Friday 4 June 2021

জার্মানি কেন নিজস্ব ভূরাজনৈতিক কৌশল প্রণয়ন করছে?

০৪ঠা জুন ২০২১

জার্মানরা বুঝতে পারছে যে, ঠান্ডা যুদ্ধের পর তৈরি করা বিশ্বব্যবস্থা এখন পুরোপুরিভাবে ভেঙ্গে পড়ছে। তাই ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাকে অনুসরণ করা ছাড়া তাদের সামনে আর কোন গত্যন্তর নেই। তবে ২০৪০ সালের কৌশল বলে দিচ্ছে যে, ন্যাটো, ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে জার্মানি এখনও এককভাবে নিজের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে এগুবার ব্যাপারে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী নয়।


জার্মান সরকার সাম্প্রতিক সময়ে ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা ২০২১ সালে ইন্দোপ্যাসিফিকে তাদের নৌবাহিনীর একটা ফ্রিগেট মোতায়েন করবে। ২০০২ সালের পর থেকে এশিয়ার সমুদ্রে জার্মান নৌবাহিনী প্রথমবারের মতো আনাগোণা করবে। কিন্তু জার্মানির ইন্দোপ্যাসিফিকে যুদ্ধজাহাজ প্রেরণের উদ্দেশ্য কি? অনেকেই বলছেন যে, এটা চীনের প্রতি একটা বার্তা। আবার কেউ কেউ বলছেন যে, এটা জার্মানির বন্ধুদের প্রতিই একটা বার্তা। তবে এখানে প্রথম প্রশ্ন হলো, এটা কি জার্মান কৌশলগত চিন্তায় কোন পরিবর্তনের প্রতিফলন কিনা।

জার্মানির কৌশলগত চিন্তায় পরিবর্তন কেন?

জার্মানির রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তারা কিভাবে চিন্তা করছেন, তার একটা সম্যক ধারণ পাওয়া যাবে ২০১৭ সালে ফাঁস হওয়া একটা গোপন দলিল থেকে। জার্মান পত্রিকা ‘ডের স্পাইজেল’ জার্মান সেনাবাহিনীর প্ল্যানিং অফিসের ১’শ ২ পৃষ্ঠার ২০৪০ সাল পর্যন্ত কৌশলগত ভবিষ্যৎবাণীর এই দলিল ফাঁস করে দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি প্রথমবারের মতো এরকম একটা দলিল তৈরি করেছে। পত্রিকাটা বলছে যে, এই দলিল লেখা হয়েছিল ২০১৫ সালের দিকে। ২০৪০ সাল পর্যন্ত ভূরাজনৈতিক ঘটনাবলীকে মোটামুটি ছয়টা সম্ভাবনার মাঝে আলোচনা করা হয়। প্রথম দু’টা সম্ভাবনাই মূলতঃ ইইউএর সমস্যা নিয়ে; যেখানে বলা হচ্ছে যে, ইইউ ব্যাপক সমস্যার মাঝে থাকলেও আটলান্টিকের ওপাড়ের সাথে দৃঢ় সম্পর্ক রাখার মাধ্যমে কোনমতে টিকে থাকবে। এর মাঝে জার্মানির নিরাপত্তার ফোকাস থাকবে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির সহায়তায় শান্তি রক্ষার কাজ করা।

তৃতীয় সম্ভাবনাটা হলো পশ্চিমা দুনিয়ায় উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়া; যার কেন্দ্রে থাকবে জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং সন্ত্রাসবাদ। চতুর্থ সম্ভাবনা হলো ইউরোপ এবং চীনে অর্থনৈতিক মন্দা। জার্মানির প্রধান দুই বাজার হলো এগুলি। সুতরাং এদের মন্দা মানেই জার্মানিও অর্থনৈতিকভাবে মারাত্মক হুমকিতে পড়বে।

পঞ্চম সম্ভাবনা হলো পশ্চিমের সাথে পূর্বের প্রতিযোগিতার বৃদ্ধি। এখানে পশ্চিম বলতে ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানো হয়েছে; ইইউকে বাদ দিয়ে চিন্তা করা হয়েছে। অপরদিকে পূর্বকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে চীন এবং রাশিয়া হিসেবে। তবে এই উত্তেজনা বড় কোন সংঘাতে রূপ নিতে পারে বলে তারা মনে করছেন না। তাদের ধারণা, বাণিজ্যকে টিকিয়ে রাখতে রাষ্ট্রগুলি যুদ্ধ এড়িয়ে যাবে। এই দ্বন্দ্বে পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশ হয়তো রাশিয়ার পক্ষ নিতে পারে।

ষষ্ঠ সম্ভাবনাটা হলো সবচাইতে মারাত্মক। তারা বলছেন যে, এটার মানে হলো ইইউ পুরোপুরি ভেঙ্গে যাবে; এবং একইসাথে যুক্তরাষ্ট্র তার বৈশ্বিক নেতৃত্বকে ধরে রাখতে পারবে না। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করবে এবং তা থামাবার ক্ষমতা পশ্চিমা দুনিয়ার কারুরই থাকবে না।

এই বিশ্লেষণের অর্থ হলো, জার্মানরা মনে করছে যে, সামনের দিনগুলি আরও অনেক বেশি অনিশ্চিত হবে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘জিওপলিটিক্যাল ফিউচার্স’ বা ‘জিপিএফ’এর বিশ্লেষণে জার্মানির সমস্যাগুলিকে সহজভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দা ইইউএর মাঝে ফাঁটল ধরায়। অর্থনৈতিক চাপে পড়ে একেক দেশ একেকভাবে চিন্তা করতে থাকে। এই ফাঁটল আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে যখন সিরিয়া যুদ্ধের কারণে হাজার হাজার শরণার্থী ইউরোপে প্রবেশ করতে থাকে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি শরণার্থীদেরকে তাদের দেশের উপর দিয়ে যেতে দেয়; কারণ শরণার্থীরা পশ্চিম ইউরোপেই যেতে চাইছিল। এরপর ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া দখল করে নিলে ন্যাটোর মাঝে ফাঁটল দেখা দেয়। জার্মানি রাশিয়ার গ্যাসের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল; অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র চাইছে জার্মানি যাতে রাশিয়ার উপর নির্ভরশীলতা না রাখে। জার্মানির উল্টো পথে হাঁটছে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলই; যারা রাশিয়ার হুমকি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের উপর বেশি নির্ভরশীল হতে থাকে।

