Sunday 16 August 2020

ইস্রাইলের সাথে আমিরাতের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের গুরুত্ব কতটুকু?

১৬ই অগাস্ট ২০২০ 


সকলেই আমিরাত এবং ইস্রাইলের চুক্তির ইস্যুটাকে ব্যবহার করবে; শুধু ফিলিস্তিনের জনগণ ছাড়া। আবারও প্রমাণিত হলো যে, মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব ফিলিস্তিনের জনগণের ব্যাপারে কতটা উদাসীন। এই ঘটনা বিশ্বব্যাপী মুসলিম দেশগুলির নেতৃবৃন্দকে জনগণের সামনে হেয় করবে এবং মুসলিমদেরকে যোগ্য নেতৃত্ব খুঁজতে আরও বেশি আগ্রহী করে তুলবে।




১৩ই অগাস্ট মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন যে, ইস্রাইল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত তাদের সম্পর্ক পুরোপুরি স্বাভাবিক করতে সম্মত হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী ইস্রাইল পশ্চিম তীরে নতুন করে ফিলিস্তিনি এলাকা দখল করার পরিকল্পনা আপাততঃ স্থগিত রাখবে। হোয়াইট হাউজের বরাত দিয়ে ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, তিন দেশের প্রতিনিধিদের দীর্ঘ আলোচনার পরই এই চুক্তি সম্ভব হয়েছে। ইস্রাইল এবং আমিরাতের একটা যৌথ বিবৃতি টুইটারে দেয়ার মাধ্যমে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এটাকে একটা ‘বিরাট অর্জন’ বলে আখ্যা দেন। যৌথ বিবৃতিতে বলা হয় যে, সামনের দিনগুলিতে দুই দেশের প্রতিনিধিরা বিনিয়োগ, পর্যটন, সরাসরি ফ্লাইট, নিরাপত্তা, টেলিকমিউনিকেশন্স, এবং অন্যান্য ইস্যু নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করবে। হোয়াইট হাউজে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে ট্রাম্প বলেন যে, তিনি আশা করছেন যে, অত্র অঞ্চলের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলিও আমিরাতের পথ অনুসরণ করবে। এই চুক্তির ফলে আমিরাত তৃতীয় মুসলিম দেশ হিসেবে ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করলো। এর আগে ১৯৭৭ সালে মিশর এবং ১৯৯৪ সালে জর্দান সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছিল।

ফিলিস্তিন, ইরান, তুরস্ক চুক্তির বিপক্ষে

ফিলিস্তিনি গ্রুপগুলি এই চুক্তির সরাসরি বিপক্ষে কথা বলেছে। হামাস বলেছে যে এই চুক্তি পিছন থেকে বিশাসঘাতকের ছুরিকাঘাতের মতো। ফাতাহ গ্রুপ বলছে যে, আমিরাত ফিলিস্তিনের প্রতি তাদের জাতীয়, ধর্মীয় এবং মানবিক দ্বায়িত্বকে অস্বীকার করেছে। এক টুইটার বার্তায় প্যালেস্টিনিয়ান লিবারেশন অর্গানাইজেশনের এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্য হানান আশরাউই বলেন যে, আমিরাত ইস্রাইলের সাথে তাদের গোপন বোঝাপরাকে এখন সামনে নিয়ে আসলো। ফিলিস্তিনের গ্রুপগুলির সাথে সরাসরি একাত্মতা জানিয়েছে তুরস্ক এবং ইরান। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে এই চুক্তিকে মুসলিম বিশ্বের জন্যে পিছন থেকে ছুরিকাঘাতের শামিল বলে বলা হয়। একইসাথে এটাকে ‘কৌশলগত নির্বুদ্ধিতা’ বলেও আখ্যা দেয়া হয়। লেবাননের টেলিভিশনের সাথে সাক্ষাতে ইরান সমর্থিত হিযবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ প্রায় একই ধরনের কথা বলেন। তিনি আরও বলেন যে, আরও কিছু আরব দেশ সম্ভবতঃ আমিরাতকে অনুসরণ করবে। তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে ফিলিস্তিনের পক্ষে থাকার কথা বলা হয়। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান বলেন যে, আমিরাতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে রাষ্ট্রদূতকে দেশে ফিরিয়ে আনার কথা ভাবছে তুরস্ক।

