Friday 2 June 2023

তুর্কি-মার্কিন সম্পর্ক… নির্ভরশীলতার খেলা

০২রা জুন ২০২৩

তুরস্কের নিজস্ব প্রযুক্তিতে পরিবর্তন করা 'এফ-১৬ ওজগুর', যা পুরোনো 'ব্লক-৩০' ভার্সনের 'এফ-১৬' পরিবর্তন করে করা হয়েছে। তুরস্ক ‘ব্লক-৩০’ ভার্সনের বিমানগুলিকে পরিবর্তন করতে পারলেও ‘ব্লক-৫০’ বিমানগুলিকে পরিবর্তন করার জন্যে ‘সোর্স কোড’ যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে দেয়নি। একারণেই এই বিমানগুলির জন্যে ‘ভাইপার আপগ্রেড কিট’ চাইছে তুরস্ক। অতএব, যুক্তরাষ্ট্রের উপরে তুরস্কের নির্ভরশীলতা এখনই কেটে যাচ্ছে না এবং একইসাথে তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতির উপর মার্কিন প্রভাবও চলে যাচ্ছে না।


গত ২৯শে মে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগানকে নির্বাচন বিজয়ে অভিনন্দন জানাতে ফোন করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আলাপের বিষয়বস্তু তুলে ধরে বাইডেন সাংবাদিকদের বলেন যে, এরদোগান এখনও তুরস্কের জন্যে ‘এফ-১৬’ যুদ্ধবিমান নিয়ে কথা বলতে চান। তবে ওয়াশিংটন চাইছে সুইডেনের ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তি। বাইডেন এরদোগানকে বলেন যে, তারা এক সপ্তাহ পর আবারও কথা বলবেন। ‘ভয়েস অব আমেরিকা’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এই প্রথম বাইডেন সুইডেনের ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তি এবং তুরস্কের জন্যে ‘এফ-১৬’ যুদ্ধবিমানের ইস্যুদু’টাকে একত্রে নিয়ে এসে কথা বললেন। তবে হোয়াইট হাউজ এবং তুর্কি সরকারের বিবৃতিতে ‘এফ-১৬’ নিয়ে কথা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়নি। হোয়াইট হাউজের প্রেস সচিব ক্যারিন জঁ-পিয়েরে সাংবাদিকদের বলেন যে, এখানে কোন শর্তের ব্যাপার নেই। প্রেসিডেন্ট বাইডেন সর্বদাই তুরস্কের কাছে ‘এফ-১৬’ বিক্রির ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে আগ্রহী ছিলেন। একই দিনে সুইডেন সফরকালে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিনকেন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে অস্বীকার করেন যে, তার সরকার সুইডেনের ইস্যুর সাথে ‘এফ-১৬’ ইস্যুকে যুক্ত করেছে। তবে ‘আল জাজিরা’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, গত জানুয়ারিতে তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু বলেন যে, তুরস্ক যদি সুইডেনকে ন্যাটো সদস্য হতে দেয়, তাহলে মার্কিন কংগ্রেস তুরস্কের ‘এফ-১৬’ ক্রয়ের ব্যাপারটাকে ভালো চোখে দেখবে।

এখানে উল্লেখ্য যে, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার ২০২২এর মে মাসে ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন ন্যাটো জোটের সদস্যপদের জন্যে আগ্রহ প্রকাশ করে। ন্যাটোর চুক্তি অনুযায়ী সকল সদস্য দেশের অনুমতি মিললেই কেবল নতুন কোন দেশ ন্যাটোর সদস্যভুক্ত হতে পারবে। এই দুই দেশের সদস্যপদ পাওয়া ঝুলে যায় তুরস্ক এবং হাঙ্গেরির বিরোধিতার কারণে। তবে শেষ পর্যন্ত এবছরের এপ্রিলে উভয় দেশের সমর্থনের পর ফিনল্যান্ড ন্যাটোর সদস্যভুক্ত হয়; যদিও তুরস্কের বিরোধিতার কারণে সুইডেনের সদস্যপদ ঝুলে যায়। ‘রয়টার্স’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ২০২১এর অক্টোবরে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ৪০টা নতুন ‘এফ-১৬’ যুদ্ধবিমান এবং পুরোনো ‘ব্লক-৫০’ ভার্সনের ৭৯টা ‘এফ-১৬’এর জন্যে ‘ভাইপার আপগ্রেড কিট’ চায়। এই পুরো চুক্তির মূল্য প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার।

তুরস্কের সামনে বড় বাধা হলো মার্কিন কংগ্রেস। কংগ্রেসের ক্ষমতা রয়েছে বড় ধরণের সামরিক বিক্রয়ে বাধা দেয়ার। কংগ্রেস চায় তুরস্ক প্রতিবেশী দেশ গ্রিসের সাথে সম্পর্কন্নোয়ন করুক, উত্তর ইরাকে সেনা অভিযান বন্ধ করুক, যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছানুযায়ী রাশিয়ার উপরে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করুক এবং তার মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন করুক। গত ৩০শে মে সিনেটর মেনেনডেজ সাংবাদিকদের বলেন যে, তুরস্ককে ‘এফ-১৬’ দেয়ার আগে দেখতে হবে যে, তুরস্ক ন্যাটো সদস্যভুক্ত দেশগুলি এবং তার প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করে কিনা। মেনেনডেজ বাইডেন প্রশাসনকে ‘এফ-১৬’ বিক্রির ব্যাপারটাকে স্থগিত রাখতে বলেছেন। তার কথায়, পররাষ্ট্র সচিব ব্লিনকেন তাকে আশ্বাস দিয়েছেন যে, হোয়াইট হাউজ তার কথা শুনবে।

