Wednesday 3 June 2020

চীন ও ভারতের সীমান্ত উত্তেজনার ভবিষ্যৎ কি?


৪ঠা জুন ২০২০

ভারতীয় কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ২৬শে মে ‘রয়টার্স’ বলছে যে, হিমালয়ের পাদদেশে বিমানবন্দর এবং রাস্তা নির্মাণকে কেন্দ্র করে ভারত এবং চীনের মাঝে উত্তেজনা শুরু হয়েছে। লাদাখ এলাকার গালওয়ান উপত্যকায় উভয় পক্ষ সামরিক ক্যাম্প স্থাপনের মাধ্যমে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে; আর একে অপরকে এই উত্তেজনার ব্যাপারে দোষারোপ করছে। ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন যে, চীনাদের প্রান্তে ৮০ থেকে ১০০টা তাঁবু গড়ে তোলা হয়েছে। উভয় পক্ষই নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তুলছে। চীনারা ট্রাকে করে সরঞ্জাম নিয়ে আসছে সেখানে। ভারতের লাদাখের অপর প্রান্তে চীনাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে আকসাই চিন অঞ্চল, যা ভারত নিজের বলে দাবি করে।

১৯৬২ সালে চীনের সাথে যুদ্ধে ভারত বেশ বড় আকারের পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। এরপর ১৯৮৮ সালে ভারতের উত্তরপূর্বের অরুনাচল প্রদেশে দুই দেশের মাঝে আরেক দফা সংঘাতের পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী চীনা নেতা দেং জিয়াওপিংএর সাথে আলোচনা বসেন। ১৯৯৩, ১৯৯৬ এবং ২০০৫ সালে কয়েক দফা বৈঠকের পর দুই দেশ সীমানা ঠান্ডা রাখতে সম্মত হয়েছিল। এর ফলশ্রুতিতে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দুই দেশের মাঝে সীমান্তে কোন সংঘাত হয়নি। তবে ২০১৭ সালে দোকলাম সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধির মাঝ দিয়ে এই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সমাপ্তি হয়। আর এবারের উত্তেজনার শুরু হয় ৫ই মে, যখন দুই পক্ষের প্রায় শ’খানেক সেনা হাতাহাতি সংঘাতে লিপ্ত হয়। তবে কোন আগ্নেয়াস্ত্র কোন পক্ষই ব্যবহার করেনি।

চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হচ্ছে যে, চীন তার নিজস্ব অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ; তবে ভারতের সাথে সীমানায় তারা শান্তি ও শৃংখলা বজায় রাখতেও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বিবৃতিতে আরও বলা হয় যে, বর্তমানে দুই দেশের সীমানা স্থিতিশীল এবং নিয়ন্ত্রণের মাঝেই রয়েছে। উভয় পক্ষই আলোচনায় মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সক্ষম। ভারতের প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব নিরুপমা রাও বলছেন যে, সীমানার কাছাকাছি ভারতের অবকাঠামো উন্নয়নের পর থেকেই চীনারা সেটাকে হুমকি হিসেবে দেখা শুরু করেছে। শি জিনপিংএর চীন তার নিজস্ব ভূমির নিরাপত্তা নিশ্চিতে যেমন কঠোর অবস্থানে রয়েছে, তেমনি ভারতও সেব্যাপারে ছাড় দিতে নারাজ।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার ২০২২ সালের মাঝে চীনের সীমানার কাছাকাছি অনেকগুলি রাস্তা তৈরির প্রকল্প গ্রহণ করেছে। লাদাখে ভারতের সামরিক রাস্তা তৈরির ইতিহাসটা বর্তমান প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ।

মার্কিন নির্মিত ‘সি-১৩০জে’ পরিবহণ বিমান চীনের সীমানার কাছাকাছি লাদাখের ‘দৌলত বেগ ওল্ডি’ নামের বিমানবন্দরে অবতরণ করছে। এই বিমানবন্দর পর্যন্ত রাস্তা তৈরির ফলেই চীনারা ধারণা করা শুরু করে যে, ভারতীয়রা হয়তোবা চীনা নিয়ন্ত্রণে থাকা আকসাই চিন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেবার পরিকল্পনা করছে।


পাঁচ কিঃমিঃ উচ্চতায় বিমানবন্দর

২০১৩ সালের অগাস্টে ভারতীয় মিডিয়ায় ঘোষণা দেয়া হয় যে, ভারতীয় বিমান বাহিনী তাদের মার্কিন নির্মিত ‘সি-১৩০জে’ পরিবহণ বিমান চীনের সীমানার কাছাকাছি লাদাখের ‘দৌলত বেগ ওল্ডি’ নামের বিমানবন্দরে অবতরণ করিয়েছে। সমুদ্র সমতল থেকে ১৬ হাজার ৬’শ ফুট বা ৫ কিঃমিঃএর বেশি উচ্চতায় অবস্থিত এই বিমাববন্দরকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিমানবন্দর বলেও দাবি করা হয়। পুরো লাদাখের গড় উচ্চতা ৩ কিঃমিঃ থেকে সাড়ে ৪ কিঃমিঃএর মতো। ষোড়শ শতকে সুলতান সৈয়দ খান লাদাখ অপারেশনে সময় এখানে মৃত্যুবরণ করেন; সেই থেকে এই জায়গার নাম ‘দৌলত বেগ ওল্ডি’। এর ২০ কিঃমিঃ উত্তরেই রয়েছে প্রায় ১৯ হাজার ফুট উচ্চতার কারাকোরাম গিরিপথ, যা লাদাখের সাথে চীনের শিনজিয়াং বা উইঘুর প্রদেশের যোগাযোগের পথ। ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত এই পথে উইঘুরের কাশগড়ের সাথে হোশিয়ারপুরের পাঞ্জাবি বণিকরা বাণিজ্য করতো। ব্রিটিশ সামরিক অফিসাররা একসময় মনে করতেন যে, কারাকোরাম গিরিপথের মাধ্যমে রুশ সামরিক হামলা হবার সম্ভাবনা রয়েছে। এই ভীতি বাস্তবতা পায়নি। পরে অবশ্য ভারত এবং চীন কারাকোরাম গিরিপথকে কোন দ্বন্দ্ব ছাড়াই নিজেদের সীমানা হিসেবে মেনে নেয়। এর পূর্বে চীন নিয়ন্ত্রিত আকসাই চিন, আর পশ্চিমে রয়েছে সিয়াচেন হিমবাহ। ভারতীয় মিডিয়া ‘ফার্স্ট পোস্ট’ বলছে যে, ঐ বছর এপ্রিল মে মাসে সেই এলাকায় উত্তেজনার পর এই বিমান অবতরণের অপারেশন চালানো হয়। ১৯৬২ সালের চীন ভারত যুদ্ধের সময় ‘দৌলত বেগ ওল্ডি’র সামরিক স্থাপনা তৈরি করা হয়েছিল। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত সেখানে মার্কিন নির্মিত ‘সি-৮২ প্যাকেট’ পরিবহণ বিমান অবতরণ করতো সৈন্যদের রসদপাতি আনানেয়ার কাজে। একটা ভূমিকম্পের পর সেই বিমানবন্দরের মাটি দুর্বল হয়ে পড়ার পর থেকে সেখানে বিমান অবতরণ বন্ধ করে দেয়া হয়। টানা ৪৩ বছর এই বিমানবন্দরের কার্যক্রম স্থগিত থাকার পর ২০০৮ সালের মে মাসে ভারতীয় বিমান বাহিনীর রুশ নির্মিত ‘এন-৩২’ পরিবহণ বিমান সেখানে অবতরণ করে। অত উচ্চতায় পণ্য পরিবহণ সক্ষমতা বৃদ্ধিতেই ২০১৩ সাল থেকে ‘সি-১৩০’ বিমান ব্যবহার করা শুরু হয়।

