Monday 8 June 2020

ক্যারিবিয়ানে কানাডার কি স্বার্থ রয়েছে?

০৯ই জুন ২০২০
  
ভেনিজুয়েলাতে মাদুরোর বিরুদ্ধে মিশন যে ব্যর্থ হবে, তা যদি সকলেই আগে থেকেই জানে, তাহলে এই মিশন কেন বাস্তবায়িত হলো? এই মিশনের নেতা গুডরোর স্বার্থই বা কি ছিলো? আর এক্ষেত্রে তার যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার নাগরিকত্ত্বের মাঝে কোন দ্বন্দ্ব আছে কিনা?

মে মাসের শুরুতে ভেনিজুয়েলার সরকার বলে যে, তারা প্রেসিডেন্ট মাদুরোর বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিয়েছে। তারা বলে যে, সমুদ্রপথে কলম্বিয়া থেকে আসা কিছু ভাড়াটে সেনাকে তারা হত্যা করেছে এবং কিছু সেনাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দু’জন মার্কিন নাগরিককে তাদের পাসপোর্ট এবং অন্যান্য পরিচয়পত্রসহ টেলিভিশনে দেখানো হয়। এরা হলেন ৪১ বছর বয়সী এইরান ব্যারি এবং ৩৪ বছর বয়সী লিউক ডেনমান। ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, এরা উভয়েই মার্কিন সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফোর্সের প্রাক্তন সদস্য ছিলেন বলে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে। এই ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় অবস্থিত ‘সিলভার কর্প’ নামের একটা নিরাপত্তা কোম্পানির মালিক জরডান গুডরো দাবি করেন যে, এই মিশন তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মাদুরোকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসা। তিনি আরও দাবি করেন যে, যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত ভেনিজুয়েলার নেতা হুয়ান গুয়াইদোর সাথে চুক্তি মোতাবেক তিনি এই অপারেশনে যান। তবে গুয়াইদো তাকে পারিশ্রমিক দেননি বলেও বলেন তিনি। ভেনিজুয়েলার টেলিভিশনে দেখানো মার্কিন সেনারা দাবি করেন যে, মিশনে যাবার সময় তারা তাদের সাথে গুয়াইদোর স্বাক্ষরিত চুক্তিপত্রও নিয়ে গিয়েছেন। মাদুরো দাবি করেন যে, মিশন চালানো ব্যক্তিরা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিরাপত্তা বাহিনীর লোক। গুয়াইদো এবং ট্রাম্প প্রশাসন উভয়েই এই মিশনের সাথে জড়িত থাকার কথা পুরোপুরি অস্বীকার করে। ‘ভোক্স’ ম্যাগাজিনের সাথে কথা বলতে গিয়ে মার্কিন নৌবাহিনীর প্রাক্তন স্পেশাল ফোর্সের সদস্য এফরাহিম মাত্তোস বলেন যে, পুরো বিষয়টা এতটাই হাস্যকর যে, এটা কখনোই কাজ করার কথা নয়। এটাকে তিনি বদ্ধ উন্মাদের কাজ বলে উল্লেখ করেন। ‘আল জাজিরা’র এক আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রশ্ন করা হয় যে, এই মিশন যে ব্যর্থ হবে, তা যদি সকলেই আগে থেকেই জানে, তাহলে এই মিশন কেন বাস্তবায়িত হলো?

কে এই জরডান গুডরো? ১৯৭৬ সালে গুডরো কানাডার ক্যালগারিতে জন্ম নেন। কলেজ শেষ করে তিনি কানাডার সামরিক বাহিনীতে ঢোকেন। তবে পরবর্তীতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান এবং ২০০১ সালে মার্কিন সেনাবাহিনীতে নাম লেখান। তিনি সেখানে স্পেশাল ফোর্সের সদস্যও হয়ে যান। ‘১০ম স্পেশাল ফোর্সেস গ্রুপ’এর সার্জেন্ট ফার্স ক্লাস পদ পান তিনি। তিনি বিভিন্ন সামরিক মিশনে অংশ নেন এবং ২০১৪ সালের অগাস্টে একটা প্যারাসুট দুর্ঘটনার পর ২০১৬ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। অবসরের পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নেন। ২০১৮ সালে তিনি ‘সিলভার কর্প’ নামের একটা নিরাপত্তা কোম্পানি চালু করেন। ২০১৮ সালের ২৬শে অক্টোবর নর্থ ক্যারোলিনার শারলোটসভিলে এক অনুষ্ঠানে ট্রাম্পের নিরাপত্তার কাজও করেন তিনি, যা ছবিতে দেখাও যায়। মাদুরো এই ব্যাপারটাকেই টার্গেট করেছেন।

এই অদ্ভূত ঘটনার পর প্রশ্ন আসছে যে, এই মিশনের উদ্দেশ্যই কি ছিলো ব্যর্থ হওয়া? গুয়াইদো যদি অর্থায়ন না করে থাকেন, তাহলে কেই বা অর্থায়নই করেছে? এখানে গুডরোর স্বার্থই বা কি ছিলো? কানাডার নাগরিক হওয়াতে ব্যাপারটা আরও ঘনীভূত হয়েছে। আর ভেনিজুয়েলার সাথে কিউবার ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে এখানে কিউবার কোন ভূমিকা আছে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। তবে সবচাইতে বড় প্রশ্ন হলো, গুডরো সরাসরি ব্যাপারটাকে স্বীকার করে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকেই আঘাত করেছেন কিনা? আর এক্ষেত্রে তার যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার নাগরিকত্ত্বের মাঝে কোন দ্বন্দ্ব আছে কিনা? মধ্য আমেরিকা, তথা ক্যারিবিয় অঞ্চলে কানাডার কর্মকান্ডের ইতিহাস দেখলে অনেক কিছুই হিসেব থেকে বাদ দেয়া সম্ভব নয়। ক্যারিবিয়ানে যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার আড়াই’শ বছরের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতার ইতিহাসটাই এখন আলোচনায় চলে আসছে।
   
১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘সারাটোগা’ পানামা খাল পারি দিচ্ছে। এই খাল যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক এবং প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলকে যোগ করেছে। এই খাল তৈরি করার পর যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবিয়ানের নিরাপত্তা নিয়ে আরও গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকে। ফলশ্রুতিতে ক্যারিবিয়ানে প্রভাব বিস্তার নিয়ে ব্রিটেনের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় তারা।

