Friday 24 July 2020

ইন্দো-প্যাসিফিকে মার্কিন নৌশক্তির ফেরত আসার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব কতটুকু?

২৪শে জুলাই ২০২০

দক্ষিণ চীন সাগরে মহড়া দিচ্ছে মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'নিমিতজ' এবং 'রোনাল্ড রেগ্যান'। চীনারা তাদের অপেক্ষাকৃত স্বল্পক্ষমতার নৌবহরকে মার্কিনীদের সক্ষমতার ফাঁকফোঁকড়ের মাঝে ব্যবহার করে মার্কিন নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছে। আর এতে তারা বেশ সাফল্যও পেয়েছে। বিশ্বব্যাপী মার্কিনীদের বন্ধু এবং প্রতিযোগী সকলেই যুক্তরাষ্ট্রের এই সীমাবদ্ধতাগুলিকে অবলোকন করছে; যা কিনা তাদের নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে অনুপ্রাণিত করছে।


করোনা মহামারির মাঝে ইন্দো-প্যাসিফিকে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি মোতায়েনের প্রতিযোগিতার খবর প্রতিনিয়তই পত্রিকাতে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। পূর্ব এশিয়ার উপকূলে সামরিক শক্তি প্রদর্শনের সবচাইতে দৃশ্যমান অস্ত্র হিসেবে দেখা যাচ্ছে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজকে। মার্কিন যুদ্ধজাহাজে করোনা সংক্রমণের মাঝে চীনারা এপ্রিলে প্রায় এক মাসের জন্যে তাদের একমাত্র বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘লিয়াওনিং’কে সমুদ্রে প্রেরণ করে। ৩০শে এপ্রিল জাহাজটা পূর্ব চীন সাগরে ‘ট্রেনিং’ মিশন শেষ করে চিংদাও বন্দরে ফিরে আসে। পূর্বের সমুদ্রে মার্কিন যুদ্ধজাহাজের প্রায় ‘অনুপস্থিতি’র মাঝে চীনাদের এই ‘শক্তি প্রদর্শন’ মার্কিন শক্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

৪ঠা মে জাপানের ইয়োকোসুকা বন্দর ছেড়ে যায় বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘রোনাল্ড রেগ্যান’। যুক্তরাষ্ট্রের ১১টা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মাঝে ‘রেগ্যান’কেই রাখা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখন্ডের বাইরে। গত ২৭ মার্চে পূর্ব এশিয়ার উপকূলে মোতায়েনকৃত যুদ্ধজাহাজ ‘থিওডোর রুজভেল্ট’এ করোনাভাইরাসের মারাত্মক সংক্রমণ আবিষ্কারের পর ‘রোনাল্ড রেগ্যান’এও সংক্রমণ ধরা পরে। প্রায় দুই মাস মার্কিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপনিবেশ গুয়ামের নৌঘাঁটিতে বসে থাকার পর ‘থিওডোর রুজভেল্ট’ ১৯শে মে সমুদ্রে বের হয়। অপরদিকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের আরেক যুদ্ধজাহাজ ‘নিমিতজ’ ২ বছরের মেইনটেন্যান্স শেষ করে ৮ই জুন যুক্তরাষ্ট্রের সান ডিয়েগো থেকে যাত্রা করে। জটিল প্রযুক্তির কারণে এধরণের জাহাজকে মেইনটেন্যান্স থেকে অপারেশনে আনতে অনেক সময় লাগে। এর উপর আবার ‘রুজভেল্ট’এ করোনা সংক্রমণের কারণে অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে ক্রুদের টেস্ট করা এবং কোয়ার‍্যান্টিনে রাখার কারণে সমুদ্রে যেতে আরও দেরি হয়। ‘নিমিতজ’এর সমুদ্রে যাবার ৪ দিনের মাথায় ১২ই জুন ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ২০১৭ সালের পর প্রথমবারের মতো প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন নৌবাহিনী একসাথে ৩টা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে; বড় খবর বলে প্রচার পায় এটা। ২১শে জুন ‘নিমিতজ’ এবং ‘রুজভেল্ট’ যুদ্ধজাহাজের গ্রুপ একত্রে মহড়া দেয়া শুরু করে। ২৮শে জুন থেকে ‘নিমিতজ’ মহড়া দেয়া শুরু করে ‘রেগ্যান’এর সাথে। ‘নিমিতজ’এর ‘ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ ১১’এর কমান্ডার রিয়ার এডমিরাল জেমস ক্লার্ক এক বিবৃতিতে ঘোষণা দেন যে, বিশ্বে একমাত্র মার্কিন নৌবাহিনীরই এরকম শক্তি একত্রিত করার সক্ষমতা রাখে।

