Wednesday 9 June 2021

জিব্রালটার প্রণালীর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বের শুরু?

১০ই জুন ২০২১
১৯৭০এর দশকে স্পেন মরক্কো ছেড়ে আসলেও মরক্কোর উত্তর উপকূলে কয়েকটা বন্দরকে স্পেন ছিটমহল হিসেবে রেখে দেয়। ভবিষ্যতে জিব্রালটার প্রণালীর দক্ষিণ উপকূল নিয়ন্ত্রণে এই ছিটমহলগুলি ইউরোপের জন্যে কাজে দিতে পারে। ইস্রাইলের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের মতো জনবিরোধী সিদ্ধান্তও মরক্কোর সরকার নিয়েছে পশ্চিম সাহারায় মরক্কোর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি পাবার জন্যে। তবে এর ফলশ্রুতিতে ইউরোপের সাথে মরক্কোর সম্পর্ক টানাপোড়েনের মাঝে পড়েছে। যদিও মরক্কোর সাথে ইউরোপের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা কম, তথাপি মরক্কোর উত্তর উপকূলে স্পেনের ছিটমহলগুলি যখন হাজারো শরণার্থীর জোয়ারে ভেসে যাবার উপক্রম, তখন এই ছিটমহলগুলির সামনের দিনগুলিতে ইউরোপের ‘ব্রিজহেড’ হিসেবে থাকার সম্ভাবনা প্রশ্নের মুখে পড়ে।



মে এবং জুন মাসে হঠাত করেই উত্তর আফ্রিকার দেশ মরক্কোর সাথে ইউরোপের, বিশেষ করে স্পেন এবং জার্মানির সম্পর্ক নিম্নমুখী হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমগুলি এই দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে বিতর্কিত পশ্চিম সাহারার কথা বললেও এর ভূরাজনৈতিক গভীরতা যথেষ্ট। এই গভীরতার একটা ধারণা পাওয়া যাবে মরক্কোর সাথে ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ইতিহাস এবং বর্তমানে তাদের মাঝে সম্পর্কের দিকে তাকালে। তবে একইসাথে তাকাতে হবে মরক্কোর অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূকৌশলগত অবস্থানের দিকে। মরক্কোর ব্যাপারগুলিকে কোন অবস্থাতেই ভূরাজনৈতিকভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ জিব্রালটার প্রণালীকে বাদ দিয়ে চিন্তা করা যাবে না।

পশ্চিম সাহারার সমস্যা ঔপনিবেশিক সময়ের

সপ্তদশ শতক থেকে স্পেন মরক্কোর উপকূলে কয়েকটা ছিটমহল উপনিবেশ হিসেবে দখল করে নেয়। ঊনিশ শতকের শেষ দিক থেকে পশ্চিম আফ্রিকার পুরোটাই ইউরোপিয় ঔপনিবেশিকদের অধীনে চলে যায়। ১৯০৬ সালে মরক্কোর সরকারের দুর্বলতার কারণ দেখিয়ে মরক্কোর দখল নিয়ে জার্মানি এবং ফ্রান্সের মাঝে দ্বন্দ্ব বাধলে ব্রিটেনের মধ্যস্ততায় মরক্কোর নিয়ন্ত্রণ নেয় ইউরোপিয়রা। ১৯১২ সালে মরক্কোর নিয়ন্ত্রণ চলে যায় স্পেন এবং ফ্রান্সের কাছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আফ্রিকায় নিজেদের উপনিবেশ থাকা অঞ্চলগুলিকে ইউরোপিয়রা নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী বিভক্ত করে অনেকগুলি নতুন রাষ্ট্র তৈরি করে। পশ্চিম আফ্রিকায় একইভাবে তৈরি করা হয় মরক্কো, আলজেরিয়া, মৌরিতানিয়া এবং অন্যান্য দেশ। ফরাসিরা ১৯৫৬ সালে মরক্কো ছেড়ে যায়। মরক্কোর দক্ষিণ অঞ্চল ছিল স্পেনের অধিকারে; অন্যদিকে আলজেরিয়া, মৌরিতানিয়া এবং অন্যান্য অঞ্চলগুলি ছিল ফরাসিদের অধীনে। এই দেশগুলির সীমানাও ঔপনিবেশিকরা তৈরি করে; যা পরবর্তীতে বহু ধরনের সংঘাতের জন্ম দেয়। এরকমই একটা দ্বন্দ্ব হলো পশ্চিম সাহারার দ্বন্দ্ব। মরক্কোর দক্ষিণের পশ্চিম সাহারা অঞ্চলটা ছিল স্পেনের উপনিবেশ; যার নাম ছিল ‘রিও ডে অরো’। আঞ্চলিকভাবে অঞ্চলটা সাহরাউই নামে পরিচিত। ১৯৭৫ সালে স্পেন এই অঞ্চল ছেড়ে যাবার সময় রিও ডে অরো অঞ্চলকে দুই ভাগে ভাগ করে নতুন তৈরি করা দুই দেশ মরক্কো এবং মৌরিতানিয়ার মাঝে বিতরণ করে। এরপরই সাহরাউই অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেয়া পলিসারিও ফ্রন্টের সাথে মৌরিতানিয়া এবং মরক্কোর যুদ্ধ শুরু হয়। চার বছর যুদ্ধ করার পর ১৯৭৯ সালে মৌরিতানিয়া তাদের অংশ ছেড়ে দিয়ে পশ্চিম সাহারা ত্যাগ করে। কিন্তু মরক্কো যুদ্ধ চালিয়ে যায়। এই যুদ্ধে মরক্কোকে সামরিক সহায়তা দেয় যুক্তরাষ্ট্র; আর পলিসারিওকে সোভিয়েত অস্ত্র দিয়ে সহায়তা দেয় আলজেরিয়া এবং লিবিয়া। পলিসারিওর সকল অস্ত্রসস্ত্রই আলজেরিয়া হয়ে আসে এবং আলজেরিয়াকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করেই পলিসারিও মরক্কোর সামরিক বাহিনীর উপর হামলা চালিয়ে যায়।। ১৯৮০এর দশকে মরক্কো পশ্চিম সাহারার মাঝ বরাবর উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত ২ হাজার ৭’শ কিঃমিঃ লম্বা বালুর দেয়াল তৈরি করে। এই দেয়ালের ফলে যুদ্ধ মরক্কো সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে; এবং পলিসারিওর সামরিক জয় পাবার আশা স্তিমিত হয়ে যায়। ১৯৯১ সালে ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হলে পশ্চিম সাহারার যুদ্ধও শেষ হয়ে যায়; এবং একটা যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। জাতিসংঘের একটা মিশনের মাধ্যমে এই যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ করা হয়; যেখানে মরক্কো সরকারের অধীনে রয়েছে পশ্চিমের অংশ; আর পলিসারিওর হাতে রয়েছে আলজেরিয়ার সীমানা ঘেঁষে পূর্বের অংশ। এই সমস্যার একটা মূল ভিত্তি হলো কে এই সংঘাতকে কিভাবে দেখছে।

