Saturday 8 August 2020

জার্মানি থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার ইউরোপের অনৈক্যকে দেখিয়ে দিচ্ছে

০৯ই অগাস্ট ২০২০
রুশ হুমকি মোকাবিলায় জার্মানি থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে যখন পোল্যান্ডে মোতায়েন করা হচ্ছে, তখন জার্মানরা তাতে খুশি; আর অপরদিকে পোল্যান্ড মার্কিন সেনাদের খরচ পুরোটাই বহণ করতে চাইছে। অর্থাৎ ইউরোপের দেশগুলির কাছে জাতীয় নিরাপত্তার সংজ্ঞা এক নয়। ইউরোপের ভিন্ন ভিন্ন দেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ভিন্ন ভিন্ন সম্পর্ক ইউরোপের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্বকে যেমন সামনে নিয়ে আসছে, তেমনি ইউরোপের অভ্যন্তরীণ অনৈক্যকে চোখে আঙ্গুল দেখিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া উভয়েই ব্যবহার করতে চাইবে।

 

গত ২৯শে জুলাই যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দেয় যে, তারা জার্মানি থেকে তাদের প্রায় ১২ হাজার সেনা সরিয়ে নিচ্ছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপার এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে, বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে, যাতে রাশিয়া এবং চীনের মতো শক্তিগুলিকে আরও ভালোভাবে মোকাবিলা করা যায়। তিনি আরও বলেন যে, এর মাধ্যমে ন্যাটো আরও শক্তিশালী হবে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে ডিটারেন্স তৈরি হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন পরিস্থিতি মোকাবিলা করাটা আরও সহজ করবে। কিন্তু প্রায় একইসাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে কোন রাখঢাক না রেখেই বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে কারণ জার্মানি তাদের নিজেদের রক্ষার জন্যে কোন খরচ করছে না। ব্যাপারটা খুবই সহজ; তারা ‘অপরাধী’। তিনি আরও বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এখন আর বোকা বনতে চায় না। আন্যান্য ন্যাটো দেশগুলির জন্যে এটা একটা উদাহরণ হিসেবে থাকবে। ট্রাম্প মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, ২০১৯ সালে জার্মানি তার জিডিপির ১ দশমিক ৩৮ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করেছে, যা ন্যাটোর বেঁধে দেয়া টার্গেট ২ শতাংশ থেকে অনেক নিচে। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তে সমালোচনা আসছে খোদ যুক্তরাষ্ট্র থেকেই। মার্কিন সিনেটর মিট রমনি এই টুইটার বার্তায় বলেন যে, এই সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের একটা বন্ধু রাষ্ট্রের মুখে চপেটাঘাত। ডেমোক্র্যাট সিনেটর বব মেনেনডেজ বলছেন যে, এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ইউরোপে ক্রেমলিনের আগ্রাসী কর্মকান্ডকে রুখে দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে আরও কঠিন হয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে জার্মানি থেকে সেনা সরিয়ে নিয়ে তাদেরকে বেলজিয়াম এবং ইতালিতে মোতায়েন করতে। কিন্তু ইতালিও ২০১৯ সালে তার জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ২২ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করেছে; বেলজিয়াম করেছে শূণ্য দশমিক ৯৩ শতাংশ! অর্থাৎ ব্যাপারটা শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা বাজেটের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। জার্মানির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অন্য দিকগুলিও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।

৭ই অগাস্ট জার্মান পত্রিকা ‘ডাই ওয়েল্ট’এর এক খবরে বলা হয়ে যে, রাশিয়ার সাথে ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প এগিয়ে নেয়ার ‘অপরাধে’ জার্মানির সাসনিতজ বন্দরের উপর ভীষণ রকমের আইনগত এবং অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করার হুমকি দিয়েছেন তিনজন মার্কিন সিনেটর টেড ক্রুজ, টম কটন এবং রন জনসন। বল্টিক সাগরের তলদেশ দিয়ে বসানো এই পাইপলাইনের কাজের অল্প কিছু অংশ বাকি রয়েছে; যা সমাপ্তির পিছনে সাসনিতজ বন্দরের অবকাঠামো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সিনেটররা এই চিঠিতে বলছেন যে, এই প্রকল্পে সাসনিতজ বন্দর সহায়তা দিলে বন্দরের মালিক এবং ম্যানেজমেন্টের কর্তাব্যক্তিদেরকে যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ করতে দেয়া হবে না এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকা তাদের সকল সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে। তারা বলছেন যে, এই পাইপলাইন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যে মারাত্মক হুমকি। তাদের কথায় মার্কিন কংগ্রেসের উভয় দলই রাশিয়ার সাথে জার্মানির এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে।

