Friday 9 June 2023

রাশিয়ার অভ্যন্তরে ইউক্রেন-সমর্থিত হামলার গুরুত্ব কতটুকু?

০৯ জুন ২০২৩

২৫শে মে, ২০২৩। উত্তর ইউক্রেনে রুশ বিদ্রোহী গ্রুপ ‘রাশান ভলানটিয়ার কোর’এর সংবাদ সন্মেলন। সরকারিভাবে মার্কিনীরা রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলাকে সমর্থন না করলেও মার্কিন চিন্তাবিদদের কথায় এটা পরিষ্কার যে, ওয়াশিংটনে রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলার পক্ষে জোরালো সমর্থন তৈরি হয়েছে। রুশ উগ্রপন্থী ‘নিও-নাজি’ গ্রুপকে ইউক্রেনিয়দের ব্যবহার করা সম্পর্কে মার্কিন চিন্তাবিদেরা বলছেন যে, ইউক্রেনিয়রা নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে এরকম গ্রুপগুলিকে ব্যবহার করতেই পারে; যেখানে চিন্তার ভিত্তিটা হলো, ‘আমার শত্রুর শত্রু হলো আমার বন্ধু’।

গত ২২শে মে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, দু’টা রুশ বিদ্রোহী গ্রুপ ইউক্রেন থেকে রাশিয়া অভ্যন্তরে হামলা করে কিছু অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। ২৪শে মে রুশ বিদ্রোহী গ্রুপ ‘ফ্রিডম অব রাশিয়া লিজিয়ন’ গ্রুপের নেতা ইলিয়া পনোমারেভ ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ থেকে ‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’কে দেয়া এক সাক্ষাতে ‘লিজিয়ন’এর চারটা এবং ‘রাশান ভলানটিয়ার কোর’এর একটা ব্যাটালিয়ন এই হামলায় অংশ নিচ্ছে বলে বলেন। তিনি বলেন যে, তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য হলো রাশিয়ার বর্তমান নেতৃত্বকে ক্ষমতাচ্যুত করা। এই মুহুর্তে তাদের সামরিক লক্ষ্য হলো ইউক্রেনিয় বাহিনীকে গ্রীষ্মকালীন আক্রমণে সহায়তা দিতে রুশ বাহিনীকে ভিন্ন দিকে ধাবিত করা। তিনি স্বীকার করেন যে, তাদের বাহিনী ইউক্রেনিয় বাহিনীর অংশ; তবে তাদের বাহিনীর সকলেই রুশ নাগরিক। ‘ন্যাশনাল রিপাবলিকান আর্মি’ নামের এক রুশ বিদ্রোহী গ্রুপ, যারা রুশ চিন্তাবিদ আলেক্সান্ডার দুগিনের কন্যাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রুশ ব্যক্তিকে হত্যা করেছে এবং যারা মস্কোতে ড্রোন হামলা করেছে, তাদের সাথেও তার গ্রুপের যোগাযোগ রয়েছে বলে তিনি স্বীকার করেন।

২৫শে মে রুশ বিদ্রোহী গ্রুপ ‘রাশান ভলানটিয়ার কোর’ উত্তর ইউক্রেনের সুমি এলাকায় রুশ সীমান্তের কাছে এক সংবাদ সন্মেলন ডাকে। ডেনিস নিকিতিন নামে তাদের নেতা সাংবাদিকদের বলেন যে, তার অনুগত সেনারা রাশিয়ার অভ্যন্তরে সীমান্তবর্তী একটা শহর দখলে নিয়েছে। তিনি নিজেকে উগ্র ডানপন্থী বলে আখ্যা দেয়াকে সমস্যা মনে করেন না; তবে নিজেকে ‘নিও-নাজি’ আখ্যা দেয়ার ক্ষেত্রে তার দ্বিমত রয়েছে। এই দলের সদস্যরা দখল করা রুশ সাঁজোয়া যান প্রদর্শন করে এবং বলে যে, পুরো ইন্টারনেট এই খবরে ভরে যাবে; যা তাদের একটা সফলতা। তবে ‘সিএনএন’ বলছে যে, এই বাহিনীর সকল সদস্যই ইউক্রেনের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য এবং তাদের রয়েছে ইউক্রেনিয় সামরিক পরিচয়পত্র। যদিও তারা বলছে যে, তারা ইউক্রেনিয় সামরিক বাহিনীর সহায়তা ছাড়াই এই মিশন পরিচালনা করছে, তথাপি তা বিশ্বাস করাটা কষ্টকর। শুধু তা-ই নয়, মার্কিন নির্মিত ‘এমর‍্যাপ’ সাঁজোয়া গাড়ি এই হামলায় ব্যবহৃত হচ্ছে। তারা বলছে যে, তারা এসকল গাড়ি খোলা বাজার থেকে কিনেছে।

