Saturday 6 June 2020

কালাপানি সীমান্ত বিরোধ - নেপাল কোন পথে যাচ্ছে?

৭ই জুন ২০২০



গত ৩১শে মে নেপালের আইনমন্ত্রী শিভামায়া তুম্বাহাংপে দেশটার পার্লামেন্টে সংবিধান সংশোধনের একটা প্রস্তাব পেশ করেন। প্রস্তাব মোতাবেক নেপালের নতুন মানচিত্র প্রকাশ করা হবে, যার মাঝে থাকবে কালাপানি, লিপুলেখ গিরিপথ এবং লিম্পিয়াধুরা, যা নিয়ে ভারতের সাথে সাম্প্রতিক সময়ে বিরোধ চলছে। এতকাল পর্যন্ত নেপালের মানচিত্রের ব্যাপারে দুই দেশের বিরোধ চললেও মানচিত্রকে নেপাল আইনের মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করেনি। পার্লামেন্টে এই প্রস্তাব পাস হলে নেপাল এই মানচিত্রকে আইনগত বৈধতা দেবে। গত ২০শে মে নেপাল সরকার এই নতুন মানচিত্র প্রকাশ করে। ভারতের মিডিয়া ‘টাইম নাউ’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, সংবিধান সংশোধন করতে হলে ক্ষমতাসীন নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি একা এই প্রস্তাব পাস করতে পারবে না; কারণ দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাদের নেই। এক্ষেত্রে অন্য দলগুলির সমর্থনও দরকার হবে। অপরদিকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অনুরাগ শিভাস্তাভা বলেন যে, নেপালের এধরনের কর্মকান্ড পুরোপুরিভাবে একতরফা, এবং তা ঐতিহাসিক সত্যের উপর ভিত্তি করে নয়। নেপাল ভালো করেই জানতো যে এব্যাপারে ভারতের অবস্থান কি। এর আগে গত ৮ই মে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং লিপুলেখ গিরিপথ এবং চীনের কৈলাস মানসসরোবরের মাঝে ৮০ কিঃমিঃ লম্বা একটা রাস্তা উদ্ভোধন করার পর নেপাল এব্যাপারে প্রতিবাদ করা শুরু করে। এর আগে ২০১৯এর নভেম্বরে ভারত সরকার নতুন মানচিত্র প্রকাশ করে, যার মাঝে বিরোধপূর্ণ অঞ্চলটা ভারতের অভ্যন্তরে দেখানো হয়েছিল। 

২১শে মে নেপালের সেনাবাহিনী ঘোষণা দেয় যে, তারা নেপাল এবং ভারতের পশ্চিম সীমান্তের সমান্তরালে ধারচুলা থেকে টিঙ্কার গিরিপথের মাঝে রাস্তা তৈরি করা শুরু করেছে। ২০০৮ সালে এই রাস্তা তৈরির কাজ স্থগিত করা হয়েছিল। নেপালের সেনাবাহিনী বলছে যে, তারা রাস্তার সাড়ে ৪’শ মিটার একটা অংশের কাজ করছে। এর মাধ্যমে ১’শ ৮২টা পরিবারের ১২’শ মানুষকে ভারতের অভ্যন্তরে গিয়ে রাস্তা ব্যবহার করতে হবে না। গত ২৬শে এপ্রিল নেপালের মন্ত্রীসভায় এই রাস্তা তৈরির সিদ্ধান্ত হয় বলে বলা হয়। এই রাস্তা নেপালের নিজস্ব অঞ্চলের ভিতরে হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় মিডিয়া এই রাস্তার ব্যাপারে খবরাখবর প্রকাশ করছে। কারণ, এই রাস্তার অবস্থান বিরোধপূর্ণ অঞ্চলের খুবই কাছে। এই রাস্তার মাধ্যমে নেপালের পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের চীনের সাথে বাণিজ্য করার একটা সম্ভবনা তৈরি হতে পারে।   
     
কূটনৈতিক কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ‘সানডে এক্সপ্রেস’ পত্রিকা বলছে যে, পার্লামেন্টে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব পেশ করার পর নেপালের পররাষ্ট্র দপ্তর এক কূটনৈতিক নোট দিয়ে ভারতকে জানায় যে, উভয় দেশের পররাষ্ট্র সচিবরা ‘ভার্চুয়াল’ আলোচনায় বসতে পারেন। এর আগে গত ৯ই মে ভারত বলেছিল যে, করোনাভাইরাসের মহামারি সফলতার সাথে মোকাবিলা করার পরই কেবল ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা এবং নেপালের পররাষ্ট্র সচিব শংকর দাশ বৈরাগী আলোচনায় বসতে পারেন। আলোচনার ব্যাপারে ভারতের অনাগ্রহ এবং নেপালের সদিচ্ছা যথেষ্টই দৃশ্যমান। আর ভারতকে আলোচনায় বসতে বাধ্য করতে নেপালি সরকার পার্লামেন্টে সংবিধান সংশোধন প্রস্তাব এবং সীমান্তে রাস্তা নির্মাণকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করবে। 