তবে ঘটনা পরিবর্তিত হয়ে যায় ২০১৯ সালে। এবছরের এপ্রিল মাসে ভারতীয়রা লাদাখের লেহ থেকে উত্তরে ‘দৌলত বেগ ওল্ডি’ পর্যন্ত আড়াইশ’ কিঃমিঃ লম্বা রাস্তা তৈরির কাজ শেষ করে। ভারতীয় পত্রিকা ‘দ্যা ট্রিবিউন’ বলছে যে, কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ এই রাস্তা সারা বছর চালু থাকবে। এই পথে মোট ৩৭টা সেতু তৈরি করা হয়েছে। দারবুক থেকে দৌলত বেগ ওল্ডি পর্যন্ত রাস্তার কোন অংশই ১৪ হাজার ফুট উচ্চতার নিচে নয়। এই পুরো পথের কোথাও বেসামরিক নাগরিকদের বসবাসের অনুমতি নেই। ২০০০ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এই রাস্তা তৈরির প্রথম চেষ্টাটা করা হয়। কিন্তু শায়ক নদীর পানির তোড়ে রাস্তা ভেসে গেলে ২০১৪ সাল থেকে নতুনভাবে প্রায় ১’শ ৬০ কিঃমিঃ রাস্তা তৈরির পরকল্পনা হাতে নেয়া হয়। এই কাজ শেষ হয় ২০১৯ সালে। এই রাস্তা তৈরির ফলেই চীনারা ধারণা করা শুরু করে যে, ভারতীয়রা হয়তোবা চীনা নিয়ন্ত্রণে থাকা আকসাই চিন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেবার পরিকল্পনা করছে।

সাম্প্রতিক সময়ে লাদাখে বিমানবন্দরের উন্নয়ন, রাস্তা তৈরি, নতুন ধরণের অস্ত্র ক্রয় এবং সেনা পরিবহণের জন্যে নতুন পরিবহণ বিমান ক্রয়, ইত্যাদি পদক্ষেপের মাধ্যমে চীন সীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনী সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। এই সক্ষমতা বৃদ্ধির পিছনে ইন্ধন যুগিয়েছে ভারতীয় চিন্তাবিদদের নিরাপত্তাহীনতার চিন্তা। ভারতীয় পত্রিকা ‘দ্যা প্রিন্ট’ বলছে যে, ১৯৯৯ সালে ভারতের ‘ক্যাবিনেট কমিটি অন সিকিউরিটি’ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘বর্ডার রোডস অর্গানাইজেশন’কে ২০০৩ সালের মাঝে চীন সীমান্তে রাস্তা তৈরির প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কাজ দেয়। এই প্রকল্পের সময় ২০১২ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি করলেও তা শেষ করতে ২০১৯ হয়ে যায়। এই প্রকল্পের অধীনে চীনের সীমানার কাছাকাছি ৩ হাজার ৩’শ ৪৬ কিঃমিঃ লম্বা ৬১টা রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। এর মাঝে ১ হাজার ২’শ ৬০ কিঃমিঃ লম্বা ৩৫টা রাস্তার কাজ শেষ হয়েছে। ২ হাজার ৩৫ কিঃমিঃএর ২০টা রাস্তা পরীক্ষা করা হচ্ছে। আর বাকি ৫১ কিঃমিঃএর ৫টা রাস্তার কাজ এখনও চলছে। ভারতীয় কর্মকর্তারা মনে করছেন যে, এই রাস্তা তৈরির ফলে দুর্গম সীমান্ত অঞ্চলে সরকারের যোগাযোগ সহজীকরণ এবং প্যাট্রল বৃদ্ধি করার লক্ষ্য বাস্তবায়িত হবে। ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন যে, ১৯৯৭ সালে চীনারা তাদের সীমান্ত এলাকায় রাস্তা তৈরির কাজ আরম্ভ করার পর ভারতীয়রা ‘চায়না স্টাডি গ্রুপ’ তৈরি করে; যা গবেষণা করে ৭৩টা পয়েন্টে রাস্তা নির্মাণ করার উপদেশ দেয়।

ভারতীয় বিমান বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এপাচি হেলিকপ্টার বুঝে নিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা পরিবহণ বিমান, হেলিকপ্টার ও কামান সীমান্ত অঞ্চলে ভারতের যুদ্ধ করার সক্ষমতা বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছে ঠিকই, তবে সেটা চীনের সাথে সম্ভাব্য সংঘাতে বিজয়ের জন্যে যথেষ্ট কিনা, সেব্যাপারে প্রশ্ন করছেন অনেকেই।


লাদাখে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সক্ষমতা কতটুকু? 