পশ্চিম সাহারার যুদ্ধ মরক্কোর সাথে অনেক দেশের সম্পর্ক নির্ধারণ করেছে। আরব দেশগুলি মরক্কোর পক্ষে থেকেছে; অন্যদিকে আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশই পলিসারিওর পক্ষ নিয়েছে। যুদ্ধের ফলে আলজেরিয়ার সাথে মরক্কোর সম্পর্ক বরাবরই খারাপ রয়েছে। আফ্রিকার দেশগুলি সাহরাউই রিপাবলিককে স্বীকৃতি দিলে ১৯৮৪ সালে মরক্কো আফ্রিকান ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যায়। তবে তিন দশক পর ২০১৭ সালে মরক্কো আবারও আফ্রিকান ইউনিয়নে প্রবেশ করে। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, আফ্রিকার দেশগুলি মূলতঃ অর্থনৈতিক কারণেই মরক্কোর আফ্রিকান ইউনিয়নে ঢোকাকে সমর্থন করেছে। মরক্কো সাম্প্রতিক সময়ে আফ্রিকার দেশগুলির সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন করেছে; যার উদ্দেশ্যই ছিল আফ্রিকান ইউনিয়নে ঢোকার পথ প্রসারিত করা। ৩৯টা দেশ মরক্কোর পক্ষে ভোট দেয়; তবে ৯টা বিপক্ষে থাকে। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বলছে যে, বিপক্ষে ভোট দেয়া দেশগুলি মূলতঃ আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের দেশ। সাহরাউইএর ব্যাপারে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের অবস্থান দেখলে বোঝা যাবে যে, বিপক্ষে ভোট দেয়া দেশগুলির মাঝে খুব সম্ভবতঃ দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ে, এঙ্গোলা থাকতে পারে। কারণ এই দেশগুলি মরক্কোর আফ্রিকান ইউনিয়নে যোগ দেয়ার সরাসরি বিরোধিতা করেছিল।
 
পশ্চিম সাহারায় মরক্কোর তৈরি করা বালির দেয়াল। ১৯৮০এর দশকে মরক্কো ২ হাজার ৭’শ কিঃমিঃ লম্বা বালুর দেয়াল তৈরি করে। এই দেয়ালের ফলে যুদ্ধ মরক্কো সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে; এবং পলিসারিওর সামরিক জয় পাবার আশা স্তিমিত হয়ে যায়। ১৯৯১ সালে ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হলে পশ্চিম সাহারার যুদ্ধও শেষ হয়ে যায়; এবং একটা যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। তবে মরক্কোর প্রায় ২ লক্ষ সদস্যের সেনাবাহিনী পশ্চিম সাহারায় ব্যস্ত থেকে জিব্রালটার এবং স্প্যানিশ ছিটমহলগুলি থেকে যে দূরে থাকছে, সেব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র খুব বেশি চিন্তিত হবার কথা নয়। 


স্পেনের সাথে দ্বন্দ্ব

মে মাসের মাঝামাঝি হঠাত করেই মরক্কো থেকে স্পেনের ছিটমহল সেউতাতে ৮ হাজার শরণার্থী ঢুকে পড়ে। স্পেন বলছে যে, মরক্কো তার সীমানা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে; যার ফলে হাজার হাজার শরণার্থী সেউতায় ঢুকেছে। সাধারণতঃ শরণার্থীদের নিয়ন্ত্রণে মরক্কো স্পেনকে যথেষ্ট সহায়তা করে থাকে। ‘বিবিসি’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, এপ্রিল মাসে স্পেন পশ্চিম সাহারার পলিসারিওর নেতা ব্রাহিম ঘালিকে স্পেনের এক হাসপাতালে করনোভাইরাসের চিকিৎসার জন্যে ভর্তি করে। মরক্কো বলছে যে, স্পেন মরক্কোকে না জানিয়ে পশ্চিম সাহারা পলিসারিওর নেতাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। অনেকেই বলছেন যে, এর প্রতিশোধ হিসেবেই মে মাসে মরক্কোর নিরাপত্তা বাহিনী কিছু সময়ের জন্যে শরণার্থীদের উপর থেকে তাদের নজরদারি সরিয়ে ফেলে; যার ফলশ্রুতিতে হাজারো শরণার্থী সেউতায় ঢুকে পড়ে। একই সময়ে স্পেনের পক্ষ থেকে পশ্চিম সাহারা নিয়ে বিবৃতি আসতে থাকে। স্পেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরাঞ্চা গোঞ্জালেজ লায়া বলেন যে, স্পেন পশ্চিম সাহার ব্যাপারে জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের উপরেই নির্ভর করবে। স্পেন চায় সকল পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান।

৬ই জুন মরক্কোর সরকার ঘোষণা দেয় যে, মরক্কো স্পেনের সাথে সমুদ্রে যাত্রীবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, ইউরোপে বসবাসকারী প্রায় ৩০ লক্ষ মরক্কোর নাগরিকের বেশিরভাগই স্পেন হয়ে মরক্কো যেতো। তবে মরক্কো সরকার ফরাসি এবং ইতালিয় বন্দরগুলির সাথে জাহাজ চলাচল স্বাভাবিক রাখবে বলে বলেছে। কারণ হিসেবে মরক্কোর সরকার করোনাভাইরাসের কথা বললেও অনেকেই মনে করছেন যে, এর সাথে দুই দেশের মাঝে চলমান উত্তেজনার সম্পর্ক থাকতে পারে।

