Saturday 22 August 2020

ভ্যাকসিন যুদ্ধ ... ক্ষয়িষ্ণু বিশ্বব্যবস্থার উপর আরেক আঘাত

২২শে অগাস্ট ২০২০

কোন দেশ কার কাছ থেকে ভ্যাকসিন কিনবে, সেটা নিয়েও শুরু হয়েছে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা। বহুজাতিক ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলির মাঝে চলছে মুনাফার প্রতিযোগিতা। শীঘ্রই গরীব দেশগুলিতে ভ্যাকসিন সরবরাহ নিয়ে শক্তিশালী দেশগুলির মাঝে শুরু হবে স্থূল প্রতিযোগিতা। বৈদেশিক আর্থিক সহায়তা এবং পশ্চিমা দেশে ভ্রমণের শর্ত হিসেবে ভ্যাকসিনের উৎসকে যাচাই করা হলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না। সামনের মাসগুলিতে ভূরাজনৈতিক প্রভাব এবং মুনাফাবৃত্তির এই প্রকাশ্য প্রতিযোগিতা করোনা আক্রান্ত ক্ষয়িষ্ণু বিশ্বব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করবে।



করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন ফাইনাল হবার আগেই কয়েকটা দেশ কোটি কোটি ডোজের ভ্যাকসিনের অর্ডার করে ফেলেছে। ‘ডয়েচে ভেলে’ বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং আরও কিছু পশ্চিমা দেশ আগেভাগেই বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির কাছ থেকে ভ্যাকসিনের অর্ডার করে ফেলেছে, যাতে করে এবছর শেষের আগেই তাদের হাতে একটা কার্যকর ভ্যাকসিন থাকে। যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত ১০ বিলিয়ন ডলার খরচে প্রায় ৭০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিনের অর্ডার করেছে। রাশিয়া এবং চীনও ভ্যাকসিন আবিষ্কারে পশ্চিমা বিশ্বের বিকল্প নিয়ে হাজির হবার যারপরনাই চেষ্টা করে যাচ্ছে। এখন এই ‘ভ্যাকসিন যুদ্ধে’র মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা নিয়ে কথা বলছেন অনেকেই।

‘জাপান টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ১৯৫৭ সালে প্রথম রুশ মহাকাশ স্যাটেলাইট ‘স্পুতনিক’ যেমন মহাকাশ প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছিল, এখন ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের প্রথম ভ্যাকসিন বাজারে আনার পিছনেও তেমনই ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। রাশিয়ার ভ্যাকসিনের নাম ‘স্পুতনিক ৫’ রাখার নামকরণের স্বার্থকতা হয়তো সেখানেই। প্রতিবেদনে আরও বলা হচ্ছে যে, ফলাও করে ভ্যাকসিনের ঘোষণা দেবার পিছনে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের স্বার্থ রয়েছে যথেষ্টই। দেশটার অর্থনীতি ধুঁকে ধুঁকে চলছে, আর ভাইরাসের আগমণের পর দেশের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। ক্রমান্বয়ে নিম্নগামী জনসমর্থনের লাগাম টানতে এই ভ্যাকসিন পুতিনকে সহায়তা করতে পারে। আর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও এটা রাশিয়ার অবস্থানকে শক্তিশালী করতে পারে। রাশিয়ার মতো চীনও প্রথম ভ্যাকসিন বাজারে আনতে ব্যাপক প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। একটা চীনা সরকারি কোম্পানি জুলাই মাসেই তার শীর্ষ কর্মকর্তাদেরকে ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক ডোজ দিয়েছে। ভ্যাকসিনের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে পুতিন নিজেও তার কন্যাকে ভ্যাকসিন দিয়েছেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও নভেম্বরের নির্বাচনের আগে আগেই ভ্যাকসিন যোগার করাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছেন।

রাশিয়া এবং চীনের ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে পশ্চিমা গবেষকেরা সন্দেহ প্রকাশ করছেন। তারা বলছেন যে, ভ্যাকসিন যদি এখন কাজও করে, সেটা কতদিন কার্যক্ষম থাকবে, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত দিতে সময় লাগবে। ইউনিভার্সিটি অব সাউদাম্পটনের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ডক্টর মাইকেল হেড বলছেন যে, ভ্যাকসিন কাজ করবে কি করবে না, এই মুহুর্তে এটা নিশ্চিত করে বলাটা বেশ কঠিন। তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের শক্তিশালী ইতিহাস থাকায় অনেকেই রাশিয়ার ভ্যাকসিনের দাবিকে এড়িয়ে যেতেও পারছেন না। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘আটলান্টিক কাউন্সিল’এর ডিসটিনগুইশড ফেলো ড্যানিয়েল ফ্রীড বলছেন যে, প্রথম ভ্যাকসিন যে দেশ বাজারে আনতে পারবে, সে বিশ্বব্যাপী যথেষ্ট সন্মানজনক একটা অবস্থান পাবে।

শক্তিশালী দেশগুলি ভ্যাকসিনের পিছনে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, ব্রিটিশ সরকার তার ৬ কোটি ৬০ লক্ষ জনগণের জন্যে মোট ৬ প্রকারের ৩৪ কোটি ডোজের ভ্যাকসিনের অর্ডার করেছে। ব্রিটিশ ভ্যাকসিন টাস্কফোর্সের প্রধান কেইট বিংহ্যাম বলছেন যে, ব্রিটেন বিভিন্ন উৎস থেকে তার ভ্যাকসিনের সরবরাহ নিশ্চিত করতে চাইছে। ভ্যাকসিনের প্রথম দিককার পরীক্ষামূলক ফলাফলগুলির দিকে ব্রিটেন দৃষ্টি রাখবে, যাতে বোঝা যায় যে, কোন ভ্যাকসিনটা ঠিকমতো কাজ করছে। ‘জনসন এন্ড জনসন’ কোম্পানি ব্রিটেনকে ৩ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন সরবরাহ করবে; সফল হলে এর সাথে আরও ২ কোটি ২০ লক্ষ ডোজ যোগ হবে। এর সাথে রয়েছে ‘নোভাভ্যাক্স’ থেকে ৬ কোটি ডোজ। ইউরোপিয়ান কমিশন ঘোষণা দিয়েছে তারা ‘এসট্রা জেনেকা’ কোম্পানির কাছ থেকে ৩০ কোটি ভ্যাকসিন অর্ডার করেছে। একই কোম্পানি ব্রিটেনকে দেবে ১০ কোটি ভ্যাকসিন; আর যুক্তরাষ্ট্রকে দেবে ৩০ কোটি। জুলাই মাসে ‘বায়ো এনটেক’ এবং ‘ফাইজার’এর যৌথ উদ্যোগের কাছ থেকে ব্রিটেন ৯ কোটি ভ্যাকসিনের অর্ডার করে; একই কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ১০ কোটি ডোজ বিক্রি করছে। ‘মার্কেট ওয়াচ’ বলছে, এই প্রতিটা কোম্পানিই অর্থনৈতিক ধ্বসের মাঝেও শেয়ার বাজারে ব্যাপক ভালো করছে। ‘নোভাভ্যাক্স’এর শেয়ার মূল্য মে মাস থেকে প্রায় ৭ গুণ হয়েছে! মার্চ থেকে ‘বায়ো এনটেক’এর শেয়ারমূল্য ১৩৬ শতাংশ বেড়েছে! এছাড়াও এপ্রিল থেকে ‘ফাইজার’এর মূল্য বেড়েছে ৩৯ শতাংশ; মার্চ থেকে ‘এসট্রা জেনেকা’র মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৬ শতাংশ। বহুজাতিক কর্পোরেটগুলি বিলিয়ন ডলারের মুনাফা করে নিচ্ছে; কিন্তু ধনী দেশগুলির জনসংখ্যার কয়েক গুণ ভ্যাকসিন অর্ডার করার উদ্দশ্য আসলে কি?

‘ওয়েলকাম ট্রাস্ট’ হেলথ চ্যারিটির গ্লোবাল পলিসির প্রধান এলেক্স হ্যারিস বলছেন যে, এভাবে ধনী দেশগুলি ভ্যাকসিনের অর্ডার করতে থাকলে গরীব দেশগুলি নিজেদের জন্যে কোন ভ্যাকসিনই পাবে না। ‘ডয়েচে ভেলে’ বলছে যে, গরীব দেশগুলির জন্যে বিনিয়োগ করতে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলি সর্বদাই কার্পণ্য করেছে। ধনী দেশগুলির কাছে বেশি মূল্যে ভ্যাকসিন বা ঔষধ বিক্রি করতে পারে বলেই তারা কখনো গরীব দেশগুলির দিকে তাকাবার প্রয়োজন মনে করে না।

নভেম্বরের নির্বাচনকে মাথায় রেখে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলছেন যে, নভেম্বরের মাঝেই যুক্তরাষ্ট্রের হাতে ভ্যাকসিন চলে আসবে। ব্রিটেনে জনমত তৈরি করা হচ্ছে, যাতে গরীব দেশগুলিতে ব্রিটেন ভ্যাকসিন দেবার মাধ্যমে তার ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করে। জনসংখ্যার ৫ গুণ ভ্যাকসিন কিনছে ব্রিটেন! রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন চাইছেন ‘স্পুতনিক ৫’ ভ্যাকসিনকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়ে ঠান্ডা যুদ্ধের ‘স্পুতনিক’ স্যাটেলাইটের মতোই রাশিয়ার হারিয়ে যাওয়া গৌরব ফিরিয়ে আনতে; একারণে নিজের মেয়েকেও পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন দিতে ছাড়েননি তিনি। বিশ্বব্যাপী নিজেদের ডেভেলপ করা ভ্যাকসিন বিক্রির উদ্যোগ হিসেবে ২১শে অগাস্ট চীনারা ইন্দোনেশিয়ার কাছে ৪ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন বিক্রির চুক্তি করেছে। কোন দেশ কার কাছ থেকে ভ্যাকসিন কিনবে, সেটা নিয়েও শুরু হয়েছে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা। বহুজাতিক ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলির মাঝে চলছে মুনাফার প্রতিযোগিতা। শীঘ্রই গরীব দেশগুলিতে ভ্যাকসিন সরবরাহ নিয়ে শক্তিশালী দেশগুলির মাঝে শুরু হবে স্থূল প্রতিযোগিতা। বৈদেশিক আর্থিক সহায়তা এবং পশ্চিমা দেশে ভ্রমণের শর্ত হিসেবে ভ্যাকসিনের উৎসকে যাচাই করা হলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না। সামনের মাসগুলিতে ভূরাজনৈতিক প্রভাব এবং মুনাফাবৃত্তির এই প্রকাশ্য প্রতিযোগিতা করোনা আক্রান্ত ক্ষয়িষ্ণু বিশ্বব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করবে।

No comments:

Post a Comment