Thursday 27 August 2020

যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মাঝে নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতা কেন?

২৮শে অগাস্ট ২০২০ 

রাশিয়া সোভিয়েত আমলের ৫০ মেগাটনের বোমা পরীক্ষার ডকুমেন্টারি প্রকাশ করলো এমন সময়ে, যখন কথা উঠছে যে, রাশিয়া এমন এক ধরনের অস্ত্র ডেভেলপ করছে, যা কিনা সাবমেরিন থেকে ছোঁড়া যাবে এবং যা প্রায় ১’শ মেগাটনের পারমাণবিক ওয়ারহেড বহণ করবে। এরকম বোমা যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলের কাছে সমুদ্রের নিচে বিস্ফোরণ ঘটালে ভয়াবহ তেজস্ক্রিয় সুনামিতে নিউ ইয়র্কসহ উপকূলের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ শহরই ধ্বংস হয়ে যাবে। আর তা মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে পুরোপুরিভাবে বাইপাস করবে। রাশিয়াকে চাপে রাখার যুক্তরাষ্ট্রের নীতিই রাশিয়াকে দুনিয়া বিধ্বংসী অস্ত্র ডেভেলপের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রাশিয়ার ভৌগোলিক অখন্ডতার চ্যালেঞ্জ রাশিয়াকে প্রতিযোগিতামূলক অস্ত্র তৈরিতে আরও বেশি আক্রমণাত্মক করে তুলতে পারে।



গত ২০শে অগাস্ট রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় আণবিক শক্তি কোম্পানি ‘রসাটম’ একটা ডকুমেন্টারি প্রকাশ করে। এতে ১৯৬১ সালের অক্টোবর মাসে বিশ্বের সবচাইতে শক্তিশালী পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা করার কার্যক্রম দেখানো হয়। ২৭ টন ওজনের এবং ২৬ ফুট লম্বা এই বিশাল বোমাটা রাশিয়ার উত্তরের অতিশীতল আর্কটিক সাগরের নোভায়া জেম্বলিয়া দ্বীপের উপর একটা ‘তুপোলেভ ৯৫’ বোমারু বিমান থেকে নিক্ষেপ করা হয়। বিস্ফোরণের ‘মাশরুম ক্লাউড’ ৬৫ কিঃমিঃ উচ্চতা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ৫০ মেগাটন বা ৫০ হাজার কিলোটন শক্তির এই হাইড্রোজেন বোমার অফিশিয়াল নাম ‘আরডিএস ২২০’ হলেও একে এখন ‘জার বম্বা’ বলেই ডাকা হচ্ছে। বোমাটা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, বোমারু বিমানের পাইলটরা কয়েক ঘন্টা পর ল্যান্ডিং করার সময় ৮’শ কিঃমিঃ দূর থেকেও এই বিস্ফোরণের ‘মাশরুম ক্লাউড’ দেখেছিলেন। বোমার প্রচণ্ডতায় কয়েক’শ কিঃমি দূরের বাড়িঘর ধ্বসে পড়েছিল অথবা জানালা ভেঙ্গে গিয়েছিল। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমা শহরের উপর যে পারমাণবিক বোমা ফেলেছিল, তার শক্তি ছিল ১৫ কিলোটন। ১৯৫৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সবচাইতে শক্তিশালী ‘ক্যাসল ব্রাভো’ পারমাণবিক পরীক্ষার শক্তি ছিল ১৫ মেগাটন। ‘পপুলার মেকানিকস’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ১৯৬৩ সালে বাতাসে পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা করা বন্ধের পর থেকে এরকম বোমা পরীক্ষা বিশ্ব আর দেখেনি। এরপর কয়েক দশকে ছোট আকারের পারমাণবিক বোমা ডিজাইন করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়; উদ্দেশ্য ছিল বোমার সংখ্যা বাড়িয়ে দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে অনেকগুলি শহরের উপর একসাথে পুংখানুপুখভাবে হামলা করা। আণবিক বিষয়ের ইতিহাস নিয়ে কাজ করা গবেষক রবার্ট নরিস ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’কে বলছেন যে, রুশরাই বারংবার মনে করিয়ে দিয়েছে যে, হাইড্রোজেন বোমা ব্যবহার করারটা কেন চিন্তাও করা উচিৎ নয়। তারা তাদের বিরাট আকারের বোমা পরীক্ষার মাধ্যমে বোমা ব্যবহারের ব্যাপারে ভীতির সঞ্চার করতে চেয়েছে। তবে নরিসের এই বক্তব্য থেকে যে প্রশ্নটা সামনে এসে যায় তা হলো, প্রায় ছয় দশক পর রাশিয়া এই বিশাল বোমা পরীক্ষার ডকুমেন্টারি কেন প্রকাশ করলো?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সরকারের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার প্রধান ফিলিপ কোইল ‘বিবিসি’র সাথে এক সাক্ষাতে বলেন যে, ১৯৬০এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক প্রযুক্তিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বহু এগিয়ে ছিল। সোভিয়েতরা চাইছিল মানুষ সোভিয়েত ইউনিয়নকে যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ হিসেবে চিন্তা করুক। একারণেই তারা ‘জার বম্বা’র মতো এতো বড় বোমা পরীক্ষা করেছিল। এমনকি এই বোমা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, সোভিয়েতরাও চাইছিল না যে, পূর্ণ শক্তি নিয়ে এটা পরীক্ষা করা হোক; যেকারণে তারা বোমার ডিজাইন করার সময়েই সীসা ব্যবহার করে এর শক্তিকে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করেছিল। পারমাণবিক অস্ত্রের মতো ধ্বংসাত্মক অস্ত্রের ক্ষেত্রেও আকার নিয়ে কথা বলাটা অদ্ভূত শোনাতে পারে, যেখানে ছোট বোমাগুলিই এককেকটা শহর ধ্বংস করে দিতে সক্ষম। এত বড় বোমার ব্যবহারিক দিকের চাইতে মনস্তাত্বিক দিকটাই বেশি গুরত্বপূর্ণ ছিল।