‘আল জাজিরা’ জানাচ্ছে যে, মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ইউরোপিয় আদালতে মরক্কোর সাথে ইইউএর বাণিজ্য চুক্তির ব্যাপারে শুনানি হয়। পলিসারিওর পক্ষ থেকে এই চুক্তির বিরোধিতা করে ইইউএর কাছে আবেদন জানানো হয়েছিল। পলিসারিও বলছে যে, মরক্কো পশ্চিম সাহারার সম্পদ লুন্ঠন করছে; যার মাঝে রয়েছে রক ফসফেট, কৃষিদ্রব্য এবং পশ্চিম সাহারার উপকূলের মৎস্যসম্পদ। অনেকেই মনে করছেন যে, এই বছরের শেষের দিকে আদালয়ের যে রায় আসবে, তা পলিসারিওর পক্ষে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। ইইউ আদালতের রায় মরক্কোর বিপক্ষে গেলে মরক্কোর সাথে ইইউএর সম্পর্কে নতুন করে দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে।

জার্মানির সাথে দ্বন্দ্ব

মরক্কো ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার এবং যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম সাহারায় মরক্কোর সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়ার ১১ দিনের মাথায় ২০২০এর ২১শে ডিসেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে জার্মানির রাষ্ট্রদূত ক্রিসটফ হিউসগেন পশ্চিম সাহারা নিয়ে একটা রুদ্ধদ্বার বৈঠকের ডাক দেন। তার উপস্থাপনায় হিউসগেন বলেন যে, পশ্চিম সাহারার সমস্যার মূলে রয়েছে মরক্কো। হিউসগেন পলিসারিওর সামরিক দুর্বলতার অবস্থান উল্লেখ করেন। পলিসারিও যুদ্ধবিরতি ভাঙলেও তিনি এর জন্যে মরক্কোকে দায়ি করেন। আর পলিসারিও যদি আশাহত হয়, তবে তারা উগ্রবাদী হয়ে যেতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। ২০১৯ সালে জাতিসংঘ মহাসচিবের দূত হিসেবে প্রাক্তন জার্মান প্রেসিডেন্ট কোহলারের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, কোহলার অসুস্থ হয়ে যাবার পর থেকে কথাবার্তা থেমে গেছে। জার্মানি চাইছে যে, পশ্চিম সাহারা নিয়ে আবারও আলোচনা শুরু হোক এবং রাজনৈতিকভাবে এর সমাধান হোক। জার্মান রাষ্ট্রদূত তার মার্কিন বন্ধুদেরকে শক্ত অবস্থান নেবার কথা বলেন।

পশ্চিম সাহারার বিষয়ে জাতিসংঘে জার্মানির বৈঠক ডাকার কারণ দেখিয়ে চার মাস পর ২০২১এর মে মাসের শুরুতে মরক্কো বার্লিনে তার রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে। ২০২০এর শেষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পশ্চিম সাহারাতে মরক্কোর সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেয়ার পরেও মরক্কোর বিরুদ্ধে জার্মানির অবস্থানের ব্যাপক সমালোচনা করে মরক্কো। মরক্কো ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সেই স্বীকৃতি পেয়েছিল। এক বিবৃতিতে মরক্কোর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলে যে, জার্মানি গঠনমূলক সমাধানের পথে না হেঁটে ধংসাত্মক মনোভাব দেখাচ্ছে। একইসাথে মরক্কো বলে যে, জার্মানি মরক্কোর প্রভাব নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে সর্বদা; বিশেষ করে লিবিয়া ইস্যুর কথা উল্লেখ করা হয়। ২০২০এর জানুয়ারিতে বার্লিনে লিবিয়া নিয়ে আলোচনায় মরক্কোকে বাদ দেয়ার জন্যে জার্মান সরকারকে অভিযুক্ত করা হয়। ‘ডয়েচে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, গত মার্চে মরক্কো সরকার তাদের সরকারি দপ্তরগুলিকে জার্মান দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে নির্দেশ দেয়।

‘আল জাজিরা’র সাথে কথা বলতে গিয়ে স্প্যানিশ সাংবাদিক ইগনাসিও সেমব্রেরো বলছেন যে, মরক্কো চাইছে যে, ইইউ এবং প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তি স্পেনের উপর চাপ সৃষ্টি করে পশ্চিম সাহারার উপর মরক্কোর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি আদায় করে নেয়া। তবে আপাততঃ ইইউ এব্যাপারে মরক্কোকে স্বীকৃতি দেবে বলে মনে করছেন না সেমব্রেরো; অন্ততঃ প্রকাশ্যে নয়। মরক্কো এবং জার্মানির অর্থনৈতিক সম্পর্ক কিন্তু বেশ ভালো। মরক্কোর সপ্তম বৃহত্তম বাণিজ্য সহযোগী হলো জার্মানি। এছাড়াও ২০২০ সালেই জার্মানির কাছ থেকে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ এবং অনুদান পেয়েছে মরক্কো।
 
২০১৮ সাল। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁর সাথে মরক্কোর রাজা ষষ্ঠ মোহাম্মদ। মরক্কোর নিরাপত্তা চিন্তায় ইউরোপ সবসময়ই রূঢ় বাস্তবতা; কারণ ইউরোপ মরক্কোকে ভূমধ্যসাগরে ঢোকার পশ্চিম দরজার দক্ষিণ পাল্লা হিসেবে দেখে। একারণেই বিংশ শতকে ইউরোপিয় উপনিবেশ হওয়া থেকে বাঁচতে পারেনি মরক্কো; যার ফলশ্রুতিতে বর্তমান মরক্কো অর্থনৈতিকভাবে ইউরোপের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। তবে নির্ভরশীলতা একমুখী নয় মোটেই; কারণ ইউরোপিয়রাও মরক্কোতে তাদের বিনিয়োগের সুরক্ষা চায়।  


