অঞ্চলে এরকম কোন বিচ্ছন্নতাবাদী আন্দোলন আবার যেন না দেখা দেয়, তিনি সেব্যাপারে সতর্ক করেন। ‘আল জাজিরা’র এক লেখায় নাইজেরিয়ার সাংবাদিক ফিসায়ো সোইয়োমবো মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, ২০২০এর অক্টোবরে মার্কিন টেকনলজি কোম্পানি টুইটারের প্রধান নির্বাহী জ্যাক ডরসি এক টুইটার বার্তায় নাইজেরিয়ার ‘এন্ডসার্স’ আন্দোলনে বিটকয়েনের মাধ্যমে অর্থ দেবার জন্যে আনুরোধ করেন। সোইয়োমবো বলছেন যে, জ্যাক ডরসির এই টুইট বার্তার পরেই বোঝা গিয়েছিল যে, টুইটার নাইজেরিয়ার সরকারের সাথে সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে। টুইটার ছাড়া এই আন্দোলন হয়তো সম্ভব হতো না। ‘এন্ডসার্স’ হলো একটা আন্দোলন, যার মাধ্যমে নাইজেরিয়ার পুলিশের ‘স্পেশাল এন্টি রবারি স্কোয়াড’ বা ‘সার্স’কে ভেঙ্গে ফেলার দাবি জানানো হয়। ‘কোয়ার্টজ আফ্রিকা’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০১৭ সাল থেকে শুরু হয়ে ২০২০এর ১৩ই অক্টোবর পর্যন্ত ‘হ্যাশট্যাগ’এর মাধ্যমে টুইটারে ২ কোটি ৮০ লক্ষ বার ছড়ায় এই আন্দোলনের বার্তা। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিনেয়াপলসে জর্জ ফ্লয়েড নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি পুলিশের নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করার পর সোশাল মিডিয়াতে ফ্লয়েডের উপর অত্যাচারের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলশ্রুতিতে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে পুলিশের সাথে দাঙ্গা শুরু হয়। নাইজেরিয়াতেও ফ্লয়েডের সূত্র ধরেই আন্দোলন হয়েছে। ২০২০এর ৩রা অক্টোবর টুইটারে একটা ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে দেখা যায় যে, খুব সম্ভবতঃ ‘সার্স’ পুলিশ সদস্যরা নাইজেরিয়ার এক তরুণকে গুলি করছে। এর ফলশ্রুতিতে পুরো দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভ দমনে বুহারির সরকারের দমনপীড়নের পদ্ধতি পরিস্থিতিকে আরও বেশি আশান্ত করে।

নাইজেরিয়া সরকারের তথ্যমন্ত্রী লাই মোহাম্মদ সাংবাদিকদের বলেন যে, নাইজেরিয়ার দক্ষিণ পূর্বের বিচ্ছন্নতাবাদী নেতা নামদি কানুর বিপজ্জনক টুইট বার্তা টুইটার কখনও মুছে না। কানু বিদেশে বসবাস করে নাইজেরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলির উপর হামলা করার নির্দেশ দিচ্ছেন। নামদি কানু হলেন নাইজেরিয়ার দক্ষিণ পূর্বের ইগবো জাতি অধ্যুষিত বিচ্ছন্নতাবাদী ‘বায়াফ্রা’ এলাকার ‘ইন্ডিজেনাস পিপল অব বায়াফ্রা’ বা ‘আইপিওবি’এর নেতা; যিনি ১৯৬০এর দশকে ব্যর্থ হওয়া বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দলনকে জিইয়ে রেখেছেন। ২০১৫ সালে তিনি একবার গ্রেপ্তার হন; দু’বছর পর তাকে ছেড়েও দেয়া হয়। সাংবাদিক সোইয়োমবো বলছেন যে, দেশের দক্ষিণ পূর্বের কিছু অঞ্চল ছাড়া ইহুদী ধর্মের অনুসারী নামদি কানুর তেমন অনুসারী নেই। কিন্তু কানুর ব্যাপারে বুহারি সরকারের অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার সূত্র ধরে নাইজেরিয়ার প্রায় ৪ কোটি টুইটার ব্যবহারকারীকেই অন্ধকারে নিপতিত করে দেয়াটা দেশব্যাপী বিক্ষোভ ডেকে এনেছে।