পানামা খাল ও এর নিরাপত্তা

১৭৭৬ সালে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্মের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকা মহাদেশে ইউরোপিয় প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করতে থাকে। ঊনিশ শতকের শুরুতে দক্ষিণ আমেরিকায় অনেকগুলি দেশ ব্রিটিশ সহায়তায় স্পেন থেকে আলাদা হয়ে যায়। এই সময়েই ১৮২৩ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেমস মনরো ঘোষণা দেন যে, এখন থেকে ইউরোপিয় শক্তিরা যদি আমেরিকায় কোন স্বাধীন দেশের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র সেই প্রচেষ্টাকে নিজের স্বার্থবিরুদ্ধ মনে করবে। ১৮৫০ সাল নাগাদ জেমস মনরোর এই চিন্তাটা ‘মনরো ডকট্রাইন’ নামে পরিচিতি পায়। যুক্তরাষ্ট্রের জন্মের সময় শুধুমাত্র আটলান্টিক উপকূলের ১৩টা রাজ্য নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল। এরপর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম দিকে তার স্থলভাগ বৃদ্ধি করতে থাকে। ১৮৪৬ সাল নাগাদ ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত মার্কিন নিয়ন্ত্রণ পৌঁছে গেলে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বিস্তৃতি পূর্বে আটলান্টিকের উপকূল থেকে পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এর ফলশ্রুতিতে যুক্তরাষ্ট্রের দুই উপকূলকে সমুদ্রপথে যুক্ত করার চিন্তাটা শক্তিশালী হতে থাকে। এর আগেই ১৮২৬ সালে স্পেন থেকে নতুন আলাদা হয়ে যাওয়া ‘গ্র্যান কলম্বিয়া’র নেতৃবৃন্দের সাথে মার্কিন কর্মকর্তারা মধ্য আমেরিকায় একটা খাল তৈরির প্রকল্প নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। এই খালের মাধ্যমে আটলান্টিক এবং প্রশান্ত মহাসাগরকে যুক্ত করা যাবে। তবে গ্র্যান কলম্বিয়ার নেতা সিমন বলিভার এই প্রস্তাবে রাজি হননি। ১৮৪৬ সালে ‘গ্র্যান কলম্বিয়া’ থেকে আলাদা হয়ে তৈরি হওয়া ‘নিউ গ্রানাডা’র (পরবর্তী কলম্বিয়া) সাথে মার্কিনীরা এক চুক্তি করে। চুক্তি মোতাবেক যুক্তরাষ্ট্র পানামা যোযকের স্থানে আটলান্টিক উপকূল থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল পর্যন্ত ৭৭ কিঃমিল লম্বা একটা রেললাইন তৈরি করে। ১৮৫৫ সালে এই রেললাইন উন্মুক্ত হয়। এই সময় থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক উপকূল থেকে জাহাজ পানামা পর্যন্ত যেত। এরপর রেললাইনের মাধ্যমে মানুষ প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল পর্যন্ত গিয়ে আরেকটা জাহাজে উঠে ক্যালিফোর্নিয়া যেত। ফরাসীরা এই রেললাইনের সমান্তরালে একটা খাল তৈরি করার চেষ্টা শুরু করে ১৮৮১ সালে। তবে ১৮৯৪ সাল নাগাদ তারা ব্যর্থ হবার পর যুক্তরাষ্ট্রের সামনে কোন ইউরোপিয় বাধা থাকে না। ১৯০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপে কলম্বিয়া থেকে পানামা আলাদা হয়ে যায় এবং পানামার সাথে খাল খননের জন্যে মার্কিন সরকার একটা চুক্তি করে। এই চুক্তি মোতাবেক ১৯০৪ থেকে ১৯১৪ সালের মাঝে পানামা খাল তৈরি করে। এখানকার নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকে পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রের উপর। এই খালের নিরাপত্তা দিতে খালের পূর্বদিকে ক্যাবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে ভাবতে শুরু করে।

পানামা খাল তৈরি করার আগেই যুক্তরাষ্ট্র মেক্সিকো উপসাগর এবং ক্যারিবিয়ান সাগরে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা উপকূল থেকে দক্ষিণ আমেরিকার উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত। পশ্চিমে কিউবা থেকে শুরু করে এই পূর্বে ত্রিনিদাদ টোবাগোর মাধ্যমে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের সমাপ্তি। মেক্সিকো উপসাগর এবং ক্যারিবিয়ান সাগরকে খাঁচার মতো ঘিরে রেখেছে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ। এই ভৌগোলিক বাস্তবতায় পানামা খাল দিয়ে যাতায়াত করা জাহাজগুলিকে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূল পৌঁছাতে হলে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের মাঝ দিয়ে যাওয়া প্রণালিগুলি পার হয়ে যেতে হবে। কিন্তু ঊনিশ শতকের শুরুতে এই দ্বীপগুলির সবগুলিই ছিল ইউরোপিয় শক্তিদের হাতে। ১৮৫৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের মানুষেরা কিউবাকে কিনে নেবার প্রস্তাব দিলেও সেটা উত্তরের মার্কিনীদের বিরোধের কারণে সফল হয়নি। দ্বীপগুলির মাঝে সবচাইতে বড় দ্বীপ কিউবাতে স্প্যানিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের উস্কে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ১৮৯৪ সাল নাগাদ বাণিজ্যের জন্যে কিউবা স্পেনের চাইতে যুক্তরাষ্ট্রের উপরেই বেশি নির্ভরশীল ছিল। যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের স্বার্থ রক্ষায় ১৮৯৮ সালে স্পেনের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। চার মাসের এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র স্পেনের কাছ থেকে ক্যারিবিয়ানের দ্বীপ পুয়ের্তো রিকো দখল করে নেয়। কিউবাকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয় স্প্যানিশরা। একইসাথে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ফিলিপাইন এবং গুয়ামকে দখল করে নেয় যুক্তরাষ্ট্র।

এছাড়াও পুয়ের্তো রিকো এবং ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জের মাঝে অবস্থিত ডেনমার্কের অধীনে থাকা ড্যানিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্র নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইছিল। ১৮৫০এর দশকেই মার্কিন কর্মকর্তারা ডেনমার্কের কাছ থেকে এই দ্বীপগুলি কিনে নিতে চাইছিল। তবে মার্কিন সিনেট একমত হতে না পারায় এই ক্রয় সম্ভব হয়নি। এরপর ১৮৯৯ থেকে ১৯০২ সালের মাঝে আরও একবার দীপগুলি কেনার কথা আসলে ড্যানিশ পার্লামেন্টের একমত না হতে পারার কারণে প্রকল্প ভেস্তে যায়। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাঝে ১৯১৬ সালে ডেনমার্কের যখন জার্মানির হাতে চলে যাবার সম্ভাবনা তৈরি হয়, তখন ২৫ মিলিয়ন ডলারে দ্বীপগুলি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করে দেয়ার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে যায়। এই চুক্তির অধীনে যুক্তরাষ্ট সেন্ট ক্রই, সেন্ট জন এবং সেন্ট থমাস দ্বীপ পেয়ে যায়। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো পুয়ের্তো রিকো এবং এই দ্বীপগুলির মাঝ দিয়ে প্রায় ৪০ কিঃমিঃ প্রস্থের সমুদ্র প্রণালী পুরোপুরিভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আসে।
  
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ত্রিনিদাদে ‘ওয়ালার’ বিমান ঘাঁটিতে মার্কিন ‘বি-২৪’ এন্টি-সাবমেরিন বোমারু বিমান। অস্ত্র সহায়তা দেয়ার বিনিময়ে মার্কিনীরা ক্যারিবিয়ানে ব্রিটিশ দ্বীপগুলিতে ৯৯ বছরের জন্যে ঘাঁটি লীজ পেয়ে যায়। ব্রিটেনের উপর জার্মানির চাপ যখন সর্বোচ্চ, তখনই যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনের কাছ থেকে ঘাঁটিগুলি আদায় করে নেয়।

ডেস্ট্রয়ারের বিনিময়ে ব্রিটিশ ঘাঁটি

ক্যারিবিয়ানে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আরও দৃঢ় হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝে। ১৯৪০ সালে জার্মান সৈন্যরা যখন ফ্রান্সের মাঝ দিয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, তখন মার্কিন সরকার যুক্তরাষ্ট্রে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত ফিলিপ কারএর মাধ্যমে লন্ডনের কাছে প্রস্তাব পাঠায়, যাতে কানাডার আটলান্টিক উপকূলের নিউফাউন্ডল্যান্ড এবং ক্যারিবিয়ানে ত্রিনিদাদ এবং বার্মুডায় ব্রিটিশ বিমান ঘাঁটিগুলি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে লিজ দেয়ার করা বলা হয়। ২৭শে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সামরিক সহায়তার বিনিময়ে এই ঘাঁটি দিতে রাজি হন। ব্রিটিশরা আটলান্টকে জার্মান সাবমেরিনের হাত থেকে ব্রিটিশ সমুদ্র বাণিজ্য রক্ষা করতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নৌবাহিনীর কিছু পুরোনো ডেস্ট্রয়ার চায়। তবে যুক্তরাষ্ট্র তাতে তৎক্ষণাৎ রাজি হয়নি। অবশেষে অগাস্টের শেষে যখন ব্রিটেন জার্মানির দ্বারা একেবারেই কোণঠাসা হয়ে যায়, তখন দুই দেশ সমঝোতায় পৌঁছায়। চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটেন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ৫০টা ডেস্ট্রয়ার লাভ করে। আর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ড উপকূলে ৪টা বিমান ঘাঁটি এবং ক্যারিবিয়ানে বার্মুডা, এন্টিগা, বাহামা, ব্রিটিশ গায়ানা, জামাইকা, সেন্ট লুসিয়া এবং ত্রিনিদাদে বিমান ও নৌঘাঁটি ৯৯ বছরের জন্যে লীজ পায়। আর এই লীজের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রকে কোন অর্থ দিতে হবে না! এর মাধ্যমে এক শতকের জন্যে যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবিয়ানে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করে ফেলে।

