Saturday 15 August 2020

বৈরুত বিস্ফোরণের পর ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মাঝে লেবানন

১৫ই অগাস্ট ২০২০

লেবাননের উপকূলে ত্রাণসামগ্রী পাঠানোর ছত্রছায়ায় পূর্ব ভূমধ্যসাগরে গ্রীসের সহায়তায় শক্তি বৃদ্ধি করার ফরাসী কৌশলই বলে দিচ্ছে যে, ফ্রান্স তুরস্কের হুমকিকে কতটা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে। লেবাননের অর্থনৈতিক দৈন্যদশা এবং বৈরুত বিস্ফোরণ দেশের মানুষের জন্যে যতটা কঠিন সময় এনে দিয়েছে, ততটাই প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্ম দিয়েছে ভূমধ্যসাগরীয় শক্তিদের মাঝে।

গত ৯ই অগাস্ট ফরাসী নৌবাহিনীর হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার ‘টোনিয়েরে’ বিভিন্ন ত্রাণসামগ্রী এবং জরুরি সহায়তা নিয়ে ফ্রান্স থেকে লেবাননের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। লেবাননের রাজধানী বৈরুতে এমোনিয়াম নাইট্রেটের গুদামে বিস্ফোরণের পর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে যাওয়া বৈরুতে বিভিন্ন দেশ থেকে সহায়তা আসছে। ফ্রান্সের যুদ্ধজাহাজ প্রেরণও এই সহায়তার অংশ। ফরাসী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, এই জাহাজে খাদ্য সামগ্রী ও মেডিক্যাল সরঞ্জাম ছাড়াও রয়েছে সাড়ে তিন’শ জনের ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ, বৈরুত বন্দরের সার্ভে কাজের জন্যে হাইড্রোগ্রাফিক সরঞ্জাম ও নৌবাহিনীর ডুবুরি দল, ল্যান্ডিং ক্রাফট, হেলিকপ্টার, অগ্নি নির্বাপক দল, কন্সট্রাকশন সরঞ্জাম, ইত্যাদি। লেবাননের পথে মানবিক সহায়তা নিয়ে রওয়ানা হলেও ২১ হাজার টনের বিশাল এই যুদ্ধজাহাজের সক্ষমতা রয়েছে সাড়ে ৪’শ থেকে ৯’শ সৈন্য, ৪০টা ভারি ট্যাঙ্ক, ৪টা ল্যান্ডিং ক্রাফট এবং ২০ থেকে ৩৫টা হেলিকপ্টার বহণ করার। ১২ই অগাস্ট ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ এক টুইটার বার্তায় ঘোষণা দেন যে, পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের বিরুদ্ধে গ্রীসকে সহায়তা দানের উদ্দেশ্যে ফ্রান্স তার সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করতে যাচ্ছে। আর এর মাঝে হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার ‘টোনিয়েরে’ও রয়েছে। এই ঘোষণার সাথেসাথে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। মোটকথা ফ্রান্স পূর্ব ভূমধ্যসাগরে নিজের সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করতে লেবাননের ইস্যুটাকেই ব্যবহার করেছে, যা কিনা লেবাননে ফ্রান্স এবং অন্যান্য দেশের সহায়তা দেবার উদ্দেশ্যগুলিকে আলোচনায় নিয়ে আসে।

গত ৪ঠা অগাস্ট বৈরুতের বন্দর এলাকায় মারাত্মক বিস্ফোরণে দেশটার প্রধান খাদ্য গুদাম ধ্বংস হয়ে যাবার পর ‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে লেবাননের অর্থমন্ত্রী রাউল নেহমের বরাত দিয়ে বলা হয় যে, দেশটাতে এক মাসেরও কম সময়ের খাদ্যশস্যের মজুদ রয়েছে। তবে প্রতিবেদনে এও বলা হয় যে, এই গুদাম ধ্বংস হওয়াটাই প্রধান সমস্যা নয়। করোনা দুর্যোগের আগেই লেবাননের অর্থনীতি পুরোপুরি ধ্বসে পড়েছিল। আর একারণেই লেবাননের সরকারের পক্ষে খাদ্যদ্রব্য আমদানি করার জন্যে বৈদেশিক মুদ্রা যোগাড় করাই কঠিন হয়ে গেছে। লেবাননের আমদানিকারক সিন্ডিকেটের প্রধান হানি বোহসালি বলছেন যে, অন্যান্য দেশ সহায়তা না করলে দেশটা খাদ্যদ্রব্য সরবরাহের মারাত্মক ঝুঁকির মাঝে পড়বে। লেবাননের এই দুর্যোগকে আশেপাশের শক্তিশালী দেশগুলি লেবানন তথা পূর্ব ভূমধ্যসাগরে প্রভাব বৃদ্ধি করার সুযোগ হিসেবেই দেখেছে।

