Saturday 17 June 2023

‘আইএমএফ’এর ছোবলে দিশেহারা নাইজেরিয়ার জনগণ

১৭ই জুন ২০২৩

নাইজেরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট তিনুবু সর্বদাই ছিলেন ব্যবসা-বান্ধব একজন রাজনীতিবিদ। প্রেসিডেন্ট হবার পর তার স্বাগত বক্তব্যে তিনুবু ঘোষণা দেন যে, তিনি দেশটার মুদ্রা বিনিময় হারকে বাজারের উপরে ছেড়ে দেবেন। পশ্চিমা প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে জাতীয় মুদ্রা নাইয়ারাকে বাজারের উপরে ছেড়ে দেয়ার কারণে জনগণকে আমদানি করা খাদ্য বহুগুণ বেশি মূল্যে ক্রয় করতে হবে। ফলস্বরূপ, ‘আইএমএফ’এর উপদেশ মেনে নাইজেরিয়ার ব্যবসা-বান্ধব সরকার এখন জনগণকে কষ্ট সহ্য করতে বলছে।


গত ১৪ই জুন আফ্রিকার সবচাইতে বড় জনসংখ্যা এবং অর্থনীতির দেশ নাইজেরিয়ার সরকার দেশের জাতীয় মুদ্রা নাইয়ারা-র উপর থেকে সকল নিয়ন্ত্রণ তুলে নিয়ে সেটাকে বাজারের উপরে ছেড়ে দেয়। এর ফলশ্রুতিতে একদিনের মাঝে ডলারের বিপরীতে নাইয়ারা-র মূল্য প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে গিয়ে ইতিহাসের সর্বনিম্ন ডলারপ্রতি ৭’শ ৫৫তে গিয়ে দাঁড়ায়। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন যে, এতে দেশের জনগণের উপর স্বল্পমেয়াদে কষ্ট বয়ে নিয়ে আসলেও দীর্ঘমেয়াদে তা নাইজেরিয়ার জন্যে ভালো হবে। নাইজেরিয়ার জাতীয় মুদ্রার মূল্য এতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করতো। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানি করা দ্রব্যের জন্যে ডলারের বিপরীতে মুদ্রার মূল্য অপেক্ষাকৃত উচ্চতর রেখেছিল; যাতে করে আমদানি করা দ্রব্য সাধারণ মানুষের ক্রমক্ষমতার মাঝে থাকে। নাইজেরিয়া আমদানি করা গমের উপরে যথেষ্ট নির্ভরশীল; যা ডলারের বিনিময়ে আমদানি করা হয়।

পশ্চিমা সংস্থাগুলি বলছে যে, নতুন নীতির ফলে নাইজেরিয়ায় বিনিয়োগ বাড়বে এবং অর্থনীতিকে শক্ত ভিতের উপরে প্রতিষ্ঠা করবে। সাম্প্রতিক সময়ে নাইজেরিয়া ব্যাপক মূল্যস্ফীতি এবং মারাত্মক বেকারত্ব সমস্যার মাঝ দিয়ে যাচ্ছে। ‘আফ্রিকা নিউজ’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে আন্তর্জাতিক কনসালট্যান্সি কোম্পানি ‘প্রাইস ওয়াটারহাউজ কুপার্স’ বা ‘পিডব্লিউসি’র নাইজেরিয়া অফিসের বিশ্লেষক তাইয়ো ওইয়েদেলে বলছেন যে, ডলারের বিপরীতে ভিন্ন ভিন্ন বিনিময় হার রাখার ফলে এতকাল বাজারে সকল ব্যবসায়ীদের জন্যে একরকম অধিকার নিশ্চিত হয়নি। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা অফিশিয়াল বিনিময় হারে ডলার বিক্রি করতে বাধ্য থাকতো; এবং একইসাথে দেশের বাইরে থেকে ডলার বিনিয়োগ আনতে পারছিলো না। মারাত্মক ডলার সংকটের ফলে নাইজেরিয়ায় ব্যবসা করা বিদেশী কোম্পানিগুলি তাদের আয় করা অর্থ দেশের বাইরে নিতে পারছিলো না। শুধুমাত্র বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলিই সাড়ে ৪’শ মিলিয়ন ডলারের আয় নাইজেরিয়ার বাইরে নিয়ে যেতে পারছে না। একারণেই নাইজেরিয়াতে বিদেশী বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