ক্রেমলিনের কর্মকর্তারা বেশ শান্ত থেকেই এই পরিস্থিতির উপরে বক্তব্য দিচ্ছে। ৩রা জুন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সরকারি টেলিভিশনে এসে রুশ কর্মকর্তাদেরকে বলেন যে, তারা রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করবেন। তিনি বিশেষ করে উল্লেখ করেন যে, কিছু লোক রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি খারাপ করতে উঠেপড়ে লেগেছে। ‘সিএনএন’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি খাপ করার যে কথাটা পুতিন বলছেন, ঠিক সেই লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে রুশ গ্রুপগুলি; যারা ইউক্রেনের সহায়তা নিয়ে ইউক্রেনের সরবরাহ করা অস্ত্র এবং গাড়ি ব্যবহার করে রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা করছে। একইসাথে রাশিয়ার অভ্যন্তরে চলছে ড্রোন হামলা। রুশ মিডিয়ার বরাত দিয়ে ‘পিবিএস’ বলছে যে, ইউক্রেনিয় হামলার কারণে সীমান্তবর্তী বেলগোরদ অঞ্চল থেকে হাজারো মানুষ পালিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেনের সীমানা থেকে বহুদূরে তেল শোধনাগার, পাইপলাইন, অস্ত্রাগার এবং রেলওয়ে জংশনের উপরে হামলা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মার্কিন কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং পোল্যান্ডের সরবরাহকৃত কমপক্ষে চারটা ‘এমর‍্যাপ’ সাঁজোয়া যান রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলায় ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়াও বেলজিয়াম এবং চেক রিপাবলিকে তৈরি রাইফেল এবং যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি ‘এটি-৪’ ট্যাঙ্ক-বিধ্বংসী রকেটও তাদের হাতে দেখা গেছে। কমপক্ষে দু’টা ‘এমর‍্যাপ’ রুশদের হাতে পড়েছে বলে সোশাল মিডিয়ার পোস্ট থেকে জানা যাচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলাকে সমর্থন করেনা। বেলজিয়ামের কর্মকর্তারা তাদের দেয়া অস্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কে কিছু বলতে পারেননি; আর চেক রিপাবলিক ও পোলিশ প্রতিরক্ষা দপ্তর মন্তব্য করতে চায়নি।

মার্কিন নির্মিত 'এমর‍্যাপ' সাঁজোয়া যান; যা কিনা রাশিয়ার বেলগোরদ এলাকায় রুশদের হাতে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে তৈরি অস্ত্র ও সরঞ্জামাদি রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলায় ব্যবহৃত হচ্ছে; যদিও সরকারিভাবে পশ্চিমা দেশগুলি রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলার সমর্থন করছে না।

ইউক্রেনের প্রাক্তন উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী আলিনা ফ্রোলোভা ‘সিএনএন’কে বলছেন যে, তিনি মনে করেন না যে, রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা করা এই গ্রুপগুলির হাতে পশ্চিমাদের সরবরাহ করা অস্ত্র যুদ্ধকে আরও বড় করতে পারে। লক্ষ লক্ষ ইউক্রেনিয় যখন জীবন ঝুঁকির মাঝে রয়েছে, তখন যুদ্ধের পরিধি বৃদ্ধির কিছু নেই; বরং সেক্ষেত্রে রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা যুদ্ধের পরিধিকে কমাতে সহায়তা করবে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইন্সটিটিউট ফর দ্যা স্টাডি অব ওয়ার’এর ডিরেক্টর জেনিফার কাফারেলা ‘পিবিএস’এর সাথে সাক্ষাতে বলছেন যে, রাশিয়ার ভিতর এই হামলাগুলি খুবই ছোট; কিন্তু সেগুলি রুশদেরকে বিচলিত করতে পেরেছে এবং সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারছে। এর মাধ্যমে রুশ জনগণকে বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, রাশিয়া এখনও যুদ্ধে জিততে পারেনি; এমনকি হেরেও যেতে পারে। তবে রাশিয়ার অভ্যন্তরে সাপ্লাই ডিপোগুলির উপরে ইউক্রেনিয় হামলাগুলির গুরুত্ব অপেক্ষাকৃত বেশি। এই মুহুর্তে ক্রেমলিনের সামনে চ্যলেঞ্জ হলো, রুশ জনগণকে আস্বস্ত করা এবং সীমিত সামরিক সক্ষমতাকে সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে একদিকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা এবং একইসাথে ইউক্রেনিয়দের গ্রীষ্মকালীন আক্রমণকে প্রতিহত করা।

সরকারিভাবে মার্কিনীরা রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলাকে সমর্থন না করলেও মার্কিন চিন্তাবিদদের কথায় এটা পরিষ্কার যে, ওয়াশিংটনে রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলার পক্ষে জোরালো সমর্থন তৈরি হয়েছে। মার্কিন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ওয়েসলি ক্লার্ক ‘সিএনএন’এর সাথে সাক্ষাতে রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলাকে সমর্থন করে বলেন যে, এই হামলার মাধ্যমে রুশ জনগণকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে যে, রাশিয়া এখন একটা যুদ্ধের মাঝে রয়েছে। এবং ইউক্রেনিয়রা নিজেদের উপরে হামলা থেকে বাঁচতে রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা করবেই; এবং এক্ষেত্রে রুশ জনগণকে এই যুদ্ধ বন্ধে চেষ্টা করতে হবে। রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা ইউক্রেনের গ্রীষ্মকালীন আক্রমণের সাথে কৌশলগতভাবে যুক্ত। মার্কিন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল স্টিভ এন্ডারসন ‘সিএনএন’কে বলছেন যে, রাশিয়ার ভেতরে এই হামলা ইউক্রেনের জন্যে একটা বড় অপারেশনাল বিজয়; কারণ এর ফলে রুশরা হয়তো ইউক্রেনের অভ্যন্তরে মোতায়েন করা ২ লক্ষ রুশ সেনার মাঝ থেকে কিছু সেনাকে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে মোতায়েন করতে বাধ্য হবে। রুশ উগ্রপন্থী ‘নিও-নাজি’ গ্রুপকে ইউক্রেনিয়দের ব্যবহার করা সম্পর্কে জেনিফার কাফারেলা বলছেন যে, ইউক্রেনিয়রা নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে এরকম গ্রুপগুলিকে ব্যবহার করতেই পারে; যেখানে চিন্তার ভিত্তিটা হলো, ‘আমার শত্রুর শত্রু হলো আমার বন্ধু’।

No comments:

Post a Comment