জার্মানরাও প্রকাশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধী অবস্থান নিয়েছে। জার্মান পত্রিকা ‘তাগেস স্পাইজেল’কে জার্মান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিয়েলস আনেন বলেন যে, মার্কিন সিনেটরদের চিঠিটাকে জার্মান সরকার মোটেই স্বাভাবিকভাবে নেয়নি; এর ভাষা এবং শব্দচয়ন ছিল একেবারেই অনভিপ্রেত। তিনি বলেন যে, ইউরোপিয়রা যদি মার্কিনীদের এধরনের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধাচরণ না করে, তবে তারা ‘ব্ল্যাকমেইল’এর শিকার হবে। জার্মান ম্যাগাজিন ‘উইয়ো’র সাথে এক সাক্ষাতে জার্মান ইস্টার্ন বিজনেস এসোসিয়েশনের প্রধান মাইকেল হার্মস বলেন যে, জার্মানরা মার্কিনীদের বিরুদ্ধে পাল্টা কোন ব্যবস্থা নিতে পারবে না, এটা যেন কেউ না বলে। ইউরোপিয় ইউনিয়নের কোম্পানিগুলির জন্যে একটা সুরক্ষা ব্যুহ থাকা উচিৎ, যেগুলি এধরনের অবরোধে কোম্পানিগুলিকে বাঁচাবে। তিনি বলেন যে, জার্মান সরকারের উচিৎ ইইউকে পাল্টা অবরোধ দিতে অনুপ্রাণিত করা।

৩১শে জুলাই থেকে ৩রা অগাস্টের মাঝে ‘ইউগভ’এর মাধ্যমে জার্মান প্রেস এজেন্সির করা এক মতামত জরিপে দেখা যাচ্ছে যে, ৪৭ শতাংশ জার্মান মনে করছে যে, জার্মানি থেকে মার্কিন সেনা কমানো উচিৎ। আর ২৫ শতাংশের মতো মানুষ বলছে যে, মার্কিন সেনা জার্মানি থেকে একেবারেই সরিয়ে নেয়া উচিৎ। ৩২ শতাংশ মনে করছে যে, মার্কিন সেনা থাকা উচিৎ। আরেক প্রশ্নের উত্তরে ৬৬ শতাংশ জার্মান মতামত দেয় যে, জার্মানি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ২০টা পারমাণবিক বোমাই সরিয়ে ফেলা উচিৎ। মাত্র ১৯ শতাংশ চাইছে যে, বোমাগুলি জার্মানিতে থাকুক। ন্যাটোর প্রতিশ্রুতিকে আমলে না নিয়ে জার্মান প্রতিরক্ষা বাজেটের ব্যাপারে ৫৮ শতাংশ মানুষ বলছে যে, জার্মানি প্রতিরক্ষার পিছনে যথেষ্ট ব্যয় করে।

ন্যাটোর যে সদস্য রাষ্ট্রগুলি প্রতিশ্রুত ২ শতাংশের বেশি প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করছে, তার বেশিরভাগই রাশিয়ার সীমানায় অবস্থিত; যেমন লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া, রোমানিয়া, পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া। এই দেশগুলির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে ভাটা পড়েনি। ইতোমধ্যেই ২০১৯ সালে ট্রাম্প প্রশাসন ঘোষণা দেয় যে, তারা পোল্যান্ডকে রক্ষা করতে সেখানে মার্কিন সেনার সংখ্যা আরও ১ হাজার বাড়িয়ে সাড়ে ৫ হাজার করবে। ‘মিলিটারি টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, অতিরিক্ত মার্কিন সেনাদের রাখার জন্যে অবকাঠামো তৈরি করা শুরু হয়েছে; আর এই খরচের প্রায় পুরোটাই বহণ করবে পোলিশ সরকার।

ইউরোপ আজ বেসুরে অর্কেস্ট্রার মতো কথা বলছে। রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি করতে জার্মানি ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ গ্যাস পাইপলাইনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইইউএর সমর্থন চাইছে। ইউরোপের সাথে রাশিয়ার অর্থনৈতিক সম্পর্ককে জার্মানরা স্বাভাবিকভাবে নিলেও যুক্তরাষ্ট্র ভালো চোখে দেখছে না। জাতীয় নিরাপত্তার হুমকির ব্যাপারে জার্মানদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক মতভেদ দৃশ্যমান। রুশ হুমকি মোকাবিলায় জার্মানি থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে যখন পোল্যান্ডে মোতায়েন করা হচ্ছে, তখন জার্মানরা তাতে খুশি; আর অপরদিকে পোল্যান্ড মার্কিন সেনাদের খরচ পুরোটাই বহণ করতে চাইছে। অর্থাৎ ইউরোপের দেশগুলির কাছে জাতীয় নিরাপত্তার সংজ্ঞা এক নয়। ইউরোপের ভিন্ন ভিন্ন দেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ভিন্ন ভিন্ন সম্পর্ক ইউরোপের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্বকে যেমন সামনে নিয়ে আসছে, তেমনি ইউরোপের অভ্যন্তরীণ অনৈক্যকে চোখে আঙ্গুল দেখিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া উভয়েই ব্যবহার করতে চাইবে।

No comments:

Post a Comment