লাদাখের নিরাপত্তায় রয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর চতুর্দশ কোর, যা ১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধের সময় গঠিত হয়। তবে এখানকার ইউনিটগুলি ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলের নাগাল্যান্ড থেকে নিয়ে আসা ইউনিট থেকেই ডেভেলপ করা হয়েছিল। নাগাল্যান্ডের পাহাড়ি এলাকায় বিদ্রোহী দমনে নিয়োজিত ইউনিটের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই ১৯৬২ সাল থেকে এর অধীন ৩য় পদাতিক ডিভিশন তৈরি করা হয়। ১৯৯০ সালের পর নাগাল্যান্ড থেকে বিদ্রোহী দমনে নিয়োজিত ৮ম পদাতিক ডিভিশনকে লাদাখে নিয়ে আসা হয়। এরপর থেকে এই ইউনিট নাগাল্যান্ডে আর ফেরত যায়নি। ২০১৯এর সেপ্টেম্বরে লাদাখের দক্ষিণপূর্ব প্রান্তে চীনা সীমানার কাছাকাছি চুশুল অঞ্চলের অত্যন্ত উঁচু এলাকায় ভারত বড় আকারের একটা সামরিক মহড়ার আয়োজন করে। ‘চাংথাং প্রাহার’ নামের এই মহড়ায় ভারতের ট্যাঙ্ক, আর্টিলারি, হেলিকপ্টার, ড্রোন, এবং বিমান বাহিনীর বিমান অংশ নেয়। বিমান থেকে প্যারাশুট দিয়ে সেনা অবতরণও করা হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর নর্দার্ন কমান্ডের কমান্ডার লেঃ জেনারেল রনবীর সিং মহড়ার সময় বলেন যে, যুদ্ধ করতে বাধ্য হলে নর্দার্ন কমান্ড তার শ্রেষ্ঠ সক্ষমতা প্রদর্শন করবে। নতুন প্রযুক্তির অস্ত্র ব্যবহারের সাথেসাথে এই সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু কাশ্মির এবং লাদাখের নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে ভারতীয় সেনবাহিনীর নর্দার্ন কমান্ড। এর অধীনেই রয়েছে লাদাখের চতুর্দশ কোর, শ্রীনগরের পঞ্চদশ কোর এবং নাগ্রতার ষোড়শ কোর। সেনাবাহিনীর এই ইউনিটগুলি অতি উঁচু ভূমিতে যুদ্ধ করতে সক্ষম। ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের অধীনে থাকা ৯টা মাউন্টেন ডিভিশনই উঁচু স্থানে যুদ্ধ করতে অভ্যস্ত। তাই লাদাখ বা কাশ্মিরে উত্তেজনার উপর ভিত্তি করে অনেক সময়েই ইস্টার্ন কমান্ড থেকে সেনা এনে নর্দার্ন কমান্ডে মোতায়েন করা হয়েছে। তবে ইস্টার্ন কমান্ডের ইউনিটগুলির একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো চীনের উপর খেয়াল রাখা। চীনা সীমানা ঠান্ডা থাকলেই কেবল ইস্টার্ন কমান্ডের ইউনিট নর্দার্ন কমান্ডে মোতায়েন করা সম্ভব। চীনের সাথে ভারতের সম্ভাব্য উত্তেজনার মাঝে সেটা কতটুকু সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে।

সেনাবাহিনী ছাড়াও ভারতীয় বিমান বাহিনীর রসদ পরিবহণ সক্ষমতাও গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে বিমান বাহিনীর ওয়েস্টার্ন কমান্ডের একটা মহড়া অনুষ্ঠিত হয়, যার মাঝে লাদাখ থেকে ৪’শ কিঃমিঃ দূরের চন্ডিগড় বিমান ঘাঁটি থেকে ৬ ঘন্টায় ৪’শ ৬৩ টন রসদ লাদাখে প্রেরণ করা হয়। বিমান বাহিনীর মোট ১৬টা পরিবহণ বিমান এতে ব্যবহৃত হয়, যার মাঝে ছিল মার্কিন নির্মিত ‘সি-১৭ গ্লোবমাস্টার’ এবং রুশ নির্মিত ‘ইলিউশিন-৭৬’ ও ‘এন্টোনভ-৩২’। ‘ফিনানশিয়াল এক্সপ্রেস’ বলছে যে, সাধারণ সময়ে ওয়েস্টার্ন এয়ার কমান্ড মাসে ৩ হাজার টনের মতো রসদ পরিবহণ করে থাকে। এয়ার ভাইস মার্শাল ধিলন বলছেন যে, লাদাখে স্বল্প সময়ের যুদ্ধাবস্থার মাঝে লজিস্টিক সাপোর্ট দেয়ার সক্ষমতার প্রমাণ রেখেছে ভারতীয় বিমান বাহিনী। 