‘জিপিএফ’ বলছে যে, ইউরোপে জাতীয়তাবাদ বাণিজ্যকে বাধাগ্রস্ত করবে; যা জার্মানির রপ্তানিভিত্তিক অর্থনীতিকে আঘাত করবে। অর্থাৎ এতে ইইউএর কাঠামো ক্রমেই প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকবে। জার্মানি ইইউএর মাঝে ছিল শুধু অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে নয়। জার্মানরা মনে করেছে যে, ইইউএর ভেতরে থাকার মাধ্যমে জার্মানি ইউরোপের মাটিতে তার অপর প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে সংঘাত এড়াতে পারবে। অপর এই প্রতিদ্বন্দ্বী হলো ফ্রান্স। অপরদিকে ২০১৪ সালের পর থেকে জার্মানি বুঝতে শুরু করে যে, ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে নিজের স্বার্থ হিসেবে আর চিন্তা করা যাবে না। কাজেই নিজের স্বার্থ অনুযায়ী কৌশল ঠিক করার সময় এসেছে। তবে ‘জিপিএফ’ বলছে যে, জার্মানরা নিজেদেরকে অনিরাপদ ভাবা শুরু করলে তারা নিজেদের সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করবে; যা কিনা যুক্তরাষ্ট্র অনেকদিন থেকেই চাইছে।

 
যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের দ্বন্দ্বে নিশ্চিতভাবে কোন পক্ষ নিতে জার্মানি বাধ্যবাধকতার মাঝে পড়তে চাইছে না; বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো জার্মানি নিজস্ব স্বকীয়তা পেতে চাইছে। তথাপি অদূর ভবিষ্যতে জার্মানি হয়তো ইন্দোপ্যাসিফিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দ্বন্দ্বে জড়াবে না; বরং জার্মানি নিজের অর্থনৈতিক শক্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেই মোতায়েন করছে।



জার্মানরা কিভাবে তাদের সামনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে চাইছে?

ব্রিটিশ ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’এর এক লেখায় জার্মানির পটসড্যাম ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর ম্যাক্সিমিলিয়ান টেরহাল বলছেন যে, ১৯৪৯ সালে যে চিন্তা নিয়ে ন্যাটো গঠিত হয়েছিল, সেটারই একটা পরিবর্তিত ধরন নিয়ে একুশ শতকের কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। ১৯৪৯ সালে যেখানে বলা হয়েছিল যে, ন্যাটো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে ভেতরে রাখার জন্যে এবং একইসাথে রাশিয়াকে বাইরে রাখা এবং জার্মানিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে। এখন ২০২০এর দশকে এসে কথাগুলির প্রথম দুই অংশ এক রেখে শুধু জার্মানির স্থানে চীনকে বসাতে করতে হবে। তিনি বলছেন যে, চীনারা তাদের প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে ইউরোপিয় ইউনিয়নের দুর্বল দেশগুলিকে টার্গেট করছে। বিশেষ করে করোনাভাইরাসের মহামারির মাঝে ইতালি এবং গ্রিসের চীনা বিনিয়োগের লোভের মাঝে পড়ে যাবার কথা বলছেন তিনি। তার মতে জার্মানির উচিত হবে ইইউএর এহেন দুর্বল সময়ে ইউরোপের নেতৃত্ব দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানো যে, চীনকে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে ইউরোপের দরকার রয়েছে। টেহহাল রাশিয়াকে ইউরোপের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখছেন; এবং মনে করছেন যে, যদি যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে কোন সংঘাতে জড়িয়ে পরে, তাহলে রাশিয়া ইউরোপের সিমানায় নিজের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ নেবে। তখন যারা রাশিয়ার শক্তি কমে গেছে বলে বলছেন, তারা দু’বার চিন্তা করতে বাধ্য হবেন। তিনি ইউরোপের সকল দেশের সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করার পক্ষপাতি। এভাবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ইউরোপের ব্যাপারে আগ্রহী করে রাখতে চাইছেন এবং একইসাথে রুশ হুমকিকে মোকাবিলা করার কথা বলছেন। দুনিয়ার উপর পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক এবং সামরিক নেতৃত্ব ধরে রাখতে ইউরোপকে একত্রিত হতে হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রকেও সাথে রাখতে হবে বলে বলছেন তিনি। আর সেই আঙ্গিকে বিশ্বব্যাপী চলমান ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে বাস্তবতা ধরে এঙ্গেলা মার্কেলের পর জার্মানির নতুন চ্যান্সেলরকে ইউরোপের নেতৃত্ব দেবার চেষ্টা করতে হবে।