ইউরোপের উপর মরক্কোর অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা

মরক্কো হলো পৃথিবীর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ফসফেট উৎপাদক। রক ফসফেট খনিজ থেকে ফসফেট সার তৈরি হয়। পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথেসাথে ফসফেট সারের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টন রক ফসফেট উৎপাদন হয়; যার প্রায় এক তৃতীয়াংশই মরক্কোতে উৎপাদিত হয়। তবে পুরো দুনিয়ার প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টন রক ফসফেট রিজার্ভের মাঝে শুধু মরক্কো এবং পশ্চিম সাহারাতেই পাওয়া গেছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টন। মরক্কোর প্রায় সকল রক ফসফেট উৎপাদন করে সরকারি মালিকানার কোম্পানি ‘ওসিপি’। ১৯৭৬ সালে পশ্চিম সাহারা মরক্কো নিজের নিয়ন্ত্রণে নেবার পর থেকে সেখানকার ‘বৌ ক্রা’ এবং ‘লাইউনি’ খনি থেকে ফসফেট উত্তোলন শুরু হয়। বর্তমানে ‘ওসিপি’র প্রায় ৮ শতাংশ উৎপাদন পশ্চিম সাহারার এই খনি থেকে আসে।

‘আইএইচএস মার্কিট’এর হিসেবে বিশ্বের প্রায় অর্থেক রক ফসফেটের ব্যবহারকারী হলো চীন। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, আফ্রিকা এবং পূর্ব ইউরোপ মিলে প্রায় এক চতুর্থাংশ ব্যবহার করে। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য এবং আমেরিকা মহাদেশের অন্যান্য দেশ ফসফেটের গুরুত্বপূর্ণ ক্রেতা। যদিও অর্থের হিসেবে ফসফেট এবং আনুসাঙ্গিক পণ্য মরক্কোর সবচাইতে বড় রপ্তানি পণ্য নয়, তথাপি বিশ্বব্যাপী শস্য উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হিসেবে ফসফেট মরক্কোকে গুরুত্বপূর্ণ করেছে।

‘ওইসি’র হিসেবে মরক্কোর সবচাইতে বড় রপ্তানি বাজার হলো স্পেন; যেখানে প্রায় ২৩ শতাংশ রপ্তানি হয়। এরপর প্রায় ২০ শতাংশ নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ফ্রান্স; ৪ শতাংশ নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে ইতালি; সাড়ে ৩ শতাংশ নিয়ে চতুর্থ স্থানে জার্মানি। এছাড়াও ইউরোপের দেশগুলির মাঝে ব্রিটেন, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম এবং রাশিয়া মরক্কোর গুরুত্বপূর্ণ বাজার। ইউরোপের বাইরে রয়েছে ভারত, তুরস্ক, চীন এবং জাপান। পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলির সাথে মরক্কোর নির্ভরশীলতা ফসফেট নিয়ে নয়; গাড়ি, ইনসুলেটেড তার এবং গার্মেন্টস পণ্যের মতো তৈরি পণ্য ইউরোপে রপ্তানি করে মরক্কো; যা কিনা ইউরোপের উপর মরক্কোকে নির্ভরশীল করেছে। মরক্কোতে বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও ফ্রান্স এবং স্পেন এগিয়ে আছে। মরক্কোর মাটিতে ফরাসি গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি ‘রেনো’ এবং ‘পোঁজো’ বিনিয়োগ করেছে।

মরক্কোর বিশাল সাড়ে তিন হাজার কিঃমিঃ লম্বা উপকূল সামুদ্রিক মাছের একটা বড় উৎস; অথচ মরক্কোর নিজের সক্ষমতা নেই গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণ করার। জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ‘এফএও’এর হিসেবে মরক্কোর বাৎসরিক সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ এবং চাষ প্রায় ১৫ লক্ষ টন; যা আফ্রিকার বৃহত্তম এবং বিশ্বে ১৭তম। প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ মৎস্য আহরণ এবং চাষের উপর নির্ভরশীল। প্রায় ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার আয় হয় মৎস্য রপ্তানি করে; যার বেশিরভাগটাই যায় ইউরোপে। ১৯৯৬ সালে ইইউএর সাথে চুক্তি অনুযায়ী মরক্কো তার দেশের উপকূলে ইইউএর, বিশেষ করে স্পেনের জাহাজগুলিকে মাছ ধরার অনুমতি দেয়। এর বিনিময়ে মরক্কো ইইউএর কাছ থেকে বাৎসরিক অর্থ সহায়তা পায়। ২০১৬ সালে মরক্কোর রাজা ষষ্ঠ মোহাম্মদ পশ্চিম সাহারার দাখলা উদ এদদাহাব উপকূল অঞ্চলে বিভিন্ন মৎস্যজাতীয় চাষের প্রকল্প উদ্ভোধন করেন। এই প্রকল্পগুলিতে ইউরোপিয় দেশগুলি ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। ২০১৯ সালে ইইউ মরক্কোর সাথে এক চুক্তি করে; যার মাধ্যমে পশ্চিম সাহারা উপকূলে ইইউ মাছ ধরার অনুমতি পায়। ‘এএফপি’র হিসেবে চার বছরের এই চুক্তির মাধ্যমে মরক্কো ইইউ থেকে ১’শ ৫৩ মিলিয়ন ইউরো পাবে। ইইউএর পার্লামেন্টে পাস হওয়া এই চুক্তির বিপক্ষে রয়েছে পশ্চিম সাহারার লবিং গ্রুপ। পলিসারিওর উপদেষ্টা নূর বকর ‘আরএফআই’কে বলছেন যে, ইউরোপের আদালতে তারা সকল প্রকারের চেষ্টা চালাবেন মরক্কোর সাথে এই চুক্তি বাতিল করতে। ইউরোপিয়ান কমিশনের হিসেবে ২০১৯ সালে মরক্কো পশ্চিম সাহারা থেকে ৫’শ ২৪ মিলিয়ন ডলার মূল্যের মৎস্য এবং কৃষিজ পণ্য ইউরোপে রপ্তানি করে।