২০১১ সালের জুনে ভারতীয় বিমান বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ১০টা ‘সি-১৭ গ্লোবমাস্টার’ পরিবহণ বিমান ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। বিমানের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িং এই বিমানের উৎপাদন শেষ করে দেবার সময় ভারত আরও ৩টা বিমান কিনতে চায়। তবে ভারতের আমতান্ত্রিক জটিলতার কারণে শেষ পর্যন্ত ২০১৯ সালের অগাস্টে ভারত তার ১১তম এবং শেষ ‘সি-১৭’এর ডেলিভারি পায়। এই বিমানটা ডেলিভারির মাধ্যমে বোয়িংএর ‘সি-১৭’ কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়। ১’শ ৮৮ জন সেনা বা ৭৩ টন রসদ বহণে সক্ষম এই বিমানগুলিকে ভারত কিনেছিল কৌশলগত পরিবহণের জন্যে। ‘সি-১৭’ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র থেকে ‘সি-১৩০জে সুপার হারকিউলিস’ পরিবহণ বিমান কিনেছে ভারত। ২০০৮ সালে প্রথম ৬টা ‘সি-১৩০জে’ অর্ডার করে ভারত। ২০১১ সাল থেকে এগুলির ডেলিভারি শুরু হয়। এরপর ২০১৩ সালে আরও ৬টা বিমান অর্ডার করে ভারত। এই বিমানগুলি প্রায় ১’শ সেনা বা ১৯ টন রসদ বহণ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা বিমানগুলি ভারতীয় বাহিনীর সোভিয়েত আমলের ‘ইলিউশিন ইল-৭৬এমডি’ এবং ‘এন্টোনভ এএন-৩২’ বিমানের সাথে যুক্ত হয়েছে। ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৮ সালের মাঝে ৪৮ টন রসদ বহণে সক্ষম ১৪টা ‘ইল-৭৬’ বিমান কেনে ভারত। ২০১৭ সালে ভারতের কম্পট্রোলার এন্ড অডিটর জেনারেল এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, বিমানগুলির মাঝে মাত্র ৪১ শতাংশ যেকোন সময় কর্মক্ষম থাকে। ভারতীয় বিমান বাহিনীর ১’শটার মতো পুরোনো ‘এন-৩২’ বিমান রয়েছে; যেগুলি মডার্নাইজেশনে প্রক্রিয়া চলছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা ‘সি-১৭’ এবং ‘সি-১৩০জে’ বিমানগুলি চীনের সীমানায় ভারতীয় বিমান বাহিনীর রসদ সরবরাহ বৃদ্ধির সক্ষমতাকে বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে। বিমানগুলির সক্ষমতার অনেকটাই হিসেব করা হয়েছে চীন সীমান্তে কত দ্রুততার সাথে কত পরিমাণ রসদ মোতায়েন করা যাবে তার উপর। এই সক্ষমতার একটা পরীক্ষাই ভারতীয় বিমান বাহিনী করেছিল ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে।

শুধু পরিবহণ বিমান ক্রয়ই নয়; ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্যে উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে ব্যবহারের উপযোগী ‘এম-৭৭৭’ হাউইটজার কামান সরবরাহ করছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৬ সালে নরেন্দ্র মোদির সরকার ব্রিটিশ কোম্পানি ‘বিএই সিস্টেমস’এর ডিজাইন করা মোট ১’শ ৪৫টা কামান ৭’শ ৩৭ মিলিয়ন ডলার খরচে কেনার অনুমোদন দেয়। প্রথম ২৫টা যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরাসরি আসলেও বাকি ১’শ ২০টা ভারতের মাহিন্দ্রা কোম্পানি এসেম্বলি করবে। ২০১৮এর নভেম্বর থেকে কামানগুলির ডেলিভারি পাওয়া শুরু করে ভারত। সাধারণ ১৫৫মিঃমিঃ হাউইটজার কামানের চাইতে প্রায় ৪০ শতাংশ কম ওজনের হবার কারণে এই কামানগুলি খুব সহজেই আকাশপথে উঁচু ভূমিতে মোতায়েন করা সম্ভব হবে, যা কিনা চীন এবং পাকিস্তানের সীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। 
‘ডেকান হেরাল্ড’ বলছে যে, ১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধের সময় ভারতীয় বিমান বাহিনী বুঝতে পারে যে, হিমালয়ের উঁচু ভূমিতে অপারেট করার মতো কোন এটাক হেলিকপ্টার ভারতের নেই। রুশ নির্মিত ‘এমআই-৩৫’ হেলিকপ্টারগুলি ৫ কিঃমিঃ উচ্চতা পর্যন্ত যেতে পারে না। অথচ কাশ্মির এবং লাদাখ সীমানায় অনেক স্থানের উচ্চতাই ৪ থেকে ৫ কিঃমিঃ বা তারও বেশি। এই অক্ষমতা কাটিয়ে উঠতে ভারত ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার খরচে ২২টা ‘এএইচ-৬৪ই এপাচি’ এটাক হেলিকপ্টার এবং ১৫টা ‘সিএইচ-৪৭ শিনুক’ পরিবহণ হেলিকপ্টার কেনার চুক্তি করে। দু’টা হেলিকপ্টারই প্রায় ৬ কিঃমিঃ উচ্চতায় উড়তে পারে এবং সফলতার সাথে আফগানিস্তানের উঁচু জায়গাগুলিতে অপারেট করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা পরিবহণ বিমান, হেলিকপ্টার ও কামান সীমান্ত অঞ্চলে ভারতের যুদ্ধ করার সক্ষমতা বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছে ঠিকই, তবে সেটা চীনের সাথে সম্ভাব্য সংঘাতে বিজয়ের জন্যে যথেষ্ট কিনা, সেব্যাপারে প্রশ্ন করছেন অনেকেই। 

গত এক বছর ধরেই ভারতের লাদাখের সীমানা থেকে প্রায় ২’শ কিঃমিঃ দক্ষিণে ‘নেগারি গুনসা’ বিমানবন্দরে চীনারা উন্নয়ন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তবে কাশ্মির এবং লাদাখের কাছাকাছি চীনারা গোটা পঞ্চাশেকের বেশি যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেনি। সংখ্যার দিক থেকে এই বিমানশক্তি খুব বড় কিছু নয়। তদুপরি তা ভারতের নিরাপত্তাহীনতাকে উস্কে দিয়েছে।  