ক্যারিবিয়ানে ব্রিটিশ উপনিবেশগুলির মাঝে বাহামা, জামাইকা, এন্টিগা, সেন্ট কিটস এন্ড নেভিস, ডমিনিকা, সেন্ট লুসিয়া, ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগো এবং গায়ানাকে ব্রিটিশরা স্বাধীনতা দেয়। ১৯৬০এর দশক থেকে ১৯৮০এর দশকের মাঝে এই উপনিবেশগুলিকে স্বাধীনতা দেয়া হয়। তবে দ্বীপগুলি অনেকক্ষেত্রেই রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়াতে সক্ষম ছিল না। ব্রিটিশদের অধীনে থাকা এই অঞ্চলগুলিতে ইংরেজি ছিল অফিশিয়াল ভাষা। মূলতঃ এই ইংরেজি ভাষাভাষি অঞ্চলগুলিতে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের প্রতিযোগিতা চলছে। তবে বাকি দ্বীপগুলি নিয়েও চলছে প্রতিযোগিতা; যেমন একসময় স্প্যানিশদের অধীনে থাকা কিউবা ও ডমিনিকান রিপাবলিক; এবং ফরাসীদের অধীনে থাকা হাইতি। এই দ্বীপগুলিতে যথাক্রমে স্প্যানিশ ও ফরাসী ভাষা চলে। প্রভাব বিস্তারের খেলায় কোন দ্বীপই বাদ যাচ্ছে না।
   
অনেকেই মনে করছেন যে, হাইড্রোকার্বন এই অঞ্চলের অর্থনীতিকে আবারও পরিবর্তন করবে। তবে চিনি, মদ, কফি, কলা, বক্সাইট, পর্যটন, ব্যাংকিং, টেক্সটাইল বা হাইড্রোকার্বন কোনটাই ক্যারিবিয়ানের সাথে কানাডার গভীর সম্পর্কের মূল কারণ নয়। ক্যারিবিয়ানে শক্ত অবস্থানে থাকার কারণেই কানাডা এখানকার ব্যবসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পেরেছে। আর এই শক্ত অবস্থানের ভিত্তি রাজনৈতিক। ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতার মাঝেই কানাডার প্রভাব বিস্তারের বীজ নিহিত।

ক্যারিবিয়ানের অর্থনীতিতে কানাডা

ষোড়শ শতক থেকেই ক্যারিবিয়ানে ইউরোপিয় ঔপনিবেশিকেরা আখের চাষ শুরু করে চিনি উৎপাদন শুরু করে। সেখানকার বাসিন্দাদের নির্মূল করে ফেলার পর চিনি শিল্পে কাজ করাতে ইউরোপিয়রা আফ্রিকা থেকে লক্ষ লক্ষ ক্রীতদাস নিয়ে আসে। চিনি শিল্পের সাথে মদও উৎপাদিত হতো। কলা, কোকোয়া, কফি এবং তামাকও যুক্ত হয় অর্থকরী ফসল হিসেবে। তবে সকল খাদ্যশস্যই আমেরিকার মূল ভূখন্ড থেকে আসতে হতো। মোটামুটিভাবে ঊনিশ শতকের প্রথমভাগ পর্যন্ত চিনির ব্যবসা ভালোভাবে চললেও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আখ এবং বীট চাষ শুরু হওয়ায় চিনির মূল্যে ধ্বস নামে এবং ক্যারিবিয়ানের ভাগ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আসে।

অষ্টাদশ শতকের শুরুর দিকে উত্তর আমেরিকার ফরাসী উপনিবেশগুলির সাথে ক্যারিবিয়ানের ফরাসী উপনিবেশগুলির বেস বাণিজ্য চলছিল। বর্তমান কানাডার আটলান্টিক উপকূলে নোভা স্কোশিয়ার সাথেই মূলতঃ এই বাণিজ্য চলছিল। ১৭৫৬ থেকে ১৭৬৩ সালের মাঝে সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটেন ফ্রান্সের কাছ থেকে পুরো উত্তর আমেরিকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এর ফলশ্রুতিতে নোভা স্কোশিয়ার সাথে নয়, বরং বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক উপকূলের বন্দরগুলির সাথে ক্যারিবিয়ানের বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। ১৭৭৬ সালে ব্রিটেন থেকে যুক্তরাষ্ট্র আলাদা হয়ে গেলেও ক্যারিবিয়ানের বাণিজ্য যুক্তরাষ্ট্রের সাথেই হতে থাকে। ১৮৬০এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত কানাডার বণিকেরা ক্যারিবিয়ানের সাথে বাণিজ্য বৃদ্ধির কিছুটা চেষ্টা করেন। তবে উৎপাদন বেশি এবং পণ্যের ভিন্নতার কারণে মার্কিনীরাই ক্যারিবিয়ানে এগিয়ে থাকে। শুল্ক বাধা উঠিয়ে দেবার ফলে যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবিয়ানের দ্বীপগুলিতে তার প্রভাব বাড়াতে থাকে। ক্যারিবিয়ানের বাণিজ্যের উপর নির্ভর করে কানাডায় বিভিন্ন শিল্প গড়ে ওঠে।

১৯৫০এর দশক থেকে জাতিসংঘ এবং বিশ্বব্যাংকের উপদেশে ক্যারিবিয়ানে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন শুরু হয়। ক্যারিবিয়ানের কিছু দ্বীপ দেশে জিডিপির ৫০ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত পর্যটনের উপর নির্ভরশীল। ‘ক্যারিবিয়ান ট্যুরিজম অর্গানাইজেশন’এর বরাত দিয়ে ‘ক্যারিবিয়ান জার্নাল’ বলছে যে, ২০১৯ সালে ক্যারিবিয় দ্বীপপুঞ্জে ৩ কোটি ১৫ লক্ষ পর্যটক ভ্রমণ করে। এদের মাঝে প্রায় ৩ কোটি পর্যটকই লাক্সারি ক্রুজ লাইনারে চড়ে ক্যারিবিয়ানে আসে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সর্বোচ্চ ১ কোটি ৫৫ লক্ষ পর্যটক আসলেও প্রায় ৩৪ লক্ষ পর্যটক নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে কানাডা। নিজস্ব জনসংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি কানাডিয় নাগরিক ক্যারিবিয়ানে ভ্রমণ করে থাকে।

তবে এখানকার কিছু দেশের অর্থনীতি অন্য সেক্টরের উপর নির্ভরশীল। হাইতির অর্থনীতির বেশিরভাগটাই রেডিমেড গার্মেন্টস রপ্তানির উপর নির্ভরশীল। জামাইকার অর্থনীতিতে আবার এলুমিনিয়ামের কাঁচামাল বক্সাইট খনির গুরুত্ব অনেক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এলুমিনিয়ামের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবার পর ১৯৫০এর দশক থেকে জামাইকাতে বক্সাইট খনি উত্তোলন শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনীর অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহৃত সকল এলুমিনিয়ামের প্রায় ৪০ ভাগ উৎপাদন করেছিল কানাডা। তাই জামাইকার বক্সাইট খনিতে কানাডার আগ্রহ ছিল সবচাইতে বেশি। কানাডা বর্তমানে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম এলুমিনিয়ান উৎপাদনকারী দেশ। নিজেদের এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রি এবং যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির উপর ভিত্তি করে কানাডা এই অবস্থানে পৌঁছেছে। তবে নিজের দেশে বক্সাইটের খনি না থাকায় কানাডিয়রা একসময় ১৯৭০এর দশক পর্যন্ত জামাইকার উপরেই নির্ভরশীল ছিল। বর্তমানে কানাডা তার বেশিরভাগ বক্সাইট ব্রাজিল এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে আনে। তবে জামাইকা এখনও কানাডার সবচাইতে কাছের বক্সাইট খনি। তাই কানাডার কাছে এখানকার খনির কৌশলগত গুরুত্ব অনেক।

ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগোর অর্থনীতিতে পর্যটনের চাইতে তেল গ্যাস উত্তোলনের গুরুত্ব অনেক। সেখানে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন ছাড়াও পেট্রোকেমিক্যাল ইন্ড্রাস্ট্রিতে ব্যাপক বিনিয়োগ হয়েছে। একসময় এমোনিয়া এবং মিথানল রপ্তানিতে বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় অবস্থানে চলে যায় তারা। তবে ত্রিনিদাদ ছাড়াও ক্যারিবিয়ানের অন্যত্রও শুরু হয়েছে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের হিড়িক। পেট্রোলিয়াম জিওসায়েন্স বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘জিওএক্সপ্রো’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এই মুহুর্তে ক্যারিবিয়ান তেল গ্যাস অনুসন্ধানের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হয়ে উঠছে। কিউবা, ডমিনিকান রিপাবলিক, বাহামা, জামাইকা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস, ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগো এই অঞ্চলের সমুদ্রে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। কানাডার সরকারি ওয়েবসাইটে ত্রিনিদাদে যেসব খাতে কানাডিয়দের বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে, সেগুলির তালিকা দেয় হয়েছে; যার মাঝে প্রথমেই রয়েছে নিরাপত্তা; তারপর শিক্ষা, অবকাঠামো, এবং সবশেষে হাইড্রোকার্বন।

অল্প কিছুদিন আগ পর্যন্তও কানাডার ব্যাংকগুলি ক্যারিবিয়ানে খুবই শক্ত অবস্থানে ছিল। ১৮৮২ সালে কানাডার সাথে ক্যারিবিয়ানের বাণিজ্যের উপর ভর করে কানাডার ব্যাংকগুলি ক্যারিবিয়ানে তাদের সাবসিডিয়ারি খুলতে শুরু করে। বিংশ শতকে ব্রিটিশরা ক্যারিবিয়ান ছেড়ে যেতে থাকলে কানাডার কোম্পানিগুলি তাদের স্থান নিতে থাকে। আর কানাডার সরকার এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে ব্যালান্স করতে কানাডার কোম্পানিগুলিকে সহায়তা দিতে থাকে। ‘আইএমএফ’এর এক হিসেবে বলা হচ্ছে যে, ক্যারিবিয়ানের সকল ব্যাংকের সকল সম্পদের ৬০ শতাংশ কানাডার তিনটা ব্যাংকের হাতে। ‘ফিনানশিয়াল পোস্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০০৯ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ধ্বসের পর ক্যারিবিয়ানের মূল ব্যবসা পর্যটনে যখন মন্দা দেখা দেয়, তখন ক্যারিবিয়ানের লোকাল ব্যাংকগুলি আর্থিক সমস্যায় পরে যায়। অথচ এর মাঝেও কানাডিয়ান ব্যাংকগুলি বিশাল অংকের মুনাফা করে। আর এই ব্যাংকগুলির বার্ষিক প্রতিবেদনে অঞ্চলভিত্তিক বিভাজন এমনভাবে করা হয়, যাতে ক্যারিবিয়ানে কোথায় কিভাবে এই মুনাফা করা হয়েছে, তা যেন বোঝা না যায়। এই ব্যাংকগুলির মুনাফার উৎস খুব সম্ভবতঃ অফশোর ব্যাংকিং। অর্থাৎ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি, যারা নিজেদের আয়ের উৎস লুকিয়ে রাখতে চান, তারাই ক্যারিবিয়ানে এসব ব্যাংকের অর্থ গচ্ছিত রাখেন। তবে ২০১৮ সাল থেকে কানাডিয়ান ব্যাংকগুলি এই অঞ্চল ছেড়ে যাচ্ছে, যার কারণ এখনও পরিষ্কার নয়।

অনেকেই মনে করছেন যে, হাইড্রোকার্বন এই অঞ্চলের অর্থনীতিকে আবারও পরিবর্তন করবে। তবে চিনি, মদ, কফি, কলা, বক্সাইট, পর্যটন, ব্যাংকিং, টেক্সটাইল বা হাইড্রোকার্বন কোনটাই ক্যারিবিয়ানের সাথে কানাডার গভীর সম্পর্কের মূল কারণ নয়। কানাডার অর্থনীতির তুলনায় ক্যারিবিয়ানের অর্থনীতি খুবই ছোট। কানাডার জিডিপি যেখানে ১ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার বা ১৭’শ বিলিয়ন ডলার; সেখানে পুরো ক্যারিবিয়ানের সকল দেশ মিলে জিডিপি ৩’শ বিলিয়নেরও কম। ক্যারিবিয়ানে শক্ত অবস্থানে থাকার কারণেই কানাডা এখানকার ব্যবসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পেরেছে। আর এই শক্ত অবস্থানের ভিত্তি রাজনৈতিক। ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতার মাঝেই কানাডার প্রভাব বিস্তারের বীজ নিহিত।
  
২০১৯ সালে ‘ক্যারিকম’এর সরকার প্রধানদের বৈঠক। ‘ক্যারিকম’এর সাথে সম্পর্ক গভীর করা মাধ্যমে কানাডা ক্যারিবিয়ানে, বিশেষ করে প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশগুলিতে তার রাজনৈতিক প্রভাব ধরে রেখেছে।




ক্যারিবিয়ানের রাজনীতিতে কানাডা

১৮৬৭ সালে উত্তর আমেরিকায় ব্রিটিশ অঞ্চলগুলিকে কানাডিয়ান কনফেডারেশনের মাঝে নিয়ে আসা হয়। এরপর থেকে বেশকিছু ক্যারিবিয় দ্বীপ কানাডিয়ান কনফেডারেশনের অংশ হবার জন্যে চেষ্টা করেছে। এই প্রচেষ্টাগুলির কিছু বেশিদূর আগায়নি; আবার কিছু ক্ষেত্রে এগুলিকে অনেকে বাস্তবসম্মতই মনে করেছে। ১৮৮২ সালে জামাইকাকে কানাডার অংশ করার একটা প্রচেষ্টা হয়েছিল, যা খুব দ্রুতই ভেস্তে যায়। বারবাডোসও চেয়েছিল কানাডার অংশ হতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন তার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপনিবেশগুলিকে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের অধীনে ছেড়ে দেয়। একইসাথে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জের সরকার চাইছিল যে, নিউ ফাউন্ডল্যান্ড, ক্যারিবিয়ান এবং ফকল্যান্ডস আইল্যান্ডে ব্রিটিশ উপনিবেশগুলিকে কানাডার অধীনে দিয়ে দিতে। কানাডার ব্যবসায়ীরা এই প্রস্তাব বাস্তবায়নে যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন। ব্যবসায়ী হ্যারি ক্রো কানাডার সরকারে নিজের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে একটা প্রতিবেদন তৈরি করান, যেখানে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জকে কানাডার অংশ করলে কি কি সুবিধা পাওয়া যেতে পারে, তার একটা তালিকা তৈরি করা হয়। এতে বলা হয় যে, প্রায় ৩ লক্ষ বর্গ কিঃমিঃ এলাকার সাথে কানাডা প্রায় ২৩ লক্ষ জনসংখ্যা পাবে; যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবিয় অঞ্চল থেকে যে পণ্য সুবিধা পাচ্ছে, কানাডাও সেটা পেতে পারে; এতে কানাডার নৌশক্তি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে; ঐ অঞ্চলে কানাডায় তৈরি পণ্যের বাজার নিশ্চিত হবে; আর বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্যে একটা পুরষ্কার হতে পারে এই দ্বীপগুলি। কিন্তু কানাডাতে উপনিবেশের পুরো নিয়ন্ত্রণ নেবার জন্যে রাজনৈতিক সমর্থন আদায় করা সম্ভব না হওয়ায় এই প্রকল্প সফল হয়নি।