নাইজেরিয়া সরকার বলছে যে, টুইটার যদি নাইজেরিয়াতে অপারেট করতে চায়, তাহলে তাকে নাইজেরিয়াতে লাইসেন্স নিতে হবে। ‘সিএনএন’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ভারত এবং নাইজেরিয়ার মতো বড় দুই দেশেই টুইটার সমস্যা পড়েছে। অথচ নিজেদের ব্যবসার সম্প্রসারণ চাইলে দুই দেশেই টুইটারের অপারেট করার কোন বিকল্প নেই। ভারত সরকার গত কয়েক মাস ধরেই টুইটারের সাথে বাকস্বাধীনতা বিষয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে আছে। কিছুদিন আগে অস্ট্রেলিয়া এবং ব্রিটেনের সাথেও মার্কিন সোশাল মিডিয়া কোম্পানিগুলির দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

‘ডয়েচে ভেলে’র সাথে কথা বলতে গিয়ে নাইজেরিয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষক আব্দুল্লাহি মোহামেদ কোলি বলেন যে, টুইটার নাইজেরিয়ার বিপক্ষে যারা কাজ করছে, তাদেরকে শক্তি যোগাচ্ছে। ‘আইপিওবি’ ছাড়াও আরও অনেক সংগঠন টুইটারকে কাজে লাগিয়ে নাইজেরিয়ার অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলছে। টুইটার নাইজেরিয়াতে অফিস খোলা, রেজিস্টার করা, নাইজেরিয়ার আইন মানা, বা ট্যাক্স প্রদান করতে চাইছে না; যা নাইজেরিয়ার স্বার্থের বিরুদ্ধে। মোহামেদ কোলির কথাগুলি নাইজেরিয়ার সরকারের কথাগুলিকেই প্রতিফলিত করে। বায়াফ্রা গৃহযুদ্ধের অর্ধশতবর্ষ পরেও নাইজেরিয়া নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে লড়াই করছে। ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া কৃত্রিম ভৌগোলিক সীমানাকে রক্ষা করতে গিয়ে নাইজেরিয়ার নেতৃত্ব নিজ জনগণকেও দূরে ঠেলে দিয়েছে; দেশকে করেছে আরও দুর্বল। টুইটারের মতো মার্কিন টেকনলজি কোম্পানিগুলি নাইজেরিয়া, ভারত, অস্ট্রেলিয়াসহ ব্রিটিশ কমনওয়েলথের দেশগুলির সাথে আইনগত দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে; যা তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ এবং কর্পোরেট আদর্শকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। বায়াফ্রা যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ডসহ কিছু ক্যাথোলিক খ্রিস্টান দেশ এবং সংস্থা বায়াফ্রাকে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সহায়তা দিয়েছিল। প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশ নাইজেরিয়া সবচাইতে বড় সহায়তা পেয়েছিল ব্রিটেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে। পশ্চিম আফ্রিকায় নাইজেরিয়া সবচাইতে বড় এবং সম্পদশালী দেশ হলেও তার কৃত্রিম সীমানা তাকে অভ্যন্তরীণভাবে দুর্বল করে রেখেছে। এই দুর্বলতা তাকে পশ্চিমাদের উপর নির্ভরশীল রেখেছে; যা আজও দৃশ্যমান। পশ্চিম আফ্রিকা জুড়ে দেশটার আশেপাশের অস্থিরতা নাইজেরিয়াকে টেনে নিলেও অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার কারণে নাইজেরিয়া ভূরাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়নি; বরং পশ্চিমাদের নিজস্ব দ্বন্দ্বের শিকারে পরিণত হয়েছে।

No comments:

Post a Comment