চীনের অবকাঠামো চ্যালেঞ্জ

বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, চীন ভারতের সীমানার কাছাকাছি এলাকায় অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ দ্রুত এগিয়ে নিচ্ছে। প্রতিরক্ষা এবং ইন্টেলিজেন্স বিশ্লেষক ক্রিস বিগার্স বলছেন যে, গত এক বছর ধরেই লাদাখের সীমানা থেকে প্রায় ২’শ কিঃমিঃ দক্ষিণে ‘নেগারি গুনসা’ বিমানবন্দরে চীনারা উন্নয়ন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে, সেখানে চীনারা নতুন ট্যাক্সিওয়ে, পার্কিং র‍্যাম্প এবং ‘কুইক রিয়্যাকশন এলার্ট র‍্যাম্প’ তৈরি করেছে। তবে একসাথে বেশি বিমান ওড়াবার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে দ্বিতীয় রানওয়ে তৈরি করেনি। সেখানে চীনারা ৪টা সুখোই ফাইটার বিমান এবং বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছে। প্রায় ১৪ হাজার ফুট বা ৪ দশমিক ৩ কিঃমিঃ উচ্চতায় অবস্থিত এই বিমানবন্দরকে বিশ্বের চতুর্থ সর্বোচ্চ বিমানবন্দর দাবি করা হয়। ভারতীয় সামরিক বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, অতি উচ্চতায় অবস্থিত হওয়ায় এই বিমানবন্দর থেকে ওড়া ফাইটার বিমানগুলি তাদের সক্ষমতার চাইতে অনেক কম অস্ত্র বহণ করতে পারবে। সক্ষমতা অনুযায়ী ইঞ্জিন না চলতে পারার কারণে জ্বালানিও বেশি বহণ করতে হতে পারে। ভারতীয় বিমান বাইনীর সাবেক অফিসার স্কোয়াড্রন লীডার সামীর জোশি বলছেন যে, এত উঁচু থেকে ওড়ার ফলে সুখোই বিমানগুলি এক ঘন্টার বেশি উড়তে পারবে না। অপরদিকে লাদাখের কাছাকাছি ভারতের অনেকগুলি বিমান ঘাঁটি রয়েছে; যেগুলি থেকে ওড়া বিমান আকাশ থেকে আকাশে রিফুয়েলিংএর মাধ্যমে তিন থেকে চার ঘন্টা আকাশে উড়তে পারবে।

তবে ভারতের সীমানায় চীনের উদ্দেশ্য বুঝতে হলে চীনের অবকাঠামো উন্নয়নকে আরও বড় পরিসরে দেখতে হবে। তিব্বতে ভারতের সীমানার কাছাকাছি চীনের খুব বেশি একটা বিমানবন্দর নেই। পূর্ব তিব্বতে অরুণাচল প্রদেশের উত্তরে রয়েছে নিংচি বিমানবন্দর এবং চামদো বিমানবন্দর। এর মাঝে চামদো বিমানবন্দরকে আরও বড় করা হচ্ছে। ভূটানের উত্তরে রয়েছে লাসা গঙ্গার এবং শিগাটসে বিমানবন্দর। দু’টাই বেশ বড়সড় বিমানবন্দর, যেগুলির একাধিক রানওয়ে রয়েছে। ভূটানের সীমানায় দোকলাম উত্তেজনার সময় এই বিমানবন্দর দু’টা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। শিগাটসে থেকে পশ্চিমে নেপালের উত্তরে প্রায় ১২’শ কিঃমিঃ কোন বিমানবন্দর নেই। শিগাটসের পর ভারতের হিমাচল প্রদেশের পূর্বে রয়েছে ‘নেগারি গুনশা’ বিমানবন্দর, যেটা বর্তমান লাদাখ ইস্যুতে খবরে এসেছে। এখানে সামরিক বিমান অপারেট করার সুযোগসুবিধা এখনও খুব বেশি একটা নেই; তবে এর উন্নয়ন চলমান। এখানে আপাততঃ ৪টা যুদ্ধবিমান দেখা গেছে। নেগারি থেকে ১৩’শ কিঃমিঃ সড়কপথে যুক্ত হয়েছে উইঘুরের ‘খোটান’। এই রাস্তা আকসাই চিনের মাঝ দিয়ে গিয়েছে। আকসাই চিন থেকে প্রায় ২’শ কিঃমিঃ উত্তরে খোটানে রয়েছে বেশ বড় একটা বিমানবন্দর। এখানে প্রায় ত্রিশ চল্লিশটার মতো ফাইটার মোতায়েন রয়েছে। খোটানের সাথে প্রায় ৫’শ কিঃমিঃ সরকপথে যুক্ত হয়েছে কাশগড়, যেখানে রয়েছে আরেকটা বড় বিমানবন্দর। এখানেও প্রায় ডজনখানেক যুদ্ধবিমান মোতায়েন রয়েছে। তবে কাশ্মির এবং লাদাখের কাছাকাছি চীনারা গোটা পঞ্চাশেকের বেশি যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেনি। সংখ্যার দিক থেকে এই বিমানশক্তি খুব বড় কিছু নয়। তদুপরি তা ভারতের নিরাপত্তাহীনতাকে উস্কে দিয়েছে।
চীন তার পশ্চিমের রাজ্যগুলিকে পূর্বের হান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলির সাথে সরাসরি যুক্ত করার চেষ্টা করছে। এই বিশাল অঞ্চলে অবকাঠামো তৈরির পিছনে রয়েছে বিশাল সব প্রকৃতিগত চ্যালেঞ্জ। কিন্তু চীন তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর ভর করে তিব্বত এবং শিনজিয়াং বা উইঘুরে অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। এর মাঝে রয়েছে নতুন রাস্তা, রেললাইন এবং বিমানবন্দর নির্মাণ। সর্বপশ্চিমের মুসলিম অধ্যুষিত উইঘুর রাজ্যে চীনের প্রকল্পগুলির কৌশলগত গুরুত্ব সবচাইতে বেশি। উইঘুরের মাধ্যমেই চীন মধ্য এশিয়ার সাথে যুক্ত হয়েছে। একইসাথে পাকিস্তানের মাঝ দিয়ে ভারত মহাসগরের তীরে গোয়াদর বন্দরের সাথে যুক্ত হবার প্রকল্প উইঘুরের মাঝ দিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির থেকে বের হয়ে ‘চায়না পাকিস্তান ইকনমিক করিডোর’ বা ‘সিপিইসি’ বা ‘সিপেক’এর রাস্তা উইঘুরের হাইওয়ে ‘জি৩১৪’এর মিলেছে এবং এরপর তা কাশগরএর জংশনের সাথে যুক্ত হয়েছে। এখান থেকে হাইওয়ে ‘জি৩০১২’ উত্তরপূর্ব দিকে উইঘুরের রাজধানী উরুমচি এবং বাকি চীনের সাথে যুক্ত হয়েছে। কাশগর থেকে  হাইওয়ে ‘জি২১৯’ বের হয়ে তিব্বতের রাজধানী লাসা গিয়েছে। এই হাইওয়ে ‘জি২১৯’ পুরো ভারতের উত্তর সীমার প্রায় সমান্তরাল গিয়েছে। এটাই হলো সেই হাইওয়ে, যা ভারতকে বিচলিত করেছে। এই হাইওয়ে চীন নিয়ন্ত্রিত আকসাই চিন অঞ্চলের মাঝ দিয়ে যায়, যা ভারত নিজের অঞ্চল বলে দাবি করে আসছে। চীনের রাষ্ট্রীয় পত্রিকা ‘গ্লোবাল টাইমস’ জানাচ্ছে যে, ‘জি২১৯’ রাস্তা ১৯৫১ থেকে ১৯৫৭ সালের মাঝে তৈরি করা হয়। এর মাঝে বেশকিছু অংশ ছিল কাঁচা রাস্তা, যা ২০১৩ সালে পাকা করা হয়। ‘শিনহুয়া’ বলছে যে, এই রাস্তার লাদাখের কাছাকাছি জিয়েশান দাবান অংশ সমুদ্র সমতল থেকে ৫ দশমিক ২৫ কিঃমিঃ উঁচু। এই অঞ্চলে গাড়ি চালাতে গেলে অনেকেই অক্সিজেন মাস্ক পড়ে থাকেন। 