১৯১১ সালে বাহামা দ্বীপপুঞ্জও কানাডার অংশ হতে চেয়েছিল, যা কানাডিয়রা বাতিল করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৫০এর দশকে ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফেডারেশন’ নামে একটা রাজনৈতিক সংগঠন তৈরির প্রচেষ্টা চালানো হয়। উদ্দেশ্য ছিল যে, দ্বীপগুলিকে একত্রিত করে একটা কাঠামোর অধীনে এনে এরপর ব্রিটেন বা কানাডার সাথে রাজনৈতিকভাবে একত্রীকরণের চেষ্টা করা। ১৯৬২ সালে এই প্রচেষ্টা ভেস্তে যায় যখন সবচাইতে বড় দ্বীপ জামাইকা এবং ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগো ফেডারেশন থেকে বের হয়ে যায়। ১৯৬০ এবং ১৯৭০এর দশকে বেশিরভাগ দ্বীপই আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে ব্রিটেন থেকে আলাদা হয়ে যায়। কানাডার সাথে যুক্ত হবার সর্বশেষ প্রচেষ্টা করে টুর্কস এন্ড কাইকোস দ্বীপপুঞ্জ। ১৯৭০এর দশকে তারা কানাডার সাথে যুক্ত হবার চেষ্টা শুরু করে। তবে ১৯৮৭ সাল নাগাদ তা ভেস্তে যায়। এরপর ২০০৩ সালে কানাডা থেকে নতুন আরেকটা প্রচেষ্টা চালানো শুরু হয়। ২০০৯ সালের মাঝে সেই প্রচেষ্টাও বানচাল হয়ে যায়। তবে যদিও কানাডা ক্যারিবিয়ানের দেশগুলিকে নিজের সাথে একত্রিত করতে চায়নি, তথাপি ক্যারিবিয়ানের সাথে কানাডার গভীর সম্পর্কের কারণে কানাডাকে ক্যারিবিয়ান থেকে আলাদা করা কঠিন। কানাডার জনগণকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক চিন্তা থেকে ‘পরিষ্কার’ রাখার জন্যেই হয়তো কানাডা ক্যারিবিয়ানের দেশগুলির সাথে আইনগত সম্পর্ক গড়েনি। তবে মুখে ক্যারিবিয়ান থেকে দূরে থাকার কথা বললেও কাজে কানাডা ক্যারিবিয়ানের অংশ হিসেবেই চিন্তা করেছে।

১৯৬৬ সালে কানাডায় ক্যারিবিয়ান দেশগুলির নেতাদের নিয়ে এক বৈঠক ডাকে কানাডা। এরপর ১৯৭৩ সালে ক্যারিবিয়ানের ইংরেজি ভাষাভাষি চারটা প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশ ‘ক্যারিবিয়ান কমিউনিটি’ বা ‘ক্যারিকম’ নামের একটা সংস্থা গঠন করে; এরা হলো জামাইকা, ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগো, গায়ানা এবং বার্বাডোস। ১৯৭০ এবং ১৯৮০এর দশকে স্বাধীনতা পাওয়া ক্যারিবিয়ানের সকল ইংরেজি ভাষাভাষি দ্বীপ দেশ এতে যোগ দেয়। ১৯৯৫ সালে ডাচ ভাষার সুরিনাম এবং ২০০২ সালে ফরাসী ভাষাভাষি হাইতিও এতে যোগ দেয়। বর্তমানে ১৫টা দেশ এর সম্পূর্ণ সদস্য; ৫টা ব্রিটিশ উপনিবেশ এসোসিয়েট সদস্য; আর ৮টা অবজারভার দেশের মাঝে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অধীন পুয়রতো রিকো, ৩টা ডাচ উনপিবেশ; আর মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশ মেক্সিকো, কলম্বিয়া ও ভেনিজুয়েলা। ক্যারিবিয়ানের একমাত্র দেশ হিসেবে ডমিনিকান রিপাবলিক এই সংস্থার অবজারভার দেশ। ১৯৭৯ সালে কানাডা এবং ‘ক্যারিকম’এর মাঝে বাণিজ্য এবং সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কানাডা এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক সহায়তা বৃদ্ধি করারও প্রতিশ্রুতি দেয়।

কানাডার সহায়তায় ১৯৬৯ সালে ‘ক্যারিবিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এখনও এই ব্যাঙ্কে প্রায় ৯ শতাংশ মালিকানা রয়েছে কানাডিয়দের; ৯ শতাংশ রয়েছে ব্রিটেনের; সাড়ে ৫ শতাংশ করে রয়েছে ইতালি, জার্মানি এবং চীনের; প্রায় ১০ শতাংশ রয়েছে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলির; আর বাকিটা রয়েছে ক্যারিবিয় দেশগুলির। এছাড়াও ক্যারিবিয়ানে কানাডার বিভিন্ন সংস্থা যথেষ্ট গভীর সম্পর্ক রেখে চলেছে; যার মাঝে রয়েছে ‘ক্যানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি’, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ‘কানাডিয়ান ট্রেড কমিশনার’, ‘আটলান্টিক কানাডা কোঅপারেশন এজেন্সি’, ‘ট্রান্সপোর্ট কানাডা’, ‘কানাডিয়ান রেডিও টেলিভিশন এন্ড টেলিকিউমিকেশন্স কমিশন’, ইত্যাদি। কানাডার ‘ভানটেজ এয়ারপোর্ট গ্রুপ’এর অধীনে ক্যারিবিয়ানে জামাইকা এবং বাহামা দ্বীপপুঞ্জে দু’টা বিমানবন্দর রয়েছে। এছাড়াও ‘অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটস’, ‘ইন্টার আমেরিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’, ‘প্যান আমেরিকান হেলথ অর্গানাইজেশন’ এবং ‘প্যাসিফিক এলায়েন্স’এর মাধ্যমে কানাডা ক্যারিবিয়ানের সাথে সম্পর্ক রাখে।


  
২০১৬ সালে ‘অপারেশন ক্যারিবে’তে অংশ নেয়া রয়াল কানাডিয়ান নেভির যুদ্ধজাহাজ ‘সাসকাচুয়ান’, ‘এডমন্টন’ এবং মার্কিন কোস্ট গার্ডের জাহাজ ‘হ্যাডক’। এই অপারেশনে মাদক বিরোধী অভিযানে অংশ নেবার মাধ্যমে কানাডা ক্যারিবিয়ানে তার সামরিক অবস্থানকে ধরে রাখছে। একইসাথে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় তারা যুক্তরাষ্ট্রকে একা ছেড়ে দেয়নি।

ক্যারিবিয়ানের সাথে কানাডার সামরিক সম্পর্ক

১৭৪৫ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত দু’শ বছরের বেশি সময় ধরে ব্রিটিশ রয়াল নেভি উত্তর আমেরিকায় তাদের অবস্থান অব্যাহত রাখে। এই অবস্থানের মূল ঘাঁটি ছিল কানাডার আটলান্টিক উপকূলের নোভা স্কোশিয়ার হ্যালিফ্যাক্স। হ্যালিফ্যাক্সে ঘাঁটি ছিল ১৯০৫ সাল পর্যন্ত। আরেকটা ঘাঁটি ছিল বার্মুডাতে; যা ১৯৫১ সাল পর্যন্ত সেখানে ছিল। তবে ১৮১৯ সালে উত্তর আমেরিকায় মূল ব্রিটিশ ঘাঁটি হ্যালিফ্যাক্স থেকে বার্মুডায় স্থানান্তর করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর হুমকিকে আরও ভালোভাবে মোকাবিলা করার জন্যে প্রস্তুতি নেয়া। ১৯১০ সালে রয়াল কানাডিয়ান নেভির জন্মের পর হ্যালিফ্যাক্সের নৌঘাঁটি কানাডার কাছে হস্তান্তর করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে কানাডার নৌবাহিনীর হাতে ছিল মাত্র ১১টা যুদ্ধজাহাজ এবং ১৮’শ নাবিক। বিশ্বযুদ্ধের মাঝে কানাডার কাছে ব্রিটিশরা পুরো উত্তর পশ্চিম আটলান্টিকের নিরাপত্তার দায়িত্ব দিয়ে দেয়। বিশ্বযুদ্ধ শেষে কানাডার হাতে ছিল ৪’শ ৩৪টা যুদ্ধজাহাজ এবং ৯৫ হাজার নাবিক।

বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ক্যারিবিয়ানে কানাডার সামরিক উপস্থিতি বাড়তে থাকে। ১৯৫০এর দশক থেকে এখন পর্যন্ত এমন কোন বছর সম্ভবতঃ পাওয়া যাবে না, যখন ক্যারিবিয়ানে কানাডার সামরিক উপস্থিতি ছিল না। কানাডার সরকারি ওয়েবসাইটে ক্যারিবিয়ানে তাদের মিশনগুলির বিশদ বর্ণনা দেয়া হয়েছে।

১৯৫০ থেকে ১৯৭৪

- ১৯৫১ সালে ঘুর্নিঝড়ে আক্রান্ত জামাইকায় ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীকে ত্রাণসামগ্রী দিয়ে সহায়তা দেয় রয়াল কানাডিয়ান এয়ার ফোর্স।

- রয়াল কানাডিয়ান নেভির জাহাজগুলি নিয়মিতই ক্যারিবিয়ান টহল দিচ্ছিল। এমনই এক সময়ে ১৯৫৭ সালের মার্চে কানাডার একটা ডেস্ট্রয়ারকে ব্রিটিশ উপনিবেশ সেন্ট লুসিয়ায় জরুরি ভিত্তিতে পাঠানো হয়। সেন্ট লুসিয়ায় চিনি এবং কলা চাষে ব্যবহৃত শ্রমিকরা ধর্মঘটের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কানাডার ডেস্ট্রয়ার ‘মিকম্যাক’এর ক্রুদেরকে শহরে মোতায়েন করা হয় এবং ফলশ্রুতিতে ধর্মঘট এড়ানো যায়।

- ১৯৬১ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ বেলিজে ঘুর্নিঝড়ের তান্ডবের পর রয়াল কানাডিয়ান এয়ার ফোর্সের বিমানে করে ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হয়।

- ১৯৬৩ সালে হাইতিতে রাজনৈতিক গোলযোগের সময় সেখানে মাত্র ৩ ঘন্টার মাঝে রয়াল কানাডিয়ান নেভির ডেস্ট্রয়ার ‘সাসকাচুয়ান’কে প্রেরণ করে। সেখানে সর্বদা নিজেদের জাহাজ টহলে রাখার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রও সেখানে নিজেদের জাহাজ প্রেরণ করে।

- ১৯৬৬ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ এন্টিগাতে রয়াল কানাডিয়ান এয়ার ফোর্সের বিমানে করে স্কুলের সরঞ্জামাদি পাঠানো হয়।

- ১৯৭২ সালে গায়ানাতে বিমান বাহিনীর বিমানে করে স্কুল বাসও প্রেরণ করা হয়। ১৯৭৪এ টুর্কস এন্ড কাইকোসেও স্কুলের সরঞ্জাম পাঠানো হয়।

- ১৯৭২ সালে কানাডা ভেনিজুয়েলার কাছে ২০টা ‘এফ-৫’ যুদ্ধবিমান বিক্রি করে।

- সেবছর নিকারাগুয়াতে ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলে সেখানে কানাডা বিমান বাহিনীর বিমানে করে ত্রাণ পাঠায়। ১৯৭৩ এবং ১৯৭৪এ হাইতিতেও বিমান এবং যুদ্ধজাহাজে করে ত্রাণ সামগ্রী পাঠানো হয়।
  
হাইতিতে কানাডার সৈন্য। ১৯৯০এর পুরো দশক জুড়েই হাইতির রাজনৈতিক সমস্যাকে কেন্দ্র করে সেখানে মার্কিন এবং জাতিসংঘের সেনা মোতায়েন থাকে। কানাডা সবসময় এই মিশনের সাথে ছিল। এই মিশনের বদৌলতে ক্যারিবিয়ানে কানাডার সামরিক উপস্থিতি স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল। এই মিশনকে ব্যবহার করে আশেপাশের দেশগুলিতেও কানাডা প্রভাব বিস্তার করেছে।


১৯৭৪ থেকে ১৯৯৯
- ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে ব্রিটেন গ্রেনাডাকে স্বাধীনতা দেয়ার পর সেখানে বিশৃংখলা শুরু হলে কানাডা সেখানে নৌবাহিনীর দু’টা ডেস্ট্রয়ার প্রেরণ করে। ১৯৭৪ সালে হন্ডুরাসে বিমানে করে ঘুর্নিঝড় পরবর্তী ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হয়।

- ১৯৭৬ সালে গুয়াতেমালায় ভূমিকম্পের পর বিমানে করে ত্রাণসামগ্রী পাঠায় কানাডা।

- ১৯৭৭ সালে গায়ানাতে কানাডার বিমান বাহিনীর বিমানে করে দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয়।

- ১৯৭৯ সালে সেন্ট ভিনসেন্টএ আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের পর সেখানে কানাডা সামরিক মেডিক্যাল দল এবং বিমান বাহিনীর বিমান প্রেরণ করে। একই বছর নিকারাগুয়ায় গৃহযুদ্ধের মাঝে বিমানে করে ত্রাণসামগ্রী প্রেরণ করা হয়।

- ১৯৮৩ সালে গ্রেনাডাতে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের সময় কানাডাও সেখানে সামরিক পরিবহণ বিমান প্রেরণ করে।

- ১৯৮৮ সালের জানুয়ারিতে হাইতিতে নির্বাচনের আগে উত্তেজনা শুরু হলে সেখানে নৌ মহড়ার আড়ালে ৭টা হেলিকপ্টার সহ তিনটা যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করা হয়। বিমান বাহিনীর পরিবহণ বিমানও প্রস্তুত রাখা হয়। একই বছরের সেপ্টেম্বরে জামাইকাতে ঘুর্নিঝড় আঘাত করার পর সেখানে বিমান বাহিনীর বিমানে করে ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হয় এবং সামরিক সদস্যদের মোতায়েন করা হয়।

- ১৯৮৯ সালে হাইতি, জামাইকা, ডমিনিকান রিপাবলিক এবং সেন্ট লুসিয়াতে বছরজুড়ে বিমান বাহিনীর বিমানে করে ত্রাণ সহায়তা পাঠানো হয়। সেবছরের সেপ্টেম্বরে মন্টসেরাতে ঘুর্নিঝড় আঘাত হানার পর কানাডার সামরিক সদস্যদের মোতায়েন করা হয়।

- ১৯৮৯ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত মধ্য আমেরিকার কোস্টারিকা, এল সালভাদর, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস এবং নিকারাগুয়ায় জাতিসংঘের শান্তি মিশনে সেনা মোতায়েন রাখে কানাডা।

- ১৯৯০ সালে কানাডা হাইতির নির্বাচনের সময় সেখানে সেনা সদস্য মোতায়েন করে।

- ১৯৯১ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত জাতিসংঘ মিশনে হন্ডুরাসে কানাডার সেনাসদস্যরা মোতায়েন থাকে।

- ১৯৯২ সালের শুরুতে হাইতির রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে সেখানে হস্তক্ষেপ করে মার্কিন এবং ফরাসীদের সহায়তায় সেখানকার বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার উদ্দেশ্যে চারটা যুদ্ধজাহাজ প্রস্তুত করে। পরে অবশ্য এই অপারেশন বাস্তবায়িত করা হয়নি।

- ১৯৯৪এর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের অধীনে সামরিক হস্তক্ষেপের জন্যে কানাডার তিনটা যুদ্ধজাহাজ হাইতির উপকুলে মোতায়েন করা হয়। ১৯৯৫এর মার্চে সেখানে ৫’শ সেনা মোতায়েন করা হয়। ১৯৯৬এর মার্চে সেখানে সামরিক সদস্যের সংখ্যা সাড়ে ৭’শ করা হয়। ১৯৯৭এর নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে কানাডার সামরিক বাহিনীর প্রায় ৭’শ সদস্য মোতায়েন থাকে। ২০০০এর মার্চ পর্যন্ত কানাডার সামরিক উপস্থিতি ছিল সেখানে। ১৯৯৩এর ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৪এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হাইতির উপকূলে কানাডার নৌবাহিনী জাহাজ মোতায়েন থাকে। পুরো অপারেশনে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্ব দিলেও কানাডা সেখান থেকে কখনোই সরে আসেনি।