আরব দেশগুলি চুক্তির পক্ষে 
 
১৪ই অগাস্ট বাহরাইনের সরকারি বার্তা সংস্থা ‘বিএনএ’ বলছে যে, আমিরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদকে ফোন করে অভিনন্দন জানান বাহরাইনের বাদশাহ হামাদ বিন ঈসা আল খলিফা। চুক্তিটাকে ‘ঐতিহাসিক সফলতা’ আখ্যা দিয়ে বাদশাহ বলেন যে, এর ফলে আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিরাট সুবিধা পাওয়া যাবে। এক টুইটার বার্তায় মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ এল সিসি চুক্তিকে স্বাগত জানান এবং বলেন যে, তিনি ব্যাপারটাকে আগ্রহের সাথে দেখছেন। ওমানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে দেশটার সরকারি বার্তা সংস্থা ‘ওমান নিউজ এজেন্সি’ বলে যে, আমিরাত এবং ইস্রাইলের এই ‘ঐতিহাসিক’ চুক্তিকে ওমান স্বাগত জানাচ্ছে। ইস্রাইলের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ইস্রাইলের সংবাদ সংস্থা ‘কেএএন’ বলছে যে, আমিরাতের পর বাহরাইনও সম্ভবতঃ ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তবে দুই দেশ এখনও অফিশিয়ালি কোন বিবৃতি দেয়নি। ইস্রাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু মিশর, ওমান এবং বাহরাইনকে সমর্থন দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। এখন পর্যন্ত এই চুক্তির ব্যাপারে সৌদি আরব কোন কিছু বলা থেকে বিরত থেকেছে। তুর্কি মিডিয়া ‘আনাদোলু এজেন্সি’ বলছে যে, আরব লীগও কোন বিবৃতি দেয়নি। কুয়েত এবং কাতার থেকেও এখনো কোন বিবৃতি পাওয়া যায়নি। 

এশিয়ার মুসলিম দেশগুলি সরাসরি কথা বলছে না

একই দিনে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বার্তায় বলা হয় যে, আমিরাত এবং ইস্রাইলের চুক্তিকে পাকিস্তান সরকার গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। এর ফলাফল সুদূরপ্রসারী হবে বলে এতে বলা হয়। একইসাথে বলা হয় যে, ফিলিস্তিনের জনগণের অধিকার আদায়ে পাকিস্তানের দায়বদ্ধতা রয়েছে। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি এবং স্থিতিশীলতাও পাকিস্তানের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ। তবে চুক্তির পক্ষে বা বিপক্ষে সরাসরি কোন বক্তব্য এই বিবৃতিতে ছিল না।

‘দ্যা স্ট্রেইটস টাইমস’ বলছে যে, পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি থেকে এখন পর্যন্ত চুক্তির ব্যাপারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া এসেছে। ১৪ই অগাস্ট ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তেউকু ফাইজাসিয়া বলেন যে, এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত তাদের কোন বক্তব্য নেই। প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ফাদিরোয়েল রাচমানও কোন মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। মালয়েশিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহামদ ‘দিস উইক ইন এশিয়া’র সাথে সাক্ষাতে আশংকা প্রকাশ করে বলেন যে, এর ফলে মুসলিম বিশ্বের মাঝে বিভাজনের সৃষ্টি হবে এবং ইস্রাইলিরা এতে জ্বালানি ঢালবে। ১৫ই অগাস্ট মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিশামুদ্দিন হুসেইন এক বিবৃতিতে বলেন যে, এই চুক্তি আমিরাতের সার্বভৌম অধিকারের ব্যাপার। তবে তিনি ফিলিস্তিনের আলাদা দেশের অধিকার আদায়ের পক্ষে মালয়েশিয়ার সমর্থন অব্যাহত থাকবে বলে বলেন।