প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির পাবলিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল এফেয়ার্সএর প্রফেসর ফ্রাঙ্ক ভন হিপেল বলছেন যে, সোভিয়েত আণবিক গবেষক আন্দ্রেই সাখারভ ঠান্ডা যুদ্ধের সময় ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ার ঘোর বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৬৭ সালে এক গোপন চিঠিতে তিনি সোভিয়েত নেতৃবৃন্দের কাছে লিখেন যে, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা অনেক বাড়িয়ে দেবে। সাখারভের কথায় বেশ যুক্তি ছিল। ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে পারমাণবিক অস্ত্র ছোঁড়ার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি অকার্যকর হয়ে গেলে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে এড়াতে সক্ষম নতুন ধরনের অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা শুরু হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯০এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র চিন্তা করা শুরু করে যে, কোন ‘অবাধ্য’ রাষ্ট্র যদি পারমাণবিক বোমা এবং দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপ করে ফেলে, তাহলে তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করবে। কারণ সেরকম ‘আবাধ্য’ রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের যেমন কৌশলগত চুক্তি ছিল, তেমন কোন চুক্তি দ্বারা আবদ্ধ থাকবে না। তবে এতে মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরসুরী রাশিয়ার। কারণ এতে রাশিয়ার পারমাণবিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলিও তাদের কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে; এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনেক পিছিয়ে পড়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়।

২০১৯এর অগাস্টে যুক্তরাষ্ট্র ‘ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস’ ‘আইএনএফ’ বা মধ্যম পাল্লার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ন্ত্রণের চুক্তি থেকে নিজেকে বের করে নেবার ঘোষণা দেবার পর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সাবধান করে দিয়ে বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপ করার ব্যাপারে যথেষ্ট তথ্য পেলে রাশিয়াও তেমন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপ করতে বাধ্য হবে। পুতিনের কথাগুলিতে সেই পিছিয়ে পড়ার ভয়ই চলে আসে, যা কিনা সোভিয়েতদের ১৯৬০এর পারমাণবিক কর্মকান্ডে প্রকাশ পেয়েছিল।

ইউক্রেনকে নিজ নিয়ন্ত্রণ থেকে হারাবার পরই রাশিয়া নিজের ভৌগোলিক অখন্ডতা রক্ষার ব্যাপারে সাবধান হতে শুরু করে। ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেবার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার উপর অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। এমতাবস্থায় ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ভয়ই রাশিয়াকে নতুন অস্ত্র প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে বাধ্য করছে, যার মাধ্যমে স্বল্প সামরিক বাজেটে রাশিয়া নিজের জাতীয় স্বার্থকে রক্ষা করতে পারবে। রাশিয়া সোভিয়েত আমলের ৫০ মেগাটনের বোমা পরীক্ষার ডকুমেন্টারি প্রকাশ করলো এমন সময়ে, যখন কথা উঠছে যে, রাশিয়া এমন এক ধরনের অস্ত্র ডেভেলপ করছে, যা কিনা সাবমেরিন থেকে ছোঁড়া যাবে এবং যা প্রায় ১’শ মেগাটনের পারমাণবিক ওয়ারহেড বহণ করবে। মার্কিন বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, এরকম বোমা যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলের কাছে সমুদ্রের নিচে বিস্ফোরণ ঘটালে ভয়াবহ তেজস্ক্রিয় সুনামিতে নিউ ইয়র্কসহ উপকূলের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ শহরই ধ্বংস হয়ে যাবে। আর ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, তা মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে পুরোপুরিভাবে বাইপাস করবে। রাশিয়াকে চাপে রাখার যুক্তরাষ্ট্রের নীতিই রাশিয়াকে দুনিয়া বিধ্বংসী অস্ত্র ডেভেলপের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রাশিয়ার ভৌগোলিক অখন্ডতার চ্যালেঞ্জ রাশিয়াকে প্রতিযোগিতামূলক অস্ত্র তৈরিতে আরও বেশি আক্রমণাত্মক করে তুলতে পারে। 

No comments:

Post a Comment