পশ্চিম সাহারার ফসফেট ইউরোপের সাথে বাণিজ্যে বড় কোন ইস্যু না হলেও মরক্কো ইইউএর উপর অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্টই নির্ভরশীল। আর সেই হিসেবে ইউরোপের আদালতে পশ্চিম সাহারার অভিযোগ মরক্কোর জন্যে বিরক্তির ব্যাপার হতে পারে। তবে মরক্কো যেমন ইইউএর উপর নির্ভরশীল, তেমনি মরক্কোতে বড় বিনিয়োগও ইইউএর দেশগুলির কাছে গুরুত্বপূর্ণ। মরক্কোর বিরুদ্ধে ইইউ আদালতের যেকোন সিদ্ধান্ত ইউরোপিয় কোম্পানিগুলিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। মরক্কোর ৩২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির বিপরীতে আমদানি হলো প্রায় ৪৯ বিলিয়ন ডলার। আমদানি এবং রপ্তানির মাঝে বড় ব্যবধান দেশটার অর্থনীতিকে ব্যাতিব্যস্ত রেখেছে। এমতাবস্থায় মরক্কোও এমন কোন সিদ্ধান্ত নিতে যাবে না, যা কিনা দেশটার অর্থনীতিকে আরও চাপের মাঝে ফেলবে।

জিব্রালটার প্রণালী উত্তর ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার সাথে ভূমধ্যসাগর, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার সংযোগপথ। একসময় প্রাকৃতিক কারণে মরক্কোর উপকূলে বড় বন্দর নির্মাণ কঠিন হলেও প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথেসাথে মরক্কোর উপকূলে বড় বড় সমুদ্রবন্দর তৈরি হতে থাকে। এর ফলে জিব্রালটার প্রণালীর নিয়ন্ত্রণ বহুকাল জিব্রালটার এবং স্পেনের উপর নির্ভরশীল হলেও এখন মরক্কোও সেখানে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। একারণেই মরক্কোর নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী দেশগুলির কাছে গুরুত্বপূর্ণ। 


ভূকৌশলগত দিক থেকে মরক্কোর অতি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান

মরক্কো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা ভৌগোলিক অবস্থান ধরে রেখেছে, যা কিনা ভূকৌশলগত দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মরক্কোর উত্তর উপকূল জিব্রালটার প্রণালির দক্ষিণ কূল নিয়ন্ত্রণ করে। ১৯০৬ সালে মরক্কোর ভবিষ্যৎ নির্ধারণকারী ইউরোপিয় দেশগুলি ব্রিটেনের একটা শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। ব্রিটেন বলেছিল যে, মরক্কোর নিয়ন্ত্রণ যার কাছেই যাক না কেন, জিব্রালটারের উল্টো পাসে মরক্কোর উত্তর উপকূলে কোন বন্দরে দুর্গ তৈরি করা যাবে না। ব্রিটেন বিশেষ করে খেয়াল রেখেছিল জার্মানি যেন মরক্কোর উপর প্রভাব বিস্তার করে সেখানে একটা নৌঘাঁটি করে ফেলতে না পারে। এটা জিব্রালটারের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্রিটেনের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৯৭০এর দশকে স্পেন মরক্কো ছেড়ে আসলেও মরক্কোর উত্তর উপকূলে কয়েকটা বন্দরকে স্পেন ছিটমহল হিসেবে রেখে দেয়। ভবিষ্যতে জিব্রালটার প্রণালীর দক্ষিণ উপকূল নিয়ন্ত্রণে এই ছিটমহলগুলি ইউরোপের জন্যে কাজে দিতে পারে। এগুলির মাঝে গুরুত্বপূর্ণ হলো সেউতা এবং মেলিলা। সেউতার পাশেই মরক্কোর তাঞ্জিয়ার এবং তাঞ্জিয়ার মেড জিব্রালটারের উল্টো দিকে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর।

জিব্রালটার প্রণালী উত্তর ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার সাথে ভূমধ্যসাগর, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার সংযোগপথ। ব্রিটেন, নেদারল্যান্ডস, জার্মানিসহ পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি এই প্রণালীর মধ্য দিয়ে যাওয়া বাণিজ্যপথের উপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল। ফ্রান্সের আটলান্টিক উপকূলের সাথে ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলের সংযোগও জিব্রালটারের মাধ্যমে। তাই এই সংযোগপথের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে ইউরোপিয়দের কাছে মরক্কোর গুরুত্ব সর্বদাই বেশি ছিল। একসময় প্রাকৃতিক কারণে মরক্কোর উপকূলে বড় বন্দর নির্মাণ কঠিন হলেও প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথেসাথে মরক্কোর উপকূলে বড় বড় সমুদ্রবন্দর তৈরি হতে থাকে। এর ফলে জিব্রালটার প্রণালীর নিয়ন্ত্রণ বহুকাল জিব্রালটার এবং স্পেনের উপর নির্ভরশীল হলেও এখন মরক্কোও সেখানে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। একারণেই মরক্কোর নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী দেশগুলির কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও মরক্কো হলো যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যের মাঝে অবস্থিত একটা দরজা। এর মাঝ দিয়ে মার্কিন সামরিক বিমানগুলি উড়ে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া আসা করে। মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলিও এই পথে ভূমধ্যসাগর এবং মধ্যপ্রাচ্যে যায়। কাজেই মার্কিনীরাও মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণ রাখতে মরক্কোর নিয়ন্ত্রণ চায়।

মরক্কো নিজের অবস্থানকে ব্যবহার করে আফ্রিকার গ্যাস ইউরোপে রপ্তানি করতে চাইছে। আলজেরিয়া থেকে একটা পাইপলাইনের মাধ্যমে মরক্কো হয়ে গ্যাস রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপে। আরেকটা পাইপলাইনের মাধ্যমে নাইজেরিয়ার গ্যাস ইউরোপে রপ্তানি করতে চাইছে মরক্কো। এই পাইপলাইনগুলি নিয়ে মরক্কোর সাথে আলজেরিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে।