জার্মান সামরিক বাহিনীর ক্রয় পরিদপ্তরের কর্মকর্তা ডমিনিক ঊল্লার্স অবশ্য ইউরোপের একমত হবার ব্যাপারে অতটা আশাবাদী নন। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র যখন তার শক্তিকে চীনের বিরুদ্ধে মোতায়েন করছে, তখন ইউরোপকে যেমনি আলাদাভাবে চিন্তা করতে হবে, তেমনি ইউরোপের প্রধান দেশগুলিকেও আলাদাভাবে চিন্তা করতে হবে। 'ওয়ার অন দ্যা রকস' ম্যাগাজিনের এক লেখায় তিনি উদাহরণস্বরূপ গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত জার্মান সরকারের ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশলকে টেনে নিয়ে আসেন। তিনি বলছেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে জার্মানিতে যুদ্ধবিরোধী মনোভাব এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাকে তুলে ধরে সেই আলোকে নিজস্ব স্বার্থের উপর ভিত্তি করে কৌশল প্রণয়ন করাটা কারুর কাছেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। কিন্তু জার্মানি এখন সেই ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাকেই তার কৌশল প্রণয়নের কেন্দ্রে রেখেছে। ইউরোপে চীনাদের অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার জার্মানির অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রতি হুমকি হওয়ায় জার্মানি ইউরোপে চীনাদের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে। অপরদিকে ইন্দোপ্যাসিফিকের ৪’শ কোটি মানুষের বিশাল বাজার এবং সেখানকার বিশাল জনশক্তির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা শিল্প অবকাঠামো জার্মানির অর্থনৈতিক স্বার্থকে ধরে রাখার জন্যে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি অত্র অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথগুলির নিরাপত্তাজনিত চ্যালেঞ্জ জার্মানির নিরাপত্তার জন্যে হুমকি। একারণেই জার্মানি তার অর্থনৈতিক স্বার্থকে রক্ষা করতে ইন্দোপ্যাসিফিকে নৌবাহিনীর একটা জাহাজ পাঠাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে জার্মানি একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক আইনকে রক্ষা করার ব্রত নিয়ে অন্যান্য ইউরোপিয় দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একই লক্ষ্যে কাজ করবে, তেমনি একইসাথে নিজের অর্থনৈতিক স্বার্থকে রক্ষা করতে নিজস্ব কৌশল বাস্তবায়ন করবে। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের দ্বন্দ্বে নিশ্চিতভাবে কোন পক্ষ নিতে জার্মানি বাধ্যবাধকতার মাঝে পড়তে চাইছে না; বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো জার্মানি নিজস্ব স্বকীয়তা পেতে চাইছে। তথাপি অদূর ভবিষ্যতে জার্মানি হয়তো ইন্দোপ্যাসিফিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দ্বন্দ্বে জড়াবে না; বরং জার্মানি নিজের অর্থনৈতিক শক্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেই মোতায়েন করছে।

 
আফগানিস্তানে কৌশলগত ব্যর্থতা জার্মান নেতৃত্বের প্রতি জার্মান সেনাদের বিশ্বস্ততাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। একারণেই জার্মান সেনাদের মাঝে উগ্র ডানপন্থী রাজনৈতিক দল ‘অলটারনেটিভ ফর জার্মানি’ বা ‘এএফডি’র জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আফগানিস্তান মিশনের কারণেই জার্মানরা এখন প্রশ্ন করছে যে, প্রতি বছর ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করে একটা সামরিক বাহিনী পোষার অর্থ কি? জার্মান সরকারের কাছে এই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই।


জার্মান সামরিক বাহিনী … ন্যাটোর অধীনে কতদিন?

‘ডয়েচে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, আফগানিস্তানে জার্মান সেনাদের থাকার মেয়াদ আরও ১০ মাস বাড়িয়ে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত করা হয়েছে। জার্মানরা প্রশ্ন করছে যে, এই মিশন আসলে কতটা সফল হয়েছে? এই মিশনের পিছনে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। প্রায় ১৩’শ জার্মান সেনা আফগানিস্তানে মোতায়েন রয়েছে। এ পর্যন্ত ৫৯ জন সেনা সেখানকার সংঘাতে প্রাণ হারিয়েছে। ‘ইউনিভার্সিটি অব পটসড্যাম’এর প্রফেসর সোনকা নাইতজেল বলছেন যে, আফগানিস্তানে যাবার পিছনে জার্মানদের কোন কৌশলগত চিন্তাই ছিল না। তারা অন্ধভাবে যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোকে অনুসরণ করেছে। তৎকালীন জার্মান চ্যান্সেলর গেরহার্ড শ্রোডার সেপ্টেম্বর ১১এর ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহমর্মিতা দেখাতে আফগানিস্তানে সৈন্য প্রেরণ করেছিল। চিন্তাটা ছিল এমন যে, ছয় মাসের মাঝেই সেই সেনাদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। পরবর্তীতে চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেল মনে করেছেন যে, আফগানিস্তানে সৈন্য রাখার মাধ্যমে জার্মানি ন্যাটো, জাতিসংঘ এবং ইইউএর মাঝে নিজের প্রভাব ধরে রাখছে। তাই সেখান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত পিছাতে পিছাতে দুই দশকে ঠেকেছে। আফগানিস্তানে মোতায়েনকৃত জার্মান সেনাদেরকে বলা হয়েছে যে, তালিবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাটা তাদের দায়িত্ব নয়। অন্যদিকে বহুজাতিক বাহিনীর কমান্ডাররা যুদ্ধ করতে গিয়ে জার্মান সেনাদেরকে পাশে না পেয়ে তাদেরকে ভিতু বলে আখ্যা দিয়েছে।