৬ই জুলাই মার্কিন মিডিয়া ‘সিএনএন’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, দু’টা মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ একত্রে দক্ষিণ চীন সাগরে মহড়া দেয়া শুরু করেছে। জাহাজদু’টা হলো জাপান থেকে আসা ‘রেগ্যান’ এবং প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব প্রান্তে সান ডিয়েগো থেকে আসা ‘নিমিতজ’। বলা হয় যে, ২০১৪ সালের পর থেকে প্রথমবারের মতো দু’টা জাহাজ একত্রে মহড়া দেয়ার ঘটনা ঘটলো। ১৭ই জুলাই তারা আবারও ঘোষণা দেয় যে, জাহাজদু’টা একই মাসে দ্বিতীয়বারের মতো একত্রে মহড়া দেয়া শুরু করেছে। তবে প্রশান্ত মহাসাগরে তৃতীয় বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘থিওডোর রুজভেল্ট’ মিডিয়ার আলোচনার বাইরে থাকে। কারণ এরই মাঝে চুপিসারে ৯ই জুলাই জাহাজটা দেশে ফেরত যায়। ‘ইউএসএনআই নিউজ’ জানাচ্ছে যে, গত জানুয়ারিতে জাহাজটা সান ডিয়েগো ছেড়ে গিয়েছিল। মার্চ মাসে ভিয়েতনামে ভ্রমণ করার পরপরই জাহাজটাতে করোনার সংক্রমণ ধরা পরে। শেষ পর্যন্ত প্রায় ১২’শ সংক্রমণ ধরা পরেছিল। এই সংক্রমণের খবর বের হবার পর জাহাজের কমান্ডার ক্যাপ্টেন ব্রেট ক্রোজিয়ারকে চাকুরিচ্যুত করা হয়।