গত এপ্রিলে ফিনল্যান্ডকে ন্যাটোর সদস্যপদের জন্যে সমর্থন দেয়ার দুই সপ্তাহ পর মার্কিন কংগ্রেস অপেক্ষাকৃত ছোট আড়াইশো মিলিয়ন ডলার মূল্যের তুরস্কের পুরোনো ‘এফ-১৬’ যুদ্ধবিমানগুলির জন্যে সফটওয়্যার আপগ্রেড বিক্রির প্রকল্পে অনুমতি দেয়। তবে তুরস্ক এখনও সুইডেনের ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তির বিরোধী; কারণ আঙ্কারা মনে করে যে, সুইডেন তুরস্কের বিচ্ছিন্নতাবাদী ‘কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি’ বা ‘পিকেকে’কে আশ্রয় এবং সমর্থন দিচ্ছে; যাদেরকে তুরস্ক সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দিয়ে থাকে। তবে ‘ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশন’এর ফেলো আসলি আয়দিনতাশবাশ ‘ভয়েস অব আমেরিকা’কে বলছেন যে, এরদোগান যদিও সুইডেনের ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তিকে কাজে লাগাতে চাইছেন, তথাপি তিনি বাস্তববাদী। খুব সম্ভবতঃ জুলাই মাসের ন্যাটো বৈঠকের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত একটা নাটকীয়তা দেখা যাবে। এমনকি হয়তো বৈঠকের রাত্রেই দেখা যাবে তুরস্ক সুইডেনের ব্যাপারে সন্মতি দিয়েছে।

তবে তুরস্কে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত জেমস জেফরি ‘ভয়েস অব আমেরিকা’কে বলছেন যে, ‘এফ-১৬’ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক এখন বেশ জটিল এবং তা মূলতঃ আদান-প্রদানের মাঝে সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছে। আঙ্কারার সাথে ওয়াশিংটনের সম্পর্কের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে রাশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা, আঞ্চলিকভাবে ইরানের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। অপরদিকে ‘মিডলইস্ট ইন্সটিটিউট’এর বিশ্লেষক হাওয়ার্ড আইসেনস্টাটএর মতে, রাশিয়া থেকে ‘এস-৪০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয় করাটা ওয়াশিংটনের সাথে আঙ্কারার সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচাইতে কন্টকময় অধ্যায়। কিছুদিন আগেই তুর্কি মিডিয়াতে বলা হয় যে, তুরস্ক তার ‘এস-৪০০’ ব্যবস্থাগুলিকে বাইডেন প্রশাসনের অনুরোধ সত্ত্বেও ইউক্রেনে পাঠাতে অস্বীকার করেছে।

তুরস্কের বিমান বাহিনীর মূল স্তম্ভই হলো ‘এফ-১৬’ যুদ্ধবিমান। ২০১৯ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়া থেকে ‘এস-৪০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার ‘অপরাধে’ তুরস্ককে ‘এফ-৩৫’ স্টেলথ যুদ্ধবিমান প্রকল্প থেকে বহিষ্কার করলে তুরস্ক বিপদে পড়ে যায়। কারণ এর ফলশ্রুতিতে আগামী কয়েক বছরের মাঝেই পুরোনো ‘এফ-১৬’ বিমানগুলিকে প্রতিস্থাপন করার মতো কোন যুদ্ধবিমান তুরস্কের কাছে থাকবে না।

২০২২ সালের জুন মাসে তুরস্কের ‘সাভুনমা সানায়িএসটি’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, তুরস্ক তার ‘এফ-১৬’ যুদ্ধবিমানগুলির জন্যে ‘ওজগুর’ নামক উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছে। আর ‘তুরডেফ’এর গত মে মাসের এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ইতোমধ্যেই পরিবর্তিত ‘এফ-১৬ ওজগুর’ তুর্কি বিমান বাহিনীকে ডেলিভারি দেয়া হয়েছে। গত ১৮ই মে তুর্কি মিডিয়া ‘এনটিভি’কে দেয়া এক সাক্ষাতে তুরস্কের সামরিক শিল্পের প্রধান ইসমাঈল দেমির বলেন যে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৩৫টা পুরোনো ‘ব্লক-৩০’ ভার্সনের ‘এফ-১৬’এর মিশন কম্পিউটারসহ মোট ১৪টা বড় রকমের পরিবর্তন করে এগুলিকে প্রায় তুর্কি বিমান বানিয়ে ফেলা হবে। শুধু তা-ই নয়, এই পরিবর্তন শেষে বিমানগুলিতে তুরস্কের নিজস্ব ‘মুরাদ এইএসএ’ রাডার সংযুক্ত করা হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করার পর এই বিমানগুলি তুরস্কের নিজস্ব ‘আতমাকা’ জাহাজধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং ‘গেজগিন’ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করতে পারবে। তথাপি এভিয়েশন ম্যাগাজিন ‘এভিয়াসি অনলাইন’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, তুরস্ক ‘ব্লক-৩০’ ভার্সনের বিমানগুলিকে পরিবর্তন করতে পারলেও ‘ব্লক-৫০’ বিমানগুলিকে পরিবর্তন করার জন্যে ‘সোর্স কোড’ যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে দেয়নি। একারণেই এই বিমানগুলির জন্যে ‘ভাইপার আপগ্রেড কিট’ চাইছে তুরস্ক। অতএব, যুক্তরাষ্ট্রের উপরে তুরস্কের নির্ভরশীলতা এখনই কেটে যাচ্ছে না এবং একইসাথে তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতির উপর মার্কিন প্রভাবও চলে যাচ্ছে না।

No comments:

Post a Comment