তিব্বতের রাজধানী লাসার পশ্চিমে শিগাটসে পর্যন্ত রেললাইন তৈরি করে বাকি চীনের সাথে সংযুক্ত করা হয় ২০১৪ সালে। এর আগে লাসা পর্যন্ত রেললাইন তৈরির কাজ শেষ হয় ২০০৬ সালে। আবার উইঘুর রাজ্যে পশ্চিমের কাশগর থেকে আকসাই চিনের উত্তরে হোতান পর্যন্ত রেললাইন তৈরি করা হয় ২০১০ সালে। এই রেললাইনের সাথেই ‘সিপেক’কে যুক্ত করার পরিকল্পনা চলছে। কাশগর পর্যন্ত রেললাইন তৈরি করা শেষ হয় ১৯৯৯ সালে। প্রত্যেকটা প্রকল্পই ছিল চীন সরকারের মেগা প্রকল্প। এই রেললাইনগুলি ব্যবহার করে চীন পক্ষে ভারতের সাথে সীমানায় সামরিক স্থাপনা গড়ে তোলা সহজ হয়েছে। বহুকাল যাবত চীনের জন্যে এই সীমানাগুলি পাহাড়া দেয়া কঠিন ছিল। এখন মাল্টিবিলিয়ন ডলারের প্রকল্পগুলি চীনের জন্যে নিজের অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যেমন সহজ হয়েছে, তেমনি তা ভারতকে করেছে বিচলিত।

ভারতের ২৮টা ফাইটার স্কোয়াড্রনের মাঝে ১৭টাই কাশ্মির এবং লাদাখের কাছাকাছি মোতায়েন রয়েছে। এই ১৭টা স্কোয়াড্রনে রয়েছে প্রায় ২’শ ৭২টা ফাইটার বিমান; যার মাঝে প্রথম সাড়ির বিমান ১’শ ৭৬টা এবং দ্বিতীয় সাড়ির বিমান ৯৬টা। এগুলির বিপরীতে চীনারা বর্তমানে মোতায়েন করেছে গোটা পঞ্চাশেক বিমান। সীমান্তের কাছাকাছি নিজেদের পাঁচ গুণ বেশি যুদ্ধবিমান মোতায়েন রাখা সত্ত্বেও ভারত চীনাদের ব্যাপারে উতকন্ঠায় রয়েছে। ১৯৪৭ পরবর্তী ভারতের সার্বক্ষণিক চিন্তায় নিরাপত্তাহীনতাই ছিল সর্বাগ্রে। 


তবুও ভারত এবং চীনের অসমান সক্ষমতা

‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় সুমিত গাঙ্গুলি এবং মানজিত পারদেসি বলছেন যে, ১৯৮৮ সালে যখন রাজীব গান্ধী চীনের সাথে আলোচনায় বসেছিলেন, তখন দুই দেশ কৌশলগত দিক থেকে মোটামুটিভাবে তুলনীয় ছিল। ভারতের জিডিপি তখন ছিল ২’শ ৯৭ বিলিয়ন ডলার; চীনের ছিল ৩’শ ১২ বিলিয়ন। ভারতের সামরিক বাজেট ছিল প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার; চীনের ছিল ১১ বিলিয়ন। কিন্তু বর্তমানে চীনের জিডিপি ১৩ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলার; যা কিনা ভারতের ২ দশমিক ৭ ট্রিলিয়নের প্রায় ৫ গুণ! আর ২০১৯ সালে চীনের সামরিক বাজেট ছিল ২’শ ৬১ বিলিয়ন ডলার; যা ভারতের ৭১ বিলিয়ন ডলারের চার গুণ! দুই দেশেরই অর্থনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পেলেও চীনারা ভারতের সাথে বড় রকমের পার্থক্য তৈরি করে ফেলেছে, যা কিনা দুই দেশের কৌশলগত ব্যালান্সকে সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। চীন তিব্বতে তার অবকাঠামোর অনেক উন্নয়ন করেছে; উঁচু পাহড়ি অঞ্চলে ব্যবহারের জন্যে ‘টাইপ ১৫’ ট্যাঙ্ক ডেভেলপ করেছে। ৩৩ টন ওজনের এই হাল্কা ট্যাঙ্ক চীনারা ২০১৮ সাল থেকে সার্ভিসে এনেছে।