২০শে জুলাই ঘোষণা দেয়া হয় যে, ‘নিমিতজ’ যুদ্ধজাহাজ দক্ষিণ চীন সাগর থেকে বঙ্গোপসাগরে এসে হাজির হয়েছে। ভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে ভারত মহাসাগরে প্রায় পাঁচ মাস ভেসে থাকার পর যুদ্ধজাহাজ ‘আইজেনহাওয়ার’ দেশে ফেরার পর থেকে ভারত মহাসাগরে কোন মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ নেই। ‘নিমিতজ’কে দিয়ে এই শূণ্যস্থান পূরণ করানো হচ্ছে। অর্থাৎ জুনের মাঝামাঝি সময় থেকে প্রায় একমাস ধরে প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন নৌবাহিনীর দাপিয়ে বেড়ানোর পালা শেষ হয়েছে। এর পরবর্তীতে ‘রেগ্যান’এর সাথে প্রশান্ত মহাসাগরে আরেকটা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করতে বেশ কয়েকমাস লেগে যেতে পারে। ‘কিটসাপ সান’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘কার্ল ভিনসন’ ওয়াশিংটন রাজ্যের ব্রেমারটনে দেড় বছরের মেইনটেন্যান্স শেষ করে অগাস্টের শুরুতে সান ডিয়েগোতে ফেরত আসার কথা রয়েছে। এরপর এর সমুদ্রে যাবার প্রস্তুতি শুরু হবে। ‘জন সি স্টেনিস’, ‘জর্জ ওয়াশিংটন’ এবং ‘জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ’ লম্বা সময়ের জন্যে ড্রাইডকে রয়েছে। নতুন জাহাজ ‘জেরাল্ড আর ফোর্ড’এর নতুন প্রযুক্তির টেস্টিং এখনও শেষ হয়নি; তাই এখনই পুরোপুরি সার্ভিসে আসছে না। ১০ মাসের মিশন শেষ করে জানুয়ারিতে সান ডিয়েগোতে ফেরত যাওয়া ‘আব্রাহাম লিঙ্কন’ খুব শিগগিরই আবার সাগরে যাচ্ছে না। ৭ মাসের মিশন শেষ করে জুনের মাঝামাঝি নরফোক নৌঘাঁটিতে ফিরেছে ‘হ্যারি এস ট্রুম্যান’। টানা ১৬১ দিন কোন বন্দরে না ভিড়ে রেকর্ড করা ‘আইজেনহাওয়ার’এর নাবিকরা ভূমিতে পা ফেলার জন্যে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিল। ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’এর সাথে সাক্ষাতে এই জাহাজের রক্ষার দায়িত্বে থাকা মার্কিন ক্রুজার ‘সান জেসিন্টো’র ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড ক্রসম্যান বলেন যে, কিছু নাবিক তার কাছে জানতে চেয়েছে যে, কোন জাহাজটা আগে বন্দরে নোঙ্গর করবে।

বিশাল সমরশক্তি থাকার পরেও মানব বাস্তবতাগুলি থেকে মার্কিনীরা বের হতে পারেনি। ১ লক্ষ টনের দৈত্যাকৃতির মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজগুলি যতোটাই শক্তিশালী হোক না কেন, তা সমুদ্রে কতটা সময় কাটাতে পারবে, তা নির্ভর করছে নাবিকদের সক্ষমতার উপর। আর অতি জটিল এবং উচ্চমূল্যের এই প্রযুক্তিকে চালু রাখতে ব্যাপক খরচ ছাড়াও নৌবহরের একটা বড় অংশকে মেইনটেন্যান্সের মাঝে থাকতে হচ্ছে। ক’দিন আগেই উভচর এসল্ট শিপ ‘বনহোমি রিচার্ড’এ ভয়াবহ আগুন এবং ২০১৭ সালে দু’টা ডেস্ট্রয়ারের দুর্ঘটনার পর দুই বছর সার্ভিসের বাইরে থাকার ঘটনা নৌবাহিনীর অপারেশনাল দক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এপ্রিল মাসে দক্ষিণ চীন সাগরে ‘এফ-৩৫’ স্টেলথ ফাইটার বহণে সক্ষম এরকমই একটা এসল্ট শিপ ‘আমেরিকা’ মার্কিন উপস্থিতিকে জিইয়ে রেখেছিল। চীনারা তাদের অপেক্ষাকৃত স্বল্পক্ষমতার নৌবহরকে মার্কিনীদের সক্ষমতার ফাঁকফোঁকড়ের মাঝে ব্যবহার করে মার্কিন নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছে। আর এতে তারা বেশ সাফল্যও পেয়েছে। বিশ্বব্যাপী মার্কিনীদের বন্ধু এবং প্রতিযোগী সকলেই যুক্তরাষ্ট্রের এই সীমাবদ্ধতাগুলিকে অবলোকন করছে; যা কিনা তাদের নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে অনুপ্রাণিত করছে।

5 comments:

  1. থাইলান্ডেরও একটি বিমানবাহী জাহাজ আছে, আমাদের কি একটি হেলিকপ্টার ক্যারিয়ারও থাকবে না ২০৩০ সাল নাগাদ?