ভারতীয়রা বলছে যে, নেপালের বর্তমান সরকার নেপালকে চীনের কাছে নিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় মিডিয়াতে নেপালের সরকারকে চীনা প্রক্সি বলতেও কার্পণ্য করছেন না কেউ কেউ। ‘ডয়েচে ভেলে’ বলছে যে, বিরোধপূর্ণ অঞ্চলের উপর নেপালের দাবি থাকা সত্ত্বেও ভারত একতরফাভাবে ৮০ কিঃমিঃ লম্বা রাস্তা তৈরি করে। নেপালের ভাষ্য হচ্ছে, ভারত তার ছোট প্রতিবেশীকে চাপে রাখতেই এধরণের কর্মকান্ড করছে। নেপাল দাবি করছে যে, ১৮১৬ সালে ব্রিটিশ ভারত সরকারের সাথে গুর্খা যুদ্ধের পর সুগাউলি চুক্তির মাধ্যমে নেপালের সীমানা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। সেই চুক্তি মোতাবেক কালি নদীকে নেপাল এবং ভারতের মাঝে সীমানা হিসেবে সম্মতি দেয় উভয় পক্ষ। ১৯৫৯ সালের নেপালের নির্বাচনে কালাপানি, লিপুলেখ গিরিপথ এবং লিম্পিয়াধুরার জনগণ ভোট দিয়ে অংশ নেয়; এবং তারা নেপাল সরকারকে করও দিয়ে যাচ্ছিল। ১৯৬২ সালে চীনের সাথে সীমান্ত যুদ্ধের পর থেকে ভারতীয় সেনারা এই অঞ্চলকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে দেয়। তবে এই বিরোধপূর্ণ অঞ্চল নিয়ে চীনের অবস্থানটা এখনও পরিষ্কার নয়। ২০১৫ সালের মে মাসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংএর আলোচনায় স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলির মাঝে ছিল চিয়াংলা এবং লিপুলেখ গিরিপথের মাধ্যমে বাণিজ্য বৃদ্ধি। সেসময় নেপাল এই চুক্তির বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ জানায়। তারা উভয় দেশকেই সীমানার ব্যাপারটা সঠিকভাবে দেখতে উপদেশ দেয়।  

ভারতের থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ১৯৫০এর দশক থেকেই নেপাল বারংবার সীমান্ত বিরোধ কাটাতে ভারতকে আলোচনায় বসার অনুরোধ করতে থাকে। কিন্তু ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তর নেপালকে আলোচনায় বসার জন্যে সময় দেয়নি। আর নেপালের বর্তমান প্রতিবাদ এমন সময়ে এলো, যখন লাদাখে ভারতের সাথে চীনের উত্তেজনা চলছে। ভারত মনে করছে যে, নেপালের নতুন কমিউনিস্ট পার্টি চীনের ইন্ধনে তৈরি হয়েছে। ২০১৮ সালের মে মাসে অফিশিয়ালি ‘নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি’র জন্ম হয়। পূর্ববর্তী মার্কস ও লেনিনের অনুসারী গ্রুপ এবং মাওপন্থী গ্রুপ একত্রিত হয়েই এই দল গঠিত হয়। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ বলছে যে, কালাপানি সীমান্ত বিরোধ নেপালের রাজনৈতিক দলগুলিকে একত্রিত করেছে, যা ইতিহাসে বিরল। ২০১৫ সালে নেপালের সংবিধান বিষয়ে মদেশীদের অন্দোলনে ভারত মদেশীদের পক্ষে হস্তক্ষেপ করে এবং নেপালের উপর অঘোষিত অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। এতে নেপালের জনগণের সাথে ভারতের দূরত্ব যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। আর অবরোধের কারণে নেপাল চীন থেকে জ্বালানি তেল আমদানি করতে বাধ্য হয়, যা নেপালকে চীনের কাছে নেয় এবং ভারতীয় চিন্তাবিদদের নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি করে। স্থলবেষ্টিত দেশ হিসেবে নেপালের বাণিজ্য ভারতের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। তদুপরি নেপালকে ভারত নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। অপরদিকে চীনের সাথে নেপালের সম্পর্ক গভীর হবার সাথেসাথে ভারত নেপালের উপর চাপ সৃষ্টি করছে, যা কিনা নেপালকে আরও কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলে দিচ্ছে। এহেন পরিস্থিতি নেপালকে শক্তিশালী ভূরাজনৈতিক ব্যালান্স নিশ্চিত করতে ভারত এবং চীনের বিকল্প খুঁজতে আগ্রহী করবে।       

No comments:

Post a Comment