নাইজেরিয়ার নতুন মুদ্রানীতিকে স্বাগত জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ‘আইএমএফ’। ১৬ই জুন ‘আইএমএফ’এর এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, বহুদিন ধরে নাইজেরিয়ার মুদ্রা ব্যবস্থার ব্যাপারে ‘আইএমএফ’এর যে উপদেশ ছিল, সেটার বাস্তবায়নের কারণে সংস্থাটা দেশের সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছে এবং এই নীতি বাস্তবায়নে সরকারকে সহায়তা দেবে ‘আইএমএফ’। নাইজেরিয়ার এনজিও ‘সেন্টার ফর দ্যা প্রোমোশন অব প্রাইভেট এন্টারপ্রাইজেস’ বা ‘সিপিপিই’এর প্রতিষ্ঠাতা মুদা ইউসুফ এক বিবৃতিতে এই নীতির সমর্থন জানিয়ে বলেন যে, এতে বিনিয়োগ, পুঁজি এবং কর্মসংস্থান বাড়বে এবং ব্যবসা-বান্ধব পরিস্থিতি তৈরি হবে।

প্রেসিডেন্ট বোলা তিনুবু সর্বদাই ছিলেন ব্যবসা-বান্ধব একজন রাজনীতিবিদ। ‘বাজ নাইজেরিয়া’ বলছে যে, ১৯৫২ সালে লেগোসের বড় ব্যবসায়ী পরিবারে জন্ম নেয়া এই রাজনীতিবিদ ১৯৭৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান পড়াশোনার জন্যে। সেখানে স্কুল শেষ করে ১৯৭৯ সালে হিসাবরক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি নেন। পাস করে বিভিন্ন মার্কিন কোম্পানিতে কাজ করে ১৯৮৩ সালে দেশে ফিরে আসেন এবং আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি ‘মোবিল’এ কাজ শুরু করেন। ১৯৯১ সালে চাকুরি ছেড়ে দিয়ে ৪০ বছর বয়সে তিনি তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। লেগোস রাজ্যের গভর্নর ছাড়াও তিনি সিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এবছরের পহেলা মার্চ তিনুবু প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ২৯শে মে প্রেসিডেন্ট হবার পর তার স্বাগত বক্তব্যে তিনুবু ঘোষণা দেন যে, তিনি দেশটার মুদ্রা বিনিময় হারকে বাজারের উপরে ছেড়ে দেবেন।

এর ঠিক দুই দিন আগে ‘বিজনেস ইনসাইডার আফ্রিকার’ এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, নাইজেরিয়াতে ‘আইএমএফ’এর প্রতিনিধি আরি আইসেন এক ভার্চুয়াল আলোচনায় বলেন যে, নাইজেরিয়ার মূল সমস্যা হলো, সরকার কর থেকে যত আয় করছে, তার চাইতে বেশি ব্যয় করছে; যেকারণে ঋণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে দেশটা যদি আয়ের অধিক ব্যয় করতে থাকে, তাহলে কোন একদিন দাতারা ঋণের অর্থ ফেরত চাইবে, অথবা নতুন ঋণ দেয়া বন্ধ করে দেবে।

পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তেল রপ্তানিকারক দেশ হওয়া সত্ত্বেও আমদানি ব্যয় মেটাতে হিমসিম খাচ্ছে নাইজেরিয়া। ‘অবজারভেটরি অব ইকনমিক কমপ্লেক্সিটি’ বা ‘ওইসি’র হিসেবে নাজেরিয়া ২০২১ সালে প্রায় ৫৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য এবং প্রায় ৫ বিলয়ন ডলারের সেবা রপ্তানি করেছিল। এর বিপরীতে দেশটা একইবছর প্রায় ৬২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য এবং প্রায় ৩৯ বিলিয়ন ডলারের সেবা আমদানি করে। ৫০ বিলিয়ন ডলারের অপরিশোধিত খনিজ তেল ও গ্যাস রপ্তানি করলেও নাইজেরিয়া প্রায় সাড়ে ১১ বিলিয়ন ডলারের পরিশোধিত তেল আমদানি করে। এছাড়াও দেশটা বিপুল পরিমাণ ডলার ব্যায়ে গম, গাড়ি, ঔষধ, যন্ত্রপাতি, ইত্যাদি আমদানি করে। বিদেশী ব্যবসায়িক সেবা, ব্যক্তিগত ভ্রমণ এবং পরিবহণ সেবা খাতে প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ডলার প্রতিবছর নাইজেরিয়া থেকে চলে যাচ্ছে। এছাড়াও এপ্রিল মাসে কনসাল্টিং কোম্পানি ‘কেপিএমজি’ বলে যে, দেশটার বেকারত্বের হার ২০২২ সালে যেখানে ছিল প্রায় ৩৮ শতাংশ, তা ২০২৩ সালে বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৪১ শতাংশে ঠেকবে। তারা বলে যে, শিল্পায়ন না হওয়ায় এবং ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ না বাড়ায় বেকারত্বের সমস্যা থেকেই যাবে।