অমুসলিম দেশগুলি খুশি

এক টুইটার বার্তায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেন যে, এই চুক্তি অনেক বড় একটা সুখবর। তিনি বলেন যে, পশ্চিম তীরে আরও ভূমি দখলের ইস্রাইলি পরিকল্পনা এগিয়ে না নেয়ার কারণে তিনি আশা দেখছেন, কারণ এতে আরও শান্তিপূর্ণ মধ্যপ্রাচ্য দেখা যাবে। ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জঁ ইভস লে ড্রিয়ান বলেন যে, চুক্তিকে ফ্রান্স স্বাগত জানিয়েছে এবং আরও বলেন যে, পশ্চিম তীরে ইস্রাইলের নতুন করে বসতি স্থাপন বন্ধ করাটা একটা ভালো কাজ হয়েছে। ইউরোপিয়ান কমিশনের মুখপাত্র নাবিলা মাসরালি বার্তা সংস্থা ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’কে বলেন যে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এই চুক্তিকে স্বাগত জানাচ্ছে এবং তারা মনে করছে যে, সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ উভয় পক্ষের জন্যে মঙ্গল বয়ে আনবে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার দিকে ধাবিত করবে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বলেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির মাঝে উত্তেজনা প্রশমনে পদক্ষেপ নেয়ায় চীন খুশি হয়েছে, যা কিনা অত্র অঞ্চলে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা আনতে সহায়তা করবে। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রিভাস্তাভা বলেন যে, ভারত এই চুক্তিকে স্বাগত জানায়। তিনি আরও বলেন যে, ভারত পশ্চিম এশিয়াতে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়ন দেখতে চায়; কারণ ভারত এই অঞ্চলকে তার নিজের প্রতিবেশী বলেই মনে করে।


১২ই অগাস্ট। হোয়াইট হাউজে বিজয়ীর বেশে ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্র আবারও প্রমাণ করলো যে, মধ্যপ্রাচ্যে তার অবস্থান আগের মতো শক্তিশালী না হলেও অত্র অঞ্চলের নেতৃত্বের উপর তার যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ট্রাম্প নির্বাচনের আগে আগেই একটা বড় জয় পেলেন, যা কিনা তার নির্বাচনে ভালো ফলাফলের পিছনে অনুপ্রেরণা দেবে।


কে কি চাইছে?

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ব্রুকিংস ইন্সটিটিউট’এর ভিজিটিং ফেলো জেফরি ফেল্টম্যান বলছেন যে, আমিরাতের সাথে চুক্তির ফলে ইস্রাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে এখন আপাততঃ পশ্চিম তীরের বসতির প্রকল্প নিয়ে এগুতে হবে না। মার্কিন নির্বাচনের আগে এধরনের প্রকল্প নিলে যদি জো বাইডেন হোয়াইট হাউজে চলে আসেন, তাহলে নেতানিয়াহু বিপদে পড়ে যেতে পারতেন। ব্রুকিংসএর সিনিয়র ফেলো তামারা কফম্যান উইটস এর সাথে যুক্ত করে বলছেন যে, আমিরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদও মার্কিন নির্বাচনকে মাথায় রেখেই হিসেব কষেছেন। ডেমোক্র্যাটরা যেহেতু সৌদিদের সমর্থক নয়, সেহেতু আমিরাতের অবস্থানকে তিনি সৌদিদের থেকে কিছুটা আলাদা করেই রাখতে চাচ্ছেন, যাতে করে হোয়াইট হাউজে ডেমোক্র্যাটরা চলে আসলে তিনি বিপদে পড়ে না যান। ‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর ‘জি জিরো মিডিয়া’ বলছে যে, এই চুক্তি থেকে দু’টা ব্যাপার সামনে আসবে। প্রথমতঃ নভেম্বরের মার্কিন নির্বাচনের আগে আগে এটা ট্রাম্প প্রশাসনের জন্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিজয়। নির্বাচন যথেষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতে পারে বিধায় ট্রাম্পের মধ্যস্ততায় এরকম একটা চুক্তি প্রশাসনের জন্যে বড় সাফল্য। আর দ্বিতীয়তঃ এটা প্রমাণ হলো যে, ফিলিস্তিন শান্তি আলোচনায় অগ্রগতি না হওয়াটা এখন থেকে আরব দেশের সরকারগুলির জন্যে ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে থাকবে না। 