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করার সময় আরও আগেই এসেছে। আশা করি এর আগের এই লেখাগুলি পড়েছেন।

      https://koushol.blogspot.com/2017/09/where-is-bangladesh-helicopter-carrier.html

      https://koushol.blogspot.com/2017/07/what-is-warship-part3.html

      Delete
    2. একটা হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার এর পরিচালনা, মেইন্ট্যানেন্স এর লোকবল সঙ্গে এর নিরাপত্তার জন্য কম করে দুটো ফ্রিগেট, সাবমারিন, কর্ভেট আর রিপ্লেনিস্মেন্ট কাম রিফিউলিং জাহাজ আর হেলিকপ্টার, আস্ত একটা বড়সড় স্কোয়াড্রন লাগবে, কম করে হলেও ১৫০০ লোকবল দরকার...

      Delete
    3. এই মুহুর্তে ব্রিটিশ রয়াল নেভির একটা হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার ক্যারিবিয়ানে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটা রয়েছে ভূমধ্যসাগরে। ফ্রান্সের একটা রয়েছে লেবাননের উপকূলে। ব্রিটিশ নৌবাহিনী এবং ডাচ নৌবাহিনীর মোট ৪টা জাহাজ এখন ভূমধ্যসাগরে। দেখে আসুন তো সেগুলি কতগুলি ফ্রিগেট, সাবমেরিন এবং কর্ভেট বা ডেস্ট্রয়ার এসকর্ট নিয়ে অপারেট করছে? এবং কয়টা বিমানের স্কোয়াড্রন নিয়ে অপারেট করছে? সিঙ্গাপুরের নৌবাহিনীতে রয়েছে ৪টা; পুরো নৌবাহিনীর সদস্যসংখ্যা ৯ হাজার। ফিলিপাইনও কিনেছে ২টা; তারা তাদের ইতিহাসে প্রথম মিসাইল ফ্রিগেট কয়েকদিন আগে হাতে পেয়েছে।

      বাংলাদেশের হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার রাখার সক্ষমতা নেই - এই কথাগুলি বাংলাদেশের নয়; দিল্লীর। ঠিক যেমনটা তারা বলেছিল বাংলাদেশ প্রথম সাবমেরিন কেনার পর। ভারতীয় যুক্তিতে একটা যুদ্ধজাহাজে একই কাজ কয়েকটা ডিভাইস করে; যেমন - কয়েকটা রাডার রাখা হয় (পাছে নষ্ট হয়ে যায়); দুই গুণ বেশি ক্ষেপণাস্ত্র রাখা হয় (পাছে মিসফায়ার করে)। ঐ ধরনের চিন্তাতে সবকিছুই বেশি বেশি দরকার হয়। তাদের হিসেবে চললে হেলিকপ্টার ক্যারিয়ারের সাথে টাগবোট এবং রিপেয়ার জাহাজও রাখা দরকার (পাছে মাঝ সমুদ্রে জাহাজ বসে যায়?) মোটকথা আত্মবিশ্বাসের অভাব। সর্বদাই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগাটা ভারতের রাষ্ট্রীয় চিন্তার অন্তর্গত; যা কিনা ব্রিটিশরা ভারতে রেখে দিয়ে গেছে। ভারতীয়রা সেটা থেকে বের হতে পারছে না।

      আশা করি উত্তরটা পেয়েছেন।

      Delete
    4. আমি বলিনি যে বাংলাদেশের সক্ষমতা নাই, বলেছি যে তাদের সে প্রস্তুতি আছে কিনা কারন বাংলাদেশ নৌবাহিনী এখনো গ্রীন ওয়াটার নেভীর মানসিকতা নিয়ে চলে যাদের কাছে ফ্রিগেট ই হল সবেধন নীলমনি অথচ অন্যরা লিটোরাল কম্বেট নিয়ে আছে।

      Delete