৬ই অগাস্ট ফরাসী প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ ছুটে যান বৈরুতে। ‘ডয়েচে ভেলে’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানি খিলাফতের পতনের পর ফরাসীরা লেবাননের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ১৯৪৩ সালে লেবাননকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা দেবার পরেও ফ্রান্স তার সেই প্রভাবখানা ধরে রেখেছে। লেবাননের মারোনাইট খ্রিস্টানরা ফ্রান্সকে তাদের রক্ষাকারী হিসেবেই দেখে। লেবাননের ক্ষমতাবান লোকেরা ফ্রান্সে বাড়ি বানিয়েছে, ফরাসী ভাষা শিখেছে, নিজেদের স্কুলে ফরাসী ভাষাকে মূল ভাষা হিসেবে শিক্ষা দিয়েছে। বৈরুতে ম্যাক্রঁর সফরকে অনেকেই লেবাননে ফ্রান্সের হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক এলি আবুআউন বলছেন যে, ফ্রান্স একা নয়, লেবাননে ইরান এবং সৌদি আরবের প্রভাব যথেষ্ট। লেবাননের বিশ্বাসগত বিভাজনের উপরই দেশটার রাজনীতি পুরোপুরি নির্ভরশীল। খ্রিস্টানদের সমর্থনদাতা হলো ফ্রান্স; শিয়াদের পিছনে রয়েছে ইরান; সুন্নিদের সমর্থন দিচ্ছে সৌদি আরব। যুক্তরাষ্ট্র এখানে ধীরে ধীরে তার প্রভাব বৃদ্ধি করছে। অপরদিকে রাশিয়া এবং তুরস্ক মোটে চেষ্টা শুরু করেছে। লেবাননের দীর্ঘ সময়ের গৃহযুদ্ধের শেষে ১৯৮৯ সালে তায়েফের সমঝোতার মাধ্যমে ঠিক করা হয় যে, লেবাননের পার্লামেন্টে ১’শ ২৮টা আসনের মাঝে ৪৩টা পাবে মারোনাইট খ্রিস্টানরা, ২৭টা পাবে সুন্নি মুসলিমরা, ২৭টা পাবে শিয়ারা, ২০টা পাবে ইস্টার্ন অর্থোডক্স খিস্টানরা, ৮টা পাবে দ্রুজরা, ২টা পাবে আলাওয়াতিরা এবং ১টা পাবে ইভানজেলিক্যাল খ্রিস্টানরা। ১৯৪৩ সালের নিয়ম অনুযায়ী দেশটার প্রেসিডেন্ট হবেন একজন মারোনাইট খ্রিস্টান এবং প্রধানমন্ত্রী হবেন একজন সুন্নি মুসলিম। এই ব্যবস্থায় মারোনাইট খ্রিস্টানরা ফ্রান্সের অধীনে যতটা সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল, তার পরিবর্তন করে মুসলিমদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়। তবে রাজনৈতিক বিভেদের এই ব্যবস্থায় লেবাননে কোনদিনই কোন শক্তিশালী সরকার গঠন করা সম্ভব হয়নি। আর বিদেশী শক্তিরা বিভিন্ন গ্রুপের পক্ষ নিয়ে লেবাননের রাজনীতিতে কলকাঠি নেড়েছে।

গত মার্চে লেবাননের সরকার ঘোষণা দেয় যে, দেশটা প্রথমবারের মতো ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের ঋণের কিস্তি ফেরত দিতে পারছে না। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব বলেন যে, এই ঋণের উপর সুদ পরিশোধ করাটা লেবাননের সক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, লেবাননের ব্যাঙ্কগুলি দেশটার নিজস্ব মুদ্রা থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় রূপান্তরে বাধা দেয়ার ফলে দেশটার মুদ্রার মান মারাত্মক কমে যায়; যার ফলশ্রুতিতে লেবানিজ পাউন্ড প্রায় মূল্যহীন হয় পড়ে। একইসাথে দেশটাতে খাদ্যদ্রব্য আমদানি করা দুষ্কর হয়ে যায়। ঋণদাতাদের নেতৃত্ব দেয়া ফ্রান্স চাইছে দেশটাতে রাজনৈতিক সংস্কার হোক। ‘রয়টার্স’ বলছে, ম্যাক্রঁ চাইছেন যে, লেবাননের রাজনৈতিক দলগুলিকে একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে রাজি করানো। এর মাধ্যমে অতি ঋণগ্রস্ত এই দেশটাকে একটা টেকনোক্র্যাট সরকারের অধীনে নিয়ে আসলে দাতা দেশগুলি লেবাননের জন্যে আবারও কয়েক বিলিয়ন ডলারের ঋণের ব্যবস্থা করবে।

লেবাননের অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যের কেন্দ্রে সিরিয়া বা আল-শামএর ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলে হওয়ায় দেশটার আকারের তুলনায় এর ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বেশি। পূর্ব ভূমধ্যসাগরে ফ্রান্স তার হারানো প্রভাব ফিরে পেতে যেমন লেবাননে তার অবস্থানকে শক্ত করতে চাইছে, তেমনি ইরান এবং সৌদি আরবও চাইছে তাদের অবস্থান যাতে কিছুতেই দুর্বল না হয়। সৌদি আরব, ইরান, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও আরও অনেক দেশ লেবাননে ত্রাণ সামগ্রী পাঠানো অব্যাহত রেখেছে। ব্রিটেন নৌবাহিনীর সার্ভে জাহাজ পাঠিয়েছে বৈরুত বন্দরকে চালু করায় সহায়তা দিতে। এর উপরে আবার তুরস্ক চাইছে বৈরুতের সমুদ্রবন্দরের উন্নয়ন করতে। অত্র অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের খেলায় সর্বশেষ খেলোয়াড় তুরস্ক। তবে লেবাননের উপকূলে ত্রাণসামগ্রী পাঠানোর ছত্রছায়ায় পূর্ব ভূমধ্যসাগরে গ্রীসের সহায়তায় শক্তি বৃদ্ধি করার ফরাসী কৌশলই বলে দিচ্ছে যে, ফ্রান্স তুরস্কের হুমকিকে কতটা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে। লেবাননের অর্থনৈতিক দৈন্যদশা এবং বৈরুত বিস্ফোরণ দেশের মানুষের জন্যে যতটা কঠিন সময় এনে দিয়েছে, ততটাই প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্ম দিয়েছে ভূমধ্যসাগরীয় শক্তিদের মাঝে।

No comments:

Post a Comment