চীনের সীমানায় ভারতীয় সেনাবাহিনী যেসব ইউনিট মোতায়েন করেছে, সেগুলির পক্ষে পাহাড়ি অঞ্চলের রাস্তা বেয়ে চীনের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করা খুবই কঠিন। এখানে উঁচু পাহাড়ের কারণে রাস্তাগুলি সরু এবং রাস্তার উপর সামরিক বহরের বিমান আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়াটা সহজ নয়। চীনা বিমান বাহিনী এক্ষেত্রে খুব সহজেই ভারতীয় সাপ্লাই রাস্তাগুলি আটকে দিতে পারবে, যদি না ভারতীয় বিমান বাহিনী চীনা বিমান বাহিনীকে আকাশযুদ্ধে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় বিমান বাহিনী তার প্রয়োজনীয় ৪২ স্কোয়াড্রন ফাইটার বিমান রাখতে পারছে না। অনেকেই বলছেন যে, পুরোনো বিমান অবসরে পাঠানো এবং নতুন বিমান ক্রয়ে দীর্ঘসূত্রিতার জেরে ভারতীয় বিমান বাহিনীকে ২০২০এর পর থেকে ২৬ স্কোয়াড্রন ফাইটার বিমান নিয়েই খুশি থাকতে হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে হিমালয়ের পাদদেশে চীনাদের সাথে যুদ্ধে ভারতীয়রা আকাশ নিজেদের দখতে নিতে পারবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। 
তবে কাশ্মির ও লাদাখের কাছাকাছি ভারতের বিমান বাহিনীর শক্তি অন্ততঃ কাগজে কলমে হলেও গুরুত্ব রাখে। ডাচ ম্যাগাজিন ‘স্ক্র্যাম্বল’ ভারতীয় বিমান বাহিনীর ঘাঁটিগুলিতে মোতায়েনকৃত স্কোয়াড্রনগুলিকে দেখাবার চেষ্টা করেছে। এর মাঝে আকাশ নিয়ন্ত্রণের জন্যে নিযুক্ত ইউনিটগুলি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আদমপুরে রয়েছে ‘মিগ-২৯’ বিমানের ৪৭তম এবং ২২৩তম স্কোয়াড্রন। হালওয়ারাতে রয়েছে ‘সুখোই-৩০’এর ২২০তম এবং ২২১তম স্কোয়ড্রন। বারেইলিতে রয়েছে ‘সুখোই-৩০’এর ৮ম এবং ২৪তম স্কোয়াড্রন। লেহতে রয়েছে ২৮তম স্কোয়াড্রনের ‘মিগ-২৯’। গোয়ালিয়রে রয়েছে ‘মিরেজ-২০০০’এর ১ম, ৭ম এবং ৯ম স্কোয়াড্রন। সিরসাতে রয়েছে ‘সুখোই-৩০’এর ১৫তম স্কোয়াড্রন। অর্থাৎ প্রথম সাড়ির ফাইটার বিমানের ১১টা স্কোয়াড্রন ছড়িয়ে আছে ৬টা বিমান ঘাঁটিতে। এছাড়াও দ্বিতীয় সাড়ির ফাইটার হিসেবে ‘মিগ-২১’ বিমানের ৫১তম, ২৬তম, ২১তম, ২৩তম স্কোয়াড্রন এবং ‘জাগুয়ার’ বিমানের ৫ম এবং ১৪তম স্কোয়াড্রনও কাছাকাছি মোতায়েন রয়েছে। অর্থাৎ দ্বিতীয় সাড়ির আরও ৬টা ফাইটার স্কোয়াড্রনও মোতায়েন রয়েছে কাছাকাছি। আম্বালাতে ফরাসী নির্মিত ‘রাফাল’ জেটগুলি ১৭তম স্কোয়াড্রনে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এবছরের জানুয়ারিতে ভারতীয় বিমান বাহিনী বলে যে, এই মুহুর্তে তাদের ২৮ স্কোয়াড্রন ফাইটার অপারেশনাল রয়েছে। এর মাঝে ১২টা ‘সুখোই-৩০’, ৩টা ‘মিগ-২৯’, ৬টা ‘জাগুয়ার’, ৩টা ‘মিরেজ-২০০০’, একটা ‘তেজাস’ এবং ৩টা ‘মিগ-২১’ স্কোয়াড্রন। আর উপরের সংক্ষ্যাগুলি বলছে যে, ২৮টা স্কোয়াড্রনের মাঝে ১৭টাই কাশ্মির এবং লাদাখের কাছাকাছি মোতায়েন রয়েছে। এই ১৭টা স্কোয়াড্রনে রয়েছে প্রায় ২’শ ৭২টা ফাইটার বিমান; যার মাঝে প্রথম সাড়ির বিমান ১’শ ৭৬টা এবং দ্বিতীয় সাড়ির বিমান ৯৬টা। এগুলির বিপরীতে চীনারা বর্তমানে মোতায়েন করেছে গোটা পঞ্চাশেক বিমান।

পাকিস্তানের সাথে কয়েক দফা যুদ্ধের পর ভারতের বিমান ঘাঁটিগুলি সর্বদাই যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত রাখা হয়। সেখানে বিমানের জন্যে বিশেষ সুরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। বেশিরভাগ বিমানই শেলটারের ভিতর রাখা হয়ে থাকে। প্রতিটা ঘাঁটিতেই একাধিক রানওয়ে রয়েছে দ্রুত বিমান ওঠানামা করার জন্যে। অপরদিকে চীনের ঘাঁটিগুলিতে ফাইটার বিমান টারমাকের উপরেই রাখা হচ্ছে। ঘাঁটির সংখ্যাও কম; ঘাঁটিতে রানওয়ের সংখ্যাও কম। প্রকৃতপক্ষে চীনারা যুদ্ধের সম্ভাবনাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়নি। তবে সীমান্তকে একেবারে অরক্ষতিও রাখতে চায়নি। সীমান্তের দু’পাশে উভয় পক্ষই অবকাঠামো উন্নয়ন করেছে। তবে ভারতের এই উন্নয়ন সীমান্তের নিরাপত্তা দেবার জন্যে হলেও চীনের ক্ষেত্রে তার পশ্চিমের প্রদেশগুলিকে আরও শক্তভাবে ধরে রাখার উদ্দেশ্য কাজ করেছে। ভারত চীনা সীমান্তে তার যুদ্ধ করার সক্ষমতা বৃদ্ধি করলেও চীনারা ভারতের সকল চেষ্টার জবাব দেয়ার চেষ্টা করেনি।