মরক্কোর সাথে পশ্চিম আফ্রিকার অন্যান্য দেশের সড়ক যোগাযোগের একমাত্র পথ হল পশ্চিম সাহারার মাঝ দিয়ে যাওয়া একটা মাত্র রাস্তা। ২০২০এর নভেম্বরে প্রায় দু’শ মালবাহী ট্রাক মৌরিতানিয়ার সীমানায় আটকে থেকে অভিযোগ করে যে, মিলিশিয়ারা রাস্তা অবরোধ করে রেখেছে। এরপরই মরক্কো এই রাস্তার নিরাপত্তা নিশ্চিতে পশ্চিম সাহারার দক্ষিণে মৌরিতানিয়ার সীমানায় গুরগেরাত বাফার জোনে সেনা মোতায়েন করে। ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’এর রিকার্ডো ফাবিয়ানি ‘আল জাজিরা’কে বলেন যে, নতুন করে শুরু হওয়া এই উত্তেজনার ফলাফল সুদূরপ্রসারী হতে পারে। আলজেরিয়ার পররাষ্ট্র দপ্তর মরক্কোর এই সামরিক মিশনের সমালোচনা করে বিবৃতি দেয়।
 
২০১৩ সাল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাথে মরক্কোর রাজা ষষ্ঠ মোহাম্মদ। মরক্কোর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বহুকালের। যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে ভূমধ্যসাগরে ঢোকার একটা পথ হলো জিব্রালটার। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ধরে রাখতে মরক্কো একটা দরজার মতো। আরব দেশগুলিও সেকারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা পাবার জন্যে মরক্কোর এই ‘দরজা’ খোলা দেখতে চায়। ইউরোপের নিয়ন্ত্রণ থেকে বাঁচতেই মরক্কো যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়েছিল।  

মরক্কোর যুক্তরাষ্ট্র কেন্দ্রিক রাজনীতি

মরক্কো যুক্তরাষ্ট্রের অনেক পুরোনো বন্ধু। যুক্তরাষ্ট্র তৈরি হবার সময়েই মরক্কোর সুলতান মোহাম্মদ বেন আব্দেল্লাহ ১৭৭৭ সালে ব্রিটেনের চোখ রাঙ্গানো উপেক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ১৭৮৬ সালে মরক্কোর করা বন্ধুত্বের চুক্তি এখনও বলবত রয়েছে। ১৯০৬ সালে ইউরোপিয় শক্তিরা মরক্কোর দখল নেবার সময় যুক্তরাষ্ট্র এর বিরোধিতা করেছিল। ১৯৫৬ সালে ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাবার পরের বছরেই মরক্কোর রাজা পঞ্চম মোহাম্মদ ওয়াশিংটন সফর করেন। পরবর্তী রাজা দ্বিতীয় হাসানও কয়েকবার ওয়াশিংটন সফর করেন। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় মরক্কো যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবেই থাকে। ১৯৯৯ সাল থেকে পরবর্তী রাজা ষষ্ঠ মোহাম্মদও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে তার পূর্ববর্তীদের নীতি অনুসরণ করেন। ১৯৮৭ সালে মরক্কোর সরকার যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের দেশের বিমান ঘাঁটিগুলি ব্যবহার করার অনুমতি দেয়। মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকায় মার্কিন সামরিক অপারেশন চালাতে মরক্কোর বিমান ঘাঁটিগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পলিসারিওর বিরুদ্ধে যুদ্ধে মরক্কোকে সামরিক সহায়তা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এই সামরিক সহায়তার পিছনে অর্থায়ন সৌদি আরব করে বলেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা। ওয়াশিংটনে মরক্কোর পক্ষে শক্তিশালী লবিং গ্রুপ থাকায় পশ্চিম সাহারা ইস্যুতে মার্কিন সরকার মরক্কোকে সরাসরি সমর্থন না করলেও যুক্তরাষ্ট্র মূলতঃ মরক্কোর পক্ষেই থাকে। মার্কিনীরা পশ্চিম সাহার জন্যে মরক্কোর অধীনে স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে লবিং করতে থাকে।

২০১৯ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্র মরক্কোর কাছে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যে ২৫টা ‘এফ ১৬ ব্লক ৭২’ ফাইটার বিমান বিক্রয়ের অনুমোদন দেয়; এবং আরও প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারে বর্তমানে মরক্কোর বিমান বাহিনীতে থাকা ২৩টা ‘এফ ১৬’ বিমানকে আপগ্রেড করার কথা বলে। একই বছরের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর মরক্কোর কাছে আরও ১ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির প্রস্তাবের অনুমোদন দেয়। ‘ডিফেন্স নিউজ’ বলছে যে, এর মাঝে ছিল ‘এফ ১৬’ যুদ্ধবিমানে ব্যবহারের জন্যে ৫ হাজার ৮’শ ‘মার্ক ৮২’ বোমা, ৩’শ ‘মার্ক ৮৪’ বোমা, ১’শ ৫টা ‘জেডিএএম’ বোমার কিট, ১’শ ৮০টা ‘জিবিইউ ১০’ বোমার কিট, ৪ হাজার ১’শ ২৫টা ‘জিবিইউ ১২’ বোমার কিট। এছাড়াও ৪’শ টা লঞ্চার সহ ২ হাজার ৪’শটা ‘টিওডব্লিউ’ ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। এক বছরের মাঝে মরক্কো যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের অস্ত্র কেনার অনুমোদন পায়।

২০২০এর ১০ই ডিসেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন যে, ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম সাহারায় মরক্কোর সার্বভোমত্ব স্বীকার করে নিয়েছে। পরদিনই যুক্তরাষ্ট্র মরক্কোর কাছে আরও ১ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির ঘোষণা দেয়। ‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, এই অস্ত্রের মাঝে রয়েছে চারটা ‘এমকিউ ৯বি সী গার্ডিয়ান’ ড্রোন এবং ‘হেলফায়ার’ ক্ষেপণাস্ত্র এবং ‘পেইভওয়ে’ ও ‘জেডিএএম’ বোমা। এই অস্ত্রগুলি পশ্চিম সাহারা নিয়ে পুনরায় সংঘাত শুরু হলে মরক্কোকে নিশ্চিতভাবে এগিয়ে রাখবে।

জিব্রালটার প্রণালী নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র বনাম ইউরোপ