জার্মানরা তাদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি মুছে ফেলার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। তাই সৈন্যদেরকে যুদ্ধ করতে বলার মতো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত জার্মান নেতৃবৃন্দ নিতে পারছে না। জার্মানরা ন্যাটো মিশনে গিয়েছে; কিন্তু তাদের ইতিহাসের ভয়ে তারা ন্যাটোর লক্ষ্য বাস্তবায়নে অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলির সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেনি। তারা ন্যাটোর মাঝে সর্বদাই ‘কিছুটা জড়িত’ থেকেছে। একারণেই আফগানিস্তানের কৌশলগত সিদ্ধান্তগুলিতেও জার্মানরা অংশগ্রহণ করতে পারেনি; তাদেরকে দ্বিতীয় সাড়ির গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। নাইতজেল বলছেন যে, আফগানিস্তানে কৌশলগত ব্যর্থতা জার্মান নেতৃত্বের প্রতি জার্মান সেনাদের বিশ্বস্ততাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। একারণেই জার্মান সেনাদের মাঝে উগ্র ডানপন্থী রাজনৈতিক দল ‘অলটারনেটিভ ফর জার্মানি’ বা ‘এএফডি’র জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নাইতজেল বলছেন যে, আফগানিস্তান মিশনের কারণেই জার্মানরা এখন প্রশ্ন করছে যে, প্রতি বছর ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করে একটা সামরিক বাহিনী পোষার অর্থ কি? জার্মান সরকারের কাছে এই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই।

জার্মান সামরিক বাহিনীর ওয়েবসাইট বলছে যে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বর্তমানে প্রায় ২ হাজার ৭’শ জার্মান সেনা মোতায়েন রয়েছে। এদের সকলেরই মিশন হলো শান্তিরক্ষা করা। আফগানিস্তানে ন্যাটোর অধীনে মিশন ছাড়াও পশ্চিম আফ্রিকার মালিতে ফরাসিদের সহায়তা করার জন্যে জাতিসংঘের অধীনে ৯’শ জার্মান সেনা মোতায়েন রয়েছে সেখানে। মোটকথা এই সবগুলির কোনটাই জার্মানির নিজস্ব মিশন নয়। কিন্তু জার্মান নেতৃত্ব মনে করছে যে, ন্যাটো এবং জাতিসংঘের অধীনে এই মিশনগুলি আন্তর্জাতিকভাবে জার্মানির প্রভাব ধরে রাখার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ।

নতুন জার্মান প্রতিরক্ষানীতি … কতটুকু বাস্তব?

২০১৬ সালে জার্মান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক শ্বেতপত্রেও প্রায় একই ধরনের চিন্তার উল্লেখ রয়েছে। জার্মান চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেল এই শ্বেতপত্রের ভূমিকায় লেখেন যে, সাম্প্রতিক বছরগুলি দেখিয়ে দেয় যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে গঠন করা ইউরোপিয় ব্যবস্থা যত সফলই হোক না কেন, এই সফলতা চিরস্থায়ী নয়। একুশ শতকে ইউরোপে সামরিক শক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের সীমানা পরিবর্তন হবে; এটা কেউ চিন্তাই করেনি। প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘আর্মি টেকনলজি’র এক প্রতিবেদনে শ্বেতপত্রের বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, এতকাল জার্মানি তার সামরিক শক্তিকে ন্যাটোর অধীনেই মোতায়েন করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের পরিস্থিতি জার্মানদেরকে সক্রিয় প্রতিরক্ষানীতি গ্রহণ করতে বাধ্য করেছে। একসময় জার্মানি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের রেজোলিউশন ছাড়া, অথবা ন্যাটোর কাঠামোর বাইরে সামরিক বাহিনী পাঠানো থেকে দূরে থেকেছে। এখন ন্যাটোর বাইরে অন্য কোন স্থানে সামরিক শক্তি মোতায়েনকে জার্মানরা স্বাভাবিক হিসেবে চিন্তা করতে শুরু করেছে।

শ্বেতপত্রে জার্মানির সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করার কথা বলা হয়। ২০২৩ সালের মাঝে সেনাবাহিনীর সদস্যসংখ্যা ১৪ হাজার ৩’শ বৃদ্ধি করতে চাইছে জার্মানি। তবে জার্মানির সামরিক বাহিনী বহুদিন ধরে কম বাজেটের উপর চলার কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০১৪ সালে ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, নৌবাহিনীর বেশিরভাগ সাবমেরিন সার্ভসের বাইরে রয়েছে; সেনাবাহিনীর ‘বক্সার’ আর্মার্ড ভেহিকলগুলির ৪০ শতাংশেরও কম কর্মক্ষম রয়েছে; নৌবাহিনীর ৪২টা ‘এনএইচ ৯০’ হেলিকপ্টারের মাঝে মাত্র ৭টা ওড়ার মতো অবস্থায় রয়েছে। এই হেলিকপ্টার ক্রয়ের প্রকল্প এতটাই সমস্যার মাঝে পতিত হয়েছে যে, ২’শ হেলিকপ্টার ক্রয়ের লক্ষ্য থাকলেও এখন কেনা হচ্ছে মাত্র ৮২টা। সামরিক বাজেট যতটা বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে, তা প্রকৃতপক্ষে প্রয়োজনের তুলনায় নগন্য। আর নতুন ভূরাজনৈতিক কৌশল বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তা কতটুকু বাস্তবমুখী হবে, তা প্রশ্ন করাই যায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে জার্মানরা যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর কৌশলগত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কাজ করছে। ইইউএর মাঝে জার্মানির অবস্থান মূলতঃ অর্থনৈতিক কারণে মনে হলেও সেটাও আসলে ফ্রান্সের সাথে সংঘাত এড়াবার জন্যে। কিন্তু একুশ শতকে পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থা জার্মানিকে বাস্তবতা শেখাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে চীন যখন ইউরোপের চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে, তখন ইউরোপের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হিমসিম খাচ্ছে জার্মানি। উল্টো রাশিয়ার গ্যাসের উপর জার্মান নির্ভরশীলতা বেড়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের তোপের মুখে পড়তে হচ্ছে বার্লিনের নেতৃত্বকে। ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হবার পর থেকে বড় কোন যুদ্ধের আশংকামুক্ত থাকায় জার্মান সামরিক বাজেটে কৃপণতার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে মরচে পড়া জার্মান অস্ত্রসস্ত্রের উপর। আর ন্যাটোকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে আফগানিস্তানের যুদ্ধে অর্থহীনভাবে জড়িয়ে পড়াকে রাজনৈতিকভাবে বৈধতা দিতে গিয়ে জার্মানিতে উগ্র জাতিয়তাবাদের উত্থান হচ্ছে। জার্মানরা বুঝতে পারছে যে, ঠান্ডা যুদ্ধের পর তৈরি করা বিশ্বব্যবস্থা এখন পুরোপুরিভাবে ভেঙ্গে পড়ছে। তাই ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাকে অনুসরণ করা ছাড়া তাদের সামনে আর কোন গত্যন্তর নেই। তবে ২০৪০ সালের কৌশল বলে দিচ্ছে যে, ন্যাটো, ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে জার্মানি এখনও এককভাবে নিজের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে এগুবার ব্যাপারে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী নয়।