লাদাখে দুই পক্ষের প্রায় শ’খানেক সেনা হাতাহাতি সংঘাতে লিপ্ত হয়। তবে কোন আগ্নেয়াস্ত্র কোন পক্ষই ব্যবহার করেনি। গত দুই দশকে ভারত এবং চীনের সীমান্ত পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে এবং তা অব্যহত থাকবে। এতে উভয় পক্ষই নিরাপত্তাহীনতার মাঝে পড়বে, যা উত্তেজনা এবং সংঘাতের সম্ভাবনা বাড়াবে। তবে লাদাখের সীনামায় দুই দেশের সেনাদের আগ্নেয়াস্ত্রবিহীন সংঘর্ষ বলে দিচ্ছে যে, কেউই সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে চাইছে না। ভারত যেমন তার সীমানাকে যুদ্ধ ছাড়াই রক্ষা করতে চাইছে, তেমনি চীনারাও বুঝতে পারছে যে, যুদ্ধ চীনের জাতীয় নিরাপত্তাকে আরও বড় হুমকিতে ফেলবে।


যুদ্ধের সম্ভাবনা আসলে কতটুকু? 

‘বিবিসি’ তাদের বিশ্লেষণে বলছে যে, চীনারা ভারতের বিজেপি নেতৃবৃন্দের পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মির দখল করে নেবার হুমকিকে চীনারা হয়তো হাল্কাভাবে নেয়নি। কারণ আজাদ কাশ্মিরের মাঝ দিয়েই ‘সিপেক’ চীনের উইঘুরের হাইওয়ে ‘জি৩১৪’এর সাথে মিলিত হয়েছে। ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ তাদের বিশ্লেষণে বলছে যে, দুই দেশের মাঝে বাণিজ্যও কিন্তু থেমে থাকেনি। চীনের এক’শর বেশি কোম্পানি ভারতে বিনিয়োগ করেছে। চীনা কোম্পানিগুলি ভারতের মোবাইল ফোন বাজারের ৬০ শতাংশ দখল করে রেখেছে। ২০১৮ সালে দুই দেশের মাঝে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৯৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯এর প্রথমার্ধে এই বাণিজ্য ছিল ৫৩ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধের মাঝে ভারত চাইছে চীন থেকে বের হয়ে যাওয়া কোম্পানিগুলিকে ভারতে নিয়ে আসতে। মোটকথা দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক এমন একটা অবস্থানে রয়েছে যে, কেউই সেটাকে সমস্যায় ফেলতে চাইবে না।

সীমান্তের কাছাকাছি নিজেদের পাঁচ গুণ বেশি যুদ্ধবিমান মোতায়েন রাখা সত্ত্বেও ভারত কেন চীনাদের ব্যাপারে উতকন্ঠায় রয়েছে? চীনাদের অবকাঠামো উন্নয়ন কেন ভারতকে চিন্তিত করেছে, যেখানে চীনারা সামরিক দিক থেকে খুব কমই শক্তি মোতায়েন করেছে? নিজস্ব সীমান্ত অবকাঠামো উন্নয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে অত্যাধুনিক অস্ত্র কেনাকেই বা ভারত কেন মনে করেনি যে তা চীনাদের উস্কে দিতে পারে? বিজেপি সরকারের আজাদ কাশ্মির দখলের চিন্তাকে চীনারা যদি তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ‘সিপেক’এর প্রতি হুমকি হিসেবে নেয়, তাহলে সেব্যাপারে ভারত কি অবস্থান নেবে, সেটা ভেবে দেখেছে কি? ১৯৪৭ পরবর্তী ভারতের সার্বক্ষণিক চিন্তায় নিরাপত্তাহীনতাই ছিল সর্বাগ্রে। বিশেষ করে নিজের ভৌগোলিক অখন্ডতা প্রশ্নে ভারত প্রয়োজনে আগ্রাসী ভূমিকাও নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের এই নিরাপত্তাহীনতাকে ব্যবহার করে অস্ত্র সরবরাহ করেছে; যা চীনকে তার স্থলসীমানার দিকে কিছুটা হলেও তাকাতে বাধ্য করেছে। তবে চীনারা আপাততঃ যদিও যুদ্ধ প্রস্তুতির দিকে দ্রুত অগ্রসর হয়নি, তথাপি ভারতের সামরিক সক্ষমতার পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধন চীনের জন্যে কিছুটা হলেও হুমকি তৈরি করেছে। ‘সিপেক’এর প্রতি হুমকি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রকে এগিয়ে রাখবে। আর চীনারা যেহেতু উইঘুর এবং তিব্বতের অবকাঠামো উন্নয়ন বন্ধ করতে পারবে না, সেহেতু নিরাপত্তাহীনতা ভারতকে সামনের দিনে আরও বেশি গ্রাস করবে। বিশেষ করে ভবিষ্যতে কাশ্মির ইস্যুতে পাকিস্তান এবং চীনের একত্রে থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়ায় তা ভারতকে বিচলিত করবে এবং তাকে আরও প্রবলভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয়ের মাঝে নিয়ে যাবে। উপসংহারে বলা যায় যে, গত দুই দশকে ভারত এবং চীনের সীমান্ত পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে এবং তা অব্যহত থাকবে। এতে উভয় পক্ষই নিরাপত্তাহীনতার মাঝে পড়বে, যা উত্তেজনা এবং সংঘাতের সম্ভাবনা বাড়াবে। তবে লাদাখের সীনামায় দুই দেশের সেনাদের আগ্নেয়াস্ত্রবিহীন সংঘর্ষ বলে দিচ্ছে যে, কেউই সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে চাইছে না। ভারত যেমন তার সীমানাকে যুদ্ধ ছাড়াই রক্ষা করতে চাইছে, তেমনি চীনারাও বুঝতে পারছে যে, যুদ্ধ চীনের জাতীয় নিরাপত্তাকে আরও বড় হুমকিতে ফেলবে। 

No comments:

Post a Comment