মরক্কোর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বহুকালের। যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে ভূমধ্যসাগরে ঢোকার একটা পথ হলো জিব্রালটার। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ধরে রাখতে মরক্কো একটা দরজার মতো। আরব দেশগুলিও সেকারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা পাবার জন্যে মরক্কোর এই ‘দরজা’ খোলা দেখতে চায়। ইউরোপের নিয়ন্ত্রণ থেকে বাঁচতেই মরক্কো যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়েছিল। মরক্কোর নিরাপত্তা চিন্তায় ইউরোপ সবসময়ই রূঢ় বাস্তবতা; কারণ ইউরোপ মরক্কোকে ভূমধ্যসাগরে ঢোকার পশ্চিম দরজার দক্ষিণ পাল্লা হিসেবে দেখে। একারণেই বিংশ শতকে ইউরোপিয় উপনিবেশ হওয়া থেকে বাঁচতে পারেনি মরক্কো; যার ফলশ্রুতিতে বর্তমান মরক্কো অর্থনৈতিকভাবে ইউরোপের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। তবে নির্ভরশীলতা একমুখী নয় মোটেই; কারণ ইউরোপিয়রাও মরক্কোতে তাদের বিনিয়োগের সুরক্ষা চায়।

অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্ব ইউরোপের সাথে দরকষাকষিতে মরক্কোকে শক্ত ভিত্তি দেয়। একারণেই ১৯৭০এর দশক থেকে সামরিক শক্তি দিয়ে পশ্চিম সাহারাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করলেও মরক্কোর উপর কোন অবরোধ কেউ দিতে পারেনি। উল্টো পলিসারিওর সাথে যুদ্ধে মরক্কো যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা অস্ত্র পেয়েছে। তবে মরক্কোর প্রায় ২ লক্ষ সদস্যের সেনাবাহিনী পশ্চিম সাহারায় ব্যস্ত থেকে জিব্রালটার এবং স্প্যানিশ ছিটমহলগুলি থেকে যে দূরে থাকছে, সেব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র খুব বেশি চিন্তিত হবার কথা নয়। পশ্চিম সাহারার ফ্রন্টলাইন অনেকদিন ঠান্ডা থাকার পর আবারও উত্তপ্ত হচ্ছে; যা মূলতঃ পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থারই ফলাফল। সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতা মরক্কোর উপর ইউরোপের চাপ বৃদ্ধির পিছনে বড় কারণ। ইস্রাইলের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের মতো জনবিরোধী সিদ্ধান্তও মরক্কোর সরকার নিয়েছে পশ্চিম সাহারায় মরক্কোর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি পাবার জন্যে। তবে এর ফলশ্রুতিতে ইউরোপের সাথে মরক্কোর সম্পর্ক টানাপোড়েনের মাঝে পড়েছে। যদিও মরক্কোর সাথে ইউরোপের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা কম, তথাপি মরক্কোর উত্তর উপকূলে স্পেনের ছিটমহলগুলি যখন হাজারো শরণার্থীর জোয়ারে ভেসে যাবার উপক্রম, তখন এই ছিটমহলগুলির সামনের দিনগুলিতে ইউরোপের ‘ব্রিজহেড’ হিসেবে থাকার সম্ভাবনা প্রশ্নের মুখে পড়ে। জিব্রালটার প্রণালীর উভয় উপকূল নিয়ন্ত্রণে রাখা ইউরোপের জন্যে ততক্ষণই কঠিন, যতক্ষণ যুক্তরাষ্ট্র শক্তিশালী হাতে মরক্কোর নিরাপত্তার দায়ভার নিতে পারবে। সাম্প্রতিক সময়ে মরক্কোর জন্যে বিপুল সামরিক সহায়তা ইউরোপের জন্যে সেই বার্তা বহণ করে।

6 comments:

  1. মরক্কো সহ উত্তর আফ্রিকার অধিকাংশ দেশই এখনো pawn হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
    এই সময়, যখন পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থা দুর্বল হচ্ছে, তবুও এই দেশ গুলি নিজেরা নিজেদের ভবিষ্যৎ পুরোপুরি ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না কেন?
    তারা কলোনিয়াল হ্যাংওভার কাটাতে পারছে না কেন?
    আর সঙ্গে 'ব্রিজহেড' বিষয়টি ব্যাখ্যা করলে ভাল হয়!

    ReplyDelete
    Replies
    1. শুধু উত্তর আফ্রিকা নয়, পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশই পশ্চিমাদের অনুসরণ করে। যেহেতু তারা কোন আদর্শকে প্রতিষ্ঠা, প্রসার এবং রক্ষা করার উদ্দেশ্য নিয়ে নামেনি, তাই তারা জানে না যে তাদের লক্ষ্য কি। আদর্শিক রাষ্ট্রগুলির লক্ষ্য নির্দিষ্ট থাকে বলে তাদের কর্মকান্ডগুলি "প্রোএকটিভ"। অপরপক্ষে অন্য দেশগুলি আদর্শিক রাষ্ট্রগুলির দিকে তাকিয়ে থাকে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে; এরা হলো "রিয়্যাকটিভ"। একটা আদর্শিক রাষ্ট বলতে পারে আরেকটা দেশ তার নিজের কর্মকান্ডকে কিভাবে দেখবে এবং কিভাবে রিয়্যাক্ট করবে। একারণেই আদর্শিক রাষ্ট্রগুলি অন্যদের উপর ছড়ি ঘোরাতে পারে। অনাদর্শিক বা জাতীয়তাবাদী দেশগুলি তাদের কাঠামোর মাঝে আটকে থাকে; কারণ তাদের কোন উদ্দেশ্য নেই। তারা শুধ্য অন্যের উদ্দেশ্যকে অনুসরণ করে।