12 comments:

  1. জার্মানির বর্তমান চিন্তার কাঠামো অনেকটাই ডিপেন্ডেবল’নিরাপত্তা কাঠামো।এই কারণে অনেক জায়গায় তারা ডেপ্লইমেন্ট হলেও আগাচ্ছেনা। জার্মানি সোসাইটি ভিতর থেকে নাজিবাদের দিকে আগাচ্ছে যেটা তাদের মুল চরিত্র।বর্তমান সময়ে আমেরিকা ডীপ ট্রাবলে আছে সে আর্থিক ও সামরিক নিরাপত্তা পাওয়ার এংেলে আমেরিকার যুদ্ধগুলোতে শামিল হয়েছিল।বর্তমানে আমেরিকার দুর্বলতার কারণে এই সার্ভিস দেওয়া পসিবল হবেনা।এই ক্ষেত্রে জার্মানির নিজের চিন্তা নিজে করা শুরু করতে হবে।গ্লোবাল ইকোনমি কাঠামো ভাংতে খুব একটা সময় লাগবেনা মনে হচ্ছে। ইউরোপের প্রতিযোগিতা শুরু হবে আউটারে সাইডে বা পুর্বে।তবে এইটা আসতে আসতে তাদের মেইন ল্যান্ড্যে ফিরে যাবে।
    যেটা পশ্চিমা সিভিলাইজেশ্যনের আদর্শিক জায়গা থেকে জাতিয়তাবাদের দিকে ফিরে যাবে মনে হচ্ছে।এই মুহুর্তে মুসলিম ভুমিতে আদর্শিক উত্তান ঘটলে তাদের অনেকেই কম্প্রোমাইজ করতে আসবে মনে হচ্ছে।।এটা সিম্পলি ধারণা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আর্টিকেলের দিকনির্দেশনাটা মোটামুটি সেরকমই। এখানে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো জার্মানি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে থাকার কথা বললেও তারা নিজেরাই কিন্তু হিসেব করে দেখছে যে, ইইউ থাকবে না; আর যুক্তরাষ্ট্রও দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণ হারাবে পুরোপুরিভাবে। যদি পশ্চিমা দেশগুলির চিন্তাভাবনাতেই এই ব্যাপারগুলি প্রতিফলিত হয়, তাহলে বুঝতে বাকি থাকে না যে, পূর্বে কি হতে পারে। সকলেই সামনের দিনগুলির জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে।

      করোনাভাইরাস ছিল ভূমিকম্প ভূমিকম্প। এখন চলছে এর আফটারশক। কত যায়গায় ফাঁটল ধরেছে, তা এখনও পরিষ্কার নয়; কারণ ধ্বসে না পড়লে অনেক কিছুই চোখে পড়ে না। দুনিয়ার টাইমলাইন এখন অসম্ভব দ্রুত এগুচ্ছে। কয়েক বছরের মাঝে এমন কিছু ঘটনা ঘটে গেছে, যা দুই তিন দশক লাগবে বলে মনে হতো একসময়।

      Delete
  2. যাযাক আল্লাহ,রিপ্লাই দেওয়ার জন্য।

    ReplyDelete
  3. যদি বর্তমান ওয়ার্ল্ড অর্ডার ভেঙে পড়ে তবে, নেশন স্টেট গ মানে লিবরাল ডেমোক্রেটিক দেশ গুলোর কি হবে?

    ReplyDelete
    Replies
    1. বর্তমানে কোন ওয়ার্ল্ড অর্ডার বিদ্যমান নেই। অর্থাৎ কোন নির্দিষ্ট নিয়মে দুনিয়ার সকল অঞ্চল চলছে না। বরং একেকটা অঞ্চলে শক্তিশালী দেশগুলি তাদের নিজেদের প্রভাব বিস্তারের যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, সেটাই সেই অঞ্চলের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করছে। যেমন -

      মধ্যপ্রাচ্যে তুর্কি গ্রুপ, সৌদি গ্রুপ, ইস্রাইল, ইরানের সাথে যুক্ত হয়েছে রাশিয়াও। তুর্কিরা রয়েছে সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, আজেরবাইজান, লিবিয়া, সোমালিয়া, কাতারে। সৌদি গ্রুপ রয়েছে ইয়েমেন, লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাক, লেবাননে। ইরান রয়েছে ইয়েমেন, ইরাক, সিরিয়া, লেবাননে। এতগুলি দেশ যদি একত্রে এতবড় অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়, তাহলে কোন একটা নিয়ম বলবত থাকা অসম্ভব!