- হাইতিতে কানাডার সেনাদের জন্যে সাপ্লাই দেয়ার সময়ে কানাডার সামরিক বিমানগুলি ১৯৯৫এর জুনে কোস্টা রিকাতেও ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যায়। সেবছরের সেপ্টেম্বরে ত্রিনিদাদেও ত্রাণসামগ্রী পাঠায় তারা। সেবছরের সেপ্টেম্বরে এন্টিগা এন্ড বারবুডাতে ঘুর্নিঝড় আঘাত হানার পর সেখানে কানাডার কোস্ট গার্ডের জাহাজে করে সামরিক সহায়তা পাঠানো হয়।

- ১৯৯৪ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত গুয়াতেমালায় জাতিসংঘ মিশনের অধীনে কানাডা সেখানে সামরিক অফিসারদের মোতায়েন রাখে।

- ১৯৯৮ সালের নভেম্বরে হন্ডুরাসে ঘুর্নিঝড় আঘাত হানার পর সেখানে কানাডার সামরিক সদস্যদের মোতায়েন করা হয়।

- ১৯৯৯ সালে হাইতি এবং সেন্ট লুসিয়াতে বিমান বাহিনীর বিমানে করে ত্রাণসামগ্রী এবং এম্বুল্যান্স পাঠানো হয়।

২০০১ থেকে ২০০৮

- ২০০১ সালের জানুয়ারিতে এল সালভাদরে ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর কানাডার বিমান বাহিনীর বিমানে করে ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হয়।

- বেলিজে ঘুর্নিঝড় আঘান হানার পর ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিমান বাহিনীর বিমানে করে সেখানে ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হয়।

- ২০০৪এর ফেব্রুয়ারিতে হাইতিতে সহিংসতা বেড়ে গেলে কানাডার বিমানবাহিনীর বিমানে করে সেখান থেকে বিদেশী নাগরিকদের বের করে আনা হয়। এরপর সেখানে জাতিসংঘের অধীনে প্রায় ৫’শ কানাডিয়ান সামরিক সদস্যকে মোতায়েন করা হয়। এর বেশিরভাগ সেনাকেই ফেরত আনা হলেও সেখানে কিছু উচ্চপদস্থ কানাডিয়ান সামরিক কর্মকর্তাকে দীর্ঘ সময়ের জন্যে রেখে দেয়া হয়।

- ২০০৭ সালের অগাস্টে ঘুর্নিঝড় আঘাত হানার পর জামাইকাতে কানাডার সামরিক বিমানে করে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেয়া হয়।

- ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে হাইতিতে ঘুর্নিঝড়ে আঘাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলে ক্যারিবিয়ানে মাদক নির্মূল অভিযানে মোতায়েনকৃত কানাডার নৌবাহিনী ফ্রিগেট ‘সেন্ট জন’কে সেখানে ত্রাণ সহায়তা দেবার জন্যে পাঠানো হয়।

এই মিশনগুলির মাঝে ১৯৫০এর দশক থেকে ১৯৮০এর দশক পর্যন্ত কানাডার সামরিক মিশনগুলি সংখ্যায় ছিল কম এবং বেশিরভাগই ছিল ত্রাণসামগ্রী পাঠাবার বা ব্রিটিশ উপনিবেশে শান্তি রক্ষা করার মিশন। ১৯৯০এর দশকে সামরিক মিশনগুলির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায় হাইতি। দুর্যোগের কারণে ত্রাণসামগ্রী পাঠাবার মিশন এর মাঝেই চলেছে। বিভিন্ন দেশে নিজেদের নাগরিক সরিয়ে নেবার কথা বলে বহুবার সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। তবে প্রতিবারই যুক্তরাষ্ট্রের মিশনের সাথে কানাডা যুক্ত ছিল।

২০০৬ সালের নভেম্বর থেকে ক্যারিবিয়ানে নতুন মিশন শুরু করে কানাডা। ‘অপারেশন ক্যারিবে’ নামের মাদক চোরাকারবারি বন্ধের উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু করা এই মিশনে ২০১০ সাল থেকে যোগ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ২০১২ সাল থেকে মার্কিন ‘অপারেশন মারটিলো’র অধীনে ন্যাস্ত করা হয় কানাডার মিশনকে। চুক্তি অনুযায়ী কানাডার জাহাজে মার্কিন কোস্ট গার্ডের সদস্যারা থাকবে; তারাই সরাসরি মাদক চোরাকারবারিদেরকে ধরবে। কানাডা এক্ষেত্রে শুধু লজিস্টিক্যাল সুবিধা দেবে। এল সালভাদরের কমালাপা বিমান ঘাঁটিতে মার্কিন নেতৃত্বে কানাডা ম্যারিটাইম প্যাট্রোল বিমান মোতায়েন করে। মিশন শুধু ক্যারিবিয়ানেই সীমাবদ্ধ নয়; মিশনের অনেকটা টহল পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে মেক্সিকো এবং মধ্য আমেরিকার পশ্চিম উপকূলেও চলছে। এই মিশনের অধীনে কানাডা অত্র অঞ্চলে নিয়মিত তাদের যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন রাখছে।
  
‘এক্সারসাইজ ট্রেইড উইন্ডস’ ২০১৯এ কানাডার সাথে অংশ নিচ্ছে ক্যারিবিয়ান সামরিক সদস্যারা। এই মহড়াকে ব্যবহার করে কানাডা জামাইকাতে ‘অপারেশনাল সাপোর্ট হাব’ বা ‘ওএসএইচ’ তৈরি করেছে, যার মাধ্যমে অতি দ্রুততার সাথে কানাডা থেকে সৈন্য, রসদ, অস্ত্র এবং অন্যান্য সাপ্লাই নিয়ে যাবে; এবং সেখান থেকে পুরো ক্যারিবিয়ানের যেকোন স্থানে নিয়ে যাওয়া যাবে।

জামাইকায় সামরিক সহায়তা

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে প্রতিবছর কানাডা ‘এক্সারসাইজ ট্রেইড উইন্ডস’ নামের মহড়ায় অংশ নেয়। এই মহড়ার লক্ষ্য হিসেবে প্রথমেই বলা হচ্ছে অপরাধ দমন; এরপর রয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা। এই মহড়াকে কেন্দ্র করেই ২০১৬ সাল থেকে কানাডিয়ানরা জামাইকাতে একটা স্থায়ী ‘অপারেশনাল সাপোর্ট হাব’ বা ‘ওএসএইচ’ তৈরি শুরু করে। এই হাবের মাধ্যমে পুরো ক্যারিবিয়ানে কানাডিয়ানরা যেকোন সময় তাদের সামরিক কর্মকান্ড চালাতে পারবে। এর মাধ্যমে তারা অতি দ্রুততার সাথে কানাডা থেকে সৈন্য, রসদ, অস্ত্র এবং অন্যান্য সাপ্লাই নিয়ে আসতে পারবে; এবং সেখান থেকে পুরো ক্যারিবিয়ানের যেকোন স্থানে নিয়ে যেতে পারবে। ২০১৮ সালের অগাস্টে এই হাব অপারেশনে আসে। জামাইকার সাথে কানাডার সামরিক সম্পর্ক সবচাইতে গভীর। ১৯৬৫ সাল থেকে জামাইকার এক হাজার ৬’শ ৬০ জন সামরিক সদস্য কানাডায় প্রশিক্ষণ পেয়েছে। আর জামাইকাতে কানাডা বেশ কয়েকটা সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি করেছে, যেখানে পুরো ক্যারিবিয়ানের সকল দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা প্রশিক্ষণ নেয়।