উপনিবেশ না হয়েও ঔপনিবেশিক নীতি যেন ছাড়ছে না নাইজেরিয়াকে। রেকর্ড মূল্যে জ্বালানি তেল রপ্তানি করলেও দেশটা এখন ব্যাপকভাবে ঋণগ্রস্ত। পরিশোধিত জ্বালানি এলপিজি রপ্তানি করে নাইজেরিয়রা নিজেদের বাসাবাড়িতে রান্নার জন্যে আমদানি করা পরিশোধিত কেরোসিন তেল ব্যবহার করে। শিল্পায়ন না হওয়ায় বেকারত্বের হার আকাশচুম্বী। ‘আফ্রিকা নিউজ’ বলছে যে, নতুন প্রেসিডেন্ট বোলা তিনুবু দেশের অর্থনীতিকে ঘোরাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর গডউইন এমেফিয়েল এবং অর্থনৈতিক ও আর্থিক দুর্নীতি দমন সংস্থার প্রধান আব্দুলরশীদ বাওয়া-কে পদচ্যুত ও গ্রেপ্তার করেছেন, এবং জ্বালানির উপর থেকে ভর্তুকি সরিয়ে নিয়েছেন। এতে ‘আইএমএফ’ খুশি হলেও পরিবহণ খরচ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জেনারেটরের খরচ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন পশ্চিমা প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে জাতীয় মুদ্রা নাইয়ারাকে বাজারের উপরে ছেড়ে দেয়ার কারণে জনগণকে আমদানি করা খাদ্য বহুগুণ বেশি মূল্যে ক্রয় করতে হবে। ফলস্বরূপ, ‘আইএমএফ’এর উপদেশ মেনে নাইজেরিয়ার ব্যবসা-বান্ধব সরকার এখন জনগণকে কষ্ট সহ্য করতে বলছে। পশ্চিমা ঋণের শর্তে নিষ্পেষিত পশ্চিম আফ্রিকার বৃহত্তম দেশ নাইজেরিয়ার অর্থনৈতিক দৈন্যতা আঞ্চলিক ভূরাজনীতিকে প্রভাবিত করবে নিঃসন্দেহে।

9 comments:

  1. IMF এর ধংস কি আসন্ন?
    যেমন্টা world Bank এর অবস্থা?

    ReplyDelete
    Replies
    1. আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক নিয়ে এই লেখাটা পড়তে পারেন -
      https://koushol.blogspot.com/2021/10/imf-world-bank-leadership-scandal-what-it-shows.html

      Delete
  2. বর্তমানে ইউএন আইএমেফ এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এর রিফর্মের কথা বলছে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনার কি ধারণা জাতিসংঘ বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে?

      Delete
    2. জাতিসংঘ কে ইউ এস সহ কয়েকটি ফরমার কলোমিয়াল দেশ নিয়ন্ত্রণ করে।
      তবে গুতারেস যে আই এম এফ আর বিশ্বব্যাংক এর রিফর্মের কথা বলছে দেখে মনে হয়েছে, যে তারা ঠিক বুঝতে পারছে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই দুটি সংস্থা তাদের অস্তিত্ব বিলীন হতে বসেছে বা কার্যকারিতা হারিয়েছে।
      তাদের ইচ্ছা যে এই সংস্থার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার। কিন্তু প্রাসঙ্গিকতা হারাতে দিয়ে চায়না, কিন্তু তাদের কিছু করার নাই।

      Delete
  3. Is IMF trying to punch above their weight by indroducing multi CBDC platform?
    What is going happen? Explain please.

    ReplyDelete
    Replies
    1. We need to remember that IMF is part of the post-WWII World Order planned in 1944. It was start of the American-led world order, where all the international institutions were led by the US. The world has changed quite a bit since then. As a result, US, though still the sole superpower, doesn't have enough political and military strength to call all the shots. The economic strength of the US is more of fraudulent system of printing US Dollar, backed up by international financial system and institutions.

      Such fraud had been tolerated by people for a long time; but has also given birth to a search for alternatives. One such effort is digital currency, which tries to bypass the fraudulent fiat currency system, which is implemented via central bank's of countries that are all part of United Nations, which is again, part of post-WWII World Order. IMF is simply trying to grip a situation, which is already showing signs of losing control. This is because the American World Order is collapsing; and IMF is part of it. You can't expect some of the pillars to remain standing when the Empire finally collapses. This is because the World Order is a set of rules; and these rules are just as strong as the writer of those rules.

      Delete
  4. De dollarisation is a fact? What is/are the reason/s behind it?
    Its due to the weakening of the dominant ideology or something esle?
    Thank you.

    ReplyDelete
    Replies
    1. This so-called "de-dollarization" term is fascinating some people. CEIC Data says China holds a record 869.3 billion USD in US Treasury Securities as of March 2023. Do you think China would let USD collapse when they hold so much of their wealth in that currency?

      Rather we should be talking of moving away from fiat currency, which has given birth to massive inflation through arbitrary printing of money.

      Delete