      পশ্চিম অফ্রিকা এবং মধ্য আফ্রিকার অবস্থা আরও খারাপ; যুদ্ধ চলছে। ফ্রান্সকে চ্যালেঞ্জ করে বসেছে ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্র। সাথে যুক্ত হয়েছে রাশিয়া, তুরস্ক। পূর্ব আফ্রিকায় নীল নদের উপর বাঁধ বানানোকে কেন্দ্র করে ইথিওপিয়ার সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে মিশর এবং সুদান। এছাড়াও তিগ্রে অঞ্চলে গৃহযুদ্ধ চলছে; যেখানে বাইরের শক্তিরাও যুক্ত হচ্ছে।

      পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়াও জাপান এবং কোরিয়া নিজদের আখের গোছাবার চেষ্টায় রয়েছে। চীনা হুমকি মোকাবিলায় নিজেদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করছে ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন।

      ইউরোপে গ্যাস পাইলপাইন নিয়ে জার্মানি এবং যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে চলছে দ্বন্দ্ব। ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া দখল করে নিয়েছে রাশিয়া; ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে রুশ গেরিলারা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তুরস্কের উপর অবরোধ দিয়েছে ন্যাটোর সদস্য দেশগুলি; যদিও তাদের মাঝে রয়েছে নিরাপত্তার চুক্তি। শরণার্থীদের চাপে ইউরোপে হয়েছে ডানপন্থী উগ্রবাদের উত্থান; ব্রিটেন বের হয়ে গেছে ইইউ থেকে বিশ্বব্যাপী নিজস্ব প্রভাব বৃদ্ধি করতে।

      যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্কিত নির্বাচন এবং ক্যাপিটন হিলে ট্রাম্প সমর্থকদের হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের নিজের অস্তিত্বই এখন প্রশ্নের মুখে। মেক্সিকো, ব্রাজিল, ভেনিজুয়েলা, কলম্বিয়া, বলিভিয়া, চিলি - ল্যাটিন আমেরিকার প্রতিটা দেশের অবস্থা খারাপ।

      এই সবই শুরু হয়েছে করোনাভাইরাস আসার আগে!! আর করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর পরিস্থিতি হয়েছে আরও বেসামাল। সারকথা হলো - এখন দুনিয়াতে কোন অর্ডার নেই; জোরাতালি দিয়ে চলছে।

      Delete
  4. আপমানে ধন্যবাদ জানাই।
    করোনা আসার পর অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হবে,যেটা এই সিস্টেম এর ধ্বংস হওয়াকে আরো ত্বরান্বিত করবে, বলেই মনে হয়।

    যদি হাইলি পজিটিভলি ভাবা যায়,তবে এই কেওটিক সিচুয়েশনের মধ্য দিয়ে এক নতুন সিস্টেমের/অর্ডারের জন্ম হতে পারে।
    এখন প্রশ্ন,এটা কি চিনা কর্তৃক অর্ডারের জন্ম দেবে নাকি অন্য কোনো আইডিওলজি ভিত্তিক অর্ডারের সুচনা করবে ❓
    নাকি! এই রকম মাৎস্যন্যায় এর যুগ চলতে থাকবে⁉️

    ReplyDelete
    Replies
    1. মানুষ হিসেবে আমরা সর্বোচ্চ বিশ্লেষণ করতে পারি এবং কিছু আভাস দিতে পারি; কিন্তু নিশ্চিতভাবে ভবিষ্যৎ বলতে পারি না। আমরা কতটুকু পারবো, সেটাও অবশ্য সৃষ্টিকর্তারই সিদ্ধান্ত। এত দুর্বল অবস্থান থেকে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় যে কখন অথবা ঠিক কিভাবে এই পরিবর্তন সাধিত হবে। তবে আমাদের নিজেদের বোধ থেকে আমরা হয়তো বুঝতে পারি যে, পরিবর্তন খুব বেশি দূরে নয়। আর বর্তমান ব্যবস্থার বিকল্প কতগুলি রয়েছে, সেখান থেকে একটা ধারণা করতে পারি যে বর্তমান ব্যবস্থার প্রতিস্থাপন হিসেবে কি ব্যবস্থা আসতে পারে।

      এই ব্লগের এবং আমার বইগুলির মাঝে একটা কথা বারংবারই পাবেন; আর তা হলো - আদর্শিক শক্তির প্রতিস্থাপন আদর্শের মাধ্যমেই হতে হবে। মানুষ একটা জীবনাদর্শে অভ্যস্ত রয়েছে; এবং তারা স্বভাবতই চাইবে প্রতিস্থাপক হিসেবে আরেকটা জীবনাদর্শই আসবে।

      চীনারা এখন কোন জীবনাদর্শ বহণ করছে না। একসময়কার কমিউনিস্ট চীন এখন ক্যাপিটালিস্ট চীন হয়েছে, কিন্তু পশ্চিমা ব্যবস্থার সকলকিছু আবার গ্রহণ করেনি। কাজেই তারা একটা হাইব্রিড প্রজাতির রাষ্ট্র হয়েছে, তার নিজস্ব কোন আদর্শ নেই; একটা মিক্সড ব্যাগ আরকি। পৃথিবীর কোন দেশ চীনাদের অনুসরণ করে চীনা সংস্কৃতি বা সামাজিক ব্যবস্থা নেবে না; নেবার কোন সম্ভাবনাও নেই। চীনের সেই রাজনৈতিক লক্ষ্যও নেই। কাজেই চীন বিশ্বকে একটা নতুন জীবনব্যবস্থা দেবে - এই অলীক চিন্তা বাদ দেয়াই উত্তম।

      Delete
  5. মানুষ হিসাবে স্বল্প বুদ্ধি নিয়ে ভবিষ্যত বলতে না পারলেও,কিছুটা অনুমান করা যায়। এই রকম অনুমানের উপর ভিত্তি করে আদর্শিক শক্তি/ রাষ্ট্রগুলো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করে। তারা এইভাবেই এগিয়ে চলে।

    এখানে ভবিষ্যত যে পুরোপুরি পালটে যাবে এটা মানুষ অনুমান করতে পারে না। একমাত্র উপরওয়ালাই জানেন।

    এখন প্রশ্ন, আদর্শিক বিকল্পগুলি কি কি আছে বলে আপনার মনে হয়❓ কোন্ আদর্শটি ভবিষ্যতে নিজের অবস্থান পাকা করে নেবে বলে অনুমান করা যায়?