১৯৯৩ সাল থেকে জামাইকাতে চালু রয়েছে ‘ক্যারিবিয়ান জুনিয়র কমান্ড এন্ড স্টাফ কোর্স ফ্যাসিলিটি’। ২০০৬ সালে তৈরি করা হয় ‘ক্যারিবিয়ান মিলিতারই এভিয়েশন স্কুল’। ২০০৮ সালে তৈরি করা হয় টেকনিক্যাল ট্রেনিং স্কুল। ২০০৯ সালে তৈরি হয় ‘ক্যারিবিয়ান কাউন্টার টেররিজম ট্রেনিং সেন্টার’। ২০১২ সালে শুরু হয় ‘ক্যারিবিয়ান মিলিটারি ম্যারিটাইম ট্রেনিং সেন্টার’। ২০১৭ সালে তৈরি হয় ‘ডিরেক্টোরেট অব ট্রেনিং এন্ড ডকট্রাইন’। ২০১৮ সালে চালু হয় ‘ক্যারিবিয়ান স্পেশাল ট্যাকটিকস সেন্টার’।
  
২০১৬ সালে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর কিউবা ভ্রমণ। কিউবার ব্যাপারে কানাডার নীতি সর্বদাই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নীতির উল্টো। ক্যারিবিয়ানে প্রভাব বিস্তারের খেলায় ব্রিটিশ সময় থেকেই কানাডা যুক্তরাষ্ট্রকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখেছে। সমাজতান্ত্রিক কিউবার সাথে সম্পর্ক ধরে রাখার ব্যাপারটাও সেই একই চিন্তার অংশ।


কিউবার সাথে সম্পর্ক

কিউবার সাথে কানাডার বাণিজ্য চলছে অষ্টাদশ শতক থেকেই। তবে রাষ্ট্র হিসেবে কানাডা এবং কিউবার মাঝে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় ১৯৪৫ সালে। পুরো ক্যারিবিয়ানে কিউবাতেই কানাডিয়ানরা প্রথম দূতাবাস খোলে। ১৯৫৯ সালে কিউবাতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর মাত্র দু’টা দেশ কিউবার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখে; এর একটা মেক্সিকো; অন্যটা কানাডা। কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জন ডিফেনবেকার ঘোষণা দেন যে, আদর্শগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তিনি কিউবার সাথে সম্পর্ক রাখবেন। একই বছরের এপ্রিলে কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো কানাডা সফরও করেন। ডিফেনবেকারের সরকার সকলকে বার্তা দেয় যে, কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি হুবহু নকল করে চলবে না। ১৯৬৩ সালে ডিফেনবেকার নির্বাচনে হেরে যাবার পর নতুন প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডোও কানাডার পররাষ্ট্রনীতিকে মার্কিন প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার কথা বলেন। পিয়েরে ট্রুডো বর্তমান প্রধানন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর বাবা। ১৯৬০ এবং ১৯৭০এর দশকে কিউবার সাথে বাণিজ্যের ব্যাপারে কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সাংঘর্ষিক নীতি অনুসরণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধে থাকা কিউবার অর্থনীতিতে কানাডার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। কিউবার ট্যুরিস্ট বোর্ডের বরাত দিয়ে ‘ট্রাভেল পালস কানাডা’ বলছে যে, ২০১৯ সালে কিউবাতে ১১ লক্ষের বেশি কানাডিয়ান ভ্রমণ করেছে। এই সংখ্যা কিউবায় ভ্রমণ করা সকল পর্যটকের প্রায় এক চতুর্থাংশ।

যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে ১৯৯৬ সালে পাস করা ‘হেলমস বারটন এক্ট’ বাস্তবায়নের জন্যে যুক্তরাষ্ট্র কানাডার উপর চাপ সৃষ্টি করে। এই আইনের ‘টাইটেল ৩’এ বলা হয় যে, কিউবাতে মার্কিন নাগরিকদের সম্পদ কিউবার সরকার বাজেয়াপ্ত করে থাকলে মার্কিন নাগরিকেরা কিউবায় সেই সম্পদের বর্তমান ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে। এই আইনের প্রতিবাদে কানাডার হাইজ অব কমন্সে ‘গডফ্রে মিলিকেন বিল’ নিয়ে আসা হয়, যার মাধ্যমে বলা হয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্মের সময় যেসকল ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার বিরোধী ছিলেন এবং কানাডায় পালিয়ে এসেছিলেন, তাদের বাজেয়াপ্ত সম্পদ তাদের উত্তরসুরীরা পাবার জন্যে চেষ্টা করতে পারবে। কানাডার প্রতিবাদের কারণে ‘হেলমস বারটন এক্ট’এর ‘টাইটেল ৩’ ২০১৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত স্থগিত করে দেয়া হয়। ২০১৯এর ২৭শে এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দেয় যে, ‘টাইটেল ৩’ এখন কার্যকর করা হবে। কানাডার প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে ৩রা মে বলা হয় যে, প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো কিউবার প্রধানমন্ত্রী মিগেল দিয়াজ কানেলের সাথে ফোনে কথা বলে যুক্তরাষ্ট্রের একতরফাভাবে ‘টাইটেল ৩’ কার্যকর করার ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ট্রুডো কিউবাতে কানাডার জনগণের স্বার্থ রক্ষা করবেন বলে বলেন।

ব্রিটিশ কমনওয়েলথের কানাডা যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করেই যাবে

জরডান গুডরোর ব্যাপারটা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের বছরে ট্রাম্পের জন্যে সুখকর কোন খবর নয়। এর মাত্র ক’দিন আগেই যুক্তরাষ্ট্র কিউবার ব্যাপারে ১৯৯৬ সালে কংগ্রেসে পাস করা আইন বাস্তবায়ন করার ঘোষণা দেয়। এর কিছুদিন পরেই ২৫শে মে ইরান থেকে তেল নিয়ে আসা ট্যাঙ্কার ভেনিজুয়েলায় প্রবেশ করে। এই ঘটনাগুলি ট্রাম্প প্রশাসনকে নির্বাচনের বছরে হিস্প্যানিক ভোটারদের সামনে দুর্বল করতে পারে। গুডরোর কানাডার নাগরিকত্ব ক্যারিবিয়ানে প্রায় আড়াই’শ বছরের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে সামনে নিয়ে এসেছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময় থেকেই কানাডা ক্যারিবিয়ানে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। ব্রিটিশরা তাদের উপনিবেশগুলিকে ছেড়ে দেবার পর কানাডা ব্রিটিশ কমনওয়েলথের নীতিই ধরে রেখেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখেছে। প্রথমে অর্থনৈতিক দিক থেকে সম্পর্কের সূচনা হলেও বর্তমান কানাডা ক্যারিবিয়ানের উপর নির্ভরশীল নয়। বরং ক্যারিবিয়ানের ছোট দ্বীপ দেশগুলিই কানাডার উপর নির্ভরশীল। ব্রিটিশদের প্রাক্তন উপনিবেশে কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলকভাবেই দেখেছে। একারণেই কানাডা ক্যারিবিয়ানে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক দিক থেকে সর্বদা ব্যস্ত থেকেছে। ঔপনিবেশিক শক্তি হবার তকমা নিতে না চাইলেও ক্যারিবিয়ানকে কানাডা নিজের মনে করেই দেখেছে। কানাডা আলাদা কোন জাতীয়তাবাদী শক্তি নয়। বিশ্বব্যবস্থায় পরিবর্তনের প্রবাহে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর কৌশলের মাঝে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডকেই ব্রিটেনের আত্মার অংশ হিসেবে চিন্তা করা হচ্ছে। আদর্শিক দিক থেকে একই সূত্রে গাঁথা এই দেশগুলি তো এক সুরেই কথা বলবে। প্রশান্ত মহাসাগরে যেমন অস্ট্রেলিয়াকে ব্রিটেনের হাত হিসেবে দেখতে চাইছেন তারা, তেমনি আমেরিকা মহাদেশে কানাডাকে তারা দেখতে চাইছেন অগ্রগামী অবস্থানে। ভেনিজুয়েলা এবং কিউবার সাম্প্রতিক ইতিহাস ক্যারিবিয়ানে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে দুর্বল করে। আর এই সুযোগটা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বীরা নিলে অবাক হবার কিছু নেই। ক্যারিবিয়ান যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রকে নিজের উঠানেই চ্যালেঞ্জ নিতে হচ্ছে।

No comments:

Post a Comment