      এখন বর্তমান বাস্তবতায় যখন আদর্শিক রাষ্ট্রগুলিই দুর্বল হতে শুরু করেছে, তখন জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রগুলি বুঝতে পারছে না যে, তাদের কি করা দরকার। সেই হিসেবে তারা বাস্তবতাকে ভিত্তি ধরে এগুবার চেষ্টা করছে (কারণ তাদের কোন লক্ষ্য নেই)। এভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় স্বার্থের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হচ্ছে। এই রাষ্ট্রগুলির কর্মকান্ড স্বার্থকেন্দ্রিক, আদর্শকেন্দ্রিক নয়। তবে তারা পশ্চিমাদের তৈরি করা ঔপনিবেশিক কাঠামো থেকে বের হতে পারছে না চিন্তাগত দিক থেকে পশ্চিমাদের অনুসরণ করার ফলে। জাতিরাষ্ট্রগুলি সংজ্ঞায়িত হয়েছে ভৌগোলিকভাবে; তাই তারা তাদের ভৌগোলিক সীমানা থেকে বের হতে পারছে না। তবে যখন পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রণ কমে যাচ্ছে, তখন আবার স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে সীমানার নিয়মগুলি তারা ভেঙ্গে ফেলছে। যেহেতু তাদের কোন আদর্শিক উদ্দেশ্য নেই, তাই পশ্চিমারা তখন এই রাষ্ট্রগুলির নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলতে পারছে। অর্থাৎ সীমানা পেরিয়া যাবার মতো কঠিন কাজটা করতে পারলেও এর ফলাফল তাদের ঘরে উঠাতে পারছে না; অন্য কেউ খেয়ে ফেলছে। যেমন মরক্কো পশ্চিম সাহারায় সামরিক মিশন পরিচালনা করলেও তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে যুক্তরাষ্ট। আর আলজেরিয়া পলিসারিওকে সহায়তা দিলেও ফলফল হিসেবে সুবিধা পাচ্ছে ইউরোপ (ব্রিটেন)।

      Delete
    2. ব্রিজহেড হলো কোন একটা উপকূলে বা শত্রুবেষ্টিত এলাকায় পা রাখার একটা অল্প জায়গা। এই পা রাখার জায়গাটাকে আরও শক্তিশালী করে পরবর্তীতে পুরো উপকূল বা শত্রুর এলাকা দখল করে ফেলা যায়। উদাহরণস্বরূপ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৪ সালে জার্মানির নিয়ন্ত্রণে থাকা ইউরোপের মাটিতে উভচর অপারেশনের মাধ্যমে মিত্রবাহিনী নামে। মিত্রবাহিনী উপকূলের নরম্যান্ডি এলাকায় একটা ছোট্ট এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়; এটাই ব্রিজহেড। নরম্যান্ডির এই ব্রিজহেডে ধীরে ধীরে প্রচুর সৈন্য এবং গোলাবারুদ নামতে থাকে। একসময় যখন তারা নিজেদেরকে যথেষ্ট শক্তিশালী মনে করে, তখন তারা সেই ব্রিজহেড ভেঙ্গে আক্রমণের মাধ্যমে বের হয়ে আসে। এটা হলো "ব্রেকথ্রু"। এই ব্রেকথ্রুএর পর তারা খুব অল্প সময়ে পুরো নরম্যান্ডিই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এরপর আরও সময় নিয়ে পুরো উত্তর ফ্রান্স এবং পরবর্তীতে পুরো পশ্চিম ইউরোপ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যুদ্ধই শেষ করে ফেলে।

      Delete
  2. ধন্যবাদ।

    বিষয়টি ভালো ভাবে বোঝা গেল। তাহলে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গেল যে, এই সব আদর্শিক রাষ্ট্রগুলো তাদের স্যাটেলাইট স্টেট দিয়ে নিজের কার্যসিদ্ধি করে নিচ্ছে, নিজের অবস্থান দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও।
    এইভাবে তারা চলতে পারবে এইটাই দেখার বিষয়।

    ReplyDelete
  3. বর্তমান পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় ইউরোপে নাৎসিদের মত উগ্রবাদী আদর্শিক রাস্ট্র তৈরীর সম্ভাবনা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। সেক্ষেত্রে এই পুজিবাদি সিস্টেম এই রিস্কটা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে বা ভবিষ্যতে এর মোকাবেলায় কি ধরনের পলিসি গ্রহনের চিন্তা করে রেখেছে?? আপনার মুল্যবান মতামত আশা করছি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. নাজিবাদ কোন আদর্শ নয়। ১৮৭০ সালে যে ভিত্তির উপর জার্মানির জন্ম হয়েছিল, সেই ভিত্তির উপরেই জার্মানি ইউরোপে যুদ্ধ করেছে। এই ভিত হলো জার্মান জাতীয়তাবাদ। ইউরোপে জাতীয়তাবাদের কারণে দু'টা বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে। ইউরোপে জাতীয়তাবাদের উত্থান একারণেই গুরুত্বপূর্ণ।

      পশ্চিমা চিন্তা জাতীয়তাবাদকে থামায় তো না-ই, বরং পশ্চিমা চিন্তার মাঝে জাতীয়তাবাদ লালিত হয়। বিশ্বব্যাপী ক্যাপিটালিস্ট সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতার মাঝে যুদ্ধ করেছে ব্রিটেন এবং ফ্রান্স। ব্রিটেনকে ডুবাতে গিয়ে ফ্রান্স ন্যাপোলিয়নের অধীনে থাকার সময় পুরো ইউরোপের নিয়ন্ত্রণ নিতে চেয়েছে। এই নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়ে ফরাসী বিপ্লবের পর থেকে দুই দশকের বেশি সময় ইউরোপ যুদ্ধ করেছে। এই যুদ্ধের মাঝে তৎকালীন প্রুশিয়ার উপর ফরাসিরা মারাত্মক অবিচার করেছে। প্রুশিয়াকে অপমানের একশেষ করেছে। প্রুশিয়া একারণেই জার্মান জাতীয়তাবাদের দিকে ধাবিত হয়েছে। এই ব্লগে জার্মানি নিয়ে লেখা রয়েছে, যেখানে এই ব্যাপারগুলি বিস্তারিত পাবেন।

      ১৮৭০ সালে জার্মানরা যখন প্যারিস অবরোধ দিয়ে শহরটার উপর অযথা গোলাবর্ষণ করে মনে ঝাল মেটাচ্ছিল, তখনই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, এই জার্মানি কোন ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। কাজেই পরবর্তীতে জার্মানি যা করেছে, তা তার নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্যেই করেছে; যেখানে জাতীয়তাবাদ মূখ্য ভূমিকা রাখে।

      পশ্চিমা চিন্তার করুণ অবস্থায় সময় ইউরোপ আবারও জাতীয়তাবাদী হচ্ছে। তবে দুনিয়ার আদর্শ সামনের দিনে কি হবে, সেটা নির্ধারণ করবে যে, জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে ইউরোপে আবারও রক্তক্ষয় হবে কিনা।

      Delete