    আর একটা প্রশ্ন করতে চাই, যেকোনো আদর্শই নিজের অবস্থান মজবুত করতে গেলে, বর্তমানের শক্তিগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করলে সে / তার অনুগামীরা বিভিন্ন "লেবেল" এর স্বীকার হবে। তার consequences আছে।

    এই বিষয়টি যদি ব্যাখ্যা করেন, তবে খুব ভাল হয়।

    ReplyDelete
    Replies
    1. একটা আদর্শ নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, রক্ষা করতে চায় এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চায়। এটা আদর্শের ধরণ। সোভিয়েত ইউনিয়ন পশ্চিমাদেরকে সমস্যা ফেলেছিল; কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন সারা দুনিয়াটাকে কমিউনিস্ট আদর্শের অধীনে দেখতে চেয়েছিল। এটা পশ্চিমারা বুঝেছিল বলেই তাদের পুঁজিবাদী আদর্শকে রক্ষা করতে তারা সারা বিশ্বে কমিউনিজমকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে। এর ফলশ্রুতিতে দুনিয়াতে প্রায় চার দশক ধরে ঠান্ডা যুদ্ধ চলেছে। উভয়েই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জয়ী ছিল; তাই উভয়েই নিজের সাফল্যের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিল।

      আদর্শ বলতে আসলে কি বোঝায়? এটা হলো জীবনের প্রতি একটা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উৎসারিত কিছু চিন্তা এবং কনসেপ্ট। মানুষ যখন কোন একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির সঠিকতা সম্পর্কে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নিশ্চিত হয়, তখন সে সেই চিন্তাকে বাস্তবায়নের পথ খোঁজে। এটার বাস্তবায়ন হয় রাষ্ট্র তৈরি করার মধ্য দিয়ে; যে রাষ্ট্র পরিচালিত হয় সেই চিন্তা এবং কনসেপ্টগুলির উপর ভিত্তি করে। যেমন, কমিউনিজম বলে যে, ব্যক্তিকে মালিকানা দিলে সে মানুষের উপর জুলুম করে; তাই তারা মানুষের কাছ থেকে মালিকানা কেড়ে নিয়ে সকল মালিকানা রাষ্ট্রের কাছে দেয়। একসময় পৃথিবীতে বহু মানুষ কমিউনিজমকে বাস্তবায়ন করতে জীবন দিয়েছে। তারা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বুঝেছিল যে, ক্যাপিটালিজমের চাইতে কমিউনিজম একটা ভালো সমাধান। কমিউনিজম জিততে পারে শেষ পর্যন্ত।

      এই মুহুর্তে ক্যাপিটালিজম দুর্বল অবস্থায় রয়েছে; যা এই ব্লগের লেখায় এবং আমার বইগুলিতে যথেষ্ট আলোচনা পাবেন। একসময় কমিউনিজমকে যেভাবে পশ্চিমারা হারিয়েছিল, সেই শক্তি এখন ক্যাপিটালিজমের নেই। একারণে প্রশ্ন উঠছে যে, আর কোন আদর্শ কি ক্যাপিটালিজমকে প্রতিস্থাপিত করতে পারে কিনা।

      স্যামুয়েল হান্টিংটনের 'ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনস' বইয়ের উপর লেখা এই ব্লগে রয়েছে। হান্টিংটন কোন রাখঢাক রাখেননি যে, পশ্চিমারা ইসলামকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখে। যুক্তরাষ্ট্র হান্টিংটনের মতো চিন্তাবিদদেরকেই অনুসরণ করে ২০০১ সালের পর থেকে মুসলিম বিশ্বে বহু যুদ্ধে জড়িয়েছে এবং সামরিক ঘাঁটি ও ড্রোন হামলা দিয়ে পত্রিকার পাতা ভরেছে।

      পশ্চিমারা খুব পরিষ্কারভাবেই বুঝেছে যে, ইসলাম শুধু একট ধর্ম নয়। বিশ্বাসগত দিক থেকে কুরআনের আয়াতগুলিকে দেখলে যে কেউই বুঝতে পারবে যে, সেখানে আল্লাহর আইন প্রয়োগের নির্দেশ যেমন দেয়া হয়েছে, তেমনি অর্থনীতি কোন ভিত্তিতে চলবে এবং পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি কি হবে, সেটাও সেখানে উল্লেখ রয়েছে। এবং কুরআনে আরও বলা হয়েছে যে, রাসূল (সাঃ)কে অনুসরণ করবে। এখন রাসূল (সাঃ) যেহেতু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে ইসলামকে বাস্তবায়ন করেছিলেন এবং ইসলামকে আরব উপদ্বীপের বাইরে নিয়ে গিয়ে তাঁর (সাঃ) পর কি করতে হবে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, সেখানে বুঝতে বাকি থাকে না যে, মুসলিমরা তাদের রাসূল (সাঃ)কে অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিলে কি হতে পারে। দুনিয়াতে বর্তমানে এই দ্বন্দ্বটাই চলছে; পশ্চিমারা খেয়াল রেখেছে যাতে মুসলিমরা একত্রিত হয়ে পশ্চিমা ক্যাপিটালিজমকে প্রতিস্থাপন করতে না পারে। কিন্তু সমস্যা হলো, প্রায় দুই দশক চেষ্টার পর তারা বুঝে গেছে তাদের চেষ্টা সফল হবে না; তাদের আদর্শ প্রতিস্থাপন হওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।

      Delete
  6. ধন্যবাদ৷ বিষয়টি ব্যাখ্যা করার জন্য।

    আমার প্রশ্নের প্রেক্ষিতে, আপনি বর্তমানে যেই আদর্শটি রুল করছে, তাকে ইসলাম প্রতিস্থাপন করতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন। আমিও বিশ্বাস করি ইসলাম শুধু মাত্র একটি ধর্ম নয়, আল্লাহ্ র মনোনীত একটি দ্বীন বা জীবনাদর্শ বা আইডিওলজি।

    এটি একমাত্র আইডিওলজি যেটি পশ্চিমা আদর্শকে সব্দিকদিয়েই টেক্কা দিতে পারে। যেমনটি হান্টিংটন তার বই এ উল্লেখকরেছিলেন।

    এখন প্রশ্ন, এই আদর্শটি কে বাস্তবায়ীত করবে৷ উত্তর মুসলিম্রা,কিন্তু এখানে আর একটি প্রশ্ন হল, যে তারা নেশন স্টেট দ্বারা শাসিত, সেই দেশগুলির জন্ম হয়েছে পশ্চিমা কলোনিয়াল দের হাতে। দেশগুলি বা রাষ্ট্র বললে বেশি মানাবে, তাদের জন্ম এর কারন কে এডিয়ে যেতে পারেনা। আপনি এই বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন, এই ব্লগে। আর বাকি থাকল নোন স্টেট এক্টররা, যাদের আদর্শ হয়ত ঠিকঠাক থাকে না। তারা কিসের জন্য এত সময় ব্যয় করছে৷

    এখন আমার মত স্বল্পবুদ্ধির মানুষের কাছে প্রশ্ন জাগছে যে, এই জীবনাদর্শ যখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, বিশ্বের মানুষকে এক্টা আদর্শ অল্টারনেটিভ উপহার দেবে! কারা সেটা দিয়ে পারে?
    নেশন স্টেট শাসনাধীন নাকি নন স্টেট এক্টর (পরোক্ষ ভাবেও এরার নেশন স্টেট শাসনামলে ছিল)?
    নাকি অন্য কেউ?
    আপ্নার মুল্যবান উত্তরে উপকৃত হব।

    ReplyDelete
    Replies
    1. দেখুন, মানুষ একটা ভ্যাকুয়ামের মাঝে জীবনধারণ করে না। একটা ব্যবস্থার মাঝে থেকে আরেকটা ব্যবস্থাকে প্রোমোট করাটা বর্তমান ব্যবস্থার বিরোধিতা। এটা রাজনৈতিকভাবে সাংঘর্ষিক। মার্কস চেয়েছিলেন ইউরোপের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ক্যাপিটালিস্ট রাষ্ট্র ব্রিটেনে কমিউনিজমকে ক্ষমতায় নিয়ে আসতে; এরপর জার্মান ভূমিতেও চেষ্টার করা হয়েছিল ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি; সেটাও ব্যর্থ হয়েছিল। সবশেষে ১৯১৭ সালে রাশিয়াতে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন লেনিন। কমিউনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজটা শুধু লেনিন করেননি; অনেকেই চেষ্টা করেছে, যতক্ষণ সেটা প্রতিষ্ঠা না হয়। তারা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বুঝেছিল যে, এটাই ঠিক; তাই এটাই করতে হবে। তারা সেটাই করেছিলেন। রাশিয়াতে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা পাবে - এটা ঊনিশ শতকে কেউ চিন্তাই করতে পারেনি। আসলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কমিউনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পিছনে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছিল। এই যুদ্ধের কারণে তা অনেক দ্রুততার সাথে হয়েছে। একটা আদর্শিক বিপ্লব কোন জাতীয়তাবাদী বিপ্লব যে নয়, সেটা এই উদাহরণেই পাবেন। আর এই আদর্শ কোথায় শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হবে, সেটাও কেউ আগে থেকে নিশ্চিত করে বলতে পারে না।

      অপরদিকে ইসলামের আবির্ভাব কোথায় হবে, সেটা আল্লাহই ভালো জানতেন; যদিও সেটার আভাস ইনজিল এবং তাওরাতে দেয়া ছিল। আরবের মানুষেরাও ইসলামের আবির্ভাব ঠেকাতে যথেষ্ট চেষ্টা করেছিল। এমনকি ইসলাম যখন মদিনাতে রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, তখন মক্কাবাসী যুদ্ধ করেছিল ইসলামকে শুরুতেই শেষ করে ফেলতে। ব্রিটিশ এবং ফরাসীরাও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর নতুন কমিউনিস্ট রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে ফেলতে চেয়েছিল। তাই তারা বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার সাথেসাথেই নতুন বলশেভিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিল। মক্কাবাসীর মতো ব্রিটিশরাও ব্যর্থ হয়েছিল নতুন রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে ফেলতে।

      মোটকথা, একটা আদর্শিক আন্দোলন থেকেই একটা আদর্শিক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এই আন্দোলনের ধরণ কমিউনিজমের জন্যে এক রকম; ইসলামের জন্যে আরেক রকম ছিল। তবে দু'টাই ছিল আদর্শকে রাষ্ট্রে স্থাপিত করার সংগ্রাম। এর জন্যে মানুষ জীবন দিয়েছে; কারণ তারা মনে করেছে যে, এটাই সঠিক। ভবিষ্যতের যেকোন আদর্শিক আন্দোলনও রাষ্ট্রে পরিণত হতে চাইবে। কারণ রাষ্ট্র ছাড়া একটা আদর্শকে বাস্তবায়ন, সুরক্ষা এবং বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব নয়।

      Delete
  7. অবশ্যই। শেষ প্যারার সাথে সহমত।

    ReplyDelete