ব্রিটেনের ‘দ্যা টেলিগ্রাফ’ পত্রিকা বলছে যে, আমিরাত এবং ইস্রাইলের চুক্তির পিছনে মূল কারণ হলো ইরান। ইস্রাইলের প্রাক্তন কূটনীতিবিদদের বরাত দিয়ে পত্রিকাটা বলছে যে, ইরানের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে একটা শক্তিশালী ফ্রন্ট গঠন করার লক্ষ্যেই এই চুক্তি করা হয়েছে। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা একই সুরে বলছে যে, মূলতঃ ইস্রাইল এবং আমিরাত অভিন্ন শত্রুর কারণে নিজেদের মাঝে শান্তি করেছে। ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ ইয়ান ব্রেমার আরও ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন যে, এই মুহুর্তে আরব দেশগুলির নেতৃত্বের কাছে অনেকগুলি ইস্যু রয়েছে যেগুলি ফিলিস্তিনের ইস্যুর চাইতে তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ; উদাহরণস্বরূপ তিনি ইয়েমেন, সিরিয়া, লিবিয়া, ইত্যাদি সমস্যার কথা উল্লেখ করেন। মাত্র এক দশক আগেও যখন এই সমস্যাগুলি আরব নেতৃত্বের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, তখন ইস্রাইলের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের প্রশ্নই ওঠেনি। অভিন্ন শত্রু ইরান এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাদের কাছে; ফিলিস্তিনের শান্তিচুক্তি নয়। এটা এখন প্রমাণ হলো যে, কোনকিছু ছেড়ে না দিয়েই ইস্রাইল মধ্যপ্রাচ্যে তাদের অবস্থানকে সংহত করেছে। আর এটা অর্জন করতে ইস্রাইলিদের জন্যে ফিলিস্তিনিদের সাথে কথাও বলতে হয়নি। ফিলিস্তিনিদের জন্যে এটা যতটাই দুঃখজনক হোক না কেন, তা-ই ঘটেছে। প্যালেস্টিনিয়ান সেন্ট্রাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসএর হিসেবে ২০২০ সালের শুরুতে ফিলিস্তিনি যুবাদের মাঝে ৪২ শতাংশ মানুষ বেকার; অনেকেই অনাহারে অর্ধাহারে রয়েছে। আর এর থেকে পরিত্রাণ পাবার কোন সম্ভাবনাই তাদের নেই।

তবে চুক্তির পিছনে ইরানকে একমাত্র কারণ হিসেবে ভাবলে আমিরাতের সাথে ইরানের সাম্প্রতিক সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টাগুলিকে এড়িয়ে যাওয়া হবে। গত বছরের অক্টোবরে ইরানের সাংসদ আকবর তোরকি বলেন যে, আমিরাত বাজেয়াপ্ত করা ৭’শ মিলিয়ন ডলারের ইরানি সম্পদ ইরানকে ফেরত দিয়েছে। দুই দেশের মাঝে আর্থিক লেনদেনও শুরু হয়েছে। গত জুন মাসে ‘আল জাজিরা’র সাথে কথা বলতে গিয়ে ইরানের নেতৃত্বের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল ইয়াহিয়া রহিম সাফাভি বলেন যে, দুই দেশের মাঝে সম্পর্ক উন্নয়ন হয়েছে এবং ইরান রাজি রয়েছে সৌদিদের সাথে আলোচনায় বসতে। তিনি মূলতঃ ইয়েমেনের যুদ্ধের জন্যে সৌদিদের দায়ী করেন; তবে আমিরাতের সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকেন। ২০১৯ থেকে লিবিয়া ইস্যু নিয়ে তুরস্কের সাথে ব্যাপক দ্বন্দ্ব এবং একই বছরের মাঝে ইয়েমেন যুদ্ধ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবার পর থেকে আমিরাতের কাছে তার মূল হুমকি ইরান নয়; বরং তুরস্ক। আমিরাত বেশ কিছুদিন ধরেই সিরিয়ার একনায়ক বাশার আল আসাদের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করে যাচ্ছে; আর এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ইরান। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, গত ডিসেম্বরেই সিরিয়াতে আমিরাতের রাষ্ট্রদূত আসাদকে ‘জ্ঞানী নেতৃত্ব’ হিসেবে উল্লেখ করে খবরে চলে আসেন। লিবিয়াতে তুরস্কের সরাসরি হস্তক্ষেপের পর থেকেই পালটা ব্যবস্থা হিসেবে সিরিয়াতে আমিরাত তার অবস্থানকে দৃঢ় করতে এগিয়েছে। আর সিরিয়াতে ইরানের শক্তিশালী অবস্থানের কারণেই ইরানের সাথেও আমিরাতের সম্পর্কের উন্নয়ন হয়েছে।

অপরদিকে ‘এরাব নিউজ’ মনে করিয়ে দিয়ে বলছে যে, চুক্তির বিরুদ্ধে ব্যাপক সোচ্চার তুরস্ক নিজেই ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক অটুট রেখেছে। অধিকৃত গাজা এবং পশ্চিম তীরে ইস্রাইলের আগ্রাসী ততপরতা নিয়ে তুরস্ক বেশ সরব থাকলেও তারা ইস্রাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেনি। ১৯৪৯ সালে ইস্রাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকে ২০১০ সালে গাজা অবরোধের সময় দুই দেশের মাঝে ব্যাপক দ্বন্দ্বও এই সম্পর্ককে পুরোপুরি স্তব্ধ করতে পারেনি। ২০১৮ সালে ট্রাম্পের জেরুজালেম ঘোষোণার পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক বেশ খারাপ হয়েছে; রাষ্ট্রদূত ফেরত নিয়ে আসা হয়েছে। তবে রাষ্ট্রদূত না থাকলেও চার্জ ডে এফেয়ার্সএর মাধ্যমে এই সম্পর্ক চালু রয়েছে। তুর্কি চিন্তাবিদ গুভেন সাক তুর্কি মিডিয়া ‘হুরিয়েত ডেইলি নিউজ’এর এক লেখায় বলছেন যে, ইস্রাইলিরা তুরস্ককে খুব ভালো একটা পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে দেখে। বর্তমানে প্রায় ৫ লক্ষ ইস্রাইলি প্রতি বছর তুরস্ক সফর করে। ২০০৮ সালে দুই দেশের মাঝে বাণিজ্য ছিল ৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার, যা বেড়ে এখন প্রায় ৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।

তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান বলেন যে, আমিরাতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে রাষ্ট্রদূতকে দেশে ফিরিয়ে আনার কথা ভাবছে তুরস্ক। অধিকৃত গাজা এবং পশ্চিম তীরে ইস্রাইলের আগ্রাসী ততপরতা নিয়ে তুরস্ক বেশ সরব থাকলেও তারা ইস্রাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেনি। ১৯৪৯ সালে ইস্রাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকে ২০১০ সালে গাজা অবরোধের সময় দুই দেশের মাঝে ব্যাপক দ্বন্দ্বও এই সম্পর্ককে পুরোপুরি স্তব্ধ করতে পারেনি। ফিলিস্তিন ইস্যুতে কথা বলে তুরস্ক মুসলিম বিশ্বের জনগণের আবেগকে জয় করতে এবং বিশ্বব্যাপী নিজেদের ভূরাজনৈতিক প্রভাব বাড়াতে চাইবে।

কে কি পাচ্ছে?

যুক্তরাষ্ট্র আবারও প্রমাণ করলো যে, মধ্যপ্রাচ্যে তার অবস্থান আগের মতো শক্তিশালী না হলেও অত্র অঞ্চলের নেতৃত্বের উপর তার যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ট্রাম্প নির্বাচনের আগে আগেই একটা বড় জয় পেলেন, যা কিনা তার নির্বাচনে ভালো ফলাফলের পিছনে অনুপ্রেরণা দেবে। মধ্যপ্রাচ্যে ইস্রাইলের অবস্থান আরও শক্ত হলো; কারণ তার শত্রুর সংখ্যা কমলো। ইস্রাইল এতে আরও বেশি আগ্রাসী হবার সুযোগ পাবে। আমিরাত এখন তার শত্রু তুরস্ককে মোকাবিলা করতে ইস্রাইলকে পাশে পাবে। কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও ২০১৮ সাল থেকে ইস্রাইলের সাথে তুরস্কের রাজনৈতিক সম্পর্ক খুব একটা হৃদ্যতাপূর্ণ যাচ্ছে না। পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তেল গ্যাস নিয়ে গ্রীস এবং মিশরের সাথে তুরস্কের দ্বন্দ্বে ইস্রাইল তুরস্কের বিপক্ষেই থাকছে। বিশেষ করে ফিলিস্তিন ইস্যুতে নিয়মিত কথা বলায় আঙ্কারার নেতৃত্ব তেল আভিভের বিরক্তির কারণ হয়েছে। আরবের অন্যান্য দেশগুলির এখন ইস্রাইলের সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে আর বাধা থাকছে না। সকলেই ইস্রাইলের সাথে গোপনে সম্পর্কোন্নয়ন করেছে; এখন শুধু তা অফিশিয়ালি স্বীকার করার পালা। অন্যান্য মুসলিম দেশগুলি অর্থনৈতিক কারণে আমিরাত বা সৌদিদের সাথে সম্পর্ক খারাপ করতে চায় না; তাই তারা আমিরাত ও ইস্রাইলের সম্পর্কের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকারই চেষ্টা করবে, যদিও তা তাদের জনগণের কাছে অপছন্দনীয় হবে। ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, চীন এবং ভারতসহ অমুসলিম দেশগুলি এই চুক্তির মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষিত হবে বলে মনে করছে; তাই তারা খুশি। ফিলিস্তিন ইস্যুতে কথা বলে তুরস্ক এবং ইরান মুসলিম বিশ্বের জনগণের আবেগকে জয় করতে এবং বিশ্বব্যাপী নিজেদের ভূরাজনৈতিক প্রভাব বাড়াতে চাইবে। তবে সেই চেষ্টায় হয়তো ইরানের চাইতে তুরস্কই এগিয়ে থাকবে। সকলেই এই ইস্যুটাকে ব্যবহার করবে; শুধু ফিলিস্তিনের জনগণ ছাড়া। আবারও প্রমাণিত হলো যে, মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব ফিলিস্তিনের জনগণের ব্যাপারে কতটা উদাসীন। এই ঘটনা বিশ্বব্যাপী মুসলিম দেশগুলির নেতৃবৃন্দকে জনগণের সামনে হেয় করবে এবং মুসলিমদেরকে যোগ্য নেতৃত্ব খুঁজতে আরও বেশি আগ্রহী করে তুলবে